ধারাবাহিক উপন্যাসঃ কাক-জ্যোৎস্নায়
কাক-ভোর (পর্ব-১৮)
শাশ্বত
স্বপন
যে কালী এতক্ষণ শিখাকে
সান্তনা দিয়েছে। তাকে কে সান্তনা দেবে? নিজের কাছে বারবার পরাজিত হয় সে। তবু
কাউকে বুঝতে দেয় না। সে দু’মাস ধরে স্কুলে যায় না। স্কুলের প্রতি তার দিন
দিন অনীহা ভাব চলে আসছে। সে বুঝে স্যার, আপা অথবা দিদি কেউ তাকে খুব একটা
পছন্দ করে না। খেলাধূলায় ভাল বলে সবাই তাকে বছরের নির্দিষ্ট কতগুলি সময়ে
ভালবাসে, শিক্ষক-শিক্ষিকারা খোঁজ খবর নেয় আর বাকী সময় সবাই তাকে উপেক্ষা করে।
কোন এক আপা কার কাছে যেন, বলেছিল কালী চরিত্রহীনা। তার অপরাধ সে বাইরের
বখাটে ছেলেদের সাথে ফ্রি ভাবে চলাফেরা করে, ফ্রি ভাবে কথাবার্তা বলে। সে
ভাল ছাত্রী নয়। তার সাথে যারা চলবে তাদের চরিত্র নষ্ট হবার আশঙ্কা আছে। অথচ
যখন জেলা পর্যায়ে কিংবা থানা পর্যায়ে প্রথম অথবা দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে
তখন শিক্ষক-শিক্ষিকাসহ প্রায় সকল ছাত্র-ছাত্রী কালীকে দেখতে আসে। তখন তাকে
দেখতে দেখতেও কারো সাধ মিটে না। শিক্ষক-শিক্ষিকারা ধন্যবাদ জানায়। ছোটরা বলে,
দিদি (কিংবা আপা) সাঁতারেও প্রথম হওয়া চাই। বড়রা বলে, উষা (কেউ কালী) খুব
ভাল করেছ। নার্ভাস ফিল করনা--আমরা আছি। যুবকরা কালীকে ঘিরে ধরে। কালীর তখন
মনে হয়, সে যেন সাবাতানি কিংবা স্টেফিগ্রাফ। আর এখন সে হরিদাসের মেয়ে কালী।
ক্লাসের ৫/৬ জন ছাড়া সবাই তাকে এড়িয়ে চলে। সে নারী, বেদনার বাহ্যিক ও
আভ্যন্তরিন প্রতীক।
স্কুলে একদিন পরিদর্শক আসবে। প্রধান শিক্ষক বেছে বেছে সুন্দরী মেয়েদের ডেকে
নিল। কালীদের ক্লাস থেকে নাসরিন, দিপা, ইতি, ববি গিয়েছিল।স্যার ওদের ডেকে
নিয়ে কি বললেন তা বাড়ীতে এসে দিপা, নাসরিন কালিকে বলে গেল।স্কুল ছুটি হবার
আগে মাথাব্যথার মিথ্যা অজুহাতে কালী বাড়িতে চলে আসে। তার আর পড়তে ভালোলাগে
না । আগামি কাল স্কুল পরিদর্শক আসবে। দীপা,নাসরিন,আরো অনেকে হলুদ শাড়ী পরে
সামনে গিয়ে দাড়াবে। পরিদর্শক হলুদ শাড়ী পরিহিতা নারী দেখে খুশি হবে। সেই
খুশীর প্রভাব পড়বে স্কুলের উপর। পরে পরিদর্শক হয়তো বলবে, ভালো খেলোয়ার
মেয়েটি কোথায়, যার নাম-ছবি পেপারে উঠেছিল। তারপর পিছনের সারিতে দাঁড়ানো
কালীর দিকে তাকাবে। কালী দিপাদের মত সুন্দরী নয় বলে, লজ্জায় মাথা নিচু করে
থাকবে। পরিদর্শক ওর খেলার প্রশংসা করবে আর মনে মনে বলবে আহা ! এত কালো। এই
কারনেই তাকে হলুদ শাড়ী পড়ানো হয়নি।
কালী ভেবে দেখল, আগামীকাল তার স্কুলে না যাওয়াই ভাল। আগামীকাল সে ‘কালো
মেযের কষ্ট দিবস’ পালন করবে। সারাদিন ভাববে, কাঁদবে, ঘুমুবে, কবিতা লিখবে,
ছিঁড়বে, অদৃশ্য ঈশ্বরের সাথে একাকী কথা বলবে, তর্ক করবে ।
আজ কালীর ‘কষ্ট দিবস’ । সে ভাবছে অনেক কথা, অনেক বছর আগের কথা। কখন, কিভাবে,
কেন এই কালত্ব বর্জন করে চোখ সাদাকে গ্রহন করল। কালো কেন ঘৃণিত, নিন্দিত।সাদা-কালো
দু’টাই ঈশ্বরের সৃষ্টি। তাহলে কেন এত হেরফের। এটা কি ঈশ্বর করেছে, নাকি
ঈশ্বরের নামে মানুষরা করেছে? কে বা কারা সেই মানুষ, এই বিভেদ সৃষ্টি করল ?
তারা কি ভবিষ্যতের কথা ভাবেনি। এই যে কালী সেও সাদাই খুঁজে। কালো মেয়েটির
প্রেম, ভালবাসা আর বিয়েতে এত কষ্ট, এত বেদনা; অথচ সেও ভবিষ্যতে তার পুত্রের
জন্য কালো বর্জন করে সাদাই গ্রহণ করবে। দিন দিন কালো হচ্ছে নিঃগৃহীত । তাই
বলে কি কালো চলছে না? হ্যাঁ, চলছে, কালোরা বিষাক্ত বেদনার বিষে জ্বলতে
জ্বলতে, তবেই চলছে, চলতে হয় বলে। আত্মহত্যা করলে তো কালোত্ব ঘুচবে না, এই
ধারা বন্ধও হবে না। বেঁচে থেকেই সংগ্রাম করে যেতে হবে। কালী জানে, প্রতিটি
কালো মেয়ে যারা অনাকর্ষনীয়, তারা এক একটা জীবন্ত লাশ। সেও একটা লাশ। কটাক্ষ
শুনবে কিন্তু কিছু বলতে পারবে না, যেহেতু লাশ কখনো কথা বলে না। কিন্তু কালী
কথা বলবে। আরো কালীদের কথা বলা শিখাবে, জীবন্ত লাশ থেকে দুর্গন্ধ ছড়িয়ে
কিভাবে কথা বলতে হয়, কিভাবে বিদ্রোহ করতে হয়। আজ তার দুঃখ দিবসে সে সারাদিন
অনশন পালন করবে। কালী চোখ বুঝে অনাগত দিনের কালোত্বের জয়-জয়কার দেখছে। হঠাৎ
নাসরিন এর ডাকে সে চোখ খুলল।
কিরে, স্কুরে যাবি না?
নারে ,আজকে যেতে ইচ্ছে করছে না।
নাসরিন বুঝতে পারল। গতকাল যখন প্রধান শিক্ষকের কথা কালীকে বলেছিল তখন ওর
চোখ ছলছল করছিল। এখনও চোখে জলের ঝাপসা কুয়াশা দেখা যাচ্ছে। প্রধান শিক্ষক
ওকে খুবই আদর করত। অথচ ক্লাশ শেষ করে সে ৬ জনকে তার কক্ষে বলল। কালীর দিকে
তাকাল না। অথচ ক্লাশে সে স্যারের সবচেয়ে প্রিয়। নাসরিন কথা না বাড়িয়ে চলে
গেল। তুলসী ঘরে ঢুকে জিজ্ঞাসা করল,
কি রে, নাসরিন স্কুলে গেল, তুই গেলি না?
কালীর চোখের ঝাপসা কুয়াসা মেঘ হল। মেঘ থেকে বৃষ্টি হয়ে ঝরতে লাগল। সে কান্না
চাপাতে পারল না। যুগ যুগের আঘাত পাওয়া শক্ত পাথর সে নয়, সে হাজার মানুষের
মত একজন মানুষ। সে ১৫ বছরের একজন কিশোরি--সে কান্নার প্রতিক--সে অহংকার আর
অভিমানের প্রতীক--সে প্রেম ও ভালোবাসার প্রতীক।কালী তুলসির গলা জড়িয়ে কাঁদতে
লাগলো।
--ঠাকুর মা আমি আর স্কুলে যাব না।
-- কেন কি হয়েছে ?
আমি যে কালো কুৎসিত।কেউ আমাকে দেখতে পারে না। আমি এখন সব বুঝি।সেদিন
স্যারদের রুমে গিয়ে করুণা দিদিরে বললাম, দিদি এখন আপনার ক্লাস। দিদি বলল
তুমি যাও, আমি আসছি। আমি দরজা পেরিয়ে আসতে তাপস স্যার দিদিকে বলল, করুণাদি,
মেয়ের বিয়ে দিতে বহু টাকা লাগবে। এতো কালো--চেহারাও ভালো নয়। দিদি বলল, কি
যে কপাল নিয়ে মেয়েটির জন্ম হয়েছিল। গরিব মেয়ে, অথচ আচার আচরন ছেলেদের মত।
দৌঁড়াতেও পারে, ছাত্রীও ভালো নয়। আমি আর কিছু না শুনে ক্লাসে চলে আসি। আজ
পরিদর্শক আসবেন। তাই ক্লাসের সুন্দরী মেয়েদের হলুদ শাড়ী পরে, সেজেগুজে
স্কুলে যেতে বলছেন হেড স্যার। তুলসি তার বুকে কালির মাথা চেপে ধরে নিজের
মৃত স্বামীকে বকতে লাগলেন কেঁদে কেঁদে, তোর দাদার জন্য তোর বাবা কালো। তোর
বাবার জন্য তুই কালো। ভগবান তুমি কোথায়?
কালী কতখন কেঁদে শক্ত হয়ে উঠলো। এভাবে কাঁদলে তো চলবে না। তাকে হাসতে হবে ।
সে ঠাকুমাকে সান্তনা দিচ্ছে। হাসাতে চেস্টা করছে। তুলসি আঁচল দিয়ে চোখ মুছতে
মুছতে চলে গেল। কালী টেবিলে এসে গতকালের অথবা তারও আগের কিছু পেপার পড়তে
শুরু করল। প্রতিদিন সে পেপার পড়ে। দোকানে পেপার আসে। কালীপদ অথবা পাশা সেই
পেপার দুপুরের খাওয়ার সময় বাড়িতে নিয়ে আসে। তারপর আকর্ষণীয় অথবা গুরুতর কোন
খবর থাকলে কালী মাকে, ঠাকুমাকে শুনায়। কালী আগে পেপার পাওয়া মাত্র খেলার
পাতায় চলে যেত। খুঁজত নারী খেলোয়াড়দের খবর, স্টেফিগ্রাম পায়ের চোট নিয়ে
খেলবেন, সাবাতানি জিতেছেন, মহিলা ক্রিকেট চর্চা ধানমন্ডিতে শুরু হচ্ছে।বাংলাদেশী
মেয়েরাও পাশ্চাতের মত ফুটবল খেলবে, ক্লিনটনের মেয়ে ফুটবল চর্চা করছে... ।
তারপর নারী নির্যাতনের খবর পড়তেন। সবশেষে পড়ত প্রথম পাতা।
ARNING:
Any unauthorized use or reproduction of 'Community' content
is strictly prohibited and constitutes copyright infringement liable to
legal action.
[প্রথমপাতা] |