[প্রথমপাতা]

 

 

 

 

 

গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভ ও পনেরজন সম্পাদক

 

প্রফেসর আবদুল মান্নান

দৈনিক আমার দেশ পত্রিকার বহুল আলোচিত সমালোচিত নিন্দিত আবার কারো কারো কাছে নন্দিত সম্পাদক মাহমুদুর রহমান, যিনি এখন কারাবন্দী, বাংলাদেশের ১৫ জন প্রতিষ্ঠিত পেশাদার সম্পাদক তার মুক্তি দাবি করে সম্প্রতি এক বিবৃতি দিয়েছেন এবং সে বিবৃতিকে কেন্দ্র করে সুধি মহলে বেশ সমালোচনার ঝড় বইছে । এই ১৫ জন সম্পাদক শুধু দৈনিক আমার দেশ সম্পাদকের শুধু মুক্তিই দাবি করেন নি একই সাথে সরকার কর্তৃক সাময়িক ভাবে বন্ধ করে দেয়া দিগন্ত ও ইসলামি টিভি চ্যানেলও পুনরায় সম্প্রচার শুরু করতে দেয়ার দাবি জানিয়েছেন । দৈনিক আমার দেশ পত্রিকা বিএনপি’র মূখপত্র বলে পরিচিত হলেও এটি মূলত জামায়াতের মূখপত্র হিসেবেই কাজ করে । দিগন্ত টিভি চ্যানেল বর্তমানে একাত্তরে সংগঠিত মানবতা বিরোধী অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত যুদ্ধাপরাধী মীর কাশেম আলীর মালিকানাধীন জামায়াতের টিভি চ্যানেল । ইসলামিক টিভি বিএনপি প্রধান বেগম খালেদা জিয়ার প্রয়াত ভাই সাইদ ইস্কান্দর কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত । তার মৃত্যুর পর এটির মালিকানা তার পরিবারের কাছেই আছে বলে জানা যায় । এই তিনটি গণমাধ্যমই বন্ধ হয়েছে অথবা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে গত ৫-৬ তারিখ রাতে হেফাজতে ইসলাম কর্তৃক ঢাকায় সংগঠিত ভয়াবহ তা-ব লীলার প্রেক্ষাপটে । তথ্য মন্ত্রনালয় বলেছে এই বন্ধ সাময়িক । বাংলাদেশে পত্রপত্রিকা বা টিভি চ্যানেল বন্ধ হওয়ার ঘটনা নতুন কোন বিষয় নয় । প্রাক বাংলাদেশ আমলে আইউব খানের শাসনামলে দৈনিক ইত্তেফাক বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল । একাত্তরের ২৬ মার্চ রাতে দৈনিক ইত্তেফাক, দি পিপল, দৈনিক গণবাংলা কামান দেগে ধ্বংস করে দেয়া হয়েছিল । ১৯৭৫ সনে বাকাশাল পদ্ধতির সরকার প্রবর্তিত হলে দেশের চারটি ছাড়া সকল সংবাদ পত্র বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল । চারদলীয় জোট সরকারের আমলে একুশে টিভি শুধু বন্ধই করে দেয়া হয়নি তার যন্ত্রপাতিও খুলে নেয়া হয়েছিল । তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে সাকাচৌ পরিবারের মালিকনাধীন সিএসবি নিউজ ও চ্যানেল ওয়ান বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল । এই সব গণমাধ্যম কোন কোনটি বন্ধ হয় রাজনৈতিক কারণে আবার কোন কোনটি বন্ধ হয় চালু করা অথবা প্রকাশের পদ্ধতিগত ত্রুটির কারণে । সম্প্রতি দৈনিক আমার দেশ এবং অন্য দু’টি টিভি চ্যানেল বন্ধ করার কারণ ছিল এই তিনটি গণমাধ্যম নিয়মিত অসত্য তথ্য প্রচার ও প্রকাশ করে পরিকল্পিত ভাবে জনগনকে বিভ্রান্ত করছিল এবং দেশে একটি সংঘাতময় পরিস্থিতি সৃষ্টি করার জন্য জনগনকে চরম উস্কানি দিচ্ছিল ।
স্বাধীন গণমাধ্যমকে বলা হয় গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভ । একটি দেশের আইন পরিষদ, বিচার ও নির্বাহি বিভাগ এবং গণমাধ্যমের স্বাধীনতা যদি নিশ্চিত করা যায় তাহলে সে দেশের গণতন্ত্র সাধারনতঃ বিপন্ন হয় না । আর এই চারটি স্তম্ভের যে কোন একটি দূর্বল হলে বা নড়বড় হলে তখন সে দেশের গণতন্ত্র বিপদে পরে । এই স্তম্ভের প্রত্যেকটির আবার নিজস্ব কিছু নীতিমালা আছে । সেই নীতিমালাগুলি মেনে চলার প্রধান দায়িত্ব এই স্তম্ভগুলি যাদের হেফাজতে আছে তাদের । আবার যখন কেউ একটা পত্রিকা প্রকাশের অথবা টিভি চ্যানেল চালু করার সিদ্ধান্ত নেয় তখন তাকে সরকারি কিছু আইন কানুনও মেনে চলতে হয় । এ’সবের ব্যতয় ঘটলে এর দায় দায়িত্ব তাদেরকেই নিতে হবে । গণমাধ্যমের স্বাধীনতা বা বাক স্বাধীনতার অর্থ এই নয় যে একজন যা ইচ্ছা তা বলতে পারার বা লিখতে পারার লাইসেন্স পাওয়া । বিশ্বের কোন দেশেই তা অনুমোদন করে না । বাংলাদেশের সংবিধান তার নাগরিকদের সমাবেশ বা সংগঠন করার অধিকার দিয়েছে । এটি তার মৌলিক অধিকারের অংশ । তাই বলে কোন একটি দল বা গোষ্টি যদি সমাবেশ ডেকে জনগনের জানমালের নিরাপত্তার বিঘœ সৃষ্টি করে অথবা তারা অবাধ চলাচলের প্রতিবন্ধকতার কারণ হয় তা হলে সেই সমাবেশ আইনের দৃষ্টিতে কখনো বৈধ হতে পারে না । পাকিস্তান সাংবিধানিক ভাবে একটা ইসলামিক প্রজাতন্ত্র । সে দেশে মসজিদের মাইক নামাজের আজান দেয়া ছাড়া অন্য কোন কাজে ব্যবহার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ । মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশগুলিতেও তাই । আমাদের দেশে মসজিদের মাইক ইদানিং কালে অনেক দাঙ্গাহাঙ্গামার কাজেতো ব্যবহার হয়ই আবার অনেক জায়গায় ইসলামী জলসার নামে গভীর রাত পর্যন্ত তা ব্যবহার করে যার কারনে এলাকার সাধারণ মানুষের শান্তির ব্যাঘাত সৃস্টি হয় । এখন তা যদি বন্ধ করা হয় তাহলে কেউ যদি বলে বাকস্বাধীনতা রুদ্ধ করা হয়েছে তা হলে তা হবে সম্পূর্ণ অযৌক্তিক । বাংলাদেশে হিজবুত তাহরির বা হুজি নিষিদ্ধ করা হয়েছে কারণ তারা জনগনের নিরাপত্তার হুমকীর কারণ হয়েছিল । বাংলাদেশের সংবিধান দেখিয়ে তারা বলতে পারে না সরকার তাদের সংগঠন করার সাংবিধানিক অধিকার ছিনিয়ে নিয়েছে । যুক্তরাষ্ট্রের মতো এত খোলা মেলা দেশেও ক্লু ক্ল্যাক্স ক্ল্যানের মতো (ককক) চরম বর্ণবাদি সংগঠন নিষিদ্ধ । আশির দশকে একজন মার্কিনী সে দেশের পতাকার ডিজাইনে তার বাড়ীর দরজার পাপোস বানিয়েছিল । পুলিশ তাকে এই অপরাধে গ্রেফতার করে । আদালতে সে বলে একটি স্বাধীন দেশে তার বাড়ীর দরজার পাপোস কী রকম হবে তা অন্য কেউ বলে দিতে পারে না । সে তার দেশের সংবিধানের দোহায় দেয় । আদালত তার রায়ে বলে স্বাধীনতা নৈরাজ্য সৃষ্টির লাইসেন্স নয় । সে যাত্রায় তাকে মোটা অংকের জরিমানা গুনতে হয় । জার্মানিতে নাৎসি পার্টি নামের কোন সংগঠন করার কথা কেউ চিন্তাও করতে পারে না । সে দেশে নাৎসি পার্টির দলীয় চিহ্ন ব্যবহার নিষিদ্ধ । তাই বলে কেউ বলে না জার্মানিতে বাক স্বাধীনতা অথবা সংগঠন করার স্বাধীনতা রূদ্ধ করা হয়েছে ।
দৈনিক আমার দেশ শুরুর দিকে আতাউস সামাদ বা আমান উল্লাহ কবিরের মতো পেশাদার সাংবাদিকদের সম্পাদনায় প্রকাশিত হতো । তখন পত্রিকাটি সাংবাদিকতার নুন্যতম নীতিমালা মেনে চলার চেষ্টা করতো । কিন্তু যে মুহুর্তে সেটি তাদের হাত হতে মাহমুদুর রহমানের মতো অপেশাদার সাংবাদিকের হাতে গিয়ে পরলো তখন তার অবস্থা হলো একজন মুমূর্ষু রোগীর হাতুড়ে ডাক্তারের হাতে পরার সামিল । মাহমুদুর রহমান পেশায় একজন প্রকৌশলী । ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএ হতে এমবিএও পাশ করেছেন । সালমান রহমানের বেক্সিমকোতে চাকুরী করতেন। হলেন বেগম জিয়ার বিনিয়োগ বোর্ডের চেয়ারমেন আর পরে জ্বালানি উপদেষ্টা । ২০০৬ সালের নির্বাচনের আগে উত্তরায় সাবেক ও কর্মরত কিছু আমলাকে নিয়ে নির্বাচনী ষড়যন্ত্র করতে গিয়ে মিডিয়ার হাতে ধরা পরলেন । ২০০৮ সালের সাধারণ নির্বাচনের সময় বেগম জিয়ার একজন নির্বাচনি উপদেষ্টার ভ’মিকা পালন করেছেন । মাঝে মধ্যে দৈনিক আমার দেশে কিছু মন্তব্য প্রতিবেদন লিখেছেন। কয়েকটি চ্যানেলে রাতের টকশোতে তাকে দেখা যাওয়া শুরু হলো । একদিন বনে গেলেন দৈনিক আমার দেশের সম্পাদক । মানবতা বিরোধী অপরাধের দায়ে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু হলে দৈনিক আমার দেশ সরাসরি তার বিরুদ্ধে অবস্থান নেয় । দেলওয়ার হোসেন সাঈদীর ফাঁসির আদেশ হলে আমার দেশ চাঁদে সাঈদীকে অবিস্কার করে । পবিত্র কাবা শরীফের গিলাফ পরিবর্তনের একটি ছবি নিজ পত্রিকায় প্রকাশ করে নীচে লেখেন সাঈদীর ফাঁসির রায়ের বিরুদ্ধে কাবা শরিফের ইমামদের প্রতিবাদ মিছিল । এতে সারা দেশে ব্যাপক দাঙ্গাহাঙ্গামা সৃষ্টি হয় । আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারি বাহিনী সহ অনেক প্রান হানি ঘটে । দেশের বিভিন্ন জেলায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সৃষ্টির চেষ্টা করা হয় । অনেক স্থানে মন্দির প্যাগোডা ধ্বংস করা হয় । দৈনিক আামার দেশ ছাড়াও এই কাজে উস্কানি দেয় দিগন্ত টিভি চ্যানেল । তবে া দিগন্ত ইসলামিক টিভি চ্যনেলকে সাথে নিয়ে সব চেয়ে ন্যাক্কারজনক ভ’মিকাটি পালন করে ঢাকায় হেফাজতি অভিযানের সময় । তারা দিনব্যাপি মতিঝিল শাপলা চত্তর হতে সরসরি হেফাজতি সমাবেশের অনুষ্ঠান ও বিভিন্ন জনের উস্কানি মূলক সাক্ষাৎকার প্রচার করে । তাদের অনুষ্ঠান দেখে মনে হচ্ছিল রাত পোহালেই আল্লামা শফি পাশে অবস্থিত বঙ্গভবনে তার সাঙ্গপাঙ্গদের নিয়ে প্রবেশ করবেন আর জুনায়েদ বাবুনগরী গণভবন দখল করবেন । যে পনের জন সম্পাদক মাহবুবুর রহমানের মুক্তি অথবা চ্যানেল দুটি খুলে দিতে দাবি করে বিবৃতিতে স্বাক্ষর করেছেন তারা কী সেই অনুষ্ঠানগুলি দেখেছেন ? দৈনিক আমার দেশ কী রকমের অপসাংবাদিকতা করে তার বিস্তারিত তথ্য দিয়েতো ডেইলী ষ্টার একাধিক রিপোর্টও করেছে । তারপরও অবাক হতে হয় বন্ধু মাহফুজ আনামও সেই বিবৃতিতে স্বাক্ষর করেছেন । আমার এক সিনিয়র সাংবাদিক বন্ধুকে এই প্রসঙ্গে প্রশ্ন করলে সে কিছুটা আমতা আমতা করে বলে অপরাধ করলে তাদের বিরুদ্ধে মামলা হোক । পত্রিকা বের না হলে অথবা টিভি চ্যানেল চালু না হলেতো অনেক সাংবাদিকের আয় রোজগার বন্ধ হয়ে যাবে । কেমন একটা খোঁড়া যুক্তি । বলি এখন হলমার্ক কেলোঙ্কারির সাথে যারা জড়িত তাদেরকে মুক্তি দিতে যদি এফবিসিসিআই একটি বিবৃতি নিয়ে হাজির হয় তাহলে আমাদের গণমাধ্যম সেটিকে কী ভাবে গ্রহণ করবে? এই প্রশ্নের জবাব বন্ধুর কাছে নেই ।
ইতোমধ্যে দেশের সুশিল সামাজ, সেক্টর কমান্ডার্স ফোরাম, বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন পনের জন সম্পাদকের বিবৃতির তীব্র ভাষায় প্রতিবাদ ও সমালোচনা করেছেন । যে পনের জন সম্পাদক এই বিবৃতিতে সই করেছেন তারা প্রত্যেকেই পেশাদার সম্পাদক এবং দেশের মানুষ তাদের যথেষ্ট সম্মান করে ও তারা আশা করে গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভের রক্ষক হিসেবে তারা তাদের দায়িত্ব পালনে আরো একটু সচেতন হবেন।

লেখক: সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় । মে ২১, ২০১৩

 

 

WARNING: Any unauthorized use or reproduction of 'Community' content is strictly prohibited and constitutes copyright infringement liable to legal action. 

 

[প্রথমপাতা]

 

 

 

লেখকের আগের লেখাঃ