[প্রথমপাতা]
|
গণতন্ত্রের জন্য ফটিকছড়ি থেরাপী ভাল নয়
প্রফেসর আবদুল মান্নান
বিএনপি বাংলাদেশের অন্যতম বৃহত্তম রাজনৈতিক দল । যদিও বা দলটি একাধিকবার
ক্ষমতায় ছিল অনেকে মনে করেন বিএনপি যত না একটি রাজনৈতিক দল তার চেয়ে বেশী
একটি ক্লাব কারণ যখন জেনারেল জিয়া বিএনপি প্রতিষ্ঠা করেন তখন তিনি নানা
মতের ও বিশ্বাসের লোকজন একত্র করে তার দল গঠন করেছিলেন । সেখানে যেমন ছিলেন
মেজর (অবঃ) হাফিজ অথবা কর্ণেল (অবঃ) অলির মতো খেতাব প্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা
তেমন ছিলেন একাত্তরের বড় মাপের দালাল শাহ আজিজুর রহমান আর পাকিস্তান
সেনাবাহিনীকে মুরগী সরবরাহকারী মসিউর রহমান যাদু মিয়া । শাহ আজিজ ১৯৭২ সনে
দালাল আইনে গ্রেফতার হয়েছিলেন । ১৯৭৩ সনে তিনি সাধারণ ক্ষমার আওতায় মুক্তি
পান । তার অপরাধ ছিল তিনি জাতিসংঘে পাকিস্তানের পক্ষে সাফাই গাইতে
গিয়েছিলেন । যে ১৮টি অপরাধ ক্ষমার অযোগ্য ঘোষণা করা হয়েছিল শাহ আজিজের
অপরাধ তার মধ্যে পরেনি বলে তিনি ছাড়া পেয়ে যান । ছাড়া পাওয়ার পর হতে তিনি
চুপচাপ ছিলেন । ১৯৭৫ সনের ১৫ই অগাষ্টের পর তিনি আবার রাজনীতিতে আত্মপ্রকাশ
করেন । জিয়া তাকে ১৯৭৮ সালে প্রথমে শ্রম ও শিল্পমন্ত্রী মন্ত্রী ও পরে ১৯৭৯
সনে প্রধান মন্ত্রী নিয়োগ করেন । কয়েকদিন আগে একটি প্রাইভেট টিভি চ্যানেলে
বিএনপি নেতা সরদার শাখাওয়াত হোসেন বকুল নির্দ্বিধায় বললেন বঙ্গবন্ধু শাহ
আজিজকে সাথে নিয়ে লাহোরের ওআইসি সম্মেলনে গিয়েছিলেন । রাজনীতি করলে যে এত
বড় অসত্য বক্তব্য দিয়ে পার পাওয়া যায় তা জানা ছিল না । অবশ্য ওআইসিতে
বঙ্গবন্ধুর সাথি তোফায়েল আহম্মদ তাকে ফোনে চ্যালেঞ্জ করলে তিনি কিছুটা তথমত
খেয়ে বলেন এই ব্যাপারে তার কাছে প্রমান আছে তা তিনি পরে দেখাবেন । তিনি ও
তোফায়েল আহম্মদ একই চ্যনেলে বিষয়টি নিয়ে আবার রোববার রাত্রে মুখোমুখি
হয়েছিলেন। তোফায়েল আহম্মদ সে সময়কার পত্রপত্রিকা নিয়ে এসে প্রমান করেছেন
বকুল বক্তব্য কতটুকু অসত্য । বকুল দুর্বল ভাবে চেষ্টা করেছিলেন তার পক্ষে
প্রমান হাজির করতে । কিন্তু বাস্তবটা হচ্ছে ইতিহাসতো আর একজন বকুলরে ইচ্ছায়
চলে না । হতে পারেন তিনি একজন বিএনপি নেতা। বিএনপিতে আরো কিছু ব্যক্তি আছেন
যারা নিয়মিত চরম লাগামহীন কথা বলেন । যেমন সম্প্রতি বললেন সাদেক হোসেন খোকা
। খোকা এক সময় মাওলানা ভাসানির রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন । মাওলানা ভাসানি
জনমানুষের রাজনীতি করতেন এবং সত্যিকার অর্থে একজন দেশ প্রেমিক ছিলেন ।
বঙ্গবন্ধুর সাথে তাঁর আজীবন সম্পর্ক ছিল গুরু শিষ্যের । মাওলানা ভাসানির
সাথে যারা রাজনীতি করতেন তাদের বেশীর ভাগই পরবর্তি কালে বিএনপিতে যোগ দেন ।
কিন্তু দূর্ভাগ্য হচ্ছে এদের অধিকাংশই সুস্থ রাজনীতি করতে পারেন নি ।
সাদেক হোসেন খোকা একজন মুক্তিযোদ্ধা । জানা মতে দলের ভিতর যারা জামায়াত
পন্থি আছেন তিনি তাদের চক্ষুশূল । মেয়র থাকাকালিন ঢাকা শহরে
মুক্তিযোদ্ধাদের নামে সড়কের নাম করণ করে তিনি সকলের প্রশংসা কুড়িয়েছেন ।
সেই সাদেক হোসেন খোকা গত ১৮ এপ্রিল নয়া পল্টন দলীয় কার্যালয়ের সামনে এক
সমাবেশে গত ১১ তারিখ ফটিকছড়িতে ঘটে যাওয়া ভয়াবহ ও নৃশংস ঘটনাকে শুধু
সমর্থনই করেন নি প্রশংসাও করেছেন এবং বলেছেন সবগুলি উপজেলাতে আগামীতে এমন
ভয়াবহ ঘটনা ঘটাতে হবে । বিএনপি দীর্ঘদিন ধরে বর্তমান সরকারকে হঠানোর
আন্দোলন করছে । সাথে আছে সন্ত্রাস সৃষ্টিতে পারঙ্গম জামায়াত শিবির । তারপরও
খুব বেশি সুবিধা হচ্ছিল না । এখন তিনি ঘোষণা করলেন মহাজোট সরকারকে হঠাতে
ফঠিকছড়ি মডেলের আশ্রয় নিতে হবে । এর আগে তিনি ঘাতকদের হাতে ব্লগার রাজীব
নিহত হলে নির্দয়ভাবে বলেছিলেন রাজীব যে এতদিন বেঁচে ছিল তাইতো আশ্চার্য ।
খোকা সাহেবদেও বুঝা উচিৎ আগামী দিনের বাংলাদেশে তাদের চয়ে রাজীবদের প্রয়োজন
অনেক বেশী । এখন দেখা যাক কি হয়েছিল গত ১১ তারিখ ফটিকছড়িতে, যদিও দেশের
মানুষ এই সম্পর্কে মোটামুটি জানেন ।
১১ এপ্রিল সারা দেশে ছাত্র শিবির পুলিশের হাতে আটক তাদের নেতাদের মুক্তির
দাবিতে হরতাল ডেকেছিল । ছাত্র শিবির বর্তমানে আর কোন ছাত্র সংগঠন নেই । এটি
এখন পুরো দস্তুর জামায়াতের একটি সন্ত্রাসি সংগঠন । সন্ত্রাস সৃষ্টির সব
ধরণের কায়দা কানুন তারা রপ্ত করে ফেলেছে বাকি শুধু আত্মঘাতি বোমা বিষ্ফোরণ
। কিছুদিনের মধ্যে তাও হয়ে যাবে মনে হয় । প্রয়োজনে তারা বিএনপি’র হয়ে ভাড়া
খাটে । বাংলাদেশে একদল হরতাল ডাকে অন্যদল তা প্রতিহত করছে বলে রাস্তায়
মিছিল করে । তা বাংলাদেশে রাজনীতির সংষ্কৃতি হয়ে উঠেছে দীর্ঘ দিন ধরে ।
ফটিকছড়ি চট্টগ্রামের একটি দূরবর্তি উপজেলা তবে বেশ বর্ধিষ্ণু । উপজেলা
সদরের নাম বড়বিবির হাট । এই উপজেলা লাগোয়া পার্বত্য চট্টগ্রাম । এখানে কিছু
স্কুল আছে আর আছে একটি কলেজ । মাদ্রাসা আছে অসংখ্য । এটি বাংলাদেশের বেশীর
ভাগ উপজেলার চিত্র । সব সরকারই সকলের জন্য শিক্ষার কথা বলে কিন্তু দেশের
প্রত্যন্ত অঞ্চলে জেলা উপজেলা অথবা ইউনিয়নে নুন্যতম একটি করে হলেও
প্রাইমারি স্কুল গড়ে তুলতে পারে নি। এই শূন্যস্থান পূরণ করেছে অপরিকল্পিত
ভাবে গড়ে উঠা মাদ্রাসা গুলি । চট্টগ্রাম, সিলেট, নোয়াখালি, দক্ষিণ বঙ্গের
কোন কোন জেলা, কক্সবাজার প্রভৃতি এলাকার এক শ্রেণীর বিত্তবান মানুষ মনে করে
মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠায় সাহায্য করা একটি বড় ধরণের পূণ্যের কাজ । বাস্তবে
অধিকাংশ মাদ্রাসা এখন জঙ্গিসৃষ্টির কারখান হিসেবে স্বীকৃত । এই সব এলাকার
প্রচুর মানুষ মধ্যপ্রাচ্যে কাজ করে এবং দেশে টাকা পাঠায় এবং এর একটি অংশ এই
সব মাদ্রাসায় দান করে । এই মাদ্রাসাগুলি যদি যুগপোযোগী শিক্ষা দিত তাহলে
আপত্তির কিছু ছিল না । এই সব মাদ্রাসায় যে ধরণের পাঠ্যসূচী ব্যবহার করা হয়
তা সার্বিক অর্থেই মান্দাতার আমলের । তদুপরি এই সব মাদ্রাসায় যে সব ছেলেরা
পড়া লেখা করে তারা বাল্যকাল হতেই ভিক্ষাবৃত্তিতে দীক্ষা নেয় কারণ তারা
নিয়মিত ভাবে মাদ্রাসার জন্য নানা ভাবে চাঁদা তুলতে বাড়ী বাড়ী ধর্ণা দেয় ।
রোজার দিনে জাকাত-ফিৎরা আর কোরবানির ঈদে গরু-খাসির চামড়া সংগ্রহে তারা
ব্যস্ত থাকে । ফটিকছড়িতে আরো আছে কিছু সাপ্তাহিক হাট-বাজার আর সদরে আছে বেশ
কিছু দোকান পাট ও মার্কেট। আছে কিছু তিন চাকার যান আর চাঁদের গাড়ী ।
উপজেলার বেশীর ভাগ বিত্তবান লোকই শহরে থাকেন । রাজনীতির দিক থেকে এই
উপজেলায় আওয়ামী লীগের ভাল সমর্থক গোষ্ঠি থাকলেও দলীয় কোন্দলে এই উপজেলায়
আওয়ামী লীগের অবস্থা কাহিল । সুযোগ নেয় বিএনপি । গত নির্বাচনে রাউজান হতে
এসে এই উপজেলা থেকে নির্বাচিত হয়েছেন যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত সাকাচৌ ।
আওয়ামী লীগের প্রাথী এটিএম পেয়ারুল ইসলাম তার কাছে পরাজিত হয়েছিলেন ।
উপজেলায় অসংখ্য মাদ্রাসার বদৌলতে এখানে সৃষ্টি হয়েছে বেশ বড় একটি
প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠি যারা সব সময় আওয়ামী লীগের বিপক্ষে অবস্থান নেয়।
১১ তারিখ পেয়ারুল ইসলামের নেতৃত্বে আনুমানিক হাজারখানিক আওয়ামী লীগ সমর্থক
চার পাঁচশত মোটর সাইকেল, চাঁদের গাড়ী, পিক আপ আর কয়েকটি কার নিয়ে বড়বিবির
হাট হতে বের হয়ে বিভিন্ন ইউনিয়ন প্রদক্ষিণ করে সদরে ফেরার কথা ছিল । মিছিল
সাড়ে এগারটায় শুরু হয় এবং যোহরের নামাজ নাগাদ মিছিল ভুজপুওে ঢোকার সময় শুরু
হয় ভয়াবহ তান্ডব । পেয়ারুল আগেই স্থানিয় মাদ্রাসার প্রিন্সিপ্যালকে তাদের
মিছিলের কথা বলে রেখেছিলেন কারণ এই এলাকাটি জামায়াত শিবির হেফাজত আর
সাকাচৌ’র প্রতি অনুগত বিএনপি কর্মীদের শক্ত ঘাঁটি । এসময় হঠাৎ করে কে
কাজিরহাট জামে শিবির ক্যাডার বেলাল মসজিদের মাইকে গুজব ছড়ায় আওয়ামী লীগের
গুন্ডারা স্থানীয় মাদ্রাসার প্রিন্সিপ্যালকে তুলে নিয়ে যাচ্ছে আর তারা
মসজিদ আর মাদ্রাসা আক্রমন করেছে । কেউ কেউ আবার এটাও বলে মহিলাদেরও তুলে
নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। এই কথা বলার সাথে সাথে পূর্বপ্রস্তুত হাজার হাজার
সন্ত্রাসি সশস্ত্র অবস্থায় বের হয়ে নিরস্ত্র মিছিলের উপর ঝাঁপিয়ে পরে ।
তারা বহরে থাকা সবগুলি যানবাহনে গান পাউডার ছড়িয়ে আগুন দেয় এবং আওয়ামী লীগ
আর ছাত্রলীগের নেতা কর্মীদের উপর ঝাঁপিয়ে পরে । তারা পুলিশ ও বিজেবি’র
গাড়ীতেও হামলা করে এবং একটি ফায়ার ব্রিগেডের গাড়ীতে আগুন দেয় । যে নৃশংসতায়
তারা স্পটে তিনজন আওয়ামী লীগ ও ছাত্র লীগ কর্মিকে কুপিয়ে ও পিঠিয়ে হত্যা
করে তা শুধু নজির বিহীনই নয় ভয়াবহও বটে যা ইতোমধ্যে দেশে এবং দেশের বাইরে
অনেকে দেখেছে । সাদেক হোসেন খোকাদের মতে এটা বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে
জনবিষ্ফোরণ এবং তারা ঘোষণা করেছে আগামীতে প্রত্যেক উপজেলায় এই ধরণের নৃশংস
হামলা নিয়মিত করতে হবে । কোন একজন দায়িত্বশীল রজেনৈতিক নেতা এমন দায়িত্বহীন
বক্তব্য দিতে পারেন তা অবিশ্বাস্য । সাদেক হোসেন খোকা ফটিকছড়ি ষ্টাইলে
হামলার ডাক দিয়ে ক্ষান্ত হন নি । তিনি শনিবার জাতীয় প্রেস ক্লাবে দলীয় এক
গোল টেবিলে বৈঠকে বলেছেন একদলীয় নির্বাচন চাইলে আওয়ামী লীগের পিটের চামড়া
তুলে নেয়া হবে । চামড়া তোলা সাদেক হোসেন খোকার পেশা নয় । এর আগে বেগম জিয়া
বলেছিলেন বর্তমান সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করতে (এবং তাকে ক্ষমতায় বসাতে) দেশের
মানুষকে আরো কিছু রক্ত দিতে হবে ।
খোকা সাহেব যে ধরণের প্রেসক্রিপসনের কথা বলছেন তা করতে হলে তার দলে শিবিরের
মতো একটি সন্ত্রাসি বাহিনী গড়ে তুলতে হবে । বাংলাদেশের রাজনীতিতে এমন ঘটনা
নতুন নয় । শিবির নামে জামায়াতের এমন বাহিনী শুরু হতেই ছিল । ১৯৭৩ সালে যখন
জাসদ গঠিত হয় তখন তাদের একটি গণবাহিনী ছিল । এরা এমন সব নাশকাতা ও
সন্ত্রাসমূলক কর্মকান্ড করতো । এখন বিএনপি’রও এমন একটা দল গঠন করতে হবে ।
তারা কোন একটি এলাকায় গিয়ে মসজিদের মাইক ব্যবহার করে এলাকার মানুষকে বলবে
আওয়ামী লীগ অমুক ঈমামকে তুলে নিয়ে যাচ্ছে বা এলাকার মসজিদ মাদ্রাসায় হামলা
করে আমাদের মহিলাদের শ্লিলতাহানি করছে । তখন এলকার মানুষ সকলে একযোগে
সশস্ত্র অবস্থায় বের হয়ে এসে আওয়ামী লীগের মিছিল অথবা বাড়ী ঘরে হামলা করবে,
লোকজনকে প্রকাশ্যে পিটিয়ে মারবে, বাড়ী ঘরে অগ্নি সংযোগ করবে । সাদেক হোসেন
খোকার মতো এত খোলাখুলি না বললেও একই সুরে কথা বেেলছেন ডঃ খোন্দকার মোর্শারফ
হোসেন ও এম কে আনওয়ার । বিএনপি’র নেতা নেত্রীদের কথা শুনলে মনে হয় তারা এক
ধরণের অবসাদ ও হতাশায় ভুগছেন । এটি হওয়ার সম্ভাব্য কারণ হচ্ছে তারা এখনো
সঠিক অর্থে একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে গড়ে উঠতে পারেনি । রয়ে গেছে জিয়ার
আমলের নানা মতের মানুষের প্লাটফর্ম । এটা বাংলাদেশের গণতন্ত্রের জন্য ভাল
নয় । সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক রাজনীতির স্বার্থে দেশে একাধিক রাজনৈতিক দল থাকা
বাঞ্চনীয় । এ ব্যপারে বিএনপি ভ’মিকা রাখতে পারে । তবে তা করতে হলে দলের
দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের এই ধরণের লাগামহীন বক্তব্য পরিহার করতে হবে ।
সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় । এপ্রিল ২২, ২০১৩
WARNING:
Any unauthorized use
or reproduction of
'Community' content is
strictly prohibited
and constitutes
copyright infringement
liable to legal
action.
[প্রথমপাতা] |
লেখকের আগের লেখাঃ
|