একটানেতে যেমন তেমন
সোহেল মাহরুফ
ক্লাসে স্যার একটানা বকবক করে যাচ্ছেন। ছেলেরা শুনছে কি শুনছে না সেদিকে
তার কোনো খেয়াল নেই। তিনি বকবক করছেন তো করছেনই। তিনি আত্মতৃপ্তিতে ভুগছেন।
আর এ আত্মতৃপ্তির কারণ হচ্ছে তিনি লন্ডন থেকে ডিগ্রি নিয়ে এসেছেন এবং
ভাবছেন তিনি যেভাবে বলছেন তা খুবই আকর্ষনীয় হচ্ছে। অবশ্য আকর্ষনীয় করার
পেছনে তার প্রচেষ্টারও কমতি নেই। সুযোগ পেলেই টেনে আনছেন লন্ডনের গল্প। তাও
অধিকাংশই মেয়ে বিষয়ক। এই যেমন আমার এক গার্লফ্রেন্ড ছিল, সুইডিশ, ওর ছিল...
ইত্যাদি, ইত্যাদি। যখনই মেয়ে বিষয়ক কোনো গল্প আসে তখনই ছেলেদের কান দুটো
আরও সচেতন এবং চোখ দুটো আরও বৃহদাকার হয়ে উঠে। তারা যেন তাদের সামনেই দেখতে
পাচ্ছে সবকিছু। জাহিদ এর এসব কিছুই ভালো লাগে না। কেননা, প্রথম প্রথম এসে
সব স্যাররাই প্রায় একই ধরণের গল্প বলেন। সে যেখান থেকেই আসেন না কেন- হোক
অস্ট্রেলিয়া কিংবা আমেরিকা- গল্পের ধরণ একই। সেই প্রতিদিনকার রাস্তায় কফি
আর হট ডগ খাওয়ার একঘেঁয়ে কাহিনি। সে হাই তুলতে তুলতে একবার ডানে তাকায়,
একবার বামে তাকায়। কি যেন খুঁজে বেড়ায় তার কৌতুহলী চোখ। হঠাৎ এককোণায় আটকে
যায় তার কৌতুহলী চোখ, হয়ে যায় নিস্পলক। যার জন্য দুচোখের এই ব্যস্ততা তাকেই
হঠাৎ দেখতে পায় সে। হ্যাঁ লীনা-লীনাকেই খুঁজছিল সে। লীনা বসেছে একদম কর্ণারে।
অনিমেষ তাকিয়ে আছে স্যারের দিকে। অথচ এতদিন যতবারই তাকাতো প্রায় প্রতিবারই
খুঁজে পেতো লীনার চোখের সীমানা। চোখে চোখেই চলতো কথা। মাঝে মাঝে লজ্জ্বা
পেয়ে সরিয়ে নিতো তার চোখ। কিন্তু আজ আর জাহিদের দিকে তাকাচ্ছে না। এই যে
জাহিদ এতক্ষন ধরে তার দিকে তাকিয়ে আছে সেদিকেও তার কোনো খেয়াল নেই। সে
তাকিয়ে আছে স্যারের দিকে- যেন সব কথা গোগ্রাসে গিলে ফেলছে। এ দেখে জাহিদের
রাগ হয়। সে আবার স্যারের দিকে তাকায়। স্যার আগের চেয়েও আকর্ষনীয় করে
উপস্থাপন করছেন তার বক্তব্য। জাহিদের ভালো লাগে না। সে আবার তাকায় লীনার
দিকে। লীনা অপলক তাকিয়ে আছে স্যারের দিকে। লীনার এই অপ্রয়োজনীয় মনোযোগ দেখে
জাহিদ আরও বিরক্তি বোধ করে। সে আবার তাকায় স্যারের দিকে। এবার কান দেয়
স্যারের বক্তব্যে। খুঁজে বের করতে চেষ্টা করে স্যার মনোযোগ দেওয়ার মতো কি
এমন বলছেন। কিন্তু সেই গার্লফ্রেন্ডদের সাথে আড্ডার কাহিনি ছাড়া আর কিছুই
খুঁজে পায় না। এবার সে স্যারকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে শুরু করে। বের করতে
চেষ্টা করে কি আছে তার ভেতরে-দৃষ্টি আকর্ষন করার মতো। জাহিদ আবিস্কার করে
লোকটির ভেতরে অনেক কিছুই আছে। তার গেটআপ, কথা বলার স্টাইল সবকিছুই দৃষ্টি
আকর্ষন করার মতো এবং সর্বোপরি ফেসভেল্যু বলে যে একটি ব্যাপার আছে তাও
উল্লেখ করার মতোই। জাহিদ এসব খুঁটিনাটি পর্যবেক্ষন করতে করতেই স্যারের চোখে
চোখ রাখে। অনুসরণ করে তাঁর চোখের এ্যাঙ্গেল। তার অপর প্রান্তে দেখতে পায়
লীনাকে। জাহিদ মাথা ঘুরায়। আবার তাকায় স্যারের দিকে। হ্যাঁ স্যার লীনার
দিকেই তাকিয়ে আছেন। তার সমস্ত প্রচেষ্টাই যেন লীনার জন্য। জাহিদ আবার তাকায়
লীনার দিকে। তার মনোযোগ আগের মতোই অবিচ্ছিন্ন। জাহিদের মেজাজ বিগড়ে যায়। সে
মনে মনে দুতিনবার স্যারকে উদ্দেশ্য করে কি যেন বলে। তারপর ক্লাস থেকে বেরিয়ে
যায়। বৈশাখের তপ্ত দুপুরে শুরু করে লংমার্চ।
বোশেখের সকালগুলো মাঝে মাঝে এরকমই হয়। কেমন যেন দমবন্ধ মনে হয়। জাহিদের
জন্য আজকের সকালটা আরও বেশি অস্বস্তিকর। এমনিতেই কাল রাতে ভালো ঘুম হয়নি
তার উপর সকালের এই ভ্যাপসা গরম। তবুও জাহিদ ক্যাম্পাসের উদ্দেশে রওনা দিয়েছে।
ভাবছে লীনার কথা। ভাবছে তার সাথে দেখা হলে ও কিভাবে ওর অসন্তোষ প্রকাশ করবে,
ইত্যাদি। তবে ও নিশ্চিত যে লীনা প্রথমেই জিজ্ঞেস করবে ও কাল কেন ওভাবে
ক্লাস থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল। এভাবে ভাবতে ভাবতে সে যখন ক্যাম্পাসে ঢুকছিল
তখন হঠাৎই একটি দৃশ্য দেখে থমকে যায়। তখনও ক্যাম্পাসে লোকজন তেমন আসেনি।
সবকিছু কেমন ফাঁকা ফাঁকা। ক্যান্টিনেও তেমন কেউ নেই। শুধু একটি টেবিলে
জানালার কাছে ঘেঁষে দু’জন বসে আছে। আর তা দেখেই জাহিদের পুরনো ক্ষতে আবার
রক্তক্ষরণ। আসলে তারা আর কেউ নয়-একজন লীনা আর একজন নাদিম জুবায়ের,
ডিপার্টমেন্টের নতুন লেকচারার। এ দেখে জাহিদ ঠাঁয় দাঁড়িয়ে যায়। কিছু ভাবতে
চেষ্টা করে। কিন্তু পারে না।
বিষয়টা হয়তো মারাত্মক কিছু না। কিন্তু সে মফস্বলের ছেলে- তার কাছে অনেক
কিছুই। আসলে ঢাকায় আসার পর সে যা কিছু পেয়েছে তার মধ্যে লীনাই হচ্ছে তার
সবচেয়ে বড় পাওয়া-সবচেয়ে আপন করে। এতদিন সে জানতো যে সে লীনাকে পুরোপুরিই
পেয়েছে। আজ মনে হচ্ছে সবটাই ভুল। লীনা একবার আড় চোখে তার দিকে তাকিয়ে চোখ
ফিরিয়ে নেয়। মনোযোগী হয় ধোঁয়া উঠা কাপের প্রতি। জাহিদ হাঁটতে শুরু করে।
কিছু ভাবতে চেষ্টা করে, কিন্তু পারে না। অনেক কিছুই মনে পড়ে বিক্ষিপ্তভাবে।
ক্লাসের শেষে হলের পেছনের পুকুর পাড়ে বসে থাকার কথা, ওর মেসের ছোট রূমটাতে
গিয়ে প্রথমদিনে লীনার নাক সিটকানোর কথা-“এ্যাঁ মা তুমি এখানে থাকো”, ইত্যাদি,
ইত্যাদি। সে হাঁটতে থাকে। ঘোলাটে হতে থাকে তার চারপাশ। জাহিদ আরও কিছু
খোঁজে- তার ভাবনার খোরাক। কিন্তু সে আর কিছু খুঁজে পায় না, শুধু অন্ধকার।
অন্ধকারেই সে হারিয়ে ফেলে ঘাসে ঢাকা সবুজ পথটা।
এখন যদি ক্যাম্পাসে কেউ বলে, কেমেস্ট্রিতে একটা স্টুডেন্ট ছিল খুবই
ট্যালেন্টেড, প্রচন্ড জেদী, ভীষণ অভিমানী... এটা ঠিক দাদীর মুখের গল্পের
মতোই শোনাবে। যেমন-একটা ছিল রাজ্য, সেখানে ছিল এক রাজা, সে ছিল মহা...
ইত্যাদি। এখন যদি নাতি প্রশ্ন করে রাজ্যের নাম কি তাহলে যেমন উত্তর মিলবে
না; তেমনি কেউ যদি জানতে চায় জাহিদের ঠিকানা তাও পাবে না। জাহিদ এ শহরেই
থাকে। তবু এখান থেকে বহুদূরে। ক্যাম্পাসের কোলাহল মাঝেমাঝে তার কানে পৌঁছে।
ঠিক যেমন অন্ধকারে পথ হারানো নাবিকের কানে বাজে দূর বন্দরের কোলাহল। সে
শোনে কিন্তু কানে তোলে না। সে এখনও অন্ধকারে পথ খোঁজে, খোঁজে স্বপ্নের
সিঁড়ি। সেই অন্ধকারেই হঠাৎ খুঁজে পায় নতুন দিগন্ত। কল্কি পাস করতে গিয়ে
হঠাৎ চমকে উঠে। তার বিশ্বাস হয় না। সে চোখ রগড়ে নেয়। আবার তাকায়। কিন্তু
কোনো পরিবর্তন নেই। তবু তার বিশ্বাস হয় না। কেননা, এটা ধাঁধার জগৎ। এখানে
যা দেখা যায় তার অধিকাংশই সত্য নয়। সে আবার চোখ রগড়ে নয়। আবার তাকায়।
হ্যাঁ, সে ঠিকই দেখছে। হ্যাঁ নাদিম স্যারই বসে আছেন তার পাশে। চিনতে খুব
কষ্ট হচ্ছে। ডিপার্টমেন্টের সবচেয়ে স্মার্ট স্যার ছিলেন তিনি। অথচ মুখে
খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি, রুক্ষ চুল, আলুথালু বেশবাশ কি এক অদ্ভুত অবস্থা! অথচ
তিনিই মৃদুলকে, সেই বাউল টাইপের ছেলেটা- রাস্তাঘাটে গীটার বাজিয়ে মাঝে মাঝে
গান গাইতো, তার জট পাকানো লম্বা চুল নিয়ে ক্লাসে ঢুকতে নিষেধ করেছিলেন।
জাহিদ পলকহীন চেয়ে থাকে। দেখে লোকটা কল্কিতে কেমন নিবিড়ভাবে ঠোঁট রেখে
গভীর নিঃশ্বাস নিচ্ছেন। জাহিদ অন্য কথা ভাবে। সেদিন পল্টনে হাঁটছিল। হঠাৎই
ওকে অবাক করে দিয়ে গাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছিল রাসেল। হ্যাঁ রাসেল, লীনার পর
ওর সবচেয়ে কাছের জন ছিল সে। সে এখন একটি বেভারেজ কোম্পানিতে আছে। বেশ ভাল
মাইনে পায়। জাহিদ অবাক হয়েছে- এত বড় প্রতিষ্ঠানের এত বড় একজন কর্মকর্তা সে;
তবু ওর এই আলুথালু বেশ দেখে একটুও হেসিটেট করেনি পুরনো বন্ধুকে বুকে জড়িয়ে
নিতে। তারপর ওকে গাড়ি করে নিয়ে গেলো রেস্টুরেন্টে। লাঞ্চের ফাঁকে ফাঁকেই
বললো নিজের কথা, জিজ্ঞেস করলো ওর কথা আর- আর বললো লীনার খবর। লীনার কথা
উঠতেই ও বিরক্ত হয়ে উঠে এলো। আসার সময় হাত পাতলো নির্লজ্জ্বের মতো। রাসেল
ফিরিয়ে দেয়নি। হাতে গুঁজে দিয়েছিলো দুটো পাঁচশো টাকার নোট। জাহিদ টাকা নিয়ে
সোজা চলে আসে। ধন্যবাদটুকুও জানায়নি। আজ মনে পড়ে রাসেল সেদিন লীনার কথা
বলেছিলো। বলেছিলো- সে বিয়ে করেছে, বিয়ের পরে হাজবেন্ডসহ আমেরিকায় পাড়ি
জমিয়েছে, ইত্যাদি। জাহিদ শুনতে ইন্টারেস্টেড হয়নি। কেননা সে ধরেই নিয়েছিলো
যে লীনা নাদিম স্যারকেই বিয়ে করেছে। কিন্তু এখন নাদিম স্যারকে তার পাশে
দেখে তার ভুল ভাঙ্গলো। এখন কেমন যেন একটা দুঃখ-একটা অনুশোচনাবোধ ওকে গ্রাস
করলো। নিজের মনেই আউড়ে উঠলো-
“নারী নাহি হতে চায় শুধু একা কারো,
এরা দেবী, এরা লোভী, যত পূজা পায়, এরা চায় তত আরো।”
ততক্ষনে কল্কি চলে এসেছে জাহিদের হাতে। সে মুখ রাখে গভীর
বিশ্বাসে-নিশ্চিন্ত নিঃশ্বাসে খোঁজে শান্তি- পেয়ে যায় স্বপ্নের পাখা।
|