[প্রথমপাতা]

 

 

 

 

 

বিজয়ের মাস হয়েই বার বার ফিরে আসুক ডিসেম্বর

 

 

প্রফেসর আবদুল মান্নান


২০১২ সালের বিজয়ের মাস ডিসেম্বর এখন শেষ পক্ষে । সব ঠিক থাকলে বর্তমান সরকারের আমলে এবারের বিজয় দিবসই এই সরকারের শেষ বিজয় দিবস । এবারের বিজয়ের মাসটি নানা কারণে বেশ তাৎপর্যপূর্ণ । স্বাধীনতার একচল্লিশ বছর পর বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী দল জামায়াতে ইসলাম এই প্রথম বারের মতো বিজয়ের এই মাসে উল্লাস নৃত্য করেছে তার কারণ পিছনে দেশের অন্যতম বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপি আন্দোলনের নামে পরিচালিত তাদের সব কর্মকান্ডে নৈতিক সমর্থন জানিয়েছে এবং সেই সমর্থনে বলিয়ান হয়ে জামায়াতের ক্যাডার ছাত্রশিবির সারা দেশ ব্যাপী তাদের হিংস্রতার কিছু নমুনা ইতোমধ্য দেখিয়েছে । তারা এই প্রথম বারের মতো রাষ্ট্রের একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সংস্থা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উপর প্রকাশ্যে হামলা করেছে । আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উপর এই আক্রমনকে তাদের মিত্র বিএনপি সমর্থন দিয়েছে এই বলে জামায়াত-শিবির শুধু ওই পুলিশদের উপরই আক্রমন করছে যারা রাজপথে মিছিল সমাবেশ করলে তাদের উপর আক্রমন করে । বিজয়ের এই মাসে জামায়াত-শিবির একক ভাবে হরতাল আহ্বান করার ধৃষ্টতা দেখিয়েছে এবং সাহস দেখিয়েছে বর্তমানে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালে তাদের যে সকল শীর্ষস্থানীয় নেতাদের বিচার চলছে তাদের নিঃশর্ত মুক্তি দাবি করার এবং ট্রাইবুনাল ভেঙ্গে দেওয়ার । জামায়াত জানে আগামী নির্বাচনে বিজয়ী হতে হলে তাদের সমর্থন ছাড়া সমর্থনদাতাদের একক শক্তিতে আসন্ন নির্বাচনে বিজয়ী হওয়া সহজ হবে না ।
এবারের বিজয় দিবস দ্বিতীয় যে কারণে তাৎপর্যপূর্ণ তা হচ্ছে এবারের মতো অতীতে কখনো এত লক্ষ লক্ষ মানুষ রাজপথে নেমে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দাবি করেনি । ক্ষমতায় গেলে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করবে তেমনটি ঘোষণা করেছিল মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দানকারী দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ । আগামী নির্বাচনে তাদের আবার জনগণের সামনে যেতে হলে তাদের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সেই অঙ্গীকারটি পূরণ করতে হবে । তা পূরণ করতে হলে তাদের জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ের অনেক প্রতিকূল অবস্থা ও ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করতে হবে । পদ্মার উপর সেতু নির্মাণও একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গীকার ছিল । সেই সেতু নিয়ে একধরণের কানামাছি খেলা চলছে প্রায় একবছর ধরে। সেই কানামাছি খেলা কখন শেষ হবে তা আন্দাজ করা মুস্কিল । এই সেতুকে কেন্দ্র করে বর্তমানে অনেকগুলি স্বার্থান্বেষী মহল ক্রিয়াশীল আছে । সরকার অবশ্যই চায় তাদের বর্তমান মেয়াদেই এই সেতুর কাজ শুরু হোক । কিন্তু যারা চায়না তাদের সংখ্যা কয়েক গুন বেশী । সেতু না হলে সামনের নির্বাচনে তা আওয়ামী লীগের জন্য একটি বড় ব্যর্থতা হিসাবে গণ্য করে তারা তাকে পূঁজি হিসাবে ব্যবহার করতে পারবে । এতে তাদের ষোল আনা লাভ । আওয়ামী লীগযে সামনের বার আর ক্ষমতায় আসছে না সে সম্পর্কে বেশ ক’জন স্বনামধন্য রাজনৈতিক বিশ্লেষক তাদের রায় দিয়ে দিয়েছেন । তারা ভুলেও বর্তমান সরকারের কোন অর্জনকে স্বীকার করতে নারাজ । বেগম জিয়ার সাম্প্রতিক ভারত ও চীন সফরকে তারা মনে করছেন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে এটি তার প্রথম কদম । এরই মধ্যে আবার ঢাকা শহরের অলিতে গলিতে পোষ্টার লাগিয়ে দলটির নেতা কর্মীরা সকলকে জানিয়ে দিয়েছে ‘বাংলাদেশের ভবিষৎ প্রধানমন্ত্রী তারেক জিয়া আসছে বাংলাদেশ কাঁপছে’ বলে । তাদের এই সব প্রত্যাশাকে কিছুটা শক্তিশালী করেছে সরকারি দলের নি¤œ পর্যায়ের কিছু অর্বাচীনের অপরিনামদর্শী কর্মকান্ড যার সর্বশেষ উদাহরণ পুরানো ঢাকায় বিশ্বজিৎ হত্যাকান্ড । সরকারি দলের যে অঙ্গ সংগঠনটি এই সব অপকর্মের সাথে জড়িত দল ক্ষমতায় না থাকলে তাদের হারিকেন দিয়ে খুঁজলেও পাওয়া যাবে না ।
২০১২ সালে বিজয়ের মাসের যে তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা দিয়ে শেষ করতে চাই তা হচ্ছে পাকিস্তানের তিনজন প্রখ্যাত ব্যক্তির বক্তব্য ও তাদের মন্তব্য প্রতিবেদনের কথা বলে । প্রথমজন বিচারপতি সৈয়দ আসিফ শাহকার । এবার বাংলাদেশ সরকার তৃতীয় দফায় যে ৬০জন বিদেশী মুক্তিযুদ্ধকালীন বন্ধুকে সম্মান জানালো তার মধ্যে পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত বিচারপতি সৈয়দ আসিফ শাহকার একজন । ৬০ ব্যক্তি ছাড়া দুটি প্রতিষ্ঠানকেও এবার সম্মান জানানো হয়েছে । যারা বর্তমান সরকার আর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অহর্নিশ সমালোচনায় মুখর থাকেন তারা কখনো ভুলেও বলেন না এই বন্ধুদের সম্মান জানানোর জন্য বাংলাদেশকে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার জন্য অপেক্ষা করতে হয়েছে । জাতি হিসেবে আমরা যে তেমন একটা অকৃতজ্ঞ নই তাতো অন্তত প্রমাণ করতে পেরেছি । ১৯৭১ সনে বিচারপতি আসিফ শাহকার পাঞ্জাব ছাত্র সংসদের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ছিলেন । তিনি গত ১৫ তারিখ ইংরেজি দৈনিক ডেইলী ষ্টারের সাথে এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন (প্রকাশ ১৬ই ডিসেম্বর) তিনি বাংলাদেশে একাত্তরে পরিচালিত গণহত্যার কথা বিভিন্ন মাধ্যমে জানতে পেরে লাহোরে প্রতিবাদ করেছিলেন । তার সাথে আরো কয়েকজন এই প্রতিবাদে সামিল হয়েছিলেন । তারা সভাসমাবেশ করেছেন, লিফলেট বিলি করেছেন, কবিতা লিখেছেন । তৎকালীন সামরিক সরকার তাদের সকলকে দেশদ্রোহী আখ্যায়িত করে জেলে পুরে অকথ্য নির্যাতন চালিয়েছিল । তার পরিবারও তাকে দেশদ্রোহী মনে করতো এবং তারা কখনো তাকে কারাগারে দেখতে আসেননি । পরে অবশ্য তাদের ভুল ভেঙ্গেছিল । জেল হতে ছাড়া পেয়ে তিনি সুইডেন চলে যান । বর্তমানে সেই দেশে তিনি একজন বিচারপতি । তিনি বলেছেন আসলে পাকিস্তানের বেশীর ভাগ মানুষ তৎকালিন পূর্ব পাকিস্তানে কী হচ্ছে তা জানত না । বর্তমান নতুন প্রজন্মের কাছে সব কিছু ধীরে ধীরে পরিষ্কার হচ্ছে । হয়তো নিকট ভবিষ্যতে তারা পাকিস্তান সরকারকে একাত্তরে তারা এদেশে যা করেছে তার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করতে বাধ্য করবে । বিচারপতি শাহকারের এটাই বাংলাদেশে প্রথম সফর । তিনি শাহ জালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে নেমে প্রথমে কপাল মাটিতে ছুঁয়ে বুক ভরে নিশ্বাস নিয়েছেন । এই সেই দেশ যার জন্য তিনি তার নিজ জন্ম স্থান ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন । তিনি এখন হতে প্রতিবছর একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে বাংলাদেশ আসতে চান । এখানে একটা বাড়ি করতে চান । সরকারকে অনুরোধ করেছেন তাঁকে যেন বাংলাদেশের সম্মানসূচক নাগরিকত্ব দেওয়া হয় । তার এই দাবিগুলি সরকার বিবেচনা করে দেখতে পারে ।
তাহির মেহেদী একজন পাকিস্তান গবেষক । তিনি সুশাসন এবং গণতন্ত্র নিয়ে গবেষণা করেন । পাকিস্তানের প্রভাবশালী দৈনিক দি ডন চার কিস্তিতে পাকিস্তানের গণতন্ত্র হত্যার উপর তার একটি ধারাবাহিক রচনা প্রকাশ শুরু করেছে যার শিরোনাম হচ্ছে ‘ঞযব পৎড়ি রং যিরঃব, ইবহমধষ রং চধশরংঃধহ’ (কাক হচ্ছে সাদা আর বাংলা হচ্ছে পাকিস্তান ) । প্রথম কিস্তিটি প্রকাশিত হয়েছে ডিসেম্বরের ১০ তারিখ আর দ্বিতীয়টি ১৮ তারিখ । আরো দুই কিস্তি প্রকাশের অপেক্ষায় । তাহির মেহেদি তার লেখাটি শুরু করেছেন এই বলে পাকিস্তানিরা বাংলাদেশীদের চোখের দিকে তাকাতে এখনো রাজি নয় । তারা এখনো পাকিস্তান হতে পৃথক হয়ে বাংলাদেশের আবির্ভাবকে একটি ষড়যন্ত্রের ফসল হিসাবে দেখে তবে এই ষড়যন্ত্রের জন্য কারা দায়ী তারা তার গভীরে যেতে চায়না । মেহেদী তার প্রতিবেদন শুরু করেছেন ১৯৪৭ সনে দেশ ভাগের পর হতে । তিনি দেখিয়েছেন কিছু পাঞ্জাবী আর ভারত হতে হিযরত করে আসা লিয়াকত আলী খানের মতো নেতারা কী ভাবে একেবারে শুরু হতেই বাংলার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শুরু করেছিলেন এবং তার বিরুদ্ধে কেমন করে কিছু বাঙালি রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ প্রতিবাদী হয়েছিলেন । তিনি ১৯৭০ এর নির্বাচনের প্রেক্ষাপট বর্ণনা করে দেখিয়েছেন ইয়াহিয়া-ভূট্টো কী ভাবে ষড়যন্ত্র করে বাঙালিদের ক্ষমতার বাইরে রাখতে চেষ্টা করেছিলেন । মেহেদি মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময় আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করে নভেম্বর মাসে বাংলাদেশে সাধারণ নির্বাচনের নামে এক প্রহসন অনুষ্ঠানের কথা লিখতে গিয়ে বলেছেন জামায়াত সেই ‘নির্বাচনে’ বিনা প্রতিদ্বন্ধীতায় ২৫ টি আসনে ‘জয়ী’ হয়েছিল । তাহির মেহেদির মতে এটি ছিল জামায়াতের ইতিহাসে সর্বশ্রেষ্ঠ নির্বাচন কিন্তু বিজয় মিছিল বের করার আগেই মিত্র বাহিনী ঢাকা দখল করে নিয়েছিল আর জামায়াতের নেতৃবৃন্দ কেউ কেউ তাদের সাধের পাকিস্তান বা অন্যত্র পালিয়ে গিয়েছিল । মেহেদির বাকি দুই কিস্তির জন্য অপেক্ষা করতে হবে ।
সর্বশেষ লেখাটি লিখেছেন পাকিস্তানের বিশিষ্ট পরমাণু বিজ্ঞানী ডঃ আবদুল কাদির খান । বর্তমানে তিনি অনেকটা গৃহবন্দী । তার লেখাটিও প্রকাশিত হয়েছে পাকিস্তানের আর একটি আন্তর্জাতিক মানের দৈনিক দি নিউজ ইন্টারন্যাশনালে । তিনি পাকিস্তানের বর্তমান অবস্থাকে ১৯৭১ এর চাইতেও ভয়াবহ বলে মন্তব্য করেছেন । একাত্তরে তিনি বেলজিয়ামে গবেষণারত ছিলেন । সেখানে তিনি যখন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে বাংলাদেশে পরিচালিত গণহত্যা এবং ধ্বংসের খবর পড়তেন বা দেখতেন তিনি শুধু লজ্জিতই হতেননা, নিজেকে প্রশ্ন করতেন একজন মুসলমান আর একজন মুসলমানের উপর বা একটি দেশের সৈন্য বাহিনী কী ভাবে তার নিজ দেশের মানুষের উপর এত নৃশংস হতে পারে ? তিনি আক্ষেপ করেছেন এই বলে যে এই সব নৃশংসতার দৃশ্য তার দেশের মানুষ কখনো দেখতে পারবে না । তিনি তার প্রবন্ধে বেশ কয়েকটি উদাহরণ দিয়েছেন কী ভাবে অতীতে মুসলমানরা মুসলমানদের ষড়যন্ত্র, হত্যা, যুদ্ধ ইত্যাদির মাধ্যমে ধ্বংস করেছে । তিনি এও আশংকা প্রকাশ করেছেন পাকিস্তানে বর্তমান অবস্থা চলতে থাকলে দেশটির ভাঙ্গন কেউ রুখতে পারবে না ।
নানা কারণে এবারের বিজয়ের মাসটি স্বাধীনতা বিরোধীদের উল্লাস নৃত্যের মাঝে শুরু হলেও প্রথমে কিছুটা আশা জাগিয়েছে এইবারের বিজয় দিবসের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বর্তমান প্রজন্মের লক্ষ জনতার অংশ গ্রহণ দেখে। আশা জাগিয়েছে একাত্তর সম্পর্কে পাকিস্তানের শিক্ষিত মহলের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন আসছে দেখে । এই আশাকে জাগ্রত রাখতে দেশের ষোল কোটি মানুষকে সচেতন থাকতে হবে । ঠিক করতে হবে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের তারা কতটুকু যেতে দিতে চায় । বর্তমানে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের দল দেশে এবং দেশের বাইরে দুহাতে ডলার উড়াচ্ছে । তা ধরার জন্য অনেকে নিজেরাই উড়ছেন । মধ্যরাতের টকশোর কিছু ব্যাক্তির বক্তব্য শুনলে তা পরিষ্কার বোঝা যায় । সরকার যদি জনগনকে সাথে রাখতে পারে শত ষড়যন্ত্র আর ডলার উড়িয়েও একাত্তরের ঘাতকদের বিচার বন্ধ করা যাবে না ।
কোন কোন পাঠক আমাকে ই-মেইল করে বেশ উষ্মা প্রকাশ করে বলেন শিক্ষকের কাজ হচ্ছে শিক্ষা নিয়ে কথা বলা তারা কেন রাজনীতি নিয়ে কথা বলেন ? তাদের বলি, দেশের অস্তিত্ব যখন হুমকীর সম্মূখীন তখন কারো চুপ করে থাকা উচিৎ নয় । আমরা আর একটি একাত্তর বা একাত্তরের ১৪ই ডিসেম্বর দেখতে চাইনা । সকলের শুভবুদ্ধিও উদয় হোক।

লেখক: সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। ডিসেম্বর ২০, ২০১২

 

 

WARNING: Any unauthorized use or reproduction of 'Community' content is strictly prohibited and constitutes copyright infringement liable to legal action. 

 

[প্রথমপাতা]

 

 

 

লেখকের আগের লেখাঃ