[প্রথমপাতা]

 

 

 

 

 

জনগন রায় দিয়েছে এখন সরকারের পালা

 

 

প্রফেসর আবদুল মান্নান

২১ ফেব্রুয়ারি পড়ন্ত বিকেলে নতুন প্রজন্মের মুক্তিযোদ্ধারা ঢাকার শাহবাগ চত্বর, যা এখন বাংলাদেশ এবং দেশের বাইরে প্রজন্ম চত্বর নামে পরিচিত সেখানে একাত্তরের ঘাতকদের ফাঁসির দাবিতে সতেরদিন তাদের লাগাতার অবস্থান কর্মসূচী শেষে আন্দোলনের আগামী দিনের কর্মসূচী ঘোষণা করলেন । এটি বাংলাদেশের ইতিহাসেতো বটেই বিশ্বের ইতিহাসেও অনেকটা নজিরবিহীন । একদল তরুণ আন্দোলনটি শুরু করেছিল গণযোগাযোগের বিভিন্ন মাধ্যম ব্যবহার করে তা যে এতদিন ধরে এত শান্তিপূর্ণভাবে চলতে পারলো তা সকলকে অবাক করেছে। আরো একটি কারণে এই আন্দোলন ব্যতিক্রমী কারণ এই আন্দোলন কোন সরকার বিরোধী আন্দোলন ছিলনা বা এখানে কোন একক নেতৃত্বও ছিলনা। এটি ছিল আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে আত্মত্যাগকারীদের প্রতি দায়বদ্ধতার আন্দোলন । লক্ষ তরুণ এই প্রজন্ম চত্বরে সতেরদিন ধরে সমবেত হয়েছিল ওই সব ঘাতকদের ফাঁসি দাবি করতে যারা একাত্তরে নিজের মাতৃভূমির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে নির্বিচারে তাদের পিতা, ভাইকে হত্যা করেছিল, তাদের মাতা ভগ্নিকে ধর্ষণ করেছিল, কোটি মানুষকে ঘরছাড়া করেছিল। এই বিচারের জন্য তারা দীর্ঘ বিয়াল্লিশ বছর অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করেছে । তাদের এই আন্দোলনকে তারা দেশে এবং দেশের বাইরে ছড়িয়ে দিতে পেরেছে এবং দলমত নির্বিশেষে দেশের সকল মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির সমর্থন আদায় করতে পেরেছে । তাদের এই আন্দোলনের ফলে সরকার বাধ্য হয়েছে সংসদে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল আইনে সংশোধন এনে আইনটিকে আরো সময়োপযোগী করতে যাতে আদালত একাত্তরের মানবতাবিরোধী ও যুদ্ধাপরাধীদের তাদের অপরাধের উপযুক্ত দ-ে দ-িত করতে পারে । এই শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের প্রাথমিক বিজয়ের জন্য নতুন প্রজন্মের মুক্তিযোদ্ধাদের অভিনন্দন ।
একুশে ফেব্রুয়ারি প্রজন্ম চত্বর হতে যে কটি দাবি উত্থাপিত হয়েছে তার মধ্যে আছে আগামী ২৬ মার্চের মধ্যে জামায়াত শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধ করার প্রক্রিয়া শুরু । জামায়াত-শিবির একাত্তরে যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত । নিষিদ্ধকরণের কাজটি বাংলাদেশ শত্রু মুক্ত হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু সরকার সাংবিধানিক ভাবে করেছিলেন এবং তাতে দেশের সকল মানুষ অকুণ্ঠ সমর্থন জানিয়েছিলেন । কিন্তু পঁচাত্তরের পনেরই আগষ্ট বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর জেনারেল জিয়া দেশের প্রথম সামরিক শাসক হিসেবে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করে বহুদলীয় রাজনীতি পুনঃপ্রবর্তনের নামে জামায়াতকে সেই স্বাধীন বাংলাদেশে রাজনীতি করার সুযোগ করে দেন যে দেশটির জন্মের বিরুদ্ধে একাত্তরে তারা যুদ্ধ ঘোষণা করেছিল । জামায়াতের আগে নতুন করে আত্মপ্রকাশ করে তাদের ছাত্র সংগঠন ইসলামি ছাত্র শিবির, যেটি একাত্তরে পরিচিত ছিল ইসলামি ছাত্র সংঘ নামে এবং সভাপতি ছিলেন বর্তমানে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালে বিচারের সম্মুখীন মতিউর রহমান নিজামী । এই ছাত্র সংঘের সদস্যরাই ছিল একাত্তরে জামায়াতের আলবদর নামের ঘাতক বাহিনীর সদস্য যাদের প্রধান দায়িত্ব ছিল বুদ্ধিজীবী হত্যা । প্রথমে আবির্ভাব ছাত্র শিবির তারপর ইসলামী ডেমোক্রেটিক লীগ তারপর জামায়াতে ইসলামি । বাংলাদেশের রাজনীতিতে শুধু জামায়াত শিবিরের আবির্ভাবই হয়নি তারা তাদের নব জন্মের পর হতেই তারা এবং অন্যান্য যুদ্ধাপরাধীরা পরবর্তী পঁয়ত্রিশ বছর রাষ্ট্রীয় পৃষ্টপোষকতা পেয়েছে । এটি অবিশ্বাস্য হলেও সত্য জেনারেল জিয়া একজন মুক্তিযোদ্ধা হয়েও নতুন দল করে সেখানে আবদুল আলিম আর মওলানা মান্নানের মতো একাত্তরের চিহ্নিত ঘাতকদের স্থান দিয়েছেন, মন্ত্রী বানিয়েছেন । এই কাজটি এরশাদও করেছেন । তার ধারাবাহিকতায় বেগম জিয়া নিজামী আর মুজাহিদের মতো ঘাতকদের তাঁর মন্ত্রী সভায় ঠাঁই দিয়েছেন । অথচ এরা একাত্তরে তার স্বামীকে পেলে কোন অবস্থাতেই জীবিত রাখতো না । একাত্তরের এই যুদ্ধাপরাধীদের সমাজে পূণর্বাসন মানুষ অনেকটা নিরবে সহ্য করে নিয়েছিল । কিন্তু যখন একাত্তরের জামায়াত সভাপতি গোলাম আযম যিনি কিনা জেনারেল জিয়ার বদান্যতায় পাকিস্তানি পাসপোর্ট নিয়ে বাংলাদেশে আসার আগ পর্যন্ত পাকিস্তান একত্রিত করার মিশন নিয়ে বিদেশে সাংগঠনিক তৎপরতা চালাচ্ছিলেন তখন মানুষের ধৈর্য্যের সকল বাঁধ অনেকটা ভেঙ্গে গেল । ১৯৯২ সালে সকলে শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে বাংলাদেশকে রাজাকার মুক্ত করতে তারা ঐক্যবদ্ধ হলেন । দুরারোগ্য ক্যান্সার ব্যাধি নিয়ে দেশকে রাজাকার মুক্ত করতে জনমত সৃষ্টি করার লক্ষ্যে তিনি সারা দেশ চষে বেড়ালেন । কিন্তু তার এই কাজটি শেষ হওয়ার আগেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন । মৃত্যুর পূর্বে তিনি তার শেষ চিঠিতে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে আহ্বান জানিয়ে যান যেন তারা তার অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করেন ।
নতুন প্রজন্ম শহীদ জননীর অসমাপ্ত কাজটি বর্তমানে সমাপ্তি করণে হাত দিয়েছে । অবশ্য এই নতুন প্রজন্মের মুক্তিযোদ্ধাদের একটা সুবিধা হয়েছে বর্তমানে যে দলটির নেতৃত্বে মহাজোট সরকার দেশ পরিচালনা করছে সেই দলের নির্বাচনী ইস্তেহারেই ছিল তারা সরকার গঠন করলে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সম্পন্ন করবেন । সে কারণেই ২০০৮ সালের নির্বাচনে মানুষ তাদের উজাড় করে ভোট দিয়েছিল । সুতরাং তাদের নিজেদের নির্বাচনী অঙ্গিকার হতে এখন সরে আসার কোন উপায় নেই । আর এটাও তো সত্যযে এই মানবতাবিরোধী আর যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্তদের বিচার আওয়ামী লীগ না করলে আর কোন দল করবেনা । যতই বিএনপি গলা ফাটিয়ে চিৎকার করুক তারা ক্ষমতায় আসলে যুদ্ধাপরাধের বিচার করবে সেই কথা সাধারণ মানুষ দূরে থাকুক নিজ দলেরই অনেকে বিশ্বাস করে না বলে মনে হয়েছে । আর বর্তমানে তাদের অবস্থানতো আরো পরিস্কার । বেগম জিয়া হতে শুরু করে মির্জা ফখরুল ইসলাম সকলে শাহবাগের আন্দোলনের পিছনে সরকারের নাটক, ভেলকিবাজি, ষড়যন্ত্র ইত্যাদি আবিষ্কার করতে ব্যস্ত । অথচ তারা বুঝতে চাইলো না তারা তাদের এই অবস্থানের ফলে বাংলাদেশের নতুন প্রজন্মের একটি বিশাল অংশের সহানুভূতি হারালো । জামায়াতের সাথে থেকে তাদের যা লাভ তার চাইতে তাদের জামায়াত বিষয়ে বর্তমান ক্ষতিটা কয়েকশত গুন বেশী যা আগামীতে বুঝা যাবে বলে ধারণা করি ।
জামায়াতে ইসলামি কখনো ইসলামের মূল চেতনাকে ধারণ করে না । তারা ইসলামকে ব্যবহার করে নিজেদের স্বার্থ উদ্ধার করে, সরল ধর্মপ্রাণ মানুষকে বিভ্রান্ত করে । এই কথা আমার নয় দেশের অনেক আলেম ও ইসলামী চিন্তাবিদদের । শান্তির ধর্ম ইসলাম কখনো ধর্মের নামে রক্তপাত, হত্যা অনুমোদন করেনা । অথচ জামায়াত শিবিরের মূল আদর্শই হচ্ছে হত্যা, নৃশংসতা আর রক্তপাত । এই কাজটি তারা বেশ পারদর্শিতার সাথে করে তাদের প্রজনন সংগঠন ছাত্র শিবির দ্বারা। তারা কত নৃশংস হতে পারে তার দু’একটি উদাহরণ দেই । ১৯৭৯ সালে চট্টগ্রাম কলেজের ছাত্রলীগ নেতা তবারককে কলেজ চত্বরে হত্যা তার মূখের উপর সকলে মিলে মূত্রত্যাগ করেছিল । ১৯৮৪ সালের ২৪ এপ্রিল । হারুন আর শাহদাত চট্টগ্রাম কলেজের হোস্টেলে একই কক্ষে ঘুমাচ্ছিল । রাত গভীর হতেই হারুন বিছানার তলা থেকে তার সংগৃহিত চাপাতি বের করে শাহদাতকে জবাই করে দিল । তারা দুজনই ইন্টারমিডেয়েট পরীক্ষার্থী ছিল । শাহদাতের অপরাধ সে ছাত্র ইউনিয়নের কর্মী ছিল। হারুনের যাবজ্জীবন কারাদ- হয়েছিল বয়সের কারণে। ১৯৮৬ সনের ২৬ নভেম্বর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় জাতীয় ছাত্র সমাজের সভাপতি আবদুল হামিদের ডান হাত ইটের উপর রেখে কিরিচ দিয়ে দ্বিখন্ডিত করে সেই কাটা কব্জি নিয়ে শিবিরের নেতৃত্বে ক্যাম্পাসে মিছিল হয়েছিল । আর বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র শিক্ষক ডঃ ইনামুল হকের তরতাজা ছেলে মুহাম্মদ মুসাকেতো সকলে মিলে পিটিয়েই মেরে ফেলেছিল কারণ সে শিবির না করে ছাত্রদল করতো । আমার অনুজ, যে কিনা বর্তমানে একটি সরকারী কলেজের অধ্যাপক তার গলায় এখনো ছুরির দাগ আছে । ভাগ্যক্রমে বেঁচে গিয়েছিল । আমাকে হত্যার উদ্দেশ্যে আক্রমনতো একাধিকবার । অন্যান্য ছাত্র সংগঠনগুলি মারামারি কাটাকাটি করে তবে তা একান্ত ভাবে ক্ষুদ্র ব্যক্তি স্বার্থে । আদর্শের কোন বালাই তাতে থাকেনা । আর শিবির যা করে তা তাদের সন্ত্রাস নির্ভর আদর্শের মন্ত্রে দীক্ষিত হয়েই করে । সন্ত্রাসের মন্ত্রে দীক্ষিত হয়েই পরবর্তীকালে এই শিবিররাই জামায়াত হয় । সুতরাং প্রজনন ক্ষেত্র উচ্ছেদ না করলে জামায়াত উচ্ছেদ কঠিন হবে ।
বাংলাদেশে অতীত অভিজ্ঞতা হতে দেখা গেছে কোন একটি গণমুখী আন্দোলন শুরু হলে তাকে বানচাল করার জন্য নানামুখী ষড়যন্ত্র হয় । এখানেও তার ব্যতিক্রম হচ্ছে না । বিএনপিতো এই আন্দোলনে শুরু হতেই ষড়যন্ত্রের গন্ধ পেয়েছে এবং সেই ভাবে তারা একটা অবস্থান নিয়েছে । অন্যদিকে আন্দোলনকারীদের একজন ব্লগার রাজীবকে হত্যা করার পর জামায়াত শিবির কর্মীরা তার নামে পবিত্র ইসলাম ধর্মকে অবমাননা করে কিছু কটূক্তি ফেইসবুকে ছেড়ে দিয়েছে । বাংলাদেশে একজন মানুষ যতবড় নাস্তিকই হোক না কেন কখনো প্রকাশ্যে সে ধর্মের বিরুদ্ধে কখা বলবেনা । রাজীবের পরিবার পরিষ্কার ভাষায় বলেছে রাজীব কখনো নাস্তিক ছিলনা । তথ্য প্রযুক্তি সম্পর্কে যাদের সামান্যতম জ্ঞান আছে তারা ঠিকই জানে এই ধরনের ভুয়া একাউন্ট খুলে যে কেউ যে কারো নামে মন্তব্য প্রচার করতে পারে । এমন একটি ভূয়া মন্তব্য নিয়ে গত বছর কক্সবাজারের রামুতে ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল । এমন অনেক মন্তব্য বা ছবি ফটোশপের মাধ্যমে তৈরী করে জামায়াত এবং বিএনপি’র শীর্ষ নেতাদের নামে নিয়মিত ফেইসবুকে আপলোড করা হয় । নিশ্চয় তারা সেগুলি দেখেন । জামায়াত এখানেই থেমে থাকে নি । তারা এই তথাকথিত ধর্মকে নিয়ে অবমানাকর মন্তব্য সৃষ্টি করার বিরুদ্ধে তাদের ভাষায় তৌহিদী জনতাকে ঐক্যবদ্ধ হতে আহ্বান জানিয়ে তিনটি দলীয় পত্রিকায় উস্কানি মূলক বিজ্ঞাপন প্রচার করেছে । শুক্রবার তারা বিভিন্ন নামে দেশের বিভিন্ন এলাকায় ফেইসবুকে দেওয়া তথাকথিত ইসলাম বিরোধী ভূয়া পোস্টকে কেন্দ্র করে সহিংস তান্ডব চালানোর চেষ্টা করেছে । তাদের প্রধান লক্ষ্য ছিল গণমাধ্যমের কর্মীরা । তারা এটিকে ব্যবহার করে দেশে একটি সাম্প্রদায়িক উত্তেজনাও সৃষ্টি করতে চেষ্টা করবে । সরকারের উচিৎ হবে এই ধরনের প্রচেষ্টাকে শক্ত হাতে দমন করা । সরকারের এই ব্যাপারে দ্বিধান্বিত থাকার কোন কারণ নেই । এই ব্যাপারে দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠী তাদের সাথে আছে । সব শেষে সরকারের কাছে একটি অনুরোধ । এখনো কিছু ছাত্রলীগ নামধারী কিছু দুর্বৃত্ত দেশের কোন কোন শিক্ষাঙ্গনে দুর্বৃত্তপনায় লিপ্ত । তাদের অচিরেই দমন না করলে আগামীতে চরা মূল্য দিতে হবে ।

লেখক: সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। ফেব্রুয়ারি ২২, ২০১৩

 

 

WARNING: Any unauthorized use or reproduction of 'Community' content is strictly prohibited and constitutes copyright infringement liable to legal action. 

 

[প্রথমপাতা]

 

 

 

লেখকের আগের লেখাঃ