[প্রথমপাতা]

 

 

 

 

 

পরিকল্পিত হত্যাকান্ড আর দূর্ঘটনা এক কথা নয়

 

প্রফেসর আবদুল মান্নান

এই লেখাটা যখন লিখছি তখন সাভার রানা প্লাজার ভবন ধসে নিহতের সংখ্যা ৩০৫ জনে উন্নীত হয়েছে । সংখ্যাটি যে আরো বাড়বে সে সম্পর্কে কোন সন্দেহ নেই । রানা প্লাজায় গত বুধবার যা ঘটেছে তা কোন অবস্থাতেই দূর্ঘটনা ছিল না । এটি ছিল একটি পরিকল্পিত হত্যাকা- । শুধুমাত্র কিছু মানুষের লাগামহীন লোভের কারণে এতগুলি মানুষ মৃতের মিছিলে সামিল হলো । এই কিছু মানুষের মাঝে আছে ভবনের মালিক সোহেল রানা আর ওই ভবনে অবস্থিত তৈরী পোষাক কারখানার মালিকরা । বাংলাদেশে গত দুই দশকে এই ধরনের হত্যাকা- একাধিক হয়েছে, জীবনহানি হয়েছে কয়েকশত মানুষের কিস্তু যারা এই সব হত্যাকা-ের জন্য দায়ী তাদের কারো কোন সাজা হয়নি এবং তা যে হবে তাও মনে হয় না কারণ এই ঘাতকদের হাত অনেক দীর্ঘ । এই সব ঘটনায় যারা মালিক তাদের তেমন কোন ক্ষতি হয় না । ক্ষতি হয় গরীব শ্রমিকদের, ক্ষতি হয় দেশের অর্থনীতি আর ওই শিল্পের এবং সর্বোপরি বহির্বিশ্বে দেশের ইমেজে বা সুনামের । বুধবারের ভয়াবহ ঘটনাটি বিশ্বের প্রায় সকল গণমাধ্যম ফলাও করে প্রচার করেছে এবং কোন কোন গণমাধ্যম বলেছে এমন ঘটনা এই দেশটিতে নিয়মিত ঘটে থাকে । এমনিতে গত কিছুদিন ধরে ১৮ দলের সরকার বিরোধী আন্দোলনের নামে প্রাণঘাতি সহিংসতা, মতিঝিলে কয়েক লক্ষ হেফাজত ওয়ালাদের আষ্ফালন আর কিছুদিন আগে তাজরিন গার্মেন্টসের ভয়াবহ অগ্নিকান্ডে ১৫৮ জন শ্রমিকের অগ্নিদগ্ধ হয়ে প্রাণহানি বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের সুনামকে যথেষ্ট ক্ষতিগ্রস্থ করেছে । এখন তার উপর সামিল হয়েছে রানা প্লাজার ভবন ধসের ঘটনা আর হত্যাকা- । এমনিতে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের জিএসপি সুবিধা বহাল রাখতে হিমশিম খাচ্ছে। তার উপর রানা প্লাজা হত্যাকা- একটি মরার উপর খাড়ার ঘা । বর্তামান পরিস্থিতিকে আরো কিছুটা জটিল করেছে সরকারের কিছু শীর্ষ পর্যায়ের ব্যক্তির অসংলগ্ন কথাবার্তা । প্রধানমন্ত্রী বলেছেন ওই ভবনের লোকজনকে আগেই সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল । যারা ওই ভবনে আটকা পড়েছে অথবা নিহত হয়েছন তারা সেখানে তাদের ব্যক্তিগত জিনিষপত্র আনতে গিয়েছিলেন । পুরো বিষয়টা সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রীকে সঠিক ভাবে ব্রীফ করা হয় নি । প্রধানমন্ত্রী যা শুনলে স্বস্তি পাবেন তাঁকে তাই শোনানো হয়েছে । এটি একটি বিপদজনক সংষ্কৃতি । শ্রমিকরা ওই ভবনে অবস্থিত পাঁচটি কারখানায় সে সময় কর্মরত ছিলেন এবং তাদেরকে অনেকটা জোর করে মালিকরা সেখানে আসতে বাধ্য করেছিলেন । এই পাঁচটি কারখানায় তিন হাজারের উপর শ্রমিক কাজ করে । নীচে আছে মার্কেট । স্বাভাবিক সময়ে এখানে চার থেকে পাঁচ হাজার মানুষ অবস্থান করে । প্রথমতঃ এদিন হরতাল থাকার কারণে সেদিন মার্কেট বন্ধ ছিল । আগের দিন ভবনে ফাটল দেখা দেয়ার কারণে ব্র্যাক ব্যাংকও বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল । তা না হলে হতাহতের সংখ্যা আরো অনেক বেশী হতে পারত । স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী বিবিসিকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন হরতাল আহ্বানকারীরা ওই ভবনরে একটি পিলার ধরে ধাক্কা ধাক্কি করেছে বলে ভবনটি ধসে পরেছে । এটি কোন বিশ্বাসযোগ্য বক্তব্য হলো না । সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেইসবুকে অনেকে ঠাট্টা করে লিখেছে দুবাইতে র্বুজ আল খলিফা ভবনের কাছে বাঙালিদের যেতে দেয় হচ্ছে না কারণ তারা হাতে ধাক্কা দিয়ে নয়তলা ভবন ফেলে দিতে পারে !
কেউ প্রশ্ন করতে পারেন কেন বুধবারের ঘটনাটিকে দূর্ঘটনা না বলে হত্যাকা- বলছি । দূর্ঘটনা কোন পূর্বাভাস ছাড়া হঠাৎ ঘটে যাওয়া ঘটনা । রাস্তায় মানুষ গাড়ী চাপা পড়লে অথবা ট্রেন লাইনচ্যুত হয়ে দূর্ঘটনা ঘটলে মানুষ হতাহত হতে পারে । এই সব ঘটনা হঠাৎ করে ঘটে যায় । কিন্তু একজন মানুষকে একটি ভবনের ছাদে নিয়ে ধাক্কা দিয়ে নীচে ফেলে দিলে অথবা সব কিছু জেনেও মানুষকে কোন বিপদের মুখে ঠেলে দিলে এবং সেখানে যদি তার প্রাণহানি হয় তাহলে তা কোন অবস্থাতেই দূর্ঘটনা নয়, তা শ্রেফ হত্যাকা- । অনেক ক্ষেত্রে আবার ঘাতকরা মানুষ হত্যা করার জন্য ফাঁদ পাতে । সেই ফাঁদে পড়ে যদি কেউ মারা পরে তা নিশ্চয় একটি হত্যাকা- । ঠিক এই কাজটি হয়েছে রানা প্লাজায় গত বুধবার । ভবনটি নির্মিত হয়েছে একটি ডোবা ও জলাশয় ভরাট করে । ভরাট কাজটি করা হয়েছে কাঠের গুড়া দিয়ে । সাথে যৎসামান্য মাটি ছিল । এমন জমিনে একটি টিনের চালার ঘর হতে পারে নয়তলা ভবন নয় । কিন্তু স্থানীয় যুবলীগ নেতা সোহেল রানাতো আর টিনের চালার মানুষ নন । তারতো প্রয়োজন নয়তলা ভবন । অতএব সেখানেই তিনি রাতারতি উঠিয়ে ফেললেন মরণ ফাঁদের সেই রানা প্লাজা । সাভার রাজউকের আওতাধীন থাকলেও সম্পূর্ণ বেআইনী ভাবে সেই ভবনের অনুমোদন দিল সাভার পৌরসভা । একটি পৌরসভার এই ধরণের ভবন নির্মানের অনুমোদন দেয়ার যোগ্যতা ও ক্ষমতা সাধারণত থাকেনা এবং সাভার পৌরসভারও ছিল লা । একটি বহুতল ভবন নির্মাণ করতে হলে তার কিছু সুক্ষ্ম হিসেব নিকেশ আছে । সাথে আছে যে সব মাল মশলা দিয়ে ভবনটি নির্মাণ করা হবে তার কিছু ন্যুনতন মান । রানা প্লাজা নির্মাণের সময় এই সবের কিছুই মানা হয়নি বলে জানা গেছে । এই সব বিষয়কে গুরুত্ব না দিয়ে কোন ভবন নির্মিত হলে সেই ভবন যেকোন সময় ধসে পড়তে পারে । কয়েক বছর আগে প্যারিস বিমান বন্দরের একটি টার্মিনাল ভবনের বর্ধিত অংশ ধসে পড়েছিল । একই ভাবে দক্ষিণ কোরিয়ায় ধসে পড়েছিল একটি সপিং মল আর একটি ফ্লাইওভার । এই সবই ধসে পরার কারন হিউম্যান এরর বা নির্মাণের সময় মানুষের স্বাভাবিক ভুল, যেগুলি সাধরণত ইচ্ছাকৃত নয় । কিন্তু রানা প্লাজা বা তাজরিন গার্মেন্টসে হত্যাকা-ের কারণ কোন অবস্থাতেই তা ছিল না । রানা প্লাজায় ফাটল দেখা দিয়েছিল বেশ কদিন আগে । এই সম্পর্কে কোন কোন পত্রিকায় সংবাদও প্রচারিত হয়েছিল । একুশে টিভি আগের দিন এই সম্পর্কে ভবনের মালিক সোহেল রানার সাথে কথা বলতে গেলে তিনি সরাসরি বলেন বিষয়টা তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয় । তিনি নাকি কোন কোন প্রকৌশলীকে দিয়ে তা অনুসন্ধান করিয়েছেন এবং তারা তাকে বলেছেন সব ঠিকঠাক আছে । যখন তিনি ক্যামরার সামনে কথা বলছিলেন তখন তাকে মোটেও প্রকৃতস্থ মনে হয়নি । বিপদ আঁচ করতে পেরে মঙ্গলবার ওই ভবনের সব কারখানায় আগাম ছুটি ঘোষণা করা হয়েছিল । ভবনরে দোতালায় অবস্থিত ব্র্যাক ব্যাংকের শাখা বন্ধ করে দেয়া হয় । এই পর্যন্ত সব ঠিক ছিল । গোল বাধলো পরদিন যখন গার্মেন্টস মালিকদের প্রতিনিধিরা মাইকিং করে, মোবাইল ফোনে সব শ্রমিকদের কাজে যোগ দিতে বললো এবং তাদের জানিয়ে দিল কাজে না আসলে তাদেরকে চাকুরিচ্যুত করা হবে তখন । একজন শ্রমিক কখনো চায় না তার চাকুরিটা চলে যাক কারণ একটি চাকুরি গেলে আর একটি চাকুরি পাওয়া সহজ নয় । ভবন মালিক রানা গার্মেন্টস মালিকদের আশ্বস্ত করেছিলেন ভবনটি নিরাপদ । এই বিশ্বাসেই তারা হয়তো তাদের কারখানা খোলা রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন । রানার মতো একজন ব্যক্তির কথায় এমন একটি ঝুঁকিপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেয়া তাদের কখনো উচিৎ হয়নি । বাংলাদেশের ইতিহাসের মানব সৃষ্ট এমন ভয়াবহ বিপর্যয় ইতোপূর্বে আর ঘটেনি । এই ঘটানার জন্য রানা প্লাজার মালিক আর গার্মেন্টস কারখানার মালিকরাতো অবস্যই দায়ী তার সাথে দায়ী রাজউক আর সাভার পৌরসভা ।
বাঙালিরা আবারো প্রমান করেছে জাতীয় কোন সংকট বা দূর্যোগের সময় তাদের একতাবদ্ধ হওয়ার ক্ষমতা অপরিসীম । বুধবার রানা প্লাজার ঘটনার পর উদ্ধার কাজে স্থানিয় জনগন, ফায়ার ব্রীগেড, সেনা ও নৌবাহিনী, আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারি বাহিনীর বিভিন্ন সদস্যরা, স্থানিয় ক্লিনিক ও সর্বোপরি এনাম হাসপাতাল যেভাবে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে তা জাতি চিরদিন স্মরণ করবে । তাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টা হাজারের উপর মানুষের জীবন বাঁচিয়েছে । গণজাগরণ মঞ্চের তরুণরা রক্তদান করার জন্য যে আহ্বান জানিয়েছিল তাতে সাড়া দিয়ে কয়েক হাজার মানুষ লাইনে দাঁড়িয়েছিল । এই সব কর্মকা- জাতি হিসেবে আমাদের নিঃসন্দেহে অভিভূত করেছে ।
আর আগে এই ধরণের যতগুলি হত্যাকা- ঘটেছে তার কোনটারই বিচার হয়নি । এবার কী দেশের মানুষ আশা করতে পারে এই ভয়াবহ ঘটনার জন্য যারাই দায়ী তাদের অভিলম্বে গ্রেফতার করে দোষীদের যথোপযুক্ত শাস্তির বিধান করা হবে?

লেখক: সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় । এপ্রিল ২৭, ২০১৩

 

 

WARNING: Any unauthorized use or reproduction of 'Community' content is strictly prohibited and constitutes copyright infringement liable to legal action. 

 

[প্রথমপাতা]

 

 

 

লেখকের আগের লেখাঃ