[প্রথমপাতা]

 

 

 

 

 

নতুন কোরবান আলীদের পদধ্বনি

 

 

প্রফেসর আবদুল মান্নান

দিন কয়েক আগে একজন আওয়ামী লীগের এক ঢাকসাইটে নেতার সঙ্গে কথা হচ্ছিল দেশের রাজনীতি নিয়ে । এখনো গায়ে মুজিব কোট পরে ঘুরে বেড়ান আর বঙ্গবন্ধু বলতে অন্তঃপ্রান । এক এগারোর পর সংষ্কারপন্থী বলে মূল দল হতে ছিটকে পরেছেন । জানতে চাই চারটি সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের পর দেশের রাজনীতি নিয়ে কী ভাবছেন ? কোন রাখঢাক না রেখেই বললেন আওয়ামী লীগ সামনের নির্বাচন বা রাজনীতি নিয়ে কী ভাবছে তার খোঁজ খবর তিনি রাখেন না তবে সামনের নির্বাচনে তারা একশত সাতটি নির্বাচনী আসনে প্রার্থী দেবেন । জানতে চাই কারা এই একশত সাতজন ? তরিৎ উত্তর যারা আওয়ামী লীগ হতে নানা অজুহাতে ছিটকে পরেছেন তারা । বলি তাতে তাদের কী লাভ? সহজ উত্তর, তাদের কোন লাভ নেই তবে তাদের মিশন হচ্ছে ভোট ভাগাভাগির মাধ্যমে আওয়ামী লীগকে পরাজিত করা । বুঝলাম সকলের অগোচরে নতুন কোরবান আলীরা সামনের নির্বাচনের জন্য বেশ আটঘাট বেধেই ইতোমধ্যে প্রস্তুতি শুরু করে দিয়েছেন ।
বর্তমান প্রজন্মের অনেকেই কোরবান আলীকে নাও চিনতে পারেন আবার যারা চিনেন তাদের স্মৃতি হতে কোরবান আলীর নাম মুছেও যেতে পারে । কোরবান আলী পেশায় আইনজীবী ছিলেন । আজীবন আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন । ১৯৭৩ এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে ঢাকা-৬ আসন হতে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন । বঙ্গবন্ধু কোরবান আলীকে খুব স্নেহ করতেন । তিনি তাঁকে আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহ-সভাপতি বানিয়েছিলেন । ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগষ্টে সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যার পর কোরবান আলীকে গ্রেফতার করা হয় । তিনি দীর্ঘদিন কারাভোগ করেন । পরবর্তীকালে আবদুল মালেক উকিল, সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দিন, মাহিউদ্দিন আহম্মেদ, আবদুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমেদ, আমির হোসেন আমুর প্রচেষ্টায় আওয়ামী লীগ পুনরুজ্জীবিত হলে কোরবান আলী তার সাথে সম্পৃক্ত হন । এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের প্রথম দিকে তিনি একজন রাজপথের সৈনিক ছিলেন । এই আন্দোলন যখন তুঙ্গে তখন একদিন হঠাৎ সকলে অবাক বিস্ময়ে দেখেন কোরবান আলী এরশাদের মন্ত্রীসভায় যোগ দিয়েছেন । ঠিক একই কাজ করেছিলেন ক্যাপ্টেন (অবঃ) আবদুল হালিম । তিনি এক সময় ন্যাপের রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন । পরে জিয়ার বিএনপিতে যোগ দেন । সকলে তাঁকে একজন সজ্জন ও মার্জিত রুচির মানুষ হিসেবে জানতো । বেগম জিয়ার নেতৃত্বে তখন সাতদলীয় ঐক্যজোট গঠিত হয়েছে । অন্যদিকে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আট দলীয় জোট আর বাম পন্থীদের নেতৃত্বে পাঁচ দলীয় জোট । সকলের অভিন্ন লক্ষ্য । আন্দোলনের মাধ্যমে স্বৈরাচার এরশাদকে হঠাতে হবে । এই লক্ষ্যে একটি লিঁয়াজো কমিটিও গঠিত হয় । এই কমিটির অন্যতম সদস্য ছিলেন আবদুল হালিম । দিনের বেলায় বিভিন্ন জোটের নানা কর্মসূচী শেষে সন্ধ্যায় আবদুল হালিম সাংবাদিকদের ব্রীফ করেন আর রাতে গিয়ে এরশাদের মন্ত্রী সভায় যোগ দেন । তবে তিনি যেহেতু তেমন বড় মাপের নেতা ছিলেন না সেহেতু মন্ত্রী সভায় যোগদানটা রাজনৈতিক মহলে তেমন একটা তোলপাড় সৃষ্টি করে নি যেমনটি কোরবান আলীর যোগদানটি করেছিল । সে সময় একজন কোরবান আলী বা একজন আবদুল হালিম ছিলেন কিন্তু বর্তমানে তাদের সংখ্যা বহুগুন বেড়েছে এবং তার জন্য সব চেয়ে বেশী খেসারত দিতে হয়েছে বা হচ্ছে দেশের বৃহত্তম দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগকে । এটি আওয়ামী লীগের জন্য একটি বড় সাংগঠনিক দূর্বলতা ।
সম্প্রতি অনুষ্ঠিত চারটি সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগ অনেকটা অপ্রত্যাশিত ভাবে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়েছে । এই চারটি নির্বাচনই ছিল স্থানীয় সরকার নির্বাচন এবং স্থানীয় সরকার নির্বাচন সাধারণতঃ স্থানীয় ইস্যু নিয়ে হয়ে থাকে । এই চারটি সিটি কর্পোরেশনের চার মেয়রই ছিলেন আওয়ামী লীগ হতে নির্বাচিত এবং স্থানীয়ভাবে বেশ জনপ্রিয় কারণ তাদের চরম শত্রুও স্বীকার করবেন তাদের প্রত্যেকই তাদের নগরের জন্য অনেক উন্নয়নমূলক কাজ করেছেন । তাদের কারো বিরুদ্ধে দূর্নীতির তেমন কোন অভিযোগও শোনা যায় নি । তাদের এই অপ্রত্যাশিত পরাজয়ের পিছনে অনেক কারণ আছে ঠিক তবে সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কারণ হচ্ছে দলের অভ্যন্তরের লাগামহীন কোন্দল এবং নতুন কোরবান আলীদের জন্ম নেয়া । বরিশালের শওকত হোসেন হিরন তার জেলার চেহারা পাল্টে দিয়েছিলেন । নির্বাচনের পর বরিশাল হতে আমার এক সাবেক ছাত্রী ফোনে অনেকটা ক্ষোভে এবং দুঃখে জানালো এই দেশে জনগণের উন্নয়নের জন্য কাজ করে কী লাভ ? জনগণতো এই সব কাজকে মূল্যায়ন করে না, তারা বিরোধী দলের মিথ্যা, বানোয়াট আর অর্ধ সত্য প্রচারণাকেই অনেক বেশী গুরুত্ব দেয় । নির্বাচনের দু‘দিন পর হিরন সাংবাদিক সম্মেলন করে জানালেন তার পরাজয়ের পিছনে আওয়ামী লীগের এক বড় মাপের নেতার অবদান সবচেয়ে বেশী । পরে অনেকের কাছে খোঁজ নিয়ে জেনেছি হিরন অসত্য কিছু বলেন নি । তাদের মতে সেই নেতা চান নি বরিশাল শহরে তার চেয়ে কোন জনপ্রিয় নেতার আবির্ভাব ঘটুক । এটি যে শুধু বরিশালে ঘটেছে তা নয় দেশের আরো অনেক জেলার অবস্থানও একই রকম । এরাতো দলের ভিতরের শত্রু কিন্তু যারা এখন গায়ে মুজিব কোট চাপিয়ে সর্বক্ষণ জনগণকে বোকা বানিয়ে কোরবান আলীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন তাদের ব্যাপারে কী হবে ?
নতুন কোরবান আলীদের আবির্ভাব শুধু দলে হচ্ছে তাও নয় । ইতোমধ্যে দলের বেশীর ভাগ অঙ্গসংগঠনেও হয়েছে এবং পেশাজীবী সংগঠন গুলিও তা হতে মুক্ত নয় । সময় মতো তারা ঠিকই স্বনামে আত্মপ্রকাশ করবে । একটি বিশ্ববিদ্যালয় দীর্ঘদিন ধরে অচল । এবং এর কারণ শিক্ষকদের দলাদলি । এখানে জামায়াত-বিএনপি-আওয়ামী লীগ নামধারিদের একাংশ একজোট হয়েছে এই বলেযে তাদের ভাষায় বর্তমান উপাচার্যকে ফেলে দিতে হবে । এর আগেও তারা এই কাজে সফল হয়েছিল । কিন্তু প্রত্যাশা অনুযায়ী তাদের মধ্য হতে চ্যান্সেলর কাউকে উপাচার্য নিয়োগ দেন নি । এতে তারা সরকার তথা চ্যান্সেলরের উপর ভীষণ ক্ষীপ্ত এবং যতক্ষণ পর্যন্ত তাদের ইচ্ছা পূরণ না হচ্ছে ততক্ষণ পর্যন্ত তারা তাদের যৌথ আন্দোলন চালিয়ে যাবে । কী সহজেই না এরা সাধারণ জনগণকে বিভ্রান্ত করে এবং নিজেদের উদ্দেশ্য হাসিল করে ?
শুরুতে যেই একশত সাতজন সম্ভাব্য নতুন কোরবান আলীদের কথা উল্লেখ করেছি সময়ের সাথে সাথে হয়তো তাদের সংখ্যা আরো বাড়বে । ১৯৯১ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের পরাজিত হওয়ার কোন কারণ ছিল না । বিএনপি’র কাছে সে সময় তিনশত আসনে দাঁড় করানোর মতো প্রার্থীও ছিল না । আমার এক সময়ের এক সহকর্মী বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে সব নির্বাচনে প্রতিদ্বন্ধিতা করতেন কিন্তু নিজেরটা ছাড়া দ্বিতীয় কোন ভোট কখনো পান নি । আমার সহকর্মী যাকে তাকে নয় পরাজিত করলেন আওয়ামী লীগের সাধারন সম্পাদক মোঃ জিল্লুর রহমানকে যিনি পরবর্তীকালে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হয়েছিলেন । সেই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ কম পক্ষে ষাটটি আসনে পরাজিত হয়েছিলেন অন্তঃদলীয় কোন্দল আর কোরবান আলীদের কারণে । সামনের নির্বাচন নিয়ে আওয়ামী লীগ কী ভাবছে তা জানার কোন সুযোগ নেই । কিছুদিন আগে দলের সভানেত্রী বলেছিলেন তাঁর কাছে তথ্য আছে কম পক্ষে ষাটজন সংসদ সদস্যের অবস্থা তাদের নিজ এলাকায় ভাল নয় এবং সামনেরবার এই সব এলাকায় প্রার্থী পরিবর্তন হতে পারে । গণমাধ্যমের মতে ষাট নয় কম পক্ষে একশত বা তার বেশী আসনে প্রার্থী পরিবর্তন করতে হবে কারণ বিগত সাড়ে চার বছরে এই সংসদ সদস্যদের সাথে তৃণমূল পর্যায়ে নেতা কর্মীদের দূরত্ব বহুগুন বেড়েছে । প্রধানমন্ত্রী নিয়মিত গণভবনে বিভিন্ন জেলার নেতা কর্মীদের নিয়ে মত বিনিময় সভা করেন । কয়েক জনের সাথে আলাপ করে জেনেছি সেই সব সভায় বেশীর ভাগ সময় সভানেত্রী বলেন আর বাকিরা শুনেন বা শোনর ভান করেন। মাঝে মধ্যে দু’একজন সুযোগ পেলে তাদের ক্ষোভের কথা বলেন । কিন্তু তাতে কী কোন কাজ হয় ? আসলে যারা গণভবনে আসেন তাদের অধিকাংশই আসেন একটু নেত্রীর সান্নিধ্য পাবার আশায় দলের কোন মঙ্গলের জন্য নয় । এলাকায় গিয়ে গণভবন আর নেত্রী দর্শনের গল্প বলেন, ওই পর্যন্ত । আমার সব সময় মনে হয়েছে এই পুরো ব্যাপারটাই পন্ডশ্রম ছাড়া আর কিছু নয় । কাজের কাজ হতো যদি সংগঠনটিকে কার্যকর করা যেত । ঠিক ১৯৯১ সালের মতো নব্য কোরবান আলীরা সামনের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রভুত ক্ষতি করবেন । গত সাড়ে চার বছরে আওয়ামী লীগতো বন্ধুর চেয়ে শত্রুর সংখ্যা কয়েকগুন বৃদ্ধি করেছে । এই দেশে যখন আওয়ামী লীগ বিরোধীতার প্রশ্ন আসে তখন সব ব্যক্তি, গোষ্টি আর দল সহজে ঐক্যবদ্ধ হয়ে পরেন । সমমনা সকলকে ঐক্যবদ্ধ করতে আওয়ামী লীগ সব সময় চরম ভাবে ব্যর্থ হয়েছে । এখন পর্যন্ত তার তেমন একটা ব্যতিক্রম দেখা যাচেছ না । এর জন্য দলতো বটেই চরম মূল্য দিতে হয় দেশের সাধারণ মানুষকে । এখন তাদেরকেই ঠিক করতে হবে এই সংকট হতে কী ভাবে উত্তরণ ঘটানো যায় । তা যদি করা সম্ভব না হয় তা হলে বিপর্যয় অনিবার্য হয়ে উঠতে পারে ।

লেখকঃ সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় । জুন ২৯, ২০১৩

 

 

WARNING: Any unauthorized use or reproduction of 'Community' content is strictly prohibited and constitutes copyright infringement liable to legal action. 

 

[প্রথমপাতা]

 

 

 

লেখকের আগের লেখাঃ