[প্রথমপাতা]

 

 

 

 

 

মহাজোট সরকারের চার বছর ও জনমত জরিপ

 

 

আবদুল মান্নান

কোন দেশে একটি পাঁচবছর মেয়াদী সরকার তার শেষ বছরে পদার্পন করার অর্থ হচ্ছে দেশে নির্বাচনী প্রস্তুতি শুরু হয়ে যাওয়া, বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয় । গত ৬ই জানুয়ারি মহাজোট তথা আওয়ামী লীগ সরকার তার ঘটনাবহুল চার বছরের মেয়াদ শেষ করে শেষ বছরে পা রাখলো । এই দিন সরকার বা দলের পক্ষ হতে এই চার বছর পূর্তিতে কোন কর্মসূচীর আয়োজন ছিলনা তবে দিনটি বিএনপি আর তার মিত্ররা পালন করেছে হরতাল দিয়ে এবং হরতালের প্রস্তুতি হিসেবে আগের দিন ঢাকা শহরে ডজন খানেক স্থানে গাড়ীতে আগুন দেয়া হয়েছে । হরতাল ডাকার কারণ হিসেবে বলা হয়েছে জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধির প্রতিবাদ। বর্তমান সরকারের আমলে এই নিয়ে পাঁচবার জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি করা হলো । পূর্ববর্তী বিএনপি’র নেতৃত্বে চারদলীয় জোট সরকারের আমলে নয়বার তেলের দাম বৃদ্ধি করা হয়েছিল । এইবার তেলের দাম বৃদ্ধিতে যতই যৌক্তিকতা থাকুক (তা নিয়ে বিতর্ক আছে) দাম বৃদ্ধির সময়টা ছিল কৌশলগত ভুল । এর অর্থ এই নয়যে বিএনপি বা তার মিত্ররা ৬তারিখ হরতাল আহ্বান করা হতে বিরত থাকতো। হরতাল ডাকতে চাইলে অজুহাতের অভাব পরেনা ।
সরকারের চার বছর পূর্তিতে দেশের তিনটি শীর্ষ স্থানীয় পত্রিকা সরকারের সফলতা আর ব্যর্থতা নিয়ে পৃথকভাবে জরিপ চালিয়েছে । জরিপ নিয়ে দেশের ইলেক্ট্রনিক্স ও প্রিন্ট মিডিয়াতে হররোজ নানা আলোচনা, সমালোচনা, তর্ক, বিতর্ক হচ্ছে । কোন কোন বিজ্ঞ আলোচক এই জরিপকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিচ্ছেন এবং বলছেন যদিও তিনটি জরিপে বলছে শেখ হাসিনার প্রতি মানুষের আস্থা বেড়েছে এবং এখন ভোট হলে আওয়ামী লীগকে দেশের সংখ্যাগরিষ্ট মানুষ ভোট দেবেন তারা তা মানতে নারাজ । তাদের মতে এটি নিশ্চিত এই মুহুর্তে ভোট হলে বিএনপি ও তার মিত্ররা হেসে খেলে সরকার গঠন করবে । আবার পাল্টা যুক্তি দিয়ে অন্যরা বলছেন বিএনপি’র অতীত এতই অন্ধকারাচ্ছন্নযে তারা অতীত থেকে শিক্ষা না নিলে এবং একাত্তরের ঘাতক দল জামায়াতের সংশ্রব ত্যাগ না করলে তাদের কোন ভবিষৎ নেই । একটি টিভি চ্যানেল টকশোতে অংশগ্রহণ করতে গিয়েছিলাম একজন সুশীল সমাজের প্রতিনিধির সাথে । সেই অনুষ্ঠানে তৃতীয় অংশগ্রহণকারী ছিলেন একটি রাজনৈতিক দলের শীর্ষ কর্ণধারের একজন ডাকসাইটে উপদেষ্টা । তিনি এসে আয়োজকদের কাছে জানতে চাইলেন কারা কারা তার সাথে থাকছেন । আমাদের নাম শুনে ভদ্রলোক প্রযোজক, নিম্নস্থরের কর্মচারীও সহ সকলকে একহাত নিলেন এবং অনেকটা ছেই ছেই করে সকলকে হতভম্ব করে স্থান ত্যাগ করলেন । বুঝলাম ভদ্রলোকের আমাদের মতো দুজন অবার্চিনকে পছন্দ হয়নি এবং মোটামুটি এটি ধরে নেওয়া যায় তিনি সামনের নির্বাচনের পর মন্ত্রী মিনিষ্টার হওয়ার খোওয়াবে ইতোমধ্যে বিভোর হয়ে পরেছেন । পরে শুনেছি তিনি এর আগেও মন্ত্রী ছিলেন এবং এক এগারর পর দীর্ঘদিন পলাতক ছিলেন ।
সেদিনের অনুষ্ঠান শেষে সঞ্চালক আমাদের দু’জনের কাছে সরকারকে পাস ফেল নম্বর দিতে অনুরোধ করলেন । আমার সহ আলোচক বললেন পাস নম্বর যদি চল্লিশ হয় তাহলে তিনি বর্তমান সরকারকে পাস নম্বর দিতে পারছেন না । উত্তরে আমি বলি শিক্ষকতা যেহেতু আমার পেশা আমরা এখন আর নম্বর দিয়ে পাশ ফেল নির্ধারণ করিনা । বর্তমানে গ্রেড পদ্ধতি চালু আছে । সুতরাং এই পদ্ধতিতে আমি বর্তমান সরকারকে তাদের চার বছরের সফলতা আর ব্যর্থতাকে মূল্যায়ন করে বি-প্লাস দিতে রাজি আছি । নম্বর দেওয়ার বেলায় আমি কিঞ্চৎ উদার । কেউ ভাল কাজে অসফল হোক তা আমি প্রত্যাশা করিনা । আর লেখাপড়া আর রাষ্ট্র পরিচালনাতো অবশ্যই অত্যন্ত ভাল কাজ ।
ফিরে আসি জরিপের বিষয়ে । যে জরিপ নিয়ে এতো আলোচনা তা একটি সামাজিক বিজ্ঞানের প্রচলিত জরিপ । এর প্রক্রিয়া পদ্ধতি নিয়ে সব সময় বিতর্ক থাকবে । কারা এই জরিপে অংশ নিয়েছে, কারা পরিচালনা করেছে অথবা দিনের কোন সময় এই জরিপ কাজটি করা হয়েছে? জরিপ যাদের উদ্যোগে পরিচালিত তাদের মতলব কী ছিল এবং তারা জরিপের ফলাফলকে পরিবর্তন, পরিমার্জন করার মতো নাজায়েজ কোন কাজ করেছে কী না । এমন একটি জরিপ যদি একশত ভাগ বিএনিপ-জামায়াত ঘরানার কোন গণমাধ্যম করতো তাহলে জরিপের ফলাফল সম্পূর্ণ ভিন্ন হওয়া বিচিত্র ছিলা না । তবে এই ধরণের গণমাধ্যমের বাজারে গ্রহণযোগ্যতা তেমন একটা থাকেনা । যে তিনটি পত্রিকার জরিপ নিয়ে আলোচনা সেই তিনিটি পত্রিকার গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে তেমন বড় কোন অভিযোগ নেই তবে পাঠক আমার সাথে সম্পূর্ণ একমত নাও হতে পারেন । আমার নিজেরও কোন কোন সময় এই তিনটি পত্রিকার কোন কোন সংবাদ পড়ে নিজেকে প্রশ্ন করি সংবাদে নেতিবাচক দিকটাকে প্রাধান্য না দিয়ে ইতিবাচক বিষয়টাকে কী প্রাধান্য দেওয়া যেতো না? তবে বাস্তবে সংবাদের কোনটিকে প্রাধান্য দেওয়া হবে তা নির্ধারণের দয়িত্ব সম্পাদকওে পাঠকের নয় । ধরে নিচ্ছি জরিপ তিনটি যতটুকু সম্ভব বস্তুনিষ্ট ভাবেই করা হয়েছে ।
তিনটি জরিপেই কিন্তু একধরণের অভিন্নতা আছে । তিনটি জরিপই পরিচালিত হয়েছে অনেকটা আওয়ামী লীগের গতবারে নির্বাচনী ইস্তেহারকে সামনে রেখে এবং গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে প্রত্যাশা আর প্রাপ্তিকে । এটি অনস্বীকার্য বাংলাদেশে একবারে তৃণমূল হতে উঠে আসা রাজনৈতিক দল বলতে মাত্র একটি, আর তা হচ্ছে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ । একসময় এই দলের নেতৃত্ব দিয়েছেন মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, হোসেন শহীদ সোহরোওয়ার্দ্দি আর জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব । এই দলের নেতৃত্বে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে । সুতরাং আওয়ামী লীগের প্রতি দেশের মানুষের স্বাভাবিক কারণেই প্রত্যাশা অন্য যে কোন দলের চাইতে বেশী থাকে । আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইস্তেহারে জনমুখী অনেক অঙ্গীকার ছিল । এই সব অঙ্গীকারের কিছু আছে যার বাস্তবায়ন হলো কী হলো না তা স্বল্পমেয়াদে মানুষ বুঝতে পারবে আর কিছু আছে তার ফলাফল পেতে হলে অপেক্ষা করতে হয় । সবগুলি তাৎক্ষণিক পাওয়ার বিষয় নয় । কিন্তু মানুষ বাস্তবে এতসব কিছু বুঝতে চায়না । মহাজোট সরকারের শুরুতে দেশের মানুষ বললো আমরা বুঝিনা বিদ্যুৎ কোথা থেকে আসবে কিন্তু আমরা বিদ্যুৎ চাই । তখন মানুষ দিনে দশ বার ঘন্টা পর্যন্ত লোড শেডিংএ অতিষ্ট । সরকার বেছে নিল কুইক রেন্টালের মতো চটজলদি ব্যবস্থা । এখন লোড শেডিং আগের যে কোন সময়ের তুলনায় কম । প্রায় জায়গায় দিনে এক বা বড়জোড় দুই ঘন্টা । কিন্তু বিদ্যুৎ উৎপাদনের এটি কোন দীর্ঘ মেয়াদী সামাধান নয় । তার জন্য চাই গ্যাস বা কয়লা ভিত্তিক বড় বেসিক পাওয়ার প্লান্ট । হতে কয়েক বছর সময়তো লাগবে । মানুষের নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যমূল্য ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে থাকুক সকলে চান। বাংলাদেশে বাজার ব্যবস্থা এতই অদক্ষ এবং মধ্যস্বত্বভোগী নিয়ন্ত্রিত যে তা রাতারাতি নিয়ন্ত্রনে আনা দূরুহ । কাজটি আরো দূরুহ হয়ে পরেছে যেহেতু বাংলাদেশের রাজনীতি বর্তমানে ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে । আবার চালের দাম শহরে কমলে শহরবাসিরা বেঝায় খুশি কিন্তু গ্রামের কৃষক তার কৃষি পণ্য উৎপাদনের খরচ তুলে আনতে না পারলে তারা সরকারের উপর নাখোস হবেন । এটি জরিপেও প্রতিফলিত ।
তিনটি জরিপেই বর্তমান যেকটি বড় ব্যর্থতা হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে তার মধ্যে আছে (১) দূর্নীতি; (২) আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি; (৩) শেয়ার মার্কেট কেলেঙ্কারি; (৪) ছাত্রলীগ নামধারীদের দূর্বৃত্তপনা উল্লেখযোগ্য । দূর্নীতির কথা আসলেই পদ্মাসেতু, হলমার্ক-সোনালী ব্যাংক কেলেঙ্কারী, ডেসটিনি টু সামনে চলে আসে । পদ্মাসেতু ঘটনাটা একটু ব্যতিক্রমী । এটির সাথে বিশ্বব্যাংক জড়িত এবং এই সেতু নিয়ে সরকারতো বটেই দক্ষিণ বঙ্গের প্রায় তিনকোটি মানুষ অনেক বড় স্বপ্ন দেখছে । চারদলীয় জোট সরকারের আমলে একাধিক প্রকল্পে দূর্নীতির অভিযোগে বিশ্বব্যাংক অর্থায়ন বন্ধ করে দিয়েছিল কিন্তু তা এতবড় সংবাদ হয়নি কারণ এই সব প্রকল্পকে ঘিরে সাধারণ মানুষের তেমন কোন বড় স্বপ্ন ছিলনা । বিশ্বব্যাংক বলেছে এই প্রকল্প বাস্তবায়নকালে দূর্নীতি করার ষড়যন্ত্র করা হয়েছে । সরকার প্রথমদিকে এই অভিযোগকে তেমন একটা গুরুত্ব না দিলেও এখন তাকে যথাযথ গুরুত্ব দিচ্ছে । এই কাজটি একবছর আগে করলে সরকার এত সমালোচিত হতো না । এখন নতুন করে আশা জেগেছে হয়তো বিশ্বব্যাংক পদ্মাসেতুর অর্থায়নে ফিরে আসবে । হলমার্ক-সোনালী ব্যাংক কেলেঙ্কারির সাথে যারা জড়িত ছিল তাদের গ্রেফতার করা হয়েছে । বিগত সরকারের সময় দূর্নীতির কারণে ওরিয়েন্টাল ব্যাংক বন্ধই হয়ে গেল কিন্তু কারো কোন শাস্তি হয়নি । শেয়ার মার্কেটকে কেন্দ্র করে যেটি হয়েছে তা যতনা দূর্নীতি তার চেয়ে তা বেশী অনৈতিক । এই অনৈতিক কর্মকান্ডের সাথে যারা জড়িত ছিলেন খোন্দকার ইব্রাহীম খালেদ কমিটি তাদের নাম তদন্তে উল্লেখ করেছেন । সরকারের উচিৎ ছিল এদের নাম প্রকাশ করা । এই অনৈতিক কর্মকান্ডের সাথে বড় দুই দলেরই ব্যবসায়ী নেতারা জড়িত ছিলেন বলে শোনা যায় । ছাত্রলীগ নামধারীদের কথা যতকম বলা যায় তত ভাল । এদের হাতের সর্বশেষ বলী গত মঙ্গলবার রাতে দক্ষিণ চট্টগ্রাম ছাত্রলীগের আহ্বায়ক আবদুল মালেক জনি । বেচারাকে পিটিয়ে মারল তারই দলের সতীর্থরা । এদের উপর আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ যত কম ভরসা করেন ততই মঙ্গল । সার্বিক আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি উন্নয়ন হলেও এখনো অনেক অপরাধের শাস্তি হয়নি বা অপরাধিদের সনাক্ত করা সম্ভব হয়নি । এই ক্ষেত্রে মানুষ আরো উন্নতি প্রত্যাশা করে ।
তিনটি জরিপেই দেখা যাচ্ছে বেশীর ভাগ মানুষেরই আস্থা এখনো শেখ হাসিনা । এর একটি প্রধান কারণ ২০০৮ এর নির্বাচনে মানুষের সামনে একটি বিকল্প ছিল । সেই বিকল্প বর্তমানে অনেকটা রুদ্ধ । সুতরাং শেখ হাসিনার উপর এখনো মানুষযে আস্থা রেখেছে সেটি তার দলের জন্য সবচেয়ে বড় পুঁজি । দেশের মানুষ আশা করে আগামী একবছর তিনি এবং তার দল এই পুঁজিকে ব্যবহার করে তার কর্মপরিকল্পরা তৈরী করবেন । অনেকের স্বাভাবিক প্রশ্ন কোন জায়গা হতে তিনি তা শুরু করতে পারেন ? শুরুটা হোক না দলের অভ্যন্তরে থাকা সঠিক ব্যক্তিদের মূল্যায়নের মধ্য দিয়ে এবং তার চারপার্শ্বে যে একটি অদৃশ্য দেয়াল নির্মিত হয়েছে তা ভেঙ্গে ফেলে । শতকরা হিসেবে সমর্থন আর সংসদে সংখ্যাগরিষ্ট পাওয়া এক কথা নয় । জরিপ নিয়ে সরকারের শঙ্কিত অথবা বিরোধী দলের উৎফুল্ল হওয়ার কোন কারণ নেই । সবগুলি জরিপেই অর্জনে শিক্ষা চ্যাম্পিয়ন। একজন শিক্ষক হিসেবে সরকার ও শিক্ষামন্ত্রীকে অভিন্দন।

লেখক: সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। জানুয়ারি ১০, ২০১৩

 

 

WARNING: Any unauthorized use or reproduction of 'Community' content is strictly prohibited and constitutes copyright infringement liable to legal action. 

 

[প্রথমপাতা]

 

 

 

লেখকের আগের লেখাঃ