[প্রথমপাতা]

 

 

 

 

 

আমার যাবার সময় হ’ল দাও বিদায়

 

 

প্রফেসর আবদুল মান্নান

চিরদিনের মতো চলে গেলেন বাংলাদেশের ১৯তম রাষ্ট্রপতি ৮৪ বছর বয়সী বর্ষীয়ান জননেতা মোঃ জিল্লুর রহমান । তার প্রিয় জন্মভূিম বাংলাদেশ হতে কয়েক হাজার মাইল দূরে সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেত হাসপাতালে গত বুধবার অপরাহ্নে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন । ঢাকার শাহ আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর দিয়ে যিনি এর আগে অসংখ্যবার আসা যাওয়া করেছেন সেই একই বিমান বন্দর দিয়ে তিনি কফিন বন্ধী হয়ে তার স্বজন এবং বাংলাদেশের কাছে ফিরলেন বৃহষ্পতিবার মধ্য দূপুরে শেষবারের মতো । একটি টেলিভিশন চ্যানেল যখন বিমান বন্দর হতে বঙ্গভবন পর্যন্ত তার শেষ যাত্রাটা সরাসরি টেলিকাস্ট করছিল তখন অনেকের অশ্রুসংবরণ করা কঠিন হয়ে পড়েছিল । রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান তার রাজনৈতিক সতীর্থদের কাছে তিনি জিল্লুর ভাই, দেশে ফিরছেন শেষ বারের মতো । এই ফেরার জন্য জাতি প্রস্তুত ছিলনা । বাংলাদেশের রাজনীতিতে যে ক’জন হাতে গোনা নির্লোভ নিরহঙ্কারী, চরিত্রবান, দৃঢ়চেতা আর দূরদর্শী নেতা ছিলেন তাদের মধ্যে প্রয়াত জিল্লুর রহমান ছিলেন অন্যতম । ২০০৭ সালের এক এগার পর যখন বাংলাদেশের দুই বৃহৎ রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ কারাগারে, যখন শেখ হাসিনা আর বেগম জিয়া উভয়ই সেনা হেফাজতে গৃহবন্দী তখন হঠাৎ আওয়ামী লীগ আর বিএনপি দুই দলই এক রাজনৈতিক বিপর্যয়কর অবস্থার মুখোমুখি হলো । বিএনপিতো প্রকাশ্যেই দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে গেল । অন্যদিকে আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি জিল্লুর রহমান দলকে আগলে ধরে রাখলেন এবং দলের ও দেশের রাজনীতির দূর্দিনে কা-ারির ভূমিকায় অবতীর্ন হলেন । সে সময় অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষকের এই মন্তব্য ছিল বিএনপি’র দূর্ভাগ্য তাদের দলে একজন জিল্লুর রহমান নেই ।
রাষ্ট্রপতি পদে শপথ নেয়ার একদিন আগে ডঃ এ কে আজাদ চৌধুরী (বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের বর্তমান চেয়ারম্যান), ডঃ সালেহউদ্দিন আহমেদ (শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যলয়ের সদ্য বিদায়ী উপাচার্য) ও আমি গিয়েছিলাম জিল্লুর রহমানের গুলশানস্থ বাসভবনে তাঁকে অভিনন্দন জানাতে । তখন সেখানে আওয়ামী লীগের নেতা কর্মী আর সাধারণ মানুষ ঘিস ঘিস করছিল । খবর দিতেই তিনি ভিতর হতে লুঙ্গি আর একটা ফতুয়া গায়ে দিয়ে বের হয়ে আসলেন । আমাদের কাছে ঠেনে নিয়ে পাশে বসালেন । বললেন দোয়া করবেন । আমি বলি আপনি একজন ভাল রাষ্ট্রপতি হবেন । চেহারায় তার এক নিষ্পাপ হাসি, মনে হলো অনেকটা স্বর্গীয় । বিগত দিনে একাধিক রাষ্ট্রপতিকে আমার কাছ থেকে দেখার সৌভাগ্য হয়েছে । বিচারপতি সাহাবুদ্দিন এবং মোঃ জিল্লুর রহমান এই দু’জনকেই আমার মনে হয়েছে একেবারেই নিষ্পাপ শিশুর মতো । বিচারপতি সাহাবুদ্দিনের কোন রাজনৈতিক অতীত ছিলনা আর জিল্লুর রহমান রাজনীতির একজন মাঠের কর্মী হতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি । দীর্ঘ প্রায় ষাট বছরের এক বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবন যার সমাপ্তি ঘটলো গত বুধবার ।
আজকাল বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে হঠাৎ আবির্ভাব হওয়া ‘রাজনীতিবিদদের’ প্রাদুর্ভাবে সুস্থ রাজনীতি বিপর্যস্থ । জিল্লুর রহমান ছিলেন সেই প্রজন্মের রাজনীতিবিদ যাদের হাত ধরে দীর্ঘদিন বাংলাদেশে সুস্থ রাজনীতি পথ চলেছে । সেই রাজনীতি এখন পথভ্রষ্ট । শুরু করেছিলেন ভাষা আন্দোলন দিয়ে । পরিণত বয়সে এসে হারালেন তার প্রিয়তমা স্ত্রী আইভি রহমানকে যখন ২০০৪ সালের ২১ আগষ্ট বঙ্গবন্ধু এভেন্যুতে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বকে চিরতরে ধ্বংস করে দেওয়ার জন্য ঘাতকরা একেবারে ব্যাগভর্তি গ্রেনেড নিয়ে দলের সমাবেশে হামলা চালালো। ঘাতকের হাতে স্ত্রী আইভি রহমানের নৃসংস মৃত্যু জিল্লুর রহমানের বয়স আরো কয়েক বছর বাড়িয়ে দিয়েছিল । রাষ্ট্রপতি মনোনিত হওয়ার পর তার অনুভূতি জানিয়ে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেছিলেন এই মুহুর্তে তিনি সব চেয়ে যার অনুপস্থিতি অনুভব করছেন তিনি আর কেউ নন, তার স্ত্রী আইভী রহমান । বুঝতে কষ্ট হয়না শেষ বয়সে এসে তিন অনেকটা নিঃসঙ্গ হয়ে পরেছিলেন । ২০১০ সালের প্রথম দিকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের সাথে বঙ্গভবনে গিয়েছিলাম রাষ্ট্রপতির সাথে এক সৌজন্য সাক্ষাতে । বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেটে আমি চ্যান্সেলর অর্থাৎ রাষ্ট্রপতির একজন প্রতিনিধি । তিনি কক্ষে প্রবেশ করতেই তাঁর সাথে কুশল বিনিময় এবং পরিচয় পর্বের পর তার হাতে আমার লেখা তিনটি বই তুলে দিয়েছিলাম যার একটি ছিল আমার লেখা বঙ্গবন্ধুর উপর একটি সংকলণ ‘একটি মহাকাব্যের শেষ অধ্যায় ।’ নামটি তাঁর বেশ পছন্দ হয়েছিল । তিনি নিজে তার ব্যক্তিগত ষ্টাফকে বললেন বঙ্গভবনের ফটোগ্রাফারকে খবর দিতে । ছবি তোলার সময় তিনি আমাকে কাছে টেনে নিলেন যাতে ছবি ভাল হয় । যেহেতেু আমাদের আলোচনার তেমন কোন এজেন্ডা ছিলনা অনেক কিছু নিয়েই আলোচনা হলো । তাঁকে জানানো হলো মালয়েশিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট ডঃ মাহাথির মুহাম্মদ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে আসার ইচ্ছা ব্যক্ত করেছেন । বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে সম্মান সূচক ডিলিট দিতে ইচ্ছুক । যেহেতু তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর সেহেতু তাঁর অনুমতি প্রয়োজন । এক কথায় তিনি রাজি । তবে জানালেন যেহেতু অনেক সময় শারীরিক কারণে তার ঢাকার বাইরে যাওয়া সম্ভব হয় না সেহেতু তিনি প্রধানমন্ত্রীকে তাঁর পক্ষে সেই অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার জন্য অনুরোধ জানাবেন । তবে তিনি এও জানালেন তিনি একসময় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে আসবেন । তিনি এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাকৃতিক পরিবেশের কথা শুনেছেন । পরবর্তীকালে ব্যক্তিগত কারণে ডঃ মাহাথির মুহাম্মদের বাংলাদেশে সফর স্থগিত হলে সেই বিশেষ সমাবর্তন আর হয়নি । দূর্ভাগ্য চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানেরও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পদধূলি পরেনি । উঠে আসার সময় আমাদের বললেন ‘আবার আসবেন’।
২০১০ সালের ১০ মে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের নয়জনের একটি প্রতিনিধি তার সাথে বঙ্গভবনে সাক্ষাৎ করতে গিয়েছিল । দলে আমিও ছিলাম । পরিচয় পর্বে আমি উঠে দাঁড়ালে তিনি বললেন আপনাকে আমি চিনি । আপনার লেখা আমি নিয়মিত পড়ি । আমিতো অনেকটা অভিভূত । আমাদের সময় ছিল আধ ঘন্টা । সেই আধ ঘন্টা পার হয়ে দেড় ঘন্টায় পরলো । বেশীর ভাগই ব্যক্তিগত আলাপ । কার ব্লাড প্রেসার কেমন, ডায়েবেটিসের কী অবস্থা এই ধরণের কথাবার্তা । তাঁর সাথে আমাদের দলের বেশ কয়েক জনের ব্যক্তিগত পরিচয় ছিল । তাঁর ব্যক্তিগত ষ্টাফ কিছুটা উসখুস করছিলেন । আমি প্রটোকল অফিসারকে ইশারা করতেই তিনি রাষ্ট্রপতির কাছে দাঁড়ালেন । জানালেন তাঁর ঔষধের সময় হয়েছে । রাষ্ট্রপতি উঠে দাঁড়িয়ে বললেন আপনারা মাঝে মাঝে আসবেন । তার নিঃসঙ্গতা কাটানোর প্রয়োজন ছিল ।
আমার বর্তমান বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম সমাবর্তন হবে । সকলে চায় তিনি সমাবর্তনে এসে অনুষ্ঠানটিকে উজ্জ্বল করুক । বঙ্গভবনের সাথে যোগাযোগ করা হলে তারা নিশ্চয়তা দিতে পারলেন না । বললেন মহামান্য রাষ্ট্রপতি শারীরিক ভাবে সুস্থ থাকলে তিনি যেতে পারেন । বঙ্গভবনে আমার পরিচিত দু’একজনের সাথে যোগাযোগ করলে তারা জানালেন রাষ্ট্রপতি যেতে পারেন তবে কোন অবস্থাতেই তাঁকে মঞ্চে চল্লিশ মিনিটের বেশী রাখা যাবেনা । আমি এক কথায় রাজি । ঘড়ি ধরে রিহার্সাল দেওয়া হলো । অনুষ্ঠানের দিন আটত্রিশ মিনিটের বেশী রাষ্ট্রপতিকে মঞ্চে থাকতে হয়নি । বাকি কয়েক মিনিট বরিষ্ট শিক্ষকদের নিয়ে তাঁর সাথে একটা ছবি তুলতে চাই । এক কথায় তিনি রাজি । সচরাচর এই পর্বটা হয়না । সেদিন আমাদের এই পর্বে দেখে অনেকে অবাক হয়েছিলেন । বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্র হতে বঙ্গভবন ফেরার পথে তার ব্যক্তিগত সহকারি আমাকে ফোন করে বললেন মহামান্য রাষ্ট্রপতি আমাদেও এত সুন্দর একটি সমাবর্তন করার জন্য ধন্যবাদ জানিয়েছেন। একজন অসামান্য উদার ব্যক্তির পক্ষেই এমন উদাহরণ সৃষ্টি করা সম্ভব । সাধারনত মানুষ কোন একটি বড় পদ পদবীতে গেলে অনেক আনুষ্ঠানিকতার বেড়াজালে আটকে যান আবার অনেকে তা পছন্দও করেন । জিল্লুর রহমান ছিলেন তার ব্যতিক্রম ।
দেশের রাজনীতির এক ক্রান্তিকালে রাষ্ট্র একজন বড় অভিভাবক হারালো । সাংবিধানিক বাধ্যবাদকতার কারণে নিশ্চয় কেউ একজন প্রয়াত জিল্লুর রহমানের স্থলাভিসিক্ত হবেন । তবে দেশের মানুষ আশা করে সেই মানুষটিরও জিল্লুর রহমানের মতো রাজনৈতিক প্রজ্ঞা থাকবে এবং তিনি তার মতো মানবিক গুনাবলির অধিকারি হবেন । রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের স্মৃতি বাংলাদেশ ও বাঙালির মনে চির জাগ্রুক থাকুক। তাঁর আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি।

লেখক: সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। মার্চ ২২, ২০১৩

 

 

 

 

WARNING: Any unauthorized use or reproduction of 'Community' content is strictly prohibited and constitutes copyright infringement liable to legal action. 

 

[প্রথমপাতা]

 

 

 

লেখকের আগের লেখাঃ