[প্রথমপাতা]

 

 

 

 

 

বাংলাদেশের আভ্যন্তরিণ বিষয়ে তুরস্কের অযাচিত হস্তক্ষেপ

 

 

আবদুল মান্নান

চারজন ‘বিজ্ঞ’ আলোচক একত্রিত হয়েছিলেন একটি বিদেশী রেডিও’র ‘জানালা’ শিরোনামের ঘন্টাব্যাপী একটি টকশোতে অংশ নিতে যেটি আবার গত সোমবার একটি বেসরকারি টিভিতে প্রচার করা হলো । সঞ্চালক এই প্রজন্মের যুবক, কথায় বার্তায় বেশ সাবলিল । সামনে বসা বাছাই করা কয়েকজন দর্শক শ্রোতা । আলোচকদের একজন একটি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, যিনি জামায়াতের রাজনীতির উপর পিএইডি করেছেন । দ্বিতীয়জন একজন পেশাদার প্রকৌশলী, পরিবেশ নিয়ে আন্দোলন করেন, ব্যক্তিগত ভাবে বেশ সজ্জন, তৃতীয়জন বিএনপি হতে নির্বাচিত একজন সংসদ সদস্য এবং শেষের জন ক্ষুদ্র দলের একজন বড় নেতা, যিনি ভাগ্যবলে আবার বর্তমান সরকারের ফাঁকতালের মন্ত্রী । তিনি আবার পূর্বের জোট সরকারের আমলেও জোটে বেশ সমাদৃত ছিলেন । আলোচনার বিষয় মূলতঃ দু’টি, একাত্তোরের যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে অভিযুক্তদের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালে বিচার ও সেই বিচারে তুরস্কের অযাচিত হস্তক্ষেপ এবং অভিযুক্তদের কয়েকজনের পুনঃ বিচারের জামায়াত বিএনপি’র দাবি আর দ্বিতীয় বিষয়টি ছিল বাংলাদেশের প্রস্তাবিত গভীর সমুদ্র বন্দর ।
বলাবাহুল্য অধ্যাপক মহোদয় এবং সংসদ সদস্য জামায়াতের অবস্থানকে সমর্থন করলেন । দু’জনই বললেন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট আবদুল্লাহ গুল বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর কাছে চিঠি লিখে গোলাম আযমসহ অন্য জামায়াত নেতাদের মৃত্যুদন্ড না দেয়ার জন্য অনুরোধ করেছেন তাকে গুরুত্ব দেয়া উচিৎ কারণ ওআইসি’র বর্তমান মহাসচিব তুরস্কের । সংসদ সদস্য মহোদয় আরো জানালেন ওআইসি’র দায়িত্ব হচ্ছে তাদের সদস্য দেশগুলিতে যাথে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয় এবং মানবাধিকার লঙ্ঘিত না হয় সে দিকে নজর রাখা । বলাবাহুল্য তিনি নিজে তার দলের অবস্থানের বাইরে যেতে পারবেন না । অধ্যাপক মহোদয় বিচারের স্বচ্ছতা প্রত্যাশা করেন এবং বেশ জোরালো ভাবে গোলাম আযম গংদের পুনঃ বিচার সমর্থন করেন । প্রকৌশলীর এই ব্যাপারে তেমন কিছু বলার যোগ্যতা ছিলনা । তিনি শুধু বিচার দ্রুত সম্পন্ন করার কথা বললেন । আর মন্ত্রী মহোদয় চোখ বন্ধ করে সরকারের অবস্থানকে সমর্থন করেইে তার দায়িত্ব সারলেন । তিনি আবার কোন কোন মধ্যরাতের টিভি টকশোতে বেশ সমাদৃত যেহেতু বিরোধী দলের পক্ষে অংশগ্রহণকারিরা তাকে বেশ কোনঠাসা করতে পারেন । যারা দর্শক শ্রোতা ছিলেন তাদের যুদ্ধাপরাধ বিষয়ে মন্তব্যর অনেকটা অধ্যাপক আর সংসদ সদস্য মহোদয়ের অবস্থানকে সমর্থন করলো । সব শেষে মনে হলে বর্তমানে একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য যাদের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালে বিচার হচ্ছে তাদের বাঁচানোর এবং এই বিচার বানচাল করার যে একটি দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র চলছে এই সব অনুষ্ঠান তারই একটি সূক্ষ্মভাবে প্রস্তুতকৃত অংশ । ইকনমিষ্টের মতো একটি জগৎ বিখ্যাত সাময়িকী যদি এই ষড়যন্ত্রের খপ্পরে পরতে পারে একটি রেডিওতো কোন ছাড় । জামায়াত তো এই বিচারকে বানচাল করার জন্য দেশে এবং বিদেশে যে কোটি কোটি ডলার খরচ করছে এবং খ্যাতিমান বিদেশী লবিষ্ট নিয়োগ করেছে তারাতো আর বসে নেই । ধরুন বিলেতের খ্যাতিমান ব্যারষ্টার টোবি ক্যাডমেন, পেশায় একজন আইনজীবী । তার কাজ হচ্ছে তার মক্কেলের হয়ে মামলা লড়া অথবা সংশ্লিষ্ট আইনজীবীদের পরামর্শ দেওয়া । তিনি তার সে কাজ বাদ দিয়ে এখন নিজামীর ছেল নাকিবুর রহমান নিজামীকে নিয়ে দেশে দেশে ঘুরে বেড়িয়ে এই বিচারের বিরুদ্ধে জনমত সৃষ্টি করে চলেছেন । ইতোমধ্যে তিনি তার উপর অর্পিত দায়িত্ব পালনে বেশ কিছুটা সফলও হয়েছেন । এই বিষয়ে ‘আরব নিউজে’ তার একটি বেশ বড় সাক্ষাৎকার সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে । গালফ নিউজ খবর দিয়েছে মাস খানেকের মধ্যে বিদেশের বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ ব্যাক্তি, যেমন রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, সংসদ সদস্য বা সিনেটর আবদুল্লাহ গুলের ভাষায় বাংলাদেশ সরকারকে আরো একটা চিঠি লিখবেন । ১৯৫৩ সনে জামায়াতের প্রতিষ্ঠাতা পিতৃপুরুষ আবুল আলা মওদুদী কাদিয়ানীদের অমুসলিম ঘোষণার দাবি তুলে লাহোরে এক ভয়াবহ দাঙ্গা বাদিয়ে প্রায় ২০০০ নিরীহ মানুষ হত্যায় ইন্ধন যুগিয়েছিলেন। পাকিস্তান সরকার সে সময় লাহোরে সামরিক আইন জারি করতে বাধ্য হয় এবং মওদুুদী গ্রেফতার হন । সামরিক আইনে মওদুদীকে মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত করা হয়। তখন জামায়াতের প্রধান পৃষ্ঠপোষক ছিলেন সৌদি আরবের বাদশাহ ইবনে সাউদ কারন মওদুদীর জামায়াত তখন পাকিস্তানে সৌদি আরব ব্র্যান্ডের কট্টর ওয়াহাবী ইসলাম আমদানি করার ঠিকাদারী নিয়েছিলেন । সেবার মওদুদী অনেকটা সৌদি বাদশাহ্র চাপের কারণে পার পেয়ে গিয়েছিলেন । আর সেটি ছিল পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হওয়ার একেবারে প্রাথমিক পর্যায়ে । কিন্তু পরবর্তি কালে যখন পাকিস্তানের সাবেক প্রেসিডেন্ট ভূট্টোর ফাঁসির হুকুম হয় তখন প্রেসিডেন্ট জিয়াউল হকের কাছে অনেক রাষ্ট্রই তার সাজা মওকুফের জন্য চাপ দিয়েছিল । কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি কারণ ততদিনে পাকিস্তান কিছুটা হলেও সাবালক হয়েছে । মওদুদীকে যে ভাবে বাঁচানো গিয়েছিল ঠিক একই কায়দায় বর্তমানে জামায়াতের যে সকল নেতা বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত হয়ে আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে তাদের বাঁচানোর জন্য জামায়াত একই ফন্দি এঁটেছে ।
তুরস্কের প্রেসিডেন্টের আবেদনের ব্যাপারে ইতোমধ্যে বাংলাদেশ তার প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে । তবে একটা কথা মনে রাখা ভাল গোলাম আযম গংদের বিচারের ব্যাপারে বাংলাদেশ যদি একটি ইস্পাত কঠিন দৃঢ় অবস্থান নিতে না পারে পরবর্তি কালে দেখা যাবে জামায়াতের হয়ে আরো অনেক দেশ এবং ব্যক্তি অথবা গোষ্ঠি তুরস্কের প্রেসিডেন্টের মতো বাংলাদেশকে অযাচিত চাপ দিচ্ছে । সরকারের পক্ষে একা এমন শক্ত অবস্থান নেয়া সহজ হবে না যদি না সরকার মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সকল শক্তিকে অন্তত এই একটি কাজে ঐক্যবদ্ধ করতে পারে ।
তুরস্কের এমন একটি আবদারের পিছনে অন্য আরো একটি বড় কারণ আছে আর সেটি হচ্ছে ১৯১৫ সন হতে ১৯২৩ সন পর্যন্ত তুরস্ক কতৃক তাদের অটোমন সা¤্রাজ্যের অন্তভর্’ক্ত আরমেনিয় জনগনের উপর পরিচালিত গণহত্যা, যে গণহত্যায় ধারণা করা হয় পনের থেকে আঠার লক্ষ পর্যন্ত নিরীহ আর্মেনিয় খৃষ্টান ও মুসলমানদের হত্যা করা হয়েছিল । হত্যা ছাড়াও এই মানবতা বিরোধী অপরাধের অন্তর্ভূক্ত ছিল ধর্ষণ, বিপুল আর্মেনিয়কে নিজভূমি হতে উচ্ছেদ, খাদ্য হতে বঞ্চিত করে হত্যা, ব্যপক হারে শিশু হত্যা ইত্যাদি । ‘মানবতাবিরোধী অপরাধ’ শব্দ দুটি প্রথমে বিশ্ব নেতৃবৃন্দ আর্মেনিয় গণহত্যাকে কেন্দ্র করে ১৯১৫ সনে ব্যবহার করেন । এই গণহত্যার প্রধান নায়ক ছিলেন অটোমন খলিফার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী মেহেদী তালাত পাশা যিনি পরবর্তি কালে হিটলারের গণহত্যার নায়ক এডলফ আইখম্যানের গুরু হিসেবে স্বীকৃত হয়েছিলেন । আইখম্যান ষাট লক্ষ ইহুদী ও অন্যান্যদের হত্যার জন্য অভিযুক্ত হয়ে পরবর্তি কালে বিচারের রায়ে ইসরাইলে ফাঁসিতে ঝুলেছিলেন । অটোমান সা¤্রাজ্য ছিল বিশ্বের বৃহত্তম ও সব চেয়ে দীর্ঘস্থায়ি সা¤্রজ্য (প্রায় ছয় শত বছর) । উত্তর আফ্রিকা হতে তা সূদুর পোলান্ড-যুগোশ্লাভিয়া (বলকান অঞ্চল) পর্যন্ত তার বিস্তৃতী ছিল । প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অটোমন খলিফা জার্মানির পক্ষ অবলম্বন করে এবং বৃটেন, ফ্রান্স ও রাশিয়ার যৌথ শক্তির কাছে পরাজিত হয় । পরাজয়ের পর বস্তুত পক্ষে যৌথ শক্তি পুরো অটোমন সা¤্রাজ্য ছাড়াও তুরস্কও দখল করে নেয় যা পরবর্তিকালে মুস্তাফা কামাল আতাতুর্কের নেতৃত্বে স্বাধীন হয়ে প্রজাতন্ত্র হিসেব আভির্ভূত হয় । বহুদিন ধরে তুরস্ক-ইরাক সিমান্তে স্বাধীনতাকামি কুর্দিদের উপর তুরস্ক নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে আসছে । ১৯৯৯ সনে হতে কুর্দি নেতা আবদুল্লাহ ওসলানেকে বিনা বিচারে তুরস্ক আটকে রেখেছে । এই ব্যাপরে যুক্তরাষ্ট্রর ক্লার্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসবিদ অধ্যাপক ওরচেষ্টার এককাম তার এক গবেষণা পত্রের অংশ বিশেষ নিউ ইয়র্ক টাইমস পত্রিকায় (জুলাই ১৯, ২০১২) বলেছেন তুরস্ক মানবাধিকারের নামে যা বলে অথবা করে তা হচ্ছে এক ধরণের ভন্ডামী । বাংলাদেশ এখন ওসলানের মুক্তি দাবি করতে পারে ।
তুরস্ক কখনো আরমেনিয় গণহত্যাকে স্বীকার করেনি এবং বর্তমানে তুরস্কে তালাত পাশার নামে সড়কেরও নামকরণ করা হয়েছে । প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষে হলে তালাত পাশা পালিয়ে জার্মানিতে গোপনে আশ্রয় নেয় এবং ১৯২১ সালে আর্মেনিয় বিপ্লবীরা বার্লিনে তাকে হত্যা করে । বহুদিন যাবৎ তুরস্ক ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য হওয়ার চেষ্টা করছে কিন্তু যে কটি বিষয় তাদেরকে এখনো ইইউ’র বাইরে থাকতে বাধ্য করছে তার অন্যতম হচ্ছে আর্মেনিয় গণহত্যার বিষয়টি স্বীকার করে ক্ষমা না চাওয়া । বাংলাদেশে বর্তমানে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালে যাদের বিচার হচ্ছে তা যদি বাংলাদেশ সফল ভাবে শেষ করতে পারে তা হলে তুরস্কের উপর আর্মেনিয় গণহত্যার জন্য ক্ষমা চাওয়ার বিষয়টা আবারো জোরালো হবে । আসলে বাংলাদেশ একাত্তরের ঘাতকদের ব্যাপারে দীর্ঘ চল্লিশ বছর অনেক বেশী নমনীয়তা প্রদর্শন করেছে । বর্তমানে যেভাবে বিচার চলছে তাও অনেকটা নজির বিহীন । বিশ্বেও কোন গণহত্যা অথবা মানবতাবিরোধী বিচারে বাংলাদেশের মতো আসামীরা এতো সুবিধা পায়নি । এই বিচার বিশ কার্য দিবসের মধ্যে শেষ হওয়া সম্ভব ছিল বলে অনেক আইনজ্ঞ মনে করেন । অথচ এই ঘাতকরা শুধু যে বর্তমানেই এতো সুযোগ সুবিধা পাচ্ছেন তাই নয় রায় তাদের বিপক্ষে গেলে তারা আবার উচ্চ আদালতে আপিল করারও সুযোগ পাবেন ।
দীঘ চল্লিশ বছর একাত্তরের অভিযুক্ত ঘাতকদের বিচার না হওয়ার ফলে বর্তমানে বেশ কিছু মুক্তিযোদ্ধাও তাদের প্রতি সহানুভুুতিশীল হয়ে পড়েছেন । গত ২৮ ডিসেম্বর বিএনপি নেতা এবং একাত্তরের রনাঙ্গনে আহত মুক্তিযোদ্ধা শমসের মুবিন চৌধুরী একটি টিভি চ্যানেলের টকশোতো বেশ জোরালো ভাবে বললেন যুদ্ধাপরাধের বিচার দুই বছরের জন্য স্থগিত করা হোক আর একই অনুষ্ঠানে বিএনপি নেতা ব্যারিস্টার মওদুদ, যিনি একাত্তরে মুজিব নগর সরকারের একজন গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তা ছিলেন, তিনিতো এই বিচার কার্য সরাসরি বাতিলের জন্য জোর দাবি তুললেন । সুতরাং সরকারের উচিৎ হবে যাতে দ্রুত এই বিচরা কাজ শেষ করে তার রায় বাস্তবায়ন হয় তার জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালানো, প্রয়োজনে আরো একটি ট্রাইবুনাল গঠন করা । আর এটি করতে ব্যর্থ হলে হয়তো আগামীতে বাংলাদেশেও গোলাম আযমের নামে সড়কের নাম করণ করতে হবে। সময় দ্রুত ফুরিয়ে আসছে।

লেখক: সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। জানুয়ারী ৩, ২০১২

 

 

WARNING: Any unauthorized use or reproduction of 'Community' content is strictly prohibited and constitutes copyright infringement liable to legal action. 

 

[প্রথমপাতা]

 

 

 

লেখকের আগের লেখাঃ