[প্রথমপাতা]

 

 

 

 

 

বিশ্বজিতের হত্যাকান্ড আমাদের অপরাধী করে গেল

 

 

প্রফেসর আবদুল মান্নান

 

ঠিক করেছিলাম লেখাটা শুরু করবো ইদানিং কালে বাংলাদেশের রাজনীতিতে কী ভাবে জামায়াত বিএনপিকে গ্রাস করে ফেলেছে সে সম্পর্কে দু’কথা দিয়ে এবং এও ঠিক করে রেখেছিলাম তা লিখতে গিয়ে আমার কয়েকজন ছাত্র যারা কিনা ছাত্রদল করতো তারা কীভাবে শিক্ষাঙ্গনে ছাত্রশিবির কর্তৃক নিগৃহিত হয়েছে বা তাদের কী নৃশংসভাবে হত্যা করেছে সে সম্পর্কে উল্লেখ করে । কিন্তু আমার লেখার সেই পরিকল্পনায় বাধ সাধলো গত রোববার পুরানো ঢাকায় সংগঠিত বিশ্বজিৎ দাস নামের এক যুবকের নৃশংস হত্যাকান্ডের ঘটনা টিভিতে দেখে এবং পরদিন পত্রিকায় পড়ে । বিশ্বজিতের সাথে রাজনীতির কোন সম্পর্ক ছিলনা । সে সাধারণ ছাপোষা একজন দর্জী, অনেকটা দিনে এনে দিনে খায় অবস্থা । বিশ্বজিৎ যখন রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিল তখন অনেকটা হঠাৎ করেই একটি ককটেল বিষ্ফোরণ নিয়ে অবরোধের পক্ষ বিপক্ষদের মধ্যে এক রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ বাধে । অবরোধের বিপক্ষ দল মনে করে ককটেল বিস্ফোরণের জন্য দায়ী বিশ্বজিৎ । সুতরাং তার উপর ছাত্রলীগ নামধারী কিছু সশস্ত্র দূর্বৃত্ত ঝাঁপিয়ে পড়ে চাপাতি আর লোহার রড নিয়ে । আঘাতের পর আঘাতে রক্তাক্ত হয় বিশ্বজিৎ । বাঁচার আকুতি জানিয়ে বিশ্বজিৎ শেষ পর্যন্ত তার ধর্মীয় পরিচয় জানিয়ে বলে ‘আমি হিন্দু’। বিশ্বজিতের ধারণা হয়েছিল তার ধর্মীয় পরিচয় জানলে সে হয়তো রেহায় পাবে । আওয়ামী লীগ বা ছাত্রলীগ বা তাদের শুভাকাক্সিক্ষরা এখনো ভ্রান্তভাবে মনে করে হিন্দুরা হচ্ছে তাদের ভোট ব্যাংক । বর্তমান যুগে ভোট ব্যাংক বলতে কিছু নেই । তা যদি থাকতো তাহলে চট্টগ্রাম আর কুমিল্লার সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা শোচনীয় ভাবে পরাজিত হতেন না । আমার হাতে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন মেয়র নির্বাচনের কেন্দ্র ওয়াড়ি সব ফলাফল আছে । সেটি দেখলে বোঝা যাবে যারা ভোট ব্যাংক তত্ত্বে বিশ্বাস করেন তারা কতটুকু বোকার স্বর্গে বাস করেন ।
পশ্চিম বঙ্গের গত রাজ্য বিধান সভা নির্বাচনে মুসলমানরা দল বেঁধে তৃণমূলকে ভোট দিয়েছে । মমতা ব্যানার্জি তার সাথে মসজিদের ইমামদের নিয়ে জনসংযোগ করেছেন । এক সময় বামফ্রন্টও মনে করতো রাজ্যের মুসলমানরা তাদের ভোট ব্যাংক । নির্বাচনের পর তাদের সেই ভুল ভেঙ্গেছে । বিশ্বজিৎও সেই ধরণের এক ঘোরের মধ্যে ছিল যদিও তার ধর্মীয় পরিচয় তার কোন কাজে আসেনি । বিশ্বজিতের নির্মম হত্যাকান্ডের পুরো দায় দায়িত্ব গিয়ে পড়েছে মূল দল আওয়ামী লীগের উপর, যদিও আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল হানিফ বলেছেন বিশ্বজিতের মৃত্যুর দায়ভার আওয়ামী লীগ নেবে না । আর ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতারা বলেছেন যারা বিশ্বজিৎকে হত্যা করেছে তারা ছাত্রলীগ নামধারি হতে পারে তবে তারা ছাত্রলীগের কেউ না । তবে প্রশ্ন হচ্ছে হত্যাকারিদের পরিচয় যাই হোক তাদের তাৎক্ষণিক গ্রেফতার করতে বাধা কোথায় ? সিটি কর্পোরেশনের ময়লার গাড়ী পোড়ানোর মামালায় যদি বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম গ্রেফতার হতে পারেন তাহলে বিশ্বজিতের হত্যাকারিরা, যাদের সকলের পরিচয় এবং ছবি প্রায় সব গণমাধ্যমে প্রকাশিত ও প্রচারিত হয়েছে তাদের কেন গ্রেফতার করা হবে না ? ঘটনার আটচল্লিশ ঘন্টা পরে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেছেন এই ঘটনায় আটজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে । তারপরই মহানগর পুলিশ বলছে কাউকে গ্রেফতার করা হয়নি । সরকারের মধ্যে সমন্বয়হীনতার একটি উৎকৃষ্ট প্রমান । আর বিশ্বজিৎকে যখন সকলে মিলে পাগলা কুকুরের মতো পিঠিয়ে হত্যা করছিল তখন ২০-২৫ গজ দূরে দাঁড়িয়ে পুলিশ নীরব দর্শকের ভূমিকা প্রশ্ন জাগায় তারা কার পক্ষ হয়ে কাজ করছেন । বর্তমান স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর উপর সাধারণ মানুষ যে আস্তা স্থাপন করেছিল সেই আস্তা এখন অনেকটা ফিকে হয়ে আসছে ।
বিশ্বজিতের হত্যাকান্ডের সচিত্র বিবরণ এখন ফেইসবুকের বদৌলতে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে । তা দেখে নিউ ইয়র্ক প্রবাসী আমার অনুজপ্রতিম সাংবাদিক শহিদুল ইসলাম লিখেছে এখন থেকে আমি ছাত্রশিবিরকে যেমনভাবে ঘৃণা করতাম ছাত্রলীগকেও ঠিক তেমন ভাবে ঘৃণা করবো । বিশ্বজিতের উপর হামলাকারী ছাত্রলীগের কেউ নয় নেতাদের এই ঘোষণায় হয়ত শহিদ আশ্বস্ত নয় । ক’মাস আগে আমি ছাত্রলীগের নাম ব্যবহার করে যারা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে নানা অপকর্মে লিপ্ত থাকে তাদের সম্পর্কে প্রথম আলোতে একটি কলাম লিখেছিলাম । তার ফলে আমি আমার পূর্বের কর্মক্ষেত্রে অবাঞ্চিত ঘোষিত হয়েছিলাম । অবশ্য পরে নেতৃবৃন্দ তাদের ভুল বুঝতে পেরে আমার কাছে দুঃখ প্রকাশ করেছিল । তাদের বলেছিলাম তোমাদের শত্রু হচ্ছে ওই ছাত্রলীগের নাম ব্যবহার করে যারা অপকর্ম করে তারা, প্রকৃত অর্থে ছাত্রলীগের আদর্শ ধারণ করে যারা ছাত্রলীগ করে তারা নয় । বিশ্বজিতের নির্মম হত্যাকান্ড আমাদের সকলকে অপরাধী করে গেল । রোববারের বিশ্বজিৎ হত্যাকন্ডের পর এখন সরকারী দলের এবং সাবেক ছাত্রলীগের অনেক নেতা নেত্রীর দায়িত্ব হয়ে পড়েছে ওই দিনের ঘটনা সম্পর্কে মিডিয়ার সামনে তাদের বক্তব্য তুলে ধরা এবং দাবি করা ওই হত্যাকান্ডের সাথে যারাই জড়িত, তারা ছাত্রলীগ হোক বা নাই হোক তাদের অবিলম্বে আইনের আওতায় এনে তাদের সর্বোচ্চ শাস্তির বিধান করা । যারা বঙ্গবন্ধুর হাতে গড়া এই ঐতিহ্যবাহী সংগঠনের নাম ভাঙ্গিয়ে খায় তারা শুধু তাদের নিজ দলের নয় বাংলাদেশর বৃহত্তম রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগেরও সর্বনাশ করছে তা হয়তো ওই বুদ্ধি বিবেকহীনরা সময় থাকতে বুঝতে পারছে না । আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হতে শুরু করে অনেক নেতা নেত্রী ইদানিং প্রায়ই বলে থাকেন ছাত্রলীগের মধ্যে অনেক ছাত্রশিবির ছাত্রদল ঢুকে পড়েছে । তা যদি সত্য হয়ে থাকে তাহলে তা শুদ্ধি অভিযানের মাধ্যমে ছাত্রলীগকে শুদ্ধ করাতো তাদেরই দায়িত্ব । এখানে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বা অন্য কেউ এসেতো তা করবেন না ।
পঞ্চম একদিনের ক্রিকেট খেলায় বাংলাদেশের ঐতিহাসিক বিজয়ের পর গত শনিবার রাতে যাচ্ছিলাম একটি টিভি টকশোতে অংশ নিতে । রাস্তায় তখন বাঁধ ভাঙ্গা জোয়ারের মতো হাজার হাজার তরুণ বিজয়ের আনন্দে মাতোয়ারা । আমাকে বহনকারী গাড়ীটি খুবই ধীর গতিতে চলছিল । চালকের আবার আশঙ্কা সময় মতো টিভি ষ্টেশনে পৌঁছানো নিয়ে । একাধিক জায়গায় দেখি কিছু তরুণ আবার মুখে পেট্রোল নিয়ে আগুনের বলয় সৃষ্টি করছে কিন্তু কোন গাড়ীতে অগ্নি সংযোগ করছেনা অথবা কোথাও ইটপাটকেলও ছুঁড়ছেনা। কিন্তু তার কয়েক ঘন্টা আগে এদের বয়সী কিছু তরুণ রোববারে ১৮ দলের ডাকা অবরোধকে কেন্দ্র করে ঢাকা সহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় গাড়ী ভাংচুর আর অগ্নি সংযোগ শুরু করে দিয়েছিল । তখন মনে হলো তারুন্যের কী ভয়াবহ অপচয় । টিভি ষ্টেশনে গিয়ে দেখি আমার সাথের আলোচক বিএনপি’র প্রেসিডিয়াম সদস্য ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া । তার সাথে আমার এই প্রথম সাক্ষাৎ । কুশল বিনিময়ের পর তিনি জানালেন তিনি পত্রিকায় আমার লেখা পড়েন । মনে হলো বেশ স্বজ্জন মানুষ ।
সব টকশোরই মূল বিষয় থাকে রাজনীতি । এদিনও তার ব্যতিক্রম ছিলনা । আর যেহেতু পরদিন ১৮ দলীয় জোটের ডাকা অবরোধ সেহেতু সেটা নিয়েই মূল আলোচনা । ব্যারিস্টার মিয়া যথারীতি তার দলের অবস্থান ব্যাখ্যা করলেন । তাকে বলি আসলে যদিও বলা হচ্ছে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে এটা ১৮ দলীয় অবরোধ বাস্তবে এই অবরোধের মূলে রয়েছে জামায়াত । বলি এখন বিএনপি’র রাজনীতি আর তাদের হাতে নেই তা ছিনতাই হয়ে জামায়াতের হাতে চলে গেছে এবং তাদের একমাত্র উদ্দেশ্যই হচ্ছে একাত্তরে মানবতা বিরোধী ও যুদ্ধাপরাধের দায়ে তাদের যে সকল নেতা অভিযুক্ত হয়ে এখন বিচারের মুখোমুখী হয়েছেন দেশে একটা চরম অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি করে তাদের রক্ষা করা । বর্তমানে এই কাজে বিএনপিও তাদের সঙ্গী হয়ে পড়েছে । বলি জামায়াত কখনো ডিসেম্বর মাসে অতীতে মিছিল সমাবেশ করার সাহস করেনি এখন বিএনপি তাদের সে সুযোগ করে দিল । আরো বলি পরদিন হয়তো আমাদের দুজনের এই বিষয়ে কথা বলার কোন সুযোগ হবে না কিন্তু আমি বলে দিতে পারি অবরোধের দিন সারা দেশে ব্যাপক ধ্বংস যজ্ঞ হবে এবং তা করবে মূলতঃ জামায়াত শিবির কিন্তু তার পুরো দায়দায়িত্বটা নিতে হবে বিএনপিকে । অবশ্য ব্যারিস্টার মিয়া তার দলের বাইরে গিয়ে আমার কথা মানবেন কেন ? শুধু রোববার নয় মঙ্গলবারেও যত হামলা আরা ভাংচুর, অগ্নি সংযোগ হয়েছে হলফ করে বলতে পারি তার সিংহভাগই করেছে জামায়াত শিবিরের কর্মীরা দায়টা পরেছে বিএনপি’র উপর । এবার অন্য আর একটি মাত্রা যোগ হয়েছে বিরোধী দলের অবরোধ/হরতালে আর তা হচ্ছে বিদেশী কূটনীতিকদের গাড়ীতে হামলা করা । রোববারের অবরোধে তারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ও জার্মান দূতাবাসের গাড়ীতে হামলা করেছে । এর প্রতিবাদ জানিয়ে জার্মান দূতাবাস চিঠি লিখে বেগম জিয়ার কাছে ঘটনার প্রতিবাদ জানিয়েছে । অবরোধ হরতালের নামে বর্তমানে বিএনপি’র ছায়াতলে জামায়াত শিবির যে তান্ডব শুরু করেছে তাতে মনে হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে হয়তো কিছুদিনের মধ্যে তারা দেশের বিভিন্ন পাড়ায় মহল্লায় বাড়ি ঘড়ে আগুন লাগানো শুরু করবে বা বাড়ীতে পার্ক করা গাড়ীতে আগুন দেবে । যে কোন মূল্যে গোলাম আযম-নিজামি গংদের মুক্তি চাই । এখন থেকে বিএনপি সতর্ক না হলে তা হলে বিএনপি অস্তিত্ব সংকটে পরে যাবে ।
যে কয়েকজন ছাত্রের কথা বলবো বলে শুরু করেছিলাম তাদের কথা বলে শেষ করি । শিবিরের উত্থান চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে । ১৯৮৬ সনের ২৬ই নভেম্বর তারা ছাত্রদল হতে ছাত্র সমাজে আসা আবদুল হামিদের হাতের কব্জী পর্যন্ত কেটে কিরিচের মাথায় গেঁতে সারা ক্যাম্পাসে প্রদক্ষিণ করে তাদের হিং¤্রতার মাত্রা সম্পর্কে জানান দেয় । জাতীয়তাবাদী শিক্ষক নেতা ডঃ এনামুল হকের পুত্র ছাত্রদলের কর্মী মুসাকে লোহার রড দিয়ে পিটিয়ে হত্যা করেছিল শিবিরের ঘাতকরা । ছাত্রদলের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি হেলালিকে টেবিলে দশজনে চেপে ধরে দুজনে তার চোখ উপড়ে ফেলতে চেষ্টা করেছিল । সেই যাত্রায় প্রক্টরের হস্তক্ষেপে সে রক্ষা পেয়েছিল । চট্টগ্রাম পলিটেকনিকের ছাত্রদলের কর্মী জমীর আর জসিমকে জবাই আর গুলি করে নৃশংসভাবে হত্যা করেছিল এই শিবির কর্মীরা যাদের নিয়ে বিএনপি এখন আন্দোলন আন্দোলন খেলছে । সময় হলেই তারা বিএনপিকে ঠিক ছোবলটি মারবে ।
সব শেষে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে একটা বিনীত আবেদন । কাজটা কে করবে তা জানিনা । তবে ছাত্রলীগে প্রকৃত অর্থে দ্রুত শুদ্ধি অভিযান প্রয়োজন । তা নাহলে ক্ষতি আপনার এবং দলের । মাঝে মাঝে মনে হয় আপনি একাই একটা পাহাড় ঠেলছেন আর আপনার চারপার্শ্বে যারা আপনাকে ঘিরে আছেন তারা বেশ আনন্দে তামাশ দেখছেন । আপনার জন্য শুভ কামনা ।

লেখক: সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় । ডিসেম্বর ১৩, ২০১২।

 

 

WARNING: Any unauthorized use or reproduction of 'Community' content is strictly prohibited and constitutes copyright infringement liable to legal action. 

 

[প্রথমপাতা]

 

 

 

লেখকের আগের লেখাঃ