[প্রথমপাতা]

 

 

 

 

 

বাংলাদেশের রাজনীতির চল্লিশ বছর

 

 

আবদুল মান্নান

দেশ বিভাগের পর মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ ও তার সহকর্মীরা বলে বেড়াতেন পাকিস্তানে মুসলীম লীগ ছাড়া আর কোন রাজনৈতিক দলের প্রয়োজন নেই এবং থাকবেও না । ব্যক্তিগত ভাবে জিন্নাহ ছিলেন অত্যন্ত স্বৈরাচারী মনোভাবাপন্ন একজন ব্যক্তি যিনি নিজের মতের বাইরে আর কারো মতামতকে গুরুত্ব দেওয়ার প্রয়োজন মনে করতেন না । এর ফলে তার সাথে আবুল হাসিম বা সোহরোওয়ার্দিও মতো বাংলার মুসলীম লীগ নেতাদের প্রায়শঃ মতভেদ দেখা দিত যা জিন্নাহ কখনো সহজে নেননি । জিন্নাহর এমন চিন্তাধারা পাঞ্জাবের অন্যান্য মুসলীম লীগ নেতাদের মধ্যেও সংক্রমিত হয়েছিল । জিন্নাহর দূর্ভাগ্য দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে সৃষ্ট তার শখের পাকিস্তানে তিনি বেশীদিন বেঁচে ছিলেন না । ১৯৪৮ সনের ১১ সেপ্টম্বর অনেকটা বিনা চিকিৎসায় যক্ষা রোগে আক্রান্ত জিন্নাহর মৃত্যু হয়েছিল সুদূর কোয়েটায়। তবে জিন্নাহর মৃত্যুর পরও তার উত্তরসূরীদের রাজনৈতিক চিন্তাধারার তেমন একটা পরিবর্তন হয়নি । পূর্ব বঙ্গের বাঙালিদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থ রক্ষা করার জন্য ১৯৪৯ সনে যখন মওলানা ভাসানী, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দি, শাসুল হক প্রমুখের প্রচেষ্টায় পাকিস্তানের প্রথম বিরোধী দল আওয়ামী মুসলীম লীগের জন্ম হয় তখন পাঞ্জাবী শাসক গোষ্টির মতে এটি ভারতীয় চক্রান্তের একটি ফসল এবং এই ধরণের রাজনৈতিক সংগঠন পাকিস্তানকে দূর্বল করা ছাড়া আর কিছুই করতে পারবে না ।
১৯৫৫ সনে আওয়ামী মুসলীম লীগকে একটি অসাম্প্রদায়িক দল হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে আওয়ামী লীগ নাম করণ করা হয় । ১৯৫৭ সনে কাগমারি সম্মেলনের পর আওয়ামী লীগ হতে মওলানা ভাসানী পৃথক হয়ে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) গঠন করেন যা আবার পরবর্তীকালে দুই ভাগ হয়ে মস্কো পন্থী (নেতৃত্বে পাখতুন নেতা খান আবদুল ওয়ালী খান) আর পিকিং পন্থী (নেতৃত্বে মওলানা ভাসানী) হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে । ১৯৭১ সনের মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগ পর্যন্ত তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে আওয়ামী লীগের পর মওলানা ভাসানীর ন্যাপ দেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দল থাকলেও তিনি ভোটের রাজনীতিতে তেমন একটা বিশ্বাসী ছিলেন না । তিনি স্বপ্ন দেখতেন পাকিস্তানে গণচীনের মাও সে তুং এর সর্বহারাদের বিপ্লবের আদলে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব করে দেশে কৃষক শ্রমিকদের শাসন কায়েম করবেন । মওলানা ভাসানী আবার সমাজতন্ত্রের সাথে ইসলাম যোগ করে তার নাম দিলেন ইসলামি সমাজতন্ত্র । মস্কোপন্থীদের ন্যাপ পূর্ব পাকিস্তানে পরিচিত ছিল মোজাফ্ফর ন্যাপ হিসাবে কারণ পূর্ব পাকিস্তান ন্যাপের প্রধান ছিলেন অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমেদ । তিনি আবার কিছুটা উদারপন্থী হিসাবে পরিচিত এবং তিনিও সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী হলেও মতবাদ হিসাবে নিলেন ‘ধর্ম কর্ম সমাজতন্ত্র’ । যেহেতু পাকিস্তান আমলে কমিউনিষ্ট পার্টি নিষিদ্ধ ছিল সেহেতু অধিকাংশ কমিউনিষ্ট মতাদর্শে বিশ্বাসী রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ এই দুই ন্যাপের ছত্রছায়ায় তাদের রাজনৈতিক কর্মকান্ড পরিচালনা করতো ।
১৯৫৪ সনের প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের কাছে শোচনীয় পরাজয়ের পর মুসলীম লীগ অনেকাংশে নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল । এই দলটি এর পরে আর কখনো মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেনি । না পশ্চিম পাকিস্তানে না পূর্ব পাকিস্তানে । এ ছাড়াও যে কয়েকটি রাজনৈতিক দল পূর্ব বাংলায় ক্রিয়াশীল ছিল তার মধ্যে কৃষক শ্রমকি প্রজা পার্টি, জামায়াতে ইসলামি, নেজামে ইসলামি অন্যতম । তবে পূর্ব বঙ্গে সব দলের রাজনীতির সাথে যারা জড়িত ছিলেন তাদের বেশীর ভাগই পেশায় ছিলেন আইনজীবী ও শিক্ষক । পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনীতিতে প্রাধান্য ছিল সামরিক বেসামরিক আমলা, ভূস্বামী, সামন্তপ্রভূ আর কোন কোন ক্ষেত্রে শিল্পপতি ।
১৯৭১ সনে বাংলাদেশ যখন স্বাধীন হয় তখনও বাংলাদেশের রাজনীতিতে তার পূর্বের বৈশিষ্ট্য অনেকটা বজায় ছিল । তবে একাত্তরে পাকিস্তানি বাহিনীর গণহত্যার সহযোগিতার কারণে বঙ্গবন্ধু সরকার সাংবিধানিক ভাবে নিষিদ্ধ করেছিল জামায়াত, মুসলীম লীগ, নেজামে ইসলামের মতো ধর্মাশ্রয়ী দলগুলিকে এবং এই সব দল বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা পর্যন্ত নিষিদ্ধ ছিল । বঙ্গবন্ধু সরকার কমিউনিষ্ট পার্টির উপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করার পর তারা আবার নতুন রূপে আত্মপ্রকাশ করে । আর যে সকল দলকে নিষিদ্ধ করা হয়ছিল তারা রাতারাতি অতি বামপন্থীদের সাথে গিয়ে মিলিত হয় এবং সিরাজ সিকদার, আবদুল হক, মোহাম্মদ তোহা, আবদুল মতিন, আলাউদ্দিনের মতো কট্টর বামপন্থী নেতাদের সহায়তায় বাংলাদেশে বেশ কিছু হঠকারী রাজনৈতিক দলের জন্ম দেয় যার মধ্যে পূর্ব বাংলা সর্বহারা পার্টি, পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিষ্ট পার্টি (তারা বাংলাদেশ মেনে নিতে অস্বীকার করে), বাংলাদেশের কমিউনিষ্ট পার্টি (এম-এল) অন্যতম । বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর তার শাসনামলে যে সকল ধর্মাশ্রয়ী রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ ছিল সামরিক শাসক জেনারেল জিয়ার বদান্যতায় তার সবকটির আবার পূনর্জন্ম হয় ।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর দেশে একটি নব্য ধনিক শ্রেনীর সৃষ্টি হয় যাদের উত্থান মূলতঃ স্বাধীনতা পরবর্তীকালে পারমিট লাইসেন্স ব্যবসার মাধ্যমে । এদের কেউ কেউ আবার মজুদদারী আর চোরাকারবারী করেও অর্থবিত্তের মালিক হয়েছে । তবে এদের অর্থবিত্ত থাকলেও ছিলনা তেমন একটা সামাজিক মর্যাদা বা গ্রহণযোগ্যতা । উপমহাদেশে সামাজিক মর্যাদা বা গ্রহণযোগ্যতা পাওয়ার বা সমাজে ক্ষমতাবান হওয়ার একটি সহজ উপায় হচ্ছে রাজনীতিতে প্রবেশ করা তবে সেই রাজনীতি হতে হবে ক্ষমতার রাজনীতি অথবা ক্ষমতার কাছাকাছি থাকার রাজনীতি । যারা এই উপায়ে রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত হয়েছেন তাদের কখনো তৃণমূল রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত হতে হয়নি, উঠে আসতে হয়নি রাজনীতির সিঁড়ির একেবারে নীচের ধাপ হতে যেমনটি বঙ্গবন্ধু বা মওলানা ভাসানীকে হতে হয়েছিল । অর্থবিত্ত থাকলেও আবার অনেক ক্ষেত্রে এদের সহায়তা নিতে হয়েছে পেশী শক্তির । এই দু’টির যোগফলে একদিন হঠাৎ করেই দেখা গেল এলাকার সব চাইতে দুশ্চরিত্র অথবা বিত্তশালী ব্যক্তিটি হয়ে গেছেন তাদের এলাকার একেবারে ‘ফুলের মতো পবিত্র চরিত্রের’ রাজনৈতিক নেতা । বিত্তশালীদের আবার রাজনীতিতে আসার ভিন্ন মতলবও থাকে যার অন্যতম হচ্ছে নিজ ধন সম্পদ রক্ষা এবং তাকে আরো সম্প্রসারিত করা । ক্ষমতার কাছাকাছি থাকলে এই কাজগুলিকে সহজে করা যায় । এই বৈশিষ্ট্যগুলি বাংলাদেশের রাজনীতিতে বেশ ভাল ভাবে প্রবেশ করেছে এবং বর্তমানে শক্তভাবে জাঁকিয়ে বসেছে । বর্তমান সংসদের প্রায় সত্তর ভাগ সংসদ সদস্য ব্যবসায়ী সম্প্রদায় হতে আসা । অর্থবিত্ত আর পেশী শক্তির দাপটে এখন আর তৃণমূল হতে উঠে আসা শিক্ষিত, মার্জিত আর জনসম্পৃক্ত রাজনৈতিক নেতা কর্মীদের বেশী দূর যাওয়া তেমন একটা সম্ভব হয়না । এটিযে শুধু বাংলাদেশে ঘটছে তা নয় ভারত-পাকিস্তানেও ঘটছে । ভারতের লোক সভায় বর্তমানে প্রায় একশত সদস্য আছেন যাদের বিরুদ্ধে ফৌজদারী মামলা আছে । এক কথায় বলতে গেলে এই উপমহাদেশের রাজনীতি অনেকাংশে বর্তমানে একধরণের দুবৃর্ত্তায়নের স্বীকার হয়েছে ।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে গত চল্লিশ বছরে আরো একটি বৈশিষ্ট্যের জন্ম হয়েছে আর তা হচ্ছে স্তাবকতন্ত্র । তৃণমূলের সাথে সম্পর্কহীন এই সব রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বরা সব সময় স্তাবক পরিবেষ্টিত হয়ে থাকতে পছন্দ করেন যার ফলে তারা যাদের প্রতিনিধিত্ব করার কথা তাদের কাছে তারা সহজে পৌঁছাতে পারেন না । এর মধ্যে ব্যতিক্রম একেবারেযে নেই তা নয় । তবে এদের সংখ্যা দিন দিন কমছে এবং তাতে শেষপর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে রাজনীতি । সুস্থ রাজনীতিকে দূরে হঠিয়ে অপরাজনীতি জায়গা করে নিচ্ছে । এর ফলে সব সময় বিকল্প শক্তি ক্ষমতা গ্রহণের সুযোগ খুজতে থাকে এবং তা একবার করতে পারলে তারা দেশটাকে এক ধাক্কায় দু’এক যুগ পিছিয়ে দিতে পারে যার উৎকৃষ্ট উদাহরণ পাকিস্তান । অতীতে বাংলাদেশেও তেমনটি ঘটতে দেখা গেছে ।
গত চল্লিশ বছরে বাংলাদেশের রাজনীতি অনেক দূর যেতে পারতো যদি না ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগষ্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হতো । তিনি তৃণমূল হতে উঠে এসেছিলেন । জনমানুষের সাথে তার সম্পর্ক ছিল । রাজনীতির শিখড়ে উঠতে তার অর্থবিত্ত আর পেশী শক্তিরও প্রয়োজন হয়নি । যেহেতু তিনি স্তাবক পরিবেষ্টিত থাকতেন না সেহেতু সাধারণ মানুষ তার কাছে তাদের সুখ দুঃখের কথা নিয়ে সহজে পৌঁছে যেতে পারতেন । চল্লিশ বছর পর দেশের মানুষের প্রত্যাশা আবার ফিরে আসুক দেশের রাজনীতি সত্যিকার অর্থে জনপ্রতিনিধিদের কাছে যারা আক্ষরিক অর্থে জনগণের প্রতিনিধি হবেন । গড়ে তুলতে পারবেন সত্যিকার অর্থে একবিংশ শতকের আধুনিক, অসাম্প্রদায়িক আর গণমানুষের বাংলাদেশ ।


সকল পাঠককে মহান বিজয় দিবসের শুভেচ্ছা।

লেখক: সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। ডিসেম্বর ১৬, ২০১২

 

 

WARNING: Any unauthorized use or reproduction of 'Community' content is strictly prohibited and constitutes copyright infringement liable to legal action. 

 

[প্রথমপাতা]

 

 

 

লেখকের আগের লেখাঃ