[প্রথমপাতা]

 

 

 

 

 

দেশে এখন রাজনৈতিক সার্কাস চলছে

 

 

প্রফেসর আবদুল মান্নান

বাংলাদেশের রাজনৈতিক ফ্রন্টে এখন বিচিত্র রকমের সব সার্কাস হচ্ছে । বেশ ক’দিন ধরে আমাদের একমাত্র নোবেল লরিয়েট ডঃ ইউনুসকে নিয়ে দেশের প্রধান বিরোধী দল বেশ খোশ মেজাজে আছে । একদিন তাঁর সাথে বেগম জিয়ার শুভেচ্ছা বার্তা আর ফুলের তোড়া নিয়ে দলের শীর্ষ নেতারা দেখা করেন তো পরদিন দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ইউনুস সেন্টারে ছোটেন । বলেন চিন্তা করবেন না আমরা ক্ষমতায় আসলে গ্রামীণ ব্যাংককে তার পূর্বের অবস্থা ফিরিয়ে দেব । বেগম জিয়ার প্রথম টার্মে তিনি বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর । তিনি বিশ্ববিদ্যালয় সমাবর্তনে গেলেন সভাপতিত্ব করতে । সমাবর্তন বক্তা হিসেবে আছেন ডঃ ইউনুস । তখনো তিনি নোবেল পুরস্কার পাননি । তবে বিশ্বের অন্য অনেক বড় বড় পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন । সেই সমাবর্তনে সরকারের উদ্দেশ্যে তাঁর মূল বক্তব্য ছিল ‘পথের বাঁধা সরিয়ে দিন সামনে পথ চলতে দিন (জনগণকে)’ । এতে মাননীয় চ্যান্সেলর বেশ ক্ষুব্দ হলেন । তাঁকে সামনে বসিয়ে সরকারের বিরুদ্ধে এমন কথা ? অলিখিত নির্দেশ জারি করলেন যে অনুষ্ঠানে তিনি উপস্থিত থাকবেন সেই অনুষ্ঠানে যেন ডঃ ইউনুসকে বক্তা হিসেবে আমন্ত্রণ জানানো না হয় । প্রয়াত অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমান পেশায় ছিলেন একজন চাটার্ড একাউন্ট্যান্ট। তার অনেক মজার মজার অর্থনৈতিক তত্ত্ব ছিল । ১৯৯২ সনে চট্টগ্রামে একটি প্রলয়ঙ্কারি ঘূর্ণিঝড়ে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হলো । অর্থমন্ত্রী চট্টগ্রাম গেলেন । আসার সময় বলে আসলেন মাঝে মাঝে ঘূর্ণিঝড়, প্রাকৃতিক দূর্যোগ হলে অর্থনীতির জন্য ভাল কারণ তাতে সহজে বৈদেশিক সাহায্য পাওয়া যায় । এতে চট্টগ্রামের মানুষ বেশ ক্ষিপ্ত হয়ে তাঁকে চট্টগ্রামে অবাঞ্চিত ঘোষণা করলেন। তার মতে ভর্তুকি দিয়ে দেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করা ঠিক নয় কারণ দেশে খাদ্য ঘাটতি দেখা দিলে অথবা খাদ্যের মূল্য চড়া হলে তা বিদেশ হতে আমদানি করে মোকাবেলা করা যাবে । ক্ষুদ্র ঋণ আর ডঃ ইউনুস সম্পর্কে কথা উঠলেই তাঁর সোজাসাপটা মন্তব্য ছিল, ‘গরীব মানুষকে দুই একটা ছাগল মুরগি দিয়ে কী আর দারিদ্র দূরীকরণ হয় ?’ এই সব কথা মির্জা ফখরুল সাহেবের মনে থাকার কথা নয় কারণ তিনি বেজায় ব্যস্ত একজন মানুষ । এইসব বিষয় নিয়ে চিন্তা করার সময় কোথায় ? তাকে যে কেন এখনো বেগম জিয়া পূর্ণ মর্যাদায় দলের মহাসচিব করছেন না তা এখনো অনেকের কাছে এক রহস্যময় বিষ্ময় । অবশ্য বর্তমান সংসদের মেয়াদ শেষ হতে চললেও সংসদে এখন পর্যন্ত বিরোধী দলের কোন উপনেতা নেই । ডঃ ইউনুসের দোড় গোড়ায় মির্জা ফখরুলদের দৌঁড় ঝাঁপের রেশ না কাটতেই সেখানে ছুটলেন বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীর উত্তম আর এলডিপি নেতা কর্ণেল (অবঃ) অলি আহম্মদ, বীর বিক্রম । তাদের মধ্যে কী আলাপ হয়েছে তা জানা না গেলেও ধারণা করা হচ্ছে তারা তাদের রাজনৈতিক মিত্ররা এর পূর্বে যা বলে এসেছেন তা তারা ক্ষমতায় গেলে ঠিক পালিত হবে তার নিশ্চয়তা দিয়ে এসেছেন । পুরো বিষয়টার সহজ সরল অর্থ করলে দাঁড়ায় যদিও সাম্প্রতিক কালে হেফাজত পার্টি বিএনপি’র সাথে বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে কাঁধ মিলিয়েছেন বলে মনে করা হচ্ছে তথাপি তারা তাদের উপর ভরসা রাখতে পারছেন না । নির্বাচনের আগে যদি তারা শর্ত দেয় ক্ষমতায় গেলে আল্লামা শফিকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি করতে হবে আর কোন বেপর্দা আওরাত দেশের প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন না তা হলেতো বিপদ । সুতরাং এই রকম সংকট যদি সৃষ্টি হয় তাহলে গ্রামীণ ব্যাংকের পঁচাশি লক্ষ সদস্যের সমর্থন তো অপরিহার্য হয়ে পরবে । আর একবার ক্ষমতায় গেলে ডঃ ইউনুসকে নিয়ে কী করা হবে তখন চিন্তা করা যাবে । রাজনীতিতে হঠাৎ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠা গ্রামীণ ব্যাংক নিয়ে সরকারও পিছিয়ে থাকবে কেন ? এই ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা অডিট করার জন্য সরকার কর্তৃক গঠিত কমিশন তাদের রির্পোটে তিনটি সুপারিশ করলেন যার মধ্যে একটি ছিল গ্রামীণ ব্যাংকের অর্থায়নে পরিচালিত উনিশটি অঙ্গ প্রতিষ্ঠানকে পরিচালনা করার জন্য তার কাঠামো পরিবর্তন করে ঊনিশটি ব্যবস্থাপনা পরিষদ গঠন করা হোক । অর্থ মন্ত্রী বললেন তার আগে একটি দিক নির্দেশনা মূলক কর্মশালা হবে যেখানে ডঃ ইউনুস হবেন সেই কর্মশালার মধ্যমনি । চারিদিকে রব উঠল শেষ হয়ে গেল আমাদের এই গর্বের ধন গ্রামীণ ব্যাংক । একে ঊনিশ টুকরো করার ষড়যন্ত্র পাকাপোক্ত করা হয়েছে । সরকার যতই বলুক এমন কোন সিদ্ধান্ত হয়নি, এটি তিনটি প্রস্তাবের মধ্যে একটি প্রস্তাব, কে শোনে কার কথা । আবার কেউ কেউ কমিশনের এমন একটা কর্মশালা করার এক্তিয়ার নিয়ে প্রশ্ন তুললেন । যখন সকলে অপেক্ষা করছে এই কর্মশালা কী হয় তা দেখার জন্য সরকার হতে হঠাৎ ঘোষণা করা হলো হচ্ছে না এই কর্মশালা । বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ডঃ আতিউর রহমান বললেন গ্রামীণ ব্যাংকের পরিবর্তন করার কোন প্রয়োজন নেই । তার কথার প্রতিধ্বনি করলেন বন ও পরিবেশ মন্ত্রী ডঃ হাসান মাহমুদ । সরকারের কাছে পঁচাশি লক্ষ গ্রামীণ ব্যাংক সদস্য ও তাদের পরিবারের সমর্থন খুবই জরুরী কারণ তার নিজের দলে কিছু অপরিনামদর্শী কর্মী, নেতা আর ক্যাডারের কারণে আওয়ামী লীগ এই মুহুর্তে একটু অস্বস্তিতে আছে । বিগত নির্বাচনে একজন বড় মাপের পীরের ছেলে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্ধিতা করেছিলেন । ২১৬ ভোট পেয়ে জামানত খুইয়েছেন । পীরের মুরিদ ছিল ত্রিশ লক্ষ । গ্রামীণ ব্যাংকের সদস্যদের নিয়েও এই সব বিচার বিশ্লেষণ চলছে বলে অনেকের ধারণা । তবে গ্রামীন ব্যাংকের সাথে সংশ্লিষ্ট অনেকেই ব্যক্তিগতভাবে আমাকে বলেছেন তারা এবার বিএনপিকে সমর্থন জানাবেন । হেফাজত ঠিক করেছে তাদের বাড়ীর মহিলারাও ভোট দিতে যাবেন ।
বাংলাদেশের একমাত্র জেল খাটা রাষ্ট্রপতি হুসেন মুহাম্মদ এরশাদ । তাঁর স্বৈরাচারী শাসন ব্যবস্থার পরিসমাপ্তি ঘটানোর জন্য দেশের মানুষ দীর্ঘ সময় ধরে আন্দোলন করেছে, অনেক রক্ত ঝরিয়েছে । বর্তমানে তিনি মহাজোট সরকারেও আছেন । খায়েস ছিল রাষ্ট্রপতি হবেন । শেখ হাসিনা তাকে রাষ্ট্রপতি না করাতে মনে বেশ কষ্ট পেয়েছেন যা তিনি সুযোগ পেলেই বলেন । বড় দুই দলই ধারণা করে নিয়েছে ক্ষমতায় যেতে হলে তার দলের সমর্থন গুরুত্বপূর্ণ । তবে সমস্যা হচ্ছে এরশাদ সাহেব কী বলেন আর কী করেন তা এক গবেষণার বিষয় । বিকেলে বলেন তিনি মহাজোটে আছেন । মধ্যরাতে ঘুম থেকে উঠে বলেন না তিনি কারো সাথে নেই । একাই নাকি তিনি এবার তিনশতটি আসনে প্রার্থী দেবেন । এক রাতে ছুটলেন সরকারের দু’জন মন্ত্রী এরশাদের বাসায় । তা যেনে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর পড়িমরি করে পরদিন ছুটেন এরশাদের দরবারে । দুয়ারবন্ধ সভা করেন তিনি কাজী জাফর সহ । এরই মধ্যে তার সাথে দেখা করে এসেছেন তার এক কালের মহাসচিব আনোয়ার হোসেন মঞ্জু। এরশাদ বলেন গাজীপুরের সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে তিনি ১৮ দলীয় প্রার্থীকে সমর্থন দিচ্ছেন । ১৪ দলীয় প্রার্থী সব কিছু ফেলে ছুটেন এরশাদ হুজুরের দোয়া নিতে । হুজুর বলেন ‘যাও বাচ্চা আমার দোয়া তোমার জন্য রইলো’। ১৮ দলীয় প্রার্থীতো আর বসে থাকতে পারেন না । বিকেলে তিনিও এরশাদের দরবারে হাজির হন । বলেন, ‘বান্ধা হাজির, দোয়া প্রার্থী’ । হুজুরের দরবার হতে কেউ খালি হাতে ফেরেন না । বলেন ‘যাও বাচ্চা তোমাকেও দোয়া করলাম’। গাজীপুরের নেতা কর্মীরা বেজায় বিভ্রান্ত ।
ড্যান মজিনা বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত । বেশ করিতকর্মা ব্যক্তি । সব রাজনৈতিক দলকে খুব ভাল ভাল উপদেশ দেন । তিনি প্রায়শঃ বাংলাদেশের একটি উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ দেখেন । কখনো কখনো অতি উৎসাহে বলে ফেলেন এক সময় বাংলাদেশ চীনের মতো একটি অর্থনৈতিক শক্তি হয়ে উঠবে । বলি তার মুখে ফুল চন্দন পড়–ক । কার না ভাল লাগে নিজ দেশ সম্পর্কে এমন সুন্দর কথা শুনতে । জীবদ্দশায় এমন অবস্থা দেখতে পারলে বুঝতাম জীবনটা সার্থক । তার বাড়ীতে প্রায়শঃ রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে নৈশ ভোজের দাওয়াত দেন । বাইরের লোক মনে করেন ভিতরে কী জানি ষড়যন্ত্র হচ্ছে । তিনি যখন হঠাৎ করে বেগম জিয়ার বাসভবনে হাজির তখন সন্দেহপ্রবণদের সন্দেহ আরো ঘনিভূত হয় । বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন স্বনামধন্য রাজনীতি বিজ্ঞানের অধ্যাপক বলেন বুঝতে পারছেন না, যুক্তরাষ্ট্র এখন বাংলাদেশকে আর একটি মিশরে পরিণত করার নীল নকশা বাস্তবায়ন করার প্রকল্প হাতে নিয়েছে । একনায়ক হুসনী মুবারককে ক্ষমতাচ্যুত করে রাষ্ট্রক্ষমতায় তাদের মদদে বসলো মুসলিম ব্রাদারহুড, যাকে বলা হয় ধর্মীয় জঙ্গিবাদের জন্মদাতা এবং জামায়াত রাজনীতির আদি সংগঠন । দীর্ঘ সময় এই দলটি মিশরে নিষিদ্ধ ছিল । মোবারক অন্য কোন দলকে তার দেশে রাজনীতি করতে দেয় নি । সুযোগ বুঝে মোবারকের পতনের পর ব্রদারহুড এখন ক্ষমতায় । তাদের এক বছরের দুঃশাসনে জনগণ অতিষ্ঠ হয়ে আবার রাজপথে । সেনা বাহিনী হুমকী দিয়েছে দ্রুত অবস্থার পরিবর্তন না হলে তারা আগামী দিনের কর্মসূচী ঠিক করবে । অনেকের ধারণা সামনের নির্বাচনে বিএনপি’র বিজয় অবশ্যম্ভাবী কিন্তু বাস্তবে ক্ষমতায় আসবেতো জামায়াত । এখন যারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলেন তখন তাদের খবর আছে । আর এখনতো যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চলছে তখন বিচার শুরু হবে যারা পাকিস্তান ভেঙ্গেছে তাদের । এখন থেকেই নাকি কোন কোন এলাকায় দেলওয়ার হোসেন সাঈদীকে অনেকে দিল্লীর হযরত নিজাম উদ্দিন আওলিয়ার সাথে তুলনা করা শুরু করেছেন । নিজাম উদ্দিন একসময় কুখ্যাত ডাকাত ছিলেন । অসংখ্য খুন খারাবি করার পর আল্লাহর ইচ্ছায় হয়ে গেলেন আওলিয়া । তাহলে একাত্তরের দ-প্রাপ্ত ঘাতক কেন আওলিয়া হতে পারবেন না ?
সর্বশেষ সার্কাসটা জাতিকে উপহার দিলেন বিরোধী দলীয় নেত্রী বেগম জিয়া ও তাঁর একান্ত পরামর্শদাতা ব্যারিস্টার মওদুদ। গত ৩০ জানুয়ারী বেগম জিয়া যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন টাইমসে স্বনামে একটি প্রবন্ধ লিখে দুনিয়াবাসীকে জানানোর চেষ্টা করেছিলেন শেখ হাসিনা বাংলাদেশটাকে কী ভাবে রসাতলে নিয়ে যাচ্ছে । তিনি যুক্তরাষ্ট্র সহ সব দাতা দেশ ও সহায়তাকারী সংস্থাকে এই বলে পরামর্শ দিলেন শেখ হাসিনার এই সব কর্মকান্ড বন্ধ করতে হলে বাংলাদেশে জিএসপি সুবিধা সহ সব ধরণের সুবিধা বন্ধ করা হোক । তা নিয়ে বিএনপি নেতা নেত্রীদের মাঝে সে সময় ঈদের আমেজ লক্ষ করা গিয়েছিল । ব্যারিষ্টার মওদুদ আর মির্জা ফখরুলতো বলেই ফেললেন ম্যাডামের বক্তব্য পড়ে সরকারি দলের গাত্রদাহ শুরু হয়েছে । ম্যাডাম ছয় মাস পর বললেন, না ওই লেখা আমার নয় । ব্যারিষ্টার সাহেব বললেন কই আমিতো বলিনি সেটি বেগম জিয়ার লেখা ছিল । মঙ্গলবার ওই পত্রিকার নির্বাহী সম্পাদক ডেভিড জ্যাকসন বলেছেন আলবত ওটি বেগম জিয়ার লিখিত । মওদুদকে আমার বেজায় পছন্দ, বিশেষ করে মারাত্মক সুন্দর করে তার অসত্য কথা বলার বিদ্যাটা আর তিনি যখন তা করেন তখন তার হাসিটা অতুলনীয় । নির্বাচন যতই সামনের দিকে যাবে ততই নানা ধরনের সার্কাস জমে উঠবে । বাঙালি খুব বিনোদন প্রিয় জাতি।

লেখক: সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় । জুলাই ৩, ২০১৩

 

 

WARNING: Any unauthorized use or reproduction of 'Community' content is strictly prohibited and constitutes copyright infringement liable to legal action. 

 

[প্রথমপাতা]

 

 

 

লেখকের আগের লেখাঃ