প্রথমপাতা  

সাম্প্রতিক সংবাদ 

 স্বদেশ

আন্তর্জাতিক

বাংলাদেশ কমিউনিটি

লাইফ স্টাইল

এক্সক্লুসিভ

বিনোদন

স্বাস্থ্য

বর্তমানের কথামালা

 শিল্প-সাহিত্য

 প্রবাসপঞ্জী 

আর্কাইভ

যোগাযোগ

 

 

 

 

 

 

 

জমজমাট নাটক ‘সালাউদ্দিন দি গ্রেট’

 


প্রফেসর আবদুল মান্নান

 

বিএনপি’র যুগ্ম মহাসচিব সালাহউদ্দিন আহমেদের প্রায় দীর্ঘ দু‘মাস পূর্বে হঠাৎ অন্তর্ধান, পরবর্তিকালে তাকে ঘিরে অনেক নাটকীয়তা, স্বাভাবিক ভাবে তার স্ত্রীর উদ্বিগ্ন চিত্তে দৌঁড়ঝাঁপের অভিনয়, তার দলের পক্ষ হতে সালাহউদ্দিনের অন্তর্ধান নিয়ে সরকারকে দোষারোপ করে নানা বক্তব্য বিবৃতি, পাল্টা আইনপ্রয়োগকারি সংস্থার বিভিন্ন শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সালাহউদ্দিনের অন্তর্ধানে তাদের কোন রকম জড়িত থাকার ব্যাপারে স্পষ্ট ভাষায় অস্বীকার, সর্বশেষ গত মঙ্গলবার হঠাৎ করে ভারতে মেঘালয় রাজ্যের শিলংএ তার আবির্ভাব ও স্থানীয় পুলিশের হাতে আটক, সব কিছু মিলিয়ে একেবারে জমজমাট নাটক । নাটকের নাম হতে পাওে ‘সালাহউদ্দিন দি গ্রেট’। একেবারে ফাটাফাটি । নাটকের বাড়তি আকর্ষণ হচ্ছে আটকের সময় তিনি বেশ পরিপাটি ছিলেন । মুখে সামান্য দাড়ি ছিল যা বড় জোর একদিন পুরানো হতে পারে । পায়ে ছিল জুতা । গায়ে একটি বাহারি শাল, চোখের দামি চশমাটাও ঠিক ছিল । ১৩ মে‘র আসাম বার্তা সংবাদ দিচ্ছে আটকের সময় সালাহউদ্দিনের পকেটে ৫৭ হাজার ভারতীয় রূপী পাওয়া যায় । তার কথাবার্তায় তেমন কোন অসংলগ্নতা ছিল না । পুলিশের কাছে দাবি করেছেন তিনি এক সময় বাংলাদেশের মন্ত্রী ছিলেন । তা শুনে পুলিশ মনে করলো বুঝি ভদ্রলোক অপ্রকৃতস্থ । মাথা খারাপ হলে মানুষ নিজেকে রাজা উজির মনে করে । মন্ত্রীতো কোন নচ্ছাড় । তাকে নিয়ে যাওয়া হলো স্থানীয় একটি মানসিক হাসপাতালে । হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ পরীক্ষা নিরীক্ষা করে জানিয়ে দিল, না, ভদ্রলোকের মাথায় কোন গন্ডগোল নেই । গায়ে কোন আঘাতের চিহ্নও নেই । তাদের ধারণা আরো বদ্ধমূল হলো যখন তিনি তার স্ত্রী হাসিনা আহমেদের টেলিফোন নাম্বারটি বলতে পেরেছেন এবং তাকে বাংলাদেশে ফোন করে বলেছেন তিনি ভাল আছেন এবং সুস্থ আছেন । এমন লোকের মাথায় গন্ডগোল থাকার কোন কারণ থাকতে পারে না । তিনি বর্তমানে একটি সিভিল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন । স্বামীর সাথে কথা বলে সালাহউদ্দিনের স্ত্রী ছুঠে যান বেগম জিয়ার বাস ভবনে । সেখানে নাকি বেগম জিয়ার ব্যক্তিগত ষ্টাফ এ্যাডভোকেট শিমুল বিশ্বাসের সাথে তার বেশ বচসা হয় কারণ হাসিনা আহমেদ শিমুল বিশ্বাসকে বলেছেন তার স্বামী তাদের নির্দেশেই দেশ ত্যাগ করেছিলেন। বিএনপি’র অনেক শীর্ষ স্থানীয় নেতা আড়ালে আবডালে বলে বেড়ান বর্তমানে বিএনপি চালান শিমুল বিশ্বাস, ল-নে পলাতক তারেক রহমানের নির্দেশে ।
সালাহউদ্দিন আহমেদের সংবাদ পড়তে গিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রখ্যাত শ্রমিক নেতা জিমি হফ্ফার কথা মনে পরলো । জিমি হফ্ফাকে এই দেশের মানুষ তেমন একটা চেনার কথা নয় । হফ্ফা পঞ্চাশের দশক হতে শ্রমিক নেতা হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রে বেশ ক’খ্যাতি অর্জন করে । ষাটের দশকের মাঝামাঝি এসে হফ্ফা যুক্তরাষ্ট্রের আনুমানিক পনের লক্ষ শ্রমিকের নেতা বনে যান । তার বিরুদ্ধে ফেডারেল আইন ভঙ্গ করার দায়ে অনেক গুলি মামলা হয় । ১৯৬৭ সনে হফ্ফা গ্রেফতার হন এবং আদালত তাকে ১৩ বছরের কারাদন্ডে দন্ডিত করেন । হফ্ফা আর শ্রমিক রাজনীতির সাথে জড়িত হবে না এই শর্তে নিক্সন তার দ- মউকুফ করেন । কিন্তু হফ্ফার তা পছন্দ হলো না কারণ যুক্তরাষ্ট্রে ইউনিয়ন নেতারা খুবই ক্ষমতাশালী হয়ে থাকেন এবং বে-আইনী ভাবে বিশাল অর্থ বিত্তের মালিক বনে যান । সেই দেশে দ্রুত কোটিপতি হওয়ার সহজ উপায় হচ্ছে শ্রমিক নেতা হাওয়া । সেই জিমি হফ্ফাকে ১৯৭৫ সালের জুলাই মাসে ডেট্রোয়েটের একটি কফি শপের সামনে শেষ বারের মতো দেখা গিয়েছিল । তার পর হতে হফ্ফা নিখোঁজ । বাংলাদেশের রাজনীতির ভাষায় গুম । এখনো তার কোন খোঁজ নেই । অন্যদিকে বাংলাদেশে শ্রমিক নেতা আমিনুল ইসলামের নিহত হওয়াকে কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্রের সে কী দৌঁড়ঝাপ । কে হফ্ফাকে গুম করলো আজতক তা রহস্যাবৃত । একসময় হফ্ফার সাথে যুক্তরাষ্ট্রে সংঘটিত অপরাধী সংগঠন মাফিয়ার সাথে সম্পর্ক ছিল । ধারণা করা হয় তাদের সাথে লেনদেনের মতপার্থক্য হওয়াতে মাফিয়াই তাকে গুম করতে পারে ।
সালাহউদ্দিন ও তার পরিবারের ভাগ্য ভাল তাকে হফ্ফার ভাগ্য বরণ করতে হয় নি । প্রায় দু’মাস রহস্যজনক ভাবে নিরুদ্দেশ থাকার পর তিনি স্বশরীরে আবির্ভূত হয়েছেন, তাও আবার ভিন দেশে, কোন বৈধ কাগজ পত্র ছাড়া । বেগম জিয়া প্রথম মেয়াদে ক্ষমতায় থাকার সময় সালাহউদ্দিন তার এপিএস ছিলেন । দক্ষিণ চট্টগ্রামের চকরিয়ায় তার বাড়ী । স্থানীয়রা তাকে গরম মিয়া বলে চেনেন । অনেকে চেনেন এপিএস সালাহউদ্দিন হিসেবে । ছাত্র হিসেবে মেধাবী ছিলেন । পরবর্তিকালে রাজনীতিতে এসে তিনি বেগম জিয়ার ক্যাবিনেটে যোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী হয়েছেন । তখন হতে তার অধঃপতন শুরু । স্ত্রী হাসিনা আহমেদও সংসদ সদস্য হয়েছিলেন । ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির সংসদ নির্বাচনের বর্ষপূর্তির পর বিএনপি-জামায়াত মিলে দেশে যে প্রাণহরণকারি পেট্রোল বোমা সংষ্কৃতির আমদানি করলো প্রথমে তার হুকুমদাতা ছিলেন রিজভী আহমেদ । তিনি গ্রেফতার হলে পরে একেবারে বিন লাদেন কায়দায় গোপন আস্তানা হতে প্রথমে ভিডিও টেপ আর পরে বিবৃতির মাধ্যমে এই কাজটি চালিয়ে যেতেন সালাহউদ্দিন আহমেদ । এখন শোনা যাচ্ছে শেষের দিকে তার সই কাটপিস করে বিবৃতি পাঠানো হতো । তিনি আগেই দেশ ত্যাগ করেছিলেন । এই পেট্রোল বোমার আঘাতে নির্মমভাবে মৃত্যুবরণ করেছেন প্রায় একশত নিরীহ মানুষ আর শরীর ঝলসে গিয়ে হাসপাতাল গুলির বার্ণ ইউনিটে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়েছেন আরো শ’দুএক । বাদ যায়নি দু’বছরের মাসুম বাচ্চা অথবা অন্তঃসত্ত্বা মহিলা । পরে জানা গেল সালাহউদ্দিন এই মানুষ হত্যার নির্দেশ দিচ্ছিলেন উত্তরার এক বাসা হতে । সেই বাসা দক্ষিণ চট্টগ্রামের এক ব্যবসায়ীর দ্বিতীয় স্ত্রীর । তারপর একদিন তার স্ত্রী হাসিনা আহমেদ সাংবাদিকদের জানালেন ২৪ ঘন্টা আগে তার স্বামী নিখোঁজ হয়েছেন । এই দীর্ঘ ২৪ ঘন্টা তিনি কেন নীরব ছিলেন সেই প্রশ্নতো উঠতেই পারে ।
হাসিনা আহমেদ তার স্বামীর নিখোঁজ হওয়ার সংবাদটি জানিয়ে চারিদিকে বেশ হৈচৈ ফেলে দিলেন । নানা জনের নানা মত আর তত্ত্ব । কেউ বললেন বেগম জিয়া পেট্রোল বোমা সন্ত্রাস পরিচালনার জন্য তার অফিস কাম রেসিডেন্সে যে কমান্ড পোষ্ট খুলেছেন সেখানে সালাহউদ্দিন আশ্রয় নিয়েছেন । বিএনপি জানিয়ে দিল সালাহউদ্দিনকে সরকারের বিশেষ বাহিনী গুম করেছে । দু’একজন সুনির্দিষ্ট ভাবে বললেন র‌্যাবই সালাহউদ্দিনকে আটকে রেখেছে । মাঠ গরম করতে নেমে গেল কিছু মানবাধিকার নামধারী সংস্থা, যেমন ‘অধিকার’ । তারা বললো সালাহউদ্দিনের গুম হওয়া কোন অবস্থাতে মেনে নেয়া যাবে না । যখন দেশে পেট্রোল বোমা সন্ত্রাস চলছিল তখন কিন্তু এরা চুপচাপ । সরকার সাফ জানিয়ে দিল তাদের কাছে সালাহউদ্দিন নামের কেউ আটক নেই । সালাহউদ্দিন বিষয়ক আলোচনা যখন তুঙ্গে তখন তার ভারতের মেঘালয়ে আচমকা আবির্ভাব বেশ নাটকীয়ই বটে ।
সালাহউদ্দিন মেঘালয়ের শিলং শহরে আটক হওয়ার পর বললেন তাকে কারা সেখানে নিয়ে গিয়েছেন তা তিনি জানেন না । জানালেন যারা তাকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল তারা সব সময় তার চোখ বেঁধে রেখেছিল যার কারণে তিনি তাদের কাউকে চিনতে পারেন নি । তাকে একটি লাল মারুতি গাড়ী হতে কেউ একজন নামিয়ে দিয়ে গেছে । চোখ বাঁধা থাকলে তিনি সেভ করলেন কী ভাবে ? গাড়ীর রং এর বর্ণনাও বা কী ভাবে এলো ? বা চশমাটাও কোথা হতে জোগাড় হলো ? জুতা জোড়া অথবা বাহারি শাল ? তার চেহারার জেল্লাও খুব একটা কমেনি । কেউ কেউ বলছেন তিনি আসলে তার সহযোগীদের মাধ্যমে প্রথমে আসামে যান । সেখানে তিনি বেগম জিয়ার এককালিন রাজনৈতিক উপদেষ্টা হারিছ চৌধুরীর সাথে যোগাযোগ করে তার সহায়তা চান । কিন্তু হারিছ চৌধুরী তাকে কোন প্রকারের সহায়তা করতে অস্বীকার করেন । এরপর তিনি সেখান হতে নেপাল হয়ে চীন যাওয়ার পরিকল্পনা করেন । কিন্তু সাম্প্রতিক কালে নেপালের ভয়াবহ ভূমিকম্প তার সব পরিকল্পনা ভেস্তে দেয় । যাদের সাথে তিনি ভারতে পরে নেপাল প্রবেশ করেছিলেন তারাও তাকে পরিত্যাগ করে উধাও হয়ে যায় । এরপর তিনি পুনরায় নেপাল হতে ভারতে প্রবেশ করেন । তারপর পুলিশের হাতে গ্রেফতার । তার পরিবার বলছে তাকে দেশে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করা হবে । তা সহজ নাও হতে পারে । তিনি বিনা পাসপোর্টে ভারতে প্রবেশ করেছেন । সেই দেশের আইনে তিনি একজন অনুপ্রবেশ কারী । তার জন্য মেঘালয়ের আদালতে তার বিচার হওয়ার কথা । বিচার শেষে তার কারাদন্ড হলে তা ভোগ করে বাংলাদেশে তাকে ফেরত দেয়া হবে । তারপর নিরীহ মানুষ হত্যার নির্দেশ দানের দায়ে তার এই দেশের আদালতে বিচার হবে । এই সবের অর্থ হচ্ছে সালাহউদ্দিন আহমেদ ওরফে গরম মিয়ার গরম কাল দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার সম্ভাবনা বেশী । অন্যদিকে তার নামে ইন্টার পোলে গ্রেফতারি পরওয়ানা জারি হয়েছে । বেশী চালাকি করতে গিয়ে ফেঁসে গেলেন সালাহউদ্দিন ।
ইলিয়াস আলী আর চৌধুরী আলম নামের আরো দু’জন বিএনপি নেতা দীর্ঘ দিন ধরে সালাহউদ্দিন কায়দায় নিখোঁজ । এক এগারর পর কোন খবর নেই হারিস চৌধুরীর । কেউ অবশ্য তার কোন খোঁজ নেয় না । এক অদ্ভুত দল বিএনপি । আগামীতে এই তিনজনের যদি হঠাৎ সালাহউদ্দিন ষ্টাইলে আবির্ভাব হয় তখন কী হবে তা ভাবনার বিষয় । আর এতদিন বিএনপি পন্থি বুদ্ধিজীবী আর সাংবাদিকরা গলা ফাটিয়ে টিভির পর্দা কঁপানেরা চেষ্টা করতেন তারাও বা কী বলবেন ? অধ্যাপক এমাজউদ্দিন এই ব্যাপারে কী বলেন তা জানার ইচ্ছা রইলো । তিনিতো আবার আগামীতে বিএনপি ক্ষমতায় এলে রাষ্ট্রপতি হওয়ার স্বপ্ন দেখেন । তবে সব কথার শেষ কথা হচ্ছে সব জল্পনা কল্পান ও দোষারোপের অবসান ঘটিয়ে সালাহউদ্দিনকে জীবিত ও অক্ষত অবস্থায় পাওয়া গেছে । এটি অস্বীকার করার উপায় নেই যে সলাহউদ্দিন উপাখ্যানে বিএনপি বড় ধরণের ক্ষতি হয়ে গেল ।

লেখক: গবেষক ও বিশ্লেষক । মে ১৫, ২০১৫

 

 

 

WARNING: Any unauthorized use or reproduction of 'Community' content is strictly prohibited and constitutes copyright infringement liable to legal action. 

 

[প্রথমপাতা]

 

 

 

লেখকের আগের লেখাঃ

[......লেখক আর্কাইভ]