|
এই সম্মান শেখ হাসিনার
প্রাপ্য ছিল
প্রফেসর আবদুল মান্নান
বাংলাদেশে এক শ্রেণীর মানুষ আর মিডিয়া আছে যারা সব সময় আওয়ামী লীগ বা শেখ
হাসিনার খুঁত ধরতে সদা ব্যস্ত থাকেন । সে দিক দিয়ে বেগম জিয়া আর তার দল বেশ
ভাগ্যবান । ৯২ দিন দেশে পেট্রোল বোমা সন্ত্রাস চালিয়ে বাংলা নববর্ষের দিন
তিনি লাল পারের শাড়ি পরে গুলশান বাসভবনে হাজির হলেন । পেট্রোল বোমা
সন্ত্রাসে প্রায় একশত জন নিরীহ মানুষ মারা গেল । তারপরও বেশ কয়েক জনকে বলতে
শুনেছি যাই বলেন ভাই বেগম জিয়াকে মানিয়েছে বেশ । যারা এই ধরণের মন্তব্য
করেন তার সকলে ব্লাডি সিভিলিয়ান । বেগম জিয়ার ধারে কাছে ঘেঁসার কোন সম্ভাবনা
নেই । অন্য দিকে আমি বেশ কয়েকজনকে জানি যারা শেখ হাসিনার শাড়ীর চয়েসকে
পর্যন্ত ছেড়ে কথা বলেন না । কিন্তু প্রয়োজনে শেখ হাসিনা তাদের
মাতৃস্নেহে বুকে জড়িয়ে ধরেন । বেগম জিয়ার সাথে দলের নেতা কর্মীদের তেমন কোন সম্পর্ক
নেই । অন্যদিকে শেখ হাসিনা দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের নেতা কর্মীদের অনেকেরই
নাম ধরে চেনেন । অনেকটা বাবার মতো । অর্জন তিল পরিমাণের হলেও বিএনপি বা
বেগম জিয়া তা তাল করতে পিছপা হন না । বেগম জিয়া যখন প্রথম দফায় বাংলাদেশের
প্রধানমন্ত্রী তখন তিনি জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে দেয়া তার ভাষণে ভারতের সাথে
গঙ্গার পানি বন্টন সমস্যা নিয়ে সামান্য উল্লেখ করেছিলেন । তাতেই বিমান
বন্দরে হাজার হাজার নেতা কর্মীর সমাবেশ । মনে হচ্ছিল তিনি বিশ্ব জয় করে
ফিরছেন । শেখ হাসিনা সেই গঙ্গা পানিবণ্টন চুক্তি করলেন তাঁর প্রথম মেয়াদে
কিন্তু দল সেই বিশাল অর্জন তা কখনো সঠিক ভাবে প্রচার করতে পারে নি ।
১৯৭৫ সালে শেখ হাসিনা ঘাতকদের হাতে সব কিছু হারিয়ে ১৯৮১ সনের ১৭ই মে আওয়ামী
লীগের সভাপতি হয়ে দেশে ফিরেছিলেন এক বৃষ্টি ভেজা বিকেলে । ঝড় বৃষ্টি উপেক্ষা
করে তেজগাঁ বিমান বন্দরে সেদিন লাখো মানুষের ঢল নেমেছিল । শেখ হাসিনা বিমান
হতে বের হয়ে বলেছিলেন আজ আপনারা ছাড়া আমার কেউ নেই । আমি আপনাদের বোন,
আপনাদের কন্যা । আমার বাবা দেশের মানুষের জন্য তাঁর জীবন উৎসর্গ করেছিলেন ।
আমি নিজেকে আপনাদের সেবার জন্য উৎসর্গ করলাম । শেখ হাসিনা তাঁর কথা
রেখেছিলেন । ১৯৮১ সন হতে ২০১৫ সন । এই দীর্ঘ সময়ে তাঁকে নিরন্তর লড়াই করতে
হয়েছে এক বৈরি পরিবেশের সাথে । মৃত্যুর মুখ হতে বেঁচে এসেছেন কয়েকবার ।
দুবার মৃত্যুকে একেবারে কাছ থেকে দেখেছেন । প্রথমবার ১৯৮৮ সনের ২৪ জানুয়ারি
যখন এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের এক পর্যায়ে তিনি চট্টগ্রামে আসেন তখন । বিনা
উস্কানিতে তাঁকে বহনকারি ট্রাকে পুলিশ গুলি করে । দলের ২৩ জন নেতা কর্মী
তাদের জীবন দিয়ে বঙ্গবন্ধু কন্যাকে রক্ষা করেন । দ্বিতীয়বার ২০০৪ সালে ২১
আগষ্ট । বঙ্গবন্ধু এভেনিউতে দলীয় কার্যালয়ের সামনে যখন তাঁর ট্রাকের উপর ১২
টি আরজেস গ্রেনেড ছোঁড়া হয় তখন । এই সময়েও তাঁকে তাঁর দলীয় নেতা কর্মীরা
নিজেদের জীবন বিপন্ন করে রক্ষা করেন । একটি প্রচলিত ধারণা আছে যে এমন সব
বিপদ হতে যখন কেউ রক্ষা পায় তখন তাঁকে দিয়ে আল্লাহ কোন একটা ভাল কাজ করান ।
শেখ হাসিনাকে দিয়ে আল্লাহ একটি নয় অনেক ভাল কাজ করিয়েছেন এবং তা দেশ এবং
জনগণের জন্য । তাঁর এই সব কাজ ও অর্জনের জন্য তাঁকে জাতীয় নাগরিক কমিটি ২৯
মে, শুক্রবার ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দি উদ্যানে এক বিশাল নাগরিক সংবর্ধনা
জানায় ।
প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শেখ হাসিনার এটি তৃতীয় মেয়াদ । প্রথম মেয়াদ ১৯৯৬-২০০১
সন । এই মেয়াদে তিনি দু’টি বড়মাপের কাজ করেছেন । প্রথমটি সংবিধানের পঞ্চম
সংশোধনী রহিত করে বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বিচার সম্পন্ন করা আর দ্বিতীয়টি
ভারতের সাথে দীর্ঘ মেয়াদি গঙ্গার পানি বন্টন চুক্তি সম্পাদন । মেয়াদ শেষে
২০০১ সালে তিনি অত্যন্ত শান্তি পূর্ণভাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হাতে ক্ষমতা
হস্তান্তর করেন যা বেগম জিয়া করতে সব সময় ব্যর্থ হয়েছেন । ২০০৯-১৩ মেয়াদ
কালে শেখ হাসিনার বড় অর্জন যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করা এবং আদালতের রায়
কার্যকর করা । ২০০৮ এর নির্বাচনের পূর্বে এটি তাঁর দলের অন্যতম অঙ্গিকার
ছিল । তিনি এই সময় বাংলাদেশকে একটি উন্নয়নের রোল মডেলে রূপান্তরিত করতে
পেরেছেন যা এখন আন্তর্জাতিক ভাবে স্বীকৃত । অর্থমন্ত্রী মুহিত সাহেব তা
যথার্থ ভাবেই শেখ হাসিনা মডেল বলে আখ্যায়িত করেছেন । পদ্মা সেতুতে
বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন নিয়ে কত যে নাটক । এক শ্রেণীর মিডিয়াতো শেখ হাসিনার
পুরো সরকারকেই চোর বানিয়ে ফেলল । একজন বর্ষিয়ান সাংবাদিক টিভিতে গিয়ে এলান
করলেন আওয়ামী লীগের কাউকে দেখলেই যেন সকলে বলে ‘তুই চোর’ । যখন শেখ হাসিনা
ঘোষণা দিলেন বিশ্বব্যাংকের বা অন্য কারো সহায়তা ছাড়া নিজস্ব অর্থায়নেই পদ্মা
সেতু করা হবে তখন সেই সাংবাদিক অট্টহাসি দিয়ে বললেন শেখ হাসিনা পদ্মা সেতুকে
বাঁশের সাঁকোর সাথে গুলিয়ে ফেলেছেন । সেদিন গোপালগঞ্জ হতে ঢাকায় ফিরতে গিয়ে
দেখি সেই পদ্মা সেতুর কাজ দ্রুত এগিয়ে চলছে । সেই বর্ষিয়ান সাংবাদিক
বর্তমানে প্রয়াত । বেঁচে থাকলে কী বলতেন জানি না । বাংলাদেশ এখন বিশ্বে
চতুর্থ বৃহৎ চাল উৎপাদনকারি দেশ । একটি খাদ্য ঘাটতির দেশ হতে খাদ্য
উদ্বৃত্তের দেশ । রপ্তানি করছে কখনো কখনো । যে দেশ নিজের খাদ্য নিজেই
উৎপাদন করতে পারে তার চেয়ে সুখি দেশ আর হতে পারে না । এটিতো সম্ভব হয়েছে
শেখ হাসিনা সরকারের কৃষি নীতির ফলে । গত ছয় বছরে দেশে দারিদ্র কমেছে ৩১% ।
নতুন নতুন কর্ম সৃষ্টি এর প্রধান কারণ । চালের দাম ত্রিশ হতে চল্লিশ টাকা
হলেও মানুষ ভুখা মিছিল বের করে না । মানুষের ক্রয় ক্ষমতা বেড়েছে । কৃষি
ক্ষেতে এখন মজুরি ছয় বছর আগের তুলনায় চারগুণ বেশী । বিশ্বমন্দার সময়েও
বাংলাদেশ শ্রীলংকার পর দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় প্রবৃদ্ধির হার ৬% এর উপরে রাখতে
পেরেছে । ১৯৭২ সনে বাংলাদেশের প্রথম বাজেটের আকার ছিল ৭২৫ কোটি টাকা ।
আসন্ন বাজেট ৩ লাখ ৩৭০ কোটি টাকা হবে বালে ধারণা করা হচ্ছে । বিশ্বের বাঘা
বাঘা অর্থনীতিবিদরা মাথা চুলকে বলেন বাংলাদেশ এক রহস্যময় অর্থনীতির দেশ বটে।
বছরের প্রথম দিনে স্কুল পড়–য়াদের হাতে ৩২ কোটি পাঠ্যপুস্তক পৌঁছে দেয়া সহজ
কথা নয় । শেখ হাসিনার সরকার তা করে বিশ্ব রেকর্ড করতে সক্ষম হয়েছে । এর ফলে
দেশে এখন অক্ষরজ্ঞান সম্পন্ন মানুষের সংখ্যা ৭১%। এর কৃতিত্বতো শেখ হাসিনা
সরকারকে দিতেই হয় । তাঁর এই দফার শাসনামলে এই অঞ্চলের প্রায় সকল দেশের সাথে
দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের উন্নতি হয়েছে । ভারতের সাথে সীমান্ত চুক্তি ও ছিটমহল
বিনিময় বাস্তবায়ন, জঙ্গিবাদ নিমূর্ল এই সব অর্জন শেখ হাসিনার সরকার না থাকলে
কী হতো? ১৯৭৪ সালে মুজিব ইন্দিরা চুক্তির ফলে ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে
সীমান্ত চিহ্নিত করণ ও ছিট মহল বিনিময় সম্পাদন হওয়ার কথা । কূটনৈতিক
তৎপরতার অভাবের ফলে তা এত দিন হয় নি । সম্প্রতি ভারতের রাজ্য সভা ও লোক
সভায় তা সর্বসম্মত ভাবে গৃহীত হয়েছে । সেই ১৯৪৭ সন হতে যে হাজার হাজার
ছিটমহলবাসি অনেকটা রাষ্ট্রহীন নাগরিকের মর্যাদায় ছিলেন তারা এখন নিজ দেশের
নাগরিকত্ব পেলেন । মায়ানামার ও ভারতের সাথে বাংলাদেশের সমুদ্র সীমানা নিয়ে
বিভাদ বহু পূরানো । সেই বিভাদ আন্তর্জাতিক আদালতের মাধ্যমে শেখ হাসিনারা
আগের সরকার মিমাংসা করে তাঁর ক’টনৈতিক সফলতার স্বাক্ষর রেখেছেন । এক সময়
বাংলাদেশ বিশে^ও অনেক দেশই শেখ মুজিবের দেশ হিসেবে চিনত । এখন চেনে একটি
উদিয়মান অর্থনীতির দেশ হিসেবে এবং স্বীকার করে এর সিংহভাগ কৃতিত্ব শেখ
হাসিনার সরকারের । যদি বলি শেখ হাসিনা দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার অনত্যম সফল
প্রধানমন্ত্রী তা হলে অনেকেই বেজার হবেন । তারপরও সত্যটাতো বলতেই হবে । শেখ
হাসিনার শাড়ীর ডিজাইন নিয়ে যারা সমালোচনা করেন তারা এ নিয়ে চিন্তা করতে
পারেন ।
২৯ তরিখে শেখ হাসিনাকে দেয়া সংবর্ধনায় বক্তারা বেশ জোর দিয়ে তাঁর শাসনামলে
বাংলাদেশের এত সব অর্জনের প্রশংসাই শুধু করেন নি তারা এও বলেছেন ২০২১ সালে
যখন বাংলাদেশ তার স্বাধীনতার সূবর্ণ জয়ন্তি পালন করবে তখনো তিনি ক্ষমতায়
আছেন তা তারা প্রত্যাশা করেন । জবাবে শেখ হাসিনা বলেন তাঁর এই সব অর্জনের
ভাগিদার এদেশের জনগণ । তিনি সে দিনের সংবর্ধনা জনগনের জন্য উৎসর্গ করেছিলেন
। বলেন তিনি জনগণের জন্য রাজনীতি করেন, নিজের জন্য নয় । ক্ষমতা তাঁর কাছে
মূখ্য নয় জনগণের সেবাই মূখ্য । সব সময় বলেন তাঁর চাওয়া পাওয়ার কিছু নেই ।
তিনি জনগণকে কিছু দেয়ার চেষ্টা করেন । বন্ধুবর ডঃ মুনতাসীর মামুন যথার্থই
বলেছেন শেখ হাসিনার সরকার বা তাঁর কাজের নেতিবাচক প্রচার করতে এক ধরণের
মিডিয়া ও সুশীল সমাজ সদা প্রস্তুত থাকেন । সমালোচনা ভাল । তবে সমালোচনার
জন্য সমালোচনা অনভিপ্রেত । নেতিবাচক প্রচারের সাথে সাথে ইতিবাচক প্রচার না
করলে সেই প্রচারে বস্তুনিষ্ঠতা থাকে না । ২৯ তারিখের নাগরিক সংবর্ধনা শেখ
হাসিনা অর্জন করেছেন । জাতীয় নাগরিক কমিটি তাঁকে সেই সংবর্ধনা দিয়ে একটি
জাতীয় দায়িত্ব পালন করেছে । তাদের ধন্যবাদ । শেখ হাসিনাকে তাঁর সকল অর্জনের
জন্য অভিবাদন ।
লেখক: বিশ্লেষক ও গবেষক । মে ৩০, ২০১৫
WARNING:
Any unauthorized use or reproduction of 'Community' content
is strictly prohibited and constitutes copyright infringement liable to
legal action.
[প্রথমপাতা] |
লেখকের আগের লেখাঃ
[......লেখক আর্কাইভ]
|