[প্রথমপাতা]

 

 

 

 

 

দেশের সার্বভৌমত্বের জন্য রাতের অভিযান প্রয়োজন ছিল

 

প্রফেসর আবদুল মান্নান

বাংলাদেশের সুধীমহলের কাছে বেসরকারি টেলিভিশনগুলির সব চেয়ে জনপ্রিয় অনুষ্ঠান সম্ভবত তার টক শো । জানা মতে টক শো হচ্ছে টিভি চ্যানেলগুলির জন্য সর্বাধিক লাভজনক অনুষ্ঠান। এই সব অনুষ্ঠানে অনেক সময় বেশ কিছু পন্ডিত ও বিদগ্ধ ব্যক্তি অংশগ্রহণ করেন যাদের বক্তব্য শুনে শ্রোতারা উপকৃত হন এবং অনেক নতুন বিষয় জানতে পারেন । আমি নিজে আগে কোন টকশোতে তেমন একটা অংশগ্রহণ করতে উৎসাহ বোধ করতাম না । এখন কোন কোন চ্যানেল ডাকলে এবং বিষয় সম্পর্কে একটা ধারণা করতে পারলে যাই । যাওয়ার আগে জেনে নেই সাথে আর কে থাকছেন । এর কারণ কোন একটি টকশোতে গিয়ে আমি অহেতুক ঝগড়া-বিবাদে জড়িয়ে পড়তে চাই না । তবে কয়েকটি চ্যানেলের টকশো গুলি সময় পেলে দেখার চেষ্টা করি । গত কয়েক দিন ধরে কিছু চ্যানেলের টকশোগুলি শুনে ও দেখে একটি ধারণা হয়েছে হয় আমি নিজে একটি বড় মাপের আহাম্মক অথবা টিভিতে যাদের শুনছি তারা আহাম্মক । এদের মধ্যে আছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, সাংবাদিক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক, রাজনীতিবিদ, সংসদ সদস্য, ব্যবসায়ী নেতৃবৃন্দ প্রমূখ সুধীজন । বলা বাহুল্য সব চ্যানেলেই এই ক’দিনের টক শোগুলির মূল বিষয় ছিল গত পাঁচ তারিখে ঢাকার কেন্দ্রস্থলে কওমী মাদ্রাসা ভিত্তিক ধুমকেতুর মতো উদয় হওয়া হেফাজত নামক একটি তথাকথিত অরাজনৈতিক সংগঠন এবং পাঁচ তারিখ দিবাগত রাতে মতিঝিল এলাকা হতে তাদের সরাতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযান এবং তার যৌক্তিকতা ও অভিযানে কতজন আহত বা নিহত হলো তার একটা কল্পিত হিসাব নিকাশ । বিরোধী দল বর্তমান সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করতে গত তিন বছর ধরে নানা ভাবে চেষ্টা করছে, তেমন একটা সুবিধা হচ্ছিল না । বাংলাদেশের রাজনীতিতে পূর্বে লাশ একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে সুতরাং যে কোন উপায়ে হোক বিরোধী দলের লাশ চাই । বেশী হলে ভাল । লাশ এরই মধ্যে অনেকগুলি পড়েছে তবে তার বেশীর ভাগই আন্দোলনের নামে সন্ত্রাস সৃষ্টি করতে গিয়ে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারির গুলিতে নিহত হয়েছে এবং এই কারণেই এই সব লাশ নিয়ে রাজনীতি করা সহজ ছিল না । ঊনসত্তরের গণ আন্দোলনের সময় স্কুল ছাত্র মতিউর বা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র আসাদ আমাদের সাথে শান্তিপূর্ণ মিছিলে ছিল । তারা কোন গাড়ীতে অগ্নি সংযোগ করতে যায়নি বা কোন পুলিশ হত্যায়ও অংশগ্রহণ করেনি । সেই শান্তিপূর্ণ মিছিলের উপর পুলিশ আর ইপিআর গুলি ছুড়েছিল । গণ অন্দোলন তখন অনিবার্য হয়ে পরেছিল ।
বর্তমানে টক শোগুলিতে যে সব বিষয় নিয়ে প-িত ব্যক্তিরা তুমুল বিতর্ক করছেন তার কয়েকটি হচ্ছে (১) মতিঝিল শাপলা চত্বরে হেফাজতকে সমাবেশ করার অনুমতি দেয়া উচিৎ হয়েছে কী না; (২) তারা যে সারাদিন তা-ব চালালো তা হেফাজত করেছে তার কোন প্রমাণ আছে কী না; (৩) হেফাজতকে মতিঝিল হতে সরিয়ে দিতে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারি বাহিনীর অভিযান রাতের বেলায় কেন করা হলো, সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করলে কী এমন অসুবিধা হতো; (৪) এই অভিযানে যে হাজার হাজার মানুষ নিহত হলো সেই সব লাশ কোথায় গুম করা হলো ?
মতিঝিল শাপলা চত্বরে এর আগে জামায়াতকে সমাবেশ করতে দেয়া হয়েছে । তখন জামায়াত সেই সমাবেশ হতে দেশে গৃহযুদ্ধ শুরু করার ঘোষণা দিয়েছে। এর পর এপ্রিল মাসের ছয় তারিখ এসেছে হেফাজত । সরকার এক রহস্যময় কারণে হেফাজতকে নিজেদের মিত্র মনে করে যদিও যেখানে হেফাজতের সদর দপ্তর চট্টগ্রামের হাটহাজারিতে সর্বশেষ আওয়ামী লীগ বিজয়ী হয়েছিল ১৯৭৩ সনে । দীর্ঘদিন ধরে এই আসনে বিজয়ী হয়ে আসছেন বিএনপি’র সৈয়দ ওয়াহিদুল আলম যিনি ১৯৭১ সালে সাকা চৌধুরীর দক্ষিণ হস্ত ছিলেন । হেফাজত তাদের সমাবেশ হতে নারী বিদ্বেষী এবং সভ্যতা বিনাশী অনেকগুলি ধারা সংযোজন করে সরকারের উদ্দেশ্যে একটি তের দফা দাবিনামা পেশ করে সে দিন বাড়ি ফিরে গিয়েছিল । যাওয়ার আগে বলে গিয়েছিল তারা সরকারকে এই সব দাবি মানার জন্য মে মাসের পাঁচ তারিখ পর্যন্ত সময় বেঁধে দিচ্ছে আর এর মধ্যে এই দাবি মানা না হলে ছয় তারিখ হতে দেশে হেফাজতের সরকার চালু হবে এবং হেফাজতের আমির আহম্মদ শফি রাষ্ট্র প্রধান হবেন । মে মাসের চার তারিখ বেগম জিয়ার নেতৃত্বে ১৮ দল একই জায়গায় সমাবেশ করলেন এবং সেই সমাবেশ হতে বেগম জিয়া সরকারকে ৪৮ ঘন্টার আল্টিমেটাম দিয়ে বললেন এই ৪৮ ঘন্টার মধ্যে তাদের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি মেনে নিতে হবে আর না হয় তাদের পদত্যাগে বাধ্য করা হবে । এই ৪৮ ঘন্টার আল্টিমেটামটি বেশ তাৎপর্যপূর্ণ কারণ পরদিন সকাল হতেই হেফাজতের পূর্ব ঘোষিত ঢাকা অবরোধ শুরু হচ্ছে । সার্বিক বিচারে মতিঝিলে কোন দলকেই সমাবেশ করতে দেয়া উচিৎ হয়নি কারণ এটি বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রাণ কেন্দ্র । পাশে বাংলাদেশ ব্যাংক এবং অন্যান্য সব ব্যাংকের সদর দপ্তর । মতিঝিলের লাগোয়া বঙ্গভবন তার আধা কিলোমিটার দূরে বাংলাদেশ সচিবালয় । আবার যদি তাদের এখানে সমাবেশ করতে সরকার বাধা দিত তাহলে যারা গণতন্ত্রের কথা বলে মুখে ফেনা তুলেন তারা বলতেন সভা সমাবেশ করা বাংলাদেশের জনগণের একটি সাংবিধানিক অধিকার, না দিলে গণতন্ত্র হুমকির সম্মুখীন হবে । তাদের মতে গাড়ী ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, পুলিশ হত্যা, বিজিবি হত্যা, সাধারণ মানুষ হত্যা, লুটপাট সব কিছুই গণতান্ত্রিক অধিকার । আর বিএনপি কথায় কথায় বলে ঘটনা তদন্তে বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠন করা হোক । এত বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠন করলে মাষ্টার রোলে অনেকজনকে বিচারক নিয়োগ করতে হবে । আর ২১ আগষ্টের ঘটনা তদন্তে গঠিত বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটির তদন্ততো দেশের মানুষ দেখেছে । সুতরাং সব সময় বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি বস্তুনিষ্ঠ ভাবে সব সত্য উদঘাটন করতে পারবে বা করবে তা কিন্তু নয় ।
হেফাজত কী করতে পারে বা পাঁচ তারিখের পর কী ঘটাতে পারে এ নিয়ে আমি একাধিক টক শো ও আমার নিয়মিত লেখায় একটা আগাম বিশ্লেষণমূলক ধারণা দিয়েছিলাম । বলে নেয়া ভাল আমি কোন ভবিষ্যৎ দ্রষ্টা নই । আমি গত দুই দশকেরও বেশী সময় ধরে স্ট্রেটেজিক ম্যানেজমেন্ট বা কৌশলগত ব্যবস্থাপনা, কেউ কেউ বলেন রণকৌশল পড়ি এবং পড়াই । এই সময়ে আমাকে বেশ অনেক ঐতিহাসিক যুদ্ধের আর ব্যবসায়িক কৌশলও জানতে হয়েছে । কোন একটা পরিস্থিতি কোন দিকে মোড় নিতে পারে তার একটা আগাম ধারণা করতে পারি । তবে তা যে সব সময় সত্য হয় তা কিন্তু নয় । বলেছিলাম হেফাজত একটি অরাজনৈতিক দল তা ঠিক আছে কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাদের কোন কর্মকান্ডই তাদের নিয়ন্ত্রণে থাকবে না, তা জামায়াত ছিনতাই করে নিয়ে যাবে এবং তারাও বেশীদিন অরাজনৈতিক থাকতে পারবে না । হেফাজত রাজনীতির মাঠে একেবারেই একটি নাদান খেলোয়াড় আর জামায়াত হচ্ছে এই উপমহাদেশে কংগ্রেসের পর সব চেয়ে প্রাচীন দল এবং এটি একমাত্র দল যারা বাংলাদেশে, ভারত ও পাকিস্তানেও ক্রিয়াশীল এবং তাদের ধ্বংসাত্মক ক্ষমতাও প্রমাণিত । তবে এই তিনটি দেশের কোনটিতেই তাদের জনসমর্থন তেমন একটা নেই । বাংলাদেশের তাদের একক সমর্থন ৪% এর বেশী নয় । বিএনপি সাথে যোগ দিলে তা ৭% পর্যন্ত উঠে । এটি একমাত্র দল যাদের শক্ত আন্তর্জাতিক যোগাযোগ আছে এবং এই যোগাযোগকে তারা বেশ কার্যকরভাবে ব্যবহার করতে পারে । বলেছিলাম হেফাজতকে কখন জামায়াত ছিনতাই করে নিয়ে যাবে তা তারা টেরও পাবে না যেমন বিএনপিও টের পায় নি । জুনায়েদ বাবুনগরী এখন স্বীকার করেন পাঁচ তারিখ সমাবেশের নিয়ন্ত্রণ তাদের হাতে ছিল না তা জামায়াতের হাতে চলে গিয়েছিল । কথা ছিল হেফাজত ঢাকা অবরোধ শেষে ফিরে যাবে । তারপর তারা বলল তাদের মতিঝিলে সমাবেশের অনুমতি দিলে সেখান হতে তারা তাদের গুরু আহম্মদ শফির বক্তব্য শুনে সন্ধ্যার আগেই ঘওে ফিরবে । সরকার বেলা এগারটা নাগাদ তাদের সেই অনুমতি দিয়েছিল যা ছিল সরকারের আত্মঘাতী ভুল সিদ্ধান্ত কারণ সব হেফাজততো ঢাকার বাইরে থেকে আসেনি । ঢাকা শহরের অভ্যন্তরে কয়েক হাজার হেফাজতি আছে । তাদের রাজনৈতিক ওরিয়েন্টেশন ঢাকার বাইরের হেফাজতিদের চেয়ে অনেক গুন বেশী এবং এদের অনেকেই জামায়াত শিবিরের রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত । মতিঝিলে সমাবেশ করার অনুমতি পেয়েছে শুনেই তারা মতিঝিলের দিকে রওনা দেয় এবং পথে তারা দুই ঘন্টার মধ্যে প্রায় ত্রিশ বার বঙ্গবন্ধু এভেন্যুতে অবিস্থত আওয়ামী লীগ অফিসে হামলা চালানোর চেষ্টা করে । ঢাকার বাইরে হতে আসা হেফাজতিরা ওই অফিসের সামনে দিয়ে যাওয়ার কথা নয় । এই হেফাজতিরাই সিপিবি অফিসে অগ্নিসংযোগ করেছে এবং পরবর্তিতে বায়তুল মোর্কারম এলাকায় ব্যাপক তা-ব চালিয়েছে, কোরান হাদিস পুড়িয়েছে । বাইরে থেকে আসা হেফজতিদের এই সব কর্ম চালানোর মতো অভিজ্ঞতা বা প্রশিক্ষণ কোনটাই ছিল না এবং তাদের একটা বড় অংশ ঢাকায় এসেছে জীবনে প্রথম বারের মতো । বেলা একটা নাগাদ আমি হোটেল সোনারগাঁয়ের সামনে হেফাজতিদের মিছিলে প্রায় দুই ঘন্টা আটকা পরেছিলাম । অবাক হয়ে দেখি মিছিলে অংশগ্রহণকারিদের কম পক্ষে প্রতি তিন জনের একজন একেবারেই নাবালক, যার বয়স দশ থেকে বার বছরের বেশী হবে না । পরে জেনেছি তারা তাদের হুজুরের নির্দেশে ঢাকায় বড় হজুরদের ওয়াজ শুনতে এসেছিল । দীর্ঘ পথ পায়ে হেঁটে পাড়ি দিয়ে তারা তখন বেশ ক্লান্ত । ছয় তারিখ দিনের বেলায় ঢাকা শহরে অনেক হেফাজতি এদিক সেদিক ঘুরে বেড়িয়েছে কারণ কোন পথে গেলে তাদের বাড়ীতে পৌঁছাতে পারবে তা তাদের জানা ছিল না । সুতরাং এটা বলা চলে ৫ তারিখ দিনের বেলায় ও রাতে ঢাকা শহরে হেফাজত যে সব তা-ব চালিয়েছে তা আসলে চালিয়েছে ঢাকার ভিতরে থাকা হেফাজত এবং ছাত্র শিবিরের সন্ত্রাসীরা যা করতে তারা বিশেষ ভাবে প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত । পাঁচ তারিখ বিকেলে হেফাজত ঘোষণা করেছিল তাদের দাবি না মানা পর্যন্ত তারা মতিঝিল ছাড়ছে না ।
পাঁচ তারিখ রাতে একটি টিভি চ্যানেলের টকশোতে অংশ নিয়েছিলাম । ঢাকা, বাংলাদেশের রাজধানী তখন জ্বলছিল । মনে হচ্ছিল দেশে কোন সরকার নেই । এদিক ওদিক ফোন করি । কখন বন্ধ হবে এই নৈরাজ্য ? নাকি সব বিএনপি বা হেফাজতের দখলে চলে যাবে ? ৪ তারিখ বিএনপি’র সমাবেশে দেখা গেছে হেফাজতের ফয়জুল্লাহ মঞ্চে উঠে বেগম জিয়ার সাথে কানে কানে শলা পরামর্শ করছেন । পরদিন এই ছবি ডেইলি ষ্টারে ছাপা হয়েছে । চিন্তা করি তা হলে বর্তমান সরকারের এটাই কী শেষ রাত ? কাল সকালে আহম্মদ শফি বাংলিস্তানের (বাংলাদেশকে নতুন নামকরণ করা হবে বলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ ফলাও করে প্রচার করা হয়েছে) আমির আর বেগম জিয়া তার প্রধানমন্ত্রী ? বিশ্বের নানা প্রান্ত হতে আমার একাধিক বন্ধু ফোনে জানতে চায় বাংলাদেশের মৃত্যু কী ঘনিয়ে আসছে? তাদের কোন জবাব দিতে পারি না । সারা দেশে একটি চরম আতঙ্ক এবং অনিশ্চয়তা । বলতে দ্বিধা নেই প্রধানমন্ত্রীর উপরও বেশ বিরক্ত হলাম । আমার এক সোর্স জানালো টকশো করেন, সব কিছু ঠিক হয়ে যাবে । ভরসা পাই না । টকশো হতে বের হয়ে দেখি বেগম জিয়া তার কর্মীদের ও ঢাকাবাসীদের উদ্দেশ্যে নির্দেশ দিয়েছেন খাবার ও পানি নিয়ে হেফাজতিদের পাশে দাঁড়াতে । তার ৪৮ ঘন্টার আল্টিমেটাম শেষ হতে আরো কয়েক ঘন্টা বাকি । পুরান ঢাকা হতে খবর আসে সেখানে দুই একটি ছোট খাট মিছিল হয়েছে নাসিরউদ্দিন পিন্টুর মুক্তি দাবি করে । তখন চিন্তা করি আলো ফুটার আগেই যদি পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা না যায় তা হলে দিনের বেলায় ঢাকা শহরে যে নারকীয় পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে তা সহজ সরল কথায় বলতে হলে ১৯৭৫ সালের ৭ই নভেম্বরের একটি বড় মাপের ধ্বংসাত্মক সংষ্করণ । হামলা হতে পারে বাংলাদেশ ব্যাংক সহ সকল গুরুত্বপূর্ণ অফিসে এবং উন্মত্ত জনতা প্রবেশ করতে পারে বঙ্গভবন অথবা সচিবালয়ে । আবার মনে মনে প্রশ্ন করি কোথায় সরকার?
পাঁচ তারিখ দিবাগত রাতের শেষ প্রহরে (৬ তারিখ) আমাদের আইন শৃঙ্খলা বাহিনী মতিঝিল এলাকা খালি করানোর জন্য যে কৌশল অবলম্বন করেছে তা একেবারেই কৌশলের পাঠ্যবইয়ে বর্ণিত ফর্মূলা যাকে বলে টেক্সটবুক অপারেশন । খ্রীষ্টপূর্ব চতুর্থ শতকে চীনের জগৎবিখ্যাত কৌশলবিদ সুন জু (ঝঁহ ঞুঁ) ‘দি আর্ট অব ওয়ার’ নামে একটি বই লিখেছিলেন যা এখনো বিশ্বের সকল নিরাপত্তা ও সামরিক বিদ্যালয়গুলিতে পড়ানো হয় । নূন্যতম প্রানহানি করে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার একটি কৌশলের নাম ঝযড়পশ ধহফ অবি (শক এ- অ ) যার অর্থ হচ্ছে অভিযানের একেবারে শুরুতেই প্রতিপক্ষ যাতে স্তম্ভিত ও ভীত হয়ে যায় এমন অবস্থা দিয়ে শুরু করতে হবে এবং শুরুটা করতে হবে তারা যখন অপ্রস্তুত থাকে তখন । বুশের বাগদাদ অভিযানও এই নামে হয়েছিল এবং নুন্যতম প্রানহানিতে মার্কিন সেনারা বাগদাদ দখল করে নিয়েছিল । ৫ তারিখ দিবাগত রাতে আমাদের আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারি বাহিনী ঠিক এই কাজটিই করেছে । রাতের তৃতীয় প্রহরে হেফাজতিরা বেশ ক্লান্ত । বিএনপি কথামতো তাদের কোন খাদ্য বা পানি সরবরাহ করেনি । অনেকে রাস্তায় ঘুমিয়ে পড়েছেন । এই সময় অভিযান শুরু হলো । চারিদিকে অন্ধকার । অন্ধকারের ভীতি সৃষ্টি করার একটি নিজস্ব শক্তি আছে । অন্ধকারে অনেকে দোয়া দরুদ পড়ে । না জানলে উচ্চ স্বরে গান গায় । যে সাউন্ড গ্রেনেড ব্যবহার করা হয়েছে তা শুধু ভয়াবহ শব্দ সৃষ্টি করতে পারে । এর কোন স্পিøন্টার নেই । গ্যাস গ্রেনেড হতে গ্যাস বের হয় । রাবার বুলেট সাধারনত মৃত্যুর কারণ হয় না যদিনা তা শরীরের কোন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে আঘাত করে । আর রাইফেল বা হাল্কা মেশিন গান দিয়ে পঁয়তাল্লিশ ডিগ্রি এঙ্গেলে লাখ লাখ বুলেট ছুড়লেও প্রাণহানি হওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই । জিরো ডিগ্রিতে করলে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হবে । নব্বই ডিগ্রিতে করলে সেই গুলি পাথরের মতো হয়ে যিনি করেন তার মাথায় পড়তে পারে । মাথায় হেলমেট না থাকলে আঘাত পাবেন । রাইফেল বা হাল্কা মেশিন গান ছাড়া সেই রাতে কোনটাই লিথেল বা মারনাস্ত্র ছিল না বলে ডিএমপি কমিশনার জানিয়েছেন যদিও তা বিরোধী দল বিশ্বাস করে নি । বিএনপি বলেছে সেই রাতে পুলিশের গুলিতে হাজার হাজার, আড়াই হাজার, দশ হাজার (হেফাজতের দাবি) তৌহিদি মানুষকে হত্যা করা হয়েছে যদিও সেই রাতের অপারেশনের সময় দেশি বিদেশি অনেক সাংবাদিক সাথে ছিল । সিএনএন বলেছে দু‘দিনে ১৪ জনের প্রানহানি হয়েছে । বিবিসি’র মতে ২৭ । আল্জাজিরার সংখ্যা ৩৬ । সরকারের প্রেসনোটে বলেছে অপারেশনে কোন প্রানহানি হয়নি তবে সারাদিনে ১১ জনের মৃত্যু হয়েছে । একটি জীবনহানিও দুঃখজনক । বিএনপি তাদের দাবির পক্ষে কোন প্রমাণ দিতে পারে নি যদিও তারা ১৯৭৮ সালের গিয়ানার জোনসটাউনের গণ আত্মহত্যা এবং ২০১০ সালের হাইতির ভূমিকম্পের নিহতদের ছবিকে মতিঝিলের তাদের ভাষায় গণহত্যার ছবি বলে চালিয়ে দিতে চেয়ে জনগণকে বোকা বানাতে চেয়েছেন । ক’দিন আগে বিএনপি’র দলীয় একজন সংসদ সদস্য একাত্তর টিভিতে এ’রকম কিছু ছবি দেখিয়ে জনগণকে উত্তেজিত ভাষায় বেওকুব বানাতে চেয়েছিলেন । কোন কোন টকশো পন্ডিত বা রাজনীতিবিদরা জনগণকে কেন যে এত আহম্মক ভাবেন বুঝি না ।
যারা এখন আহাজারি করছেন কেন রাতে অভিযান চালানো হলো, কেন এত শক্তি প্রয়োগ হলো, কেন এত গুলি ছোড়া হলো, কেন হেফাজতকে ডেকে এনে মেহমান হিসেবে তাদের সাথে আচরণ করা হলো না , দিনের বেলায় অপারেশন করা হলে কী ক্ষতি হতো তারা আসলে হতাশ হয়েছে এই কারণেই যে আহম্মদ শফিকে তারা তাদের আমির হিসেবে পায়নি এবং একজন হামিদ কারজাইকে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বে দেখা হতে বঞ্চিত হয়েছেন । এদের কয়েকজন বিভিন্ন টকশোতে হেফাজতকে কয়েকদিন ধরে রীতিমতো উস্কানি দিয়েছেন । আসলে আহাম্মক কে সেই প্রশ্নের উত্তর এখনো খুঁজছি ।
ওই রাতে সরকার যে পদক্ষেপ গুলি নিয়েছে তার প্রত্যেকটাই সঠিক ছিল এবং ওই রাতে প্রধানমন্ত্রী প্রকৃত অর্থেই প্রচ- সাহসের পরিচয় দিয়ে বাংলাদেশকে জনগণের কাছে ফিরিয়ে দিয়েছেন । ধন্যবাদ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, ধন্যবাদ আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারি বাহিনীর সদস্য বৃন্দ । তবে সামনে আরো কঠিন দিন আসছে । ৫-৬ তারিখের মতো বাঁকা পথে ক্ষমতায় যেতে আবারো হয়তো চেষ্টা হবে । তার জন্য এখন হতেই প্রস্তুতি নেয়া প্রয়োজন ।
এই মাত্র খবর পেলাম সাভার ট্র্যাজেডির ৪০৮ ঘন্টা পর একজন রেশমাকে অলৌকিকভাবে জীবন্তু উদ্ধার করা হয়েছে । এই ঘটনা একটি জীবনের জয়গান । এর মধ্যে সৃষ্টির আনন্দ আছে । ৫-৬ তারিখ ঢাকায় যা ঘটেছে তা ছিল ধ্বংসের উন্মত্ততা যা এই দেশের জনগন আর দেখতে চায় না । রেশমার দীর্ঘায়ূ কামনা করি ।

লেখক: সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় । মে ১১, ২০১৩

 

 

WARNING: Any unauthorized use or reproduction of 'Community' content is strictly prohibited and constitutes copyright infringement liable to legal action. 

 

[প্রথমপাতা]

 

 

 

লেখকের আগের লেখাঃ