[প্রথমপাতা]

 

 

 

 

 

একটি সমৃদ্ধ বাংলাদেশের হাতছানি

 

 

আবদুল মান্নান

বাংলাদেশের রাজনীতি দেশের মানুষকে তেমন একটা ভাল খবর দিতে না পারলেও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে কয়েক সপ্তাহের ব্যবধানে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সাফল্য ও সম্ভাবনা নিয়ে বেশ কয়েকটি সংবাদ ও বিশ্লেষণ প্রকাশিত হয়েছে যা সাধারণ মানুষকে বেশ উজ্জীবিত করবে । অবশ্য এই ধরণের সংবাদে যারা সব সময় অর্ধেক পানি ভর্তি গ্লাস না দেখে শুধু অর্ধেক খালি গ্লাস দেখতে অভ্যস্থ অথবা যারা দেশ পরিচালনার ভার রাজনীতিবিদদের হাতে থাকুক তা চাননা তারা খুশি হবেন না ।
২০১২ সালের ১০ ফেব্রুয়ারী জাতি সংঘের অর্থনীতিবিদ ডঃ রব ভস বিশ্বসংস্থার মহাসচিবের পক্ষে ২০১১ সালে বিশ্ব অর্থনীতির উপর তার প্রতিবেদন পেশ করতে গিয়ে বলেন বিশ্ব অর্থনীতিতে বাংলাদেশ হচ্ছে একটি নক্ষত্রের মতো । যেখানে উন্নত বিশ্ব বার্ষিক প্রবৃদ্ধির হার ২% এর উপরে তুলতে হিমসিম খাচ্ছিল সেখানে বাংলাদেশ তার প্রবৃদ্ধি ৬.৬%এ ধরে রাখতে পেরেছে । ডঃ ভস তার মন্তব্যে আরো বলেন বাংলাদেশ তার প্রবৃদ্ধির হারে এই গতি ধরে রাখতে পারলে ২০১২ ও ২০১৩ সালে যথাক্রমে তা ৬.৭% ও ৭% এ উন্নীত করতে পারবে । তিনি আরো বলেন বাংলাদেশ এমন একটি সময়ে এই প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে সক্ষম হলো যখন পশ্চিমের শিল্পোন্নত দেশ সমূহ অর্থনৈতিক মন্দা কাটিয়ে উঠতে আপ্রাণ চেষ্টা করছে । জাতি সংঘ যখন তাদের প্রতিবেদন প্রকাশ করে তখন দূভার্গ্যজনক ভাবে বাংলাদেশে বিরোধী দল রাজনৈতিক অস্থিরতার সূত্রপাত করে এবং গত একবছর ধরে সেই অস্থিরতা কয়েকগুন বৃদ্ধি পেয়েছে আর বছর শেষ হওয়ার আগেই তা সহিংস রূপ ধারণ করেছে । সার্বিক অবস্থা বিশ্লেষণ করলে এটি মনে করার যথেষ্ট কারণ আছে যে ২০১৩ সালটিও বাংলাদেশের সাধারণ জনগণকে চরম রাজনৈতিক অস্থিরতার মাঝে কাটাতে হবে । তবে সুখের বিষয় হচ্ছে এতো সব রাজনৈতিক অস্থিরতার মাঝেও বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং প্রবৃদ্ধি সচল রয়েছে ।
কয়েক সপ্তাহ আগে বিশ্ব ব্যাংক তাদের বার্ষিক প্রতিবেদনে বাংলাদেশের গত বছরের অর্জনকে একটি রহস্যজনক বিষ্ময় হিসেবে আখ্যায়িত করেছে । গত নভেম্বরের ১৩ তারিখে প্রকাশিত বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে বাংলাদেশ প্রতি এক দশকে তার প্রবৃদ্ধির হার গড়ে একশতাংশ করে বৃদ্ধি করতে সক্ষম হয়েছে । সত্তরের দশকে যা ছিল ৩% তা বর্তমানে বাংলাদেশ ৬% এর উপর ধরে রাখতে পেরেছে । তাদের প্রতিবেদনে তারা এও উল্লেখ করেছে কোন কোন দশকে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি বৃদ্ধির হার ১.৭% পর্যন্ত হয়েছে । বাংলাদেশের এই বিষ্ময়কর সাফল্যের পিছনে বিশ্বব্যাংক কয়েকটি কারণকে সনাক্ত করেছে যার মধ্যে আছে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার নিয়ন্ত্রণ, অভ্যন্তরীণ সম্পদ আহরণে সাফল্য, ব্যষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা, শিক্ষার বিস্তার এবং উদার অর্থনৈতিক নীতি । বিশ্বব্যাংক তাদের প্রতিবেদনে এও বলেছে বাংলাদেশ যদি তদের স্বাধীনতার স্বর্ণ জয়ন্তীর বছর ২০২১ সালের মধ্যে প্রত্যাশিত মধ্যম আয়ের দেশে পরিনত হতে চায় তা হলে এই প্রবৃদ্ধির হার ৭.৫%-৮% এর মধ্যে নিয়ে যেতে হবে যা করতে হলে বর্তমানেও প্রবৃদ্ধির হার ধরে রাখতে হবে ।
বৎসরের শেষ নাগাদ গত ১৭ই ডিসেম্বর বিশ্ব ব্যাংকের বাংলাদেশ সম্পর্কে মন্তব্যের ধারাবাহিকতায় আন্তর্জাতিক আর্থিক সামর্থ মূল্যায়ন সংস্থা (ৎধঃরহম ধমবহপু) মুডী বলেছে বাংলাদেশের দেনা পরিশোধের স্থিতিশীলতা (পৎবফরঃ ৎধঃরহম) বর্তমানে যে কোন সময়ের চাইতে সন্তোষজনক । তবে তাজরীন গার্মেন্টস কারখানায় আগুন লাগার ঘটনা এবং পদ্মা সেতু নিয়ে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে জটিলতা দেশটিকে কিছুটা হলেও অস্বস্তির মধ্যে ফেলে দিয়েছে । মুডী জ্বালানি সহ আরো কিছু কিছু ক্ষেত্রে সরকারি ভর্তূকি কমানোর পদক্ষেপকে প্রশংসা করে মন্তব্য করেছে বাংলাদেশ হচ্ছে দক্ষিণ এশিয়ার একমাত্র দেশ যেটি চলতি হিসাবে উদ্বৃত্ত প্রদর্শন করতে সক্ষম হয়েছে । তবে সংস্থাটি এই বলে সতর্ক করে দিয়েছে যে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির এই গতি ধরে রাখা কিছুটা চাপের মুখে পরতে পারে যদি না দেশটির সরকার শ্রমিক অসন্তোষ ও রাজনৈতিক অস্থিরতাকে সফলভাবে মোকাবেলা করতে পারে ।
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সাফল্যের বছরের সর্বশেষ সনদটি দিল লন্ডন হতে প্রকাশিত গার্ডিয়ান পত্রিকা । গার্ডিয়ান যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক অর্থনৈতিক গবেষণা সংস্থা এবং অডিটিং ফাম প্রাইসওয়াটার হাউজ কূপারসের এক গবেষণা কর্মের বরাত দিয়ে তাদের গত ১৮ই ডিসেম্বর সংখ্যায় উন্নয়নশীল বিশ্বের কয়েকটি দেশের উপর একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে । সত্তরের দশকে এসব দেশের প্রত্যেকটি সম্পর্কে পশ্চিমা দেশের বাঘা বাঘা রাজনীতিবিদ আর অর্থনীতিবিদরা সব সময় নেতিবাচক মন্তব্য করতেন এবং উপসংহারে বলতেন এই সব দেশের ভবিষৎ অনেকটা তমাসাচ্ছন্ন । এই দেশগুলিকে এই বলে তারা বিদ্রুপ করতেনযে এগুলি হচ্ছে অর্থনীতির ভাষায় ‘বাস্কেট কেস’ । নিক্সন প্রশাসনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরী কিসিঞ্জার বঙ্গবন্ধু সরকারের আমলে বাংলাদেশ সম্পর্কে এই মন্তব্য করে বাংলাদেশ বিরোধীদের হাতে নতুন সরকারের সমালোচনা করার জন্য একটি মোক্ষম হাতিয়ার তুলে দিয়েছিলেন । কিসিঞ্জারের এই নির্দয় মন্তব্য এখনো কিছু অবার্চিন রাজনীতিবিদ সুযোগ পেলেই আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে ব্যবহার করে । তারা এটি কখনো বলেনা যে স্বাধীন বাংলাদেশের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নেতৃত্বে প্রথম সরকারটি একটি যুদ্ধবিধ্বস্থ দেশকে পূনর্গঠন করতে কী অসাধ্য সাধন করেছিল । যে সব দেশ সম্পর্কে বর্তমান আশব্যাঞ্জক মন্তব্য সে সবের মধ্যে আছে বাংলাদেশ, ফিলিপিন্স, পাকিস্তান, ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া, তুরষ্ক, মিশর, ইরান, দক্ষিণ কোরিয়া, মেক্সিকো আর আর্জেন্টিনা । প্রাইস ওয়াটার হাউজ কূপারসের প্রধান অর্থনীতিবিদ জন হকস্ওয়ার্থের মতে এই দেশগুলির অর্থনীতি ২০৫০ সাল নাগাদ পশ্চিমা দুনিয়ার দেশগুলিকেও ছাড়িয়ে যাবে । ইতোমধ্যে চীন বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে । ইউরোপ বা যুক্তরাষ্ট্রের যে অর্থনৈতিক উন্নয়ন করতে এক থেকে দেড়শত বছর সময় লেগেছে তা করতে চীন বা ভারতের লেগেছে তিন দশকের কম সময় আর বাংলাদেশের মতো বিশাল জনসংখ্যা অধ্যুষিত একটি ক্ষুদ্র দেশ তা করতে পারার সম্ভবনা দেখা দিয়েছে স্বাধীনতার সত্তর থেকে আশি বছর সময়ের মধ্যে । প্রাইসওয়াটার হাউজ কুপারসের বক্তব্যে সাত বছর আগে য্ক্তুরাষ্ট্রের আর একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান গোল্ডম্যান স্যাস আর তার অর্থনীতিবিদ জীম ও’নীল একই ধরনের ভবিষৎবাণী করে বলেছিলেন প্রথম ধাপে চারটি দেশ (ব্রাজিল, রাশিয়, ভারত ও চীন) অর্থনৈতিক পরাশক্তি হিসাবে বিশ্ব মানচিত্রে উঠে আসবে তারপর আরো এগারটি দেশ তাদের পদাঙ্ক অনুসরণ করবে যাদের মধ্যে বাংলাদেশ প্রথম কাতারে থাকবে । একটা সময় ছিল যখন ইউরোপ, যুক্তরাষ্ট্র আর জাপানের বিশ্ব শিল্পোৎপাদনে গড় অংশ ছিল প্রায় ৮০% । এখন খুব দ্রুত সেই চিত্রটা পাল্টে যাচ্ছে । এই দেশগুলি বর্তমানে খুব দ্রুত তাদের শিল্পপন্য এবং সেবাখাতের অবদানের জন্য এশিয়া ও দক্ষিণ আমেরিকার উল্লেখিত দেশ সমূহের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে ।
উপরে উল্লেখিত বাস্তবতাটা হচ্ছে বাংলাদেশ সম্পর্কিত বর্তমান চিত্র এবং আগামী দিনের সম্ভাবনার কথা । সম্ভাবনাকে বাস্তবে রূপ দিতে হলে চাই অনেকগুলি বাস্তব পদক্ষেপ যা দ্রুত বাস্তবায়ন করতে হবে । বিশ্বব্যাংক যথার্থ ভাবেই বাংলাদেশের প্রত্যাশিত অগ্রগতির পথে যে’কটি অন্তরায় চিহ্নিত করেছে তার মধ্যে আছে দূর্বল অথনৈতিক প্রশাসনিক ব্যবস্থা, জমির উপর অত্যাধিক নির্ভরশীলতা, বিদ্যুৎ সরবরাহ অপ্রতুলতা, বন্দরের অপ্রতুল ধারণ ক্ষমতা, অপর্যাপ্ত পরিবহণ ব্যবস্থা, এবং সর্বোপরি উপরিকাঠামোগত অপর্যাপ্ততা । তবে সব কিছুর উপর আছে দক্ষ মানব সম্পদের মারাত্মক অপ্রতুলতা এবং ক্রমবর্ধমান রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা । এই প্রসঙ্গে পরে আসছি । বিদ্যমান উপরিকাঠামোগত অপর্যাপ্ততার কারনে বর্তমানে বাংলাদেশে ভারী বা মাঝারি পন্য উৎপাদন খাতে যে পরিমানের বিদেশী বিনিয়োগ হওয়ার সম্ভাবনা ছিল তা হয়না । এর ফলে পর্যাপ্ত কর্মসংস্থান বাধাগ্রস্থ হয় । বর্তমানে বাংলাদেশে বছরে ১৮ লক্ষ মানুষ শ্রম বাজারে প্রবেশ করে এবং প্রতি বছর প্রায় ২৭ লক্ষ কর্মক্ষম মানুষ বেকার বা অর্ধ বেকার থাকে । এই মূহুর্তে বাংলাদেশের একমাত্র বড় শ্রমঘন শিল্প হচ্ছে তৈরী পোষাক প্রস্তুতকারি শিল্প যেখানে পরোক্ষ আর প্রত্যক্ষ ভাবে প্রায় চল্লিশ লক্ষ শ্রমিক কাজ করে । চীনের শ্রম ব্যয় বৃদ্ধি পাওয়ার কারনে অনেক তৈরী পোষাক প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান তাদের উৎপাদন ব্যবস্থা অন্যদেশে স্থানান্তর করার চেষ্টা করছে এবং বাংলাদেশ হতে পারে তাদের জন্য একটি অত্যন্ত আকর্ষনীয় গন্তব্য যদি বাংলাদেশ তাদের বিদ্যমান সমস্যাগুলি সমাধান করতে পারে । বর্তমানে বাংলাদেশ বিশ্বে তৈরী পোষাক রপ্তানিকারক দেশ হিসেবে ৪% রপ্তানি করে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে আছে । চীন ৩০% রপ্তানি করে প্রথম স্থানে আছে অথচ এই শিল্পে চীনের যাত্রা বাংলাদেশের প্রায় একদশক পরে । অনেক বিশ্লেষক মনে করেন বাংলাদেশ যদি তার সমস্যাগুলিকে সমাধান করতে পারে তাহলে ২০২০ সাল নাগাদ বিশ্ব তৈরী পোষাক রপ্তানিতে বাংলাদেশের ভাগ ১০% এ উন্নীত হতে পারে । কিছুটা স্বস্তির বিষয় হচ্ছে বর্তমান সরকারের আমলে বিদ্যুৎ উৎপাদন পূর্বের সরকারের আমলের প্রায় দ্বিগুন হয়েছে যদিও অনেক সমালোচক বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রত্রিুয়া নিয়ে প্রশ্ন তোলেন । তাদের মতে কুইক রেন্টাল পদ্ধতিতে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয়বহুল এবং এটি স্বল্প মেয়াদের জন্য ঠিক হলেও দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনার অংশ হিসেবে আমাদের পুরানো বড় বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলিকে আধুনিকায়ন করতে হবে এবং আরো নতুন নতুন বিদ্যুৎ কেন্দ্র তৈরী করতে হবে । তাদের এই মতের সাথে দ্বিমত করার কোন অবকাশ নেই তবে বিগত চার বছরে কুইক রেন্টালের মাধ্যমে বাড়তি খরচে বিদ্যুৎ উৎপাদন করলেও শিল্পদ্যোক্তা এবং ব্যবসায়ীরা বলছেন বিদ্যুতের এই বাড়তি উৎপাদন না হলে তাদের অনেক শিল্পকারখানা বন্ধ হয়ে যেত । এটি মানতে হবে বর্তমানে লোড শেডিং গত বছরের তুলনায় বেশ খানিকটা হলেও কমে এসেছে ।
বাংলাদেশকে তার প্রত্যাশিত উন্নয়নের দিকে নিয়ে যেতে হলে মানব সম্পদ উন্নয়নের কোন বিকল্প নেই । একটি সময় ছিল যখন মনে করা হতো জনসংখ্যা বাংলাদেশের জন্য একটি বড় সমস্যা । বিশ্বায়নের এই যুগে এখন এই জনসংখ্যাই হয়ে উঠতে পারে আমাদের সব চাইতে বড় সম্পদ যদি তাদের সঠিক প্রশিক্ষণ এবং শিক্ষা দিয়ে জনসম্পদে রূপান্তর করা যায় । বিশ্বব্যাপী বর্তমানে দক্ষ জনসম্পদের এখন বড় আকাল । সম্প্রতি লন্ডন হতে প্রকাশিত ইংরেজি সাপ্তাহিক ইকোনমিস্ট পত্রিকা এক জরিপ চালিয়ে বলেছে ইউরোপ এবং মধ্যপ্রাচ্যের অনেকগুলি দেশে ১৫ হতে ২৪ বছর বয়সের তরুনদের মাঝে প্রায় একচতুর্থাংশ বেকার কারণ তাদের কর্মদক্ষতা আর যোগ্যতার অভাব । জাপানে সাতলক্ষ বেকার বর্তামানে বাড়িতে অলস দিন কাটায় । যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন ব্যবস্থাপনা পরামর্শদাতা ফার্ম ম্যাকিন্সে নয়টি দেশের উপর (যুক্তরাষ্ট্র, ব্রাজিল, বৃটেন, জার্মানি, ভারত, মেক্সিকো, মরক্কো, সৌদি আরব ও তুরষ্ক) এক জরিপ চালিয়ে বলেছে দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান গুলি প্রাথমিক স্তরে তাদের প্রয়োজনের শুধু মাত্র ৪৩% খালি পদ পূরণ করতে পারে কারণ যোগ্য প্রার্থী পাওয়া যায়না । ম্যাকিন্সের মতে বিভিন্ন দেশের বিশ্ববিদ্যালয় সহ অন্যান্য শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান সমূহ যে ধরণের শিক্ষা বা প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে তার সাথে প্রায়শঃ বাস্তব প্রয়োজনের কোন সামঞ্জস্য থাকেনা । বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এই পর্যবেক্ষণ একশতভাগ সত্য । এটি সত্য বাংলাদেশে গত দুই দশকে শিক্ষিতের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে তবে তার সাথে শিক্ষার মান তাল রাখতে পারেনি । সরকারি এবং বেসরকারি পর্যায়ে দেশে এখন অনেকগুলি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে সত্য তবে তার চাইতে বেশী প্রয়োজন ছিল অধিক সংখ্যক কারিগরী প্রশিক্ষণ কেন্দ্র গড়ে তোলা । বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বিদেশে কর্মরত শ্রমিকদের পাঠানো অর্থ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে তবে এদের অধিকাংশই অদক্ষ শ্রমিক। এর ফলে এই শ্রমিকদের বেশীর ভাগই স্বল্প মজুরীতে চাকুরী করতে বাধ্য হয় । তুলনামূলক ভাবে ভারত, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপিন্স প্রভৃতি দেশের শ্রমিকরা দুই হতে তিন গুন বেতনে কাজ করে । বাংলাদেশ মধ্যপ্রাচ্যে বা আরব দেশগুলিতে যদি কাজের বুয়া না পাঠিয়ে দক্ষ কারিগর, ডাক্তার, নার্স অথবা প্রকৌশলী বা সফ্টওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার পাঠাতে পারে তা হলে এই শ্রমিকদের অনেকেই সে সব দেশে কর্মকর্তা বা মাঝারি পর্যায়ের ব্যবস্থাপক হিসেবে কাজ করতে পারবে আর বাংলাদেশে পাঠানো তাদের অর্থ দ্বিগুন হতে বাধ্য । এই বাস্তবতাটি সরকারি নীতি নির্ধারকদের দ্রুত অনুধাবন করতে হবে । বর্তমানে বাংলাদেশে বৈধভাবে এক লক্ষ আশি হাজার বিদেশী বিভিন্ন কলকারখানা আর সেবামূলক প্রতিষ্ঠানে কাজ করে । অবৈধ ভাবে করে কমপক্ষে আরো একলক্ষ । অন্যদিকে বাংলাদেশের অনেক ‘শিক্ষিত’ তরুণ বেকার হয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ায় । এর অন্যতম কারণ হচ্ছে এদের অধিকাংশেরই চাকুরী করার মতো যোগ্যতার অভাব । তারা আমাদের গলদ শিক্ষাব্যবস্থার শিকার । এই পরিস্থিতির দ্রুত উত্তরণ না হলে বাংলাদেশকে ২০৫০ সাল নাগাদ তার অভিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাতে অনেক বেগ পেতে হবে ।
সব শেষে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে কিঞ্চিত আলোচনা করতে চাই । বাংলাদেশের রাজনীতি বর্তমানে অনেকটা ব্যক্তিগত স্বার্থে ঘুরপাক খাচ্ছে । এটি দূর্ভাগ্য হলেও সত্য আমাদের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের দূরদর্শিতার প্রচন্ড অভাব আছে । তারা নিজেরা কী চান তা বলতে পারেন কিন্তু দেশের কী প্রয়োজন তা কদাচিৎ উপলব্ধী করেন । এর ফলে যেটি হয় দেশ এক কদম সামনের দিকে অগ্রসর হয়তো দুই কদম পিছিয়ে আসে । বাংলাদেশের দূর্ভাগ্য হচ্ছে এদেশে বর্তমানে যারা রাজনীতি করেন তাদের অনেকেরই রাজনীতি করার কথা নয় আর যার রাজনীতিতে আসলে দেশের এবং তাদের রাজনীতির একটি গুনগত পরিবর্তন হতে পারতো তারা নানা কারণে রাজনীতিতে আসেন না । এই সব অবস্থার পরিবর্তন হলেই জাতি সংঘ হতে শুরু করে প্রাইসওয়াটার হাউজ কূপারস বাংলাদেশকে ২০৫০ সনে যে স্থানে দেখতে চায় বাংলাদেশ হয়তো তার চাইতেও আরো উঁচু স্থানে পৌঁছাতে পারবে।

একটি সমৃদ্ধ বাংলাদেশ প্রত্যাশা করে সকল পাঠকদের খ্রীষ্টীয় নব বর্ষের শুভেচ্ছা।

লেখক: সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। বর্তমানে শিক্ষক, ইউল্যাব, ঢাকা। ডিসেম্বর ২৫, ২০১২

 

 

WARNING: Any unauthorized use or reproduction of 'Community' content is strictly prohibited and constitutes copyright infringement liable to legal action. 

 

[প্রথমপাতা]

 

 

 

লেখকের আগের লেখাঃ