|
হরতাল-অবরোধে মরছে গরীব, ধনীরা নিরাপদে, এই রহস্যের অর্থ কী!
মোঃ মহিউদ্দিন মজুমদার মাসুম
বিত্তবানদের মৃত্যু কামনা করছি, এমনটা ভাববেন না । ধনী-গরীব কোন মানুষেরই
অনাহুত মৃত্যু কাম্য নয় । জীবনের অমোঘ নিয়মে ধনী-গরীব সবাই একদিন মরবেন,
এটাই স্বাভাবিক । কিন্তু ২০-দলীয় জোটের বর্তমান আন্দোলনে বিত্তবৈভবহীন অভাবী
গরীব মানুষরা স্বাভাবিক মৃত্যুর সুযোগটুকু হারিয়েছেন, এই অস্থিরতায় শুধু
গরীবরাই মারা পড়ছেন । গরীব মানুষ যাতায়াতে ব্যবহৃত বাস এবং ট্রাকের
ড্রাইভার হেলফারই পেট্রোল বোমার একমাত্র লক্ষ্যবস্তু । ধনীদের ব্যবহৃত
প্রাইভেটকার, পাজেরো, জিপ গাড়ী এবং নামী-দামী মাইক্রো রাস্তায় নিরাপদে চলছে
। এ ধরনের গাড়ীতে পোট্রোল বোমার আক্রমন নাই বললেই চলে, আহত নিহত হওয়ার
প্রশ্নই আসেনা । তাই স্বভাবতঃই প্রশ্ন জাগে এই গরীবরা কী দোষ করেছে ? তারাতো
এই সংকট তৈরী করেননি । কেন শুধু তাদেরই জীবন যাবে ? স্বাধীন এই দেশটাতে
গরীবদের জীবন কী এতোটাই মূল্যহীন ! তাদের জীবনের বিনিময়ে ক্ষমতা বদলের
নিষ্পুত্তি হতে হবে । এহেন পরিস্থিতি দেখে একটি বাংলা প্রবাদ-প্রবচনের কথা
মনে পড়ল- গরীবের বউ সবার ভাবী অর্থাৎ গরীবের বউকে নিয়ে নির্দ্বিধায়
টিকা-টিপ্পুটি কাটা যায়, দুষ্টুমি করা যায় । মনে হচ্ছে তেমনি গরীবের জীবনকে
নিয়েও রাজপথে হোলিখেলা যায় । গরীবের জীবন, তার আবার কীসের মূল্য ! তাই ধনীক
শ্রেনীর রাজনীতিকদের আন্দোলন সফলতার বলি হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে- গরীবের জীবন
।
বিএনপি-জামাত নেতৃত্বাধীন ২০-দলীয় জোটের কর্মসূচীর অন্তরালে গরীবরা মরছে
অথচ ওনারা এই হত্যাকান্ডের দায়-দায়িত্ব নিচ্ছেন না, অভিযোগের ইংগিত সরকারের
দিকে । আবার সরকারের অভিযোগের তীর বিএনপি-জামাতের দিকে । কেউ স্বীকার করছেন
না, চলছে পাল্টা-পাল্টি অভিযোগ । গরীবের জীবন আজ ঠূয়া খেলার বেড়াজালে পড়েছে
। কিশোর-কিশোরীরা যেমনি আলো-আধারীর আড্ডায় দুষ্টুমির ছলে দু-চার জন বন্ধু
মিলে অন্য বন্ধুকে নাকাল করার নিমিত্তে ঠূয়া মেরে অন্যদিকে তাকিয়ে অস্বীকার
করে মজা নেয় । তেমনি কী মজা নিচ্ছেন আমাদের রাজনীতিকরা ? হত্যা করছেন অথচ
স্বীকার করছেন না, অভিযোগ আর পাল্টা অভিযোগের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখছেন । এ
যেন গরীবের জীবনকে নিয়ে নির্মম ঠূয়া খেলা । বাস্তবতা হচ্ছে- বিএনপি স্বীকার
করুক আর নাইবা করুক, যেহেতু বিএনপির কর্মসূচীর অন্তরালে এহেন ন্যাক্কারজনক
বর্বোরোচিত হত্যাকান্ড ঘটছে, এসবের দায় বিএনপিকে নিতে হবে । অন্যদিকে
জনগনকে নিরাপত্তাদানে ব্যর্থতার দায় সরকারীদলকে নিতে হবে । দুঃখজনক হলেও
সত্য, সরকার কঠোর হস্তে দমন না করে ধীরস্থির গতিতে এগুচ্ছে, আর এতে হতাহতের
সারি দিন-দিন দীর্ঘ হচ্ছে । সরকারের ভাবখানা এমন যাচ্ছেতো গরীবের উপর দিয়ে,
তাতে অসুবিধা কী, আমরাতো নিরাপদে আছি । বরং লাশের সারি লম্বা হলে বিএনপি
নেত্রী খালেদা জিয়াকে বিদেশীদের কাছে জঙ্গী নেত্রীর তকমা লাগিয়ে দেয়া সহজ
হবে । এই দুই দলের কাছে গরীবের জীবন কতটা মূল্যহীন, তা ওনারা চোখে আঙ্গুল
দিয়ে বুঝিয়ে দিচ্ছেন । অথচ এই গরীব জনগন ভুল মোহ বা ভুল আবেগে তাড়িত হয়ে এই
দুই দলের পতাকা তলেই নিজেদের ভবিষ্যত সুখের স্বপ্নবুনেন ।
এই গরীবদের কষ্টের জীবন দীর্ঘায়িত হলে সমাজ-সংসারে দুঃখ-কষ্টের জঞ্জাল
বাড়বে, তাই অল্পতেই মেরে শেষ করে দাও, তা কিন্তু নয় । তাহলে এই টার্গেটেড
হত্যাকান্ডের রহস্য কী ? প্রিন্ট মিডিয়ায় কলামিষ্টদের কলামে এবং ইলেকট্রনিক
মিডিয়ায় টকশোর পন্ডিতরা সত্যিকার চিত্র তুলে ধরছেন না । যার-যার দলীয়
দৃষ্টিভঙ্গিতে চালাচ্ছেন যতসব কুতর্ক, প্রকৃত সত্য অপাংতেয় । লেখক কবি
সাহিত্যিক শিক্ষক বুদ্ধিজীবীরাও তুলনামূলকভাবে নীরব । কেন এই নীরবতা ? নাকী
গরীবের জীবন নিয়ে ভাববার মত অবকাশ ওনাদের নেই, নাকী ভাবছেন আমরাতো নিরাপদ
আছি, দরকার কী মূল্যহীন গরীবী জীবন নিয়ে মূল্যবান সময় নষ্ট করার, নাকী
ওনাদের বিবেক-বুদ্ধি সবই ধনীক শ্রেনীর স্বার্থ সংরক্ষণে দায়বদ্ধ !
পত্র-পত্রিকার খবর ও সম-সাময়িক রাজনৈতিক কর্মকান্ড বিচার-বিশ্লেষনের
মাধ্যমে গনপরিবহনে হামলার কিছু কারন স্পষ্ট । এক) সমাজের বিত্তবান
প্রভাবশালী ব্যবসায়ী, বিভিন্ন মিডিয়ার মালিক হর্তা-কর্তা, সম্পদশালী
বিশিষ্টজন, সরকার এবং বিরোধী দলের নেতা-পাতি নেতা, রাষ্ট্রের আমলা এবং
বিদেশী কূটনৈতিকরা সাধারনতঃ নামী-দামী ব্রান্ডের প্রাইভেট কার, জিপ ও
পাজেরো গাড়ীতে চলাফেরা করেন । ঐ সমস্ত গাড়ীতে হামলা হলে সমাজের এহেন
উঁচুতলার মানুষরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন, আর তাতে উঁচুতলার মিডিয়া মালিক এবং
তথাকথিত সুশীল বুদ্ধিজীবীরা স্ব-জাতির ক্ষতিতে ব্যাপক হায়-হুতাশ, গণসমবেদনা
ও প্রতিবাদী প্রচার-প্রপাগান্ডায় কোমর বেঁধে নেমে পড়বেন । ফলে সরকার কঠোর
ভাবে আন্দোলন দমনে মিডিয়ার আনুকূ#2482;্য পেয়ে যাবে । এতে আন্দোলন ঝুঁকির মধ্যে
পড়বে । আবার ভুলক্রমে বিদেশী কূটনৈতিকের গাড়ীতে হামলা হলেতো বিদেশী
কূটনৈতিকদের কূটনৈতিক তৎপরতা বিপরীতমুখী রুপ ধারন করার সম্ভাবনাও আছে ।
(নিশ্চয় সবার স্মরণে আছে- বিগত আন্দোলনে জামাত-শিবির কর্মীদের হামলায়
আমেরিকান এ্যামবেসীর গাড়ীর সামান্য ক্ষতি হয়, আর জামাত আমেরিকান এ্যামবেসীর
ভয়ে সাথে-সাথে দায় স্বীকার পূর্বক দুঃখ প্রকাশ করেন এবং ক্ষতিপূরণ দানের
অভিপ্রায় ব্যক্ত করেন । অথচ ঐ সময়কার আন্দোলনে হাজার-হাজার গণপরিবহন
পুড়িয়েও ওরা ছিল নির্বিকার ।) তাই প্রাইভেট পরিবহনকে বাদ দিয়ে হামলাটা
এককেন্দ্রিক ভাবে গণপরিবহনের উপরই চলছে এবং নীরবে সাধারন মানুষ পুড়ে মরছে ।
দুই) হামলাকারী দলের নেতা এবং ডোনাররা যেহেতু গণপরিবহন ব্যবহার করেন না,
তাই গণপরিবহনই হামলাকারীদের লক্ষ্যবস্তু । তিন) রাজনীতিতে যুক্ত নয় কিন্তু
অর্থ-বিত্তে প্রভাবশালী এমন ধরনের কোন ব্যক্তির প্রাইভেট পরিবহনে হামলার
ফলে পুড়ে মরলে আইন-শৃংখলা বাহিনী এবং উক্ত সম্পদশালী ব্যক্তির নিজস্ব
পেটুয়া বাহিনীর তৎপরতায় অন্ততঃপক্ষে ঐ দূর্ঘটনাকবলিত এলাকায় আন্দোলনকারীদের
মাঠে থাকা সম্ভব হবে না । তাই আন্দোলনকারীরা প্রাইভেট পরিবহনকে এড়িয়ে যতসব
হামলা গণপরিবহনেই চালাচ্ছেন ।
সর্বোপরি, কাঁকে যেমনি কাঁকের মাংস খায় না, তেমনি ধনীক শ্রেনীর রাজনীতিকরা
ধনীক শ্রেনীর গায়ে আঁচড় কাটছেন না । রাজনীতির যত মার-কাট সবই চলছে গরীবের
জীবন নিয়ে । কারন গরীবের জন্যতো কেউ নড়ে-চড়ে প্রতিবাদে সোচ্চার হবেন না,
থাকবে শুধু এক ধরনের মায়া কান্নার ভাণ এবং ব্লেমগেমের ছলনা । তাই সময় এসেছে
গরীব সাধারন মানুষদের আত্মরক্ষায় তাদের নিজস্ব দল গঠনের অথবা গরীব দরদী দলে
নিজেদের সংযুক্তকরনের ।
লেখকঃ জাপান প্রবাসী।
WARNING:
Any unauthorized use or reproduction of 'Community' content
is strictly prohibited and constitutes copyright infringement liable to
legal action.
[প্রথমপাতা] |
লেখকের আগের লেখাঃ
|