|
পিতার অসমাপ্ত কাজ শেষ
করলেন কন্যা
প্রফেসর আবদুল মান্নান
কাজটি শুরু করেছিলেন একজন পিতা সেই ৪১ বছর আগে, ১৯৭৪ সনে । জাতির দূর্ভাগ্য
তিনি কাজটির শেষ দেখে যেতে পারেন নি । তিনি শুধু তাঁর সন্তানদের পিতাই নন
বরং তিনি বাঙালি জাতির পিতা শেখ মুজিব । বাংলার মানুষ দেশের জন্য তাঁর
ত্যাগের স্বীকৃতি স্বরূপ তাঁকে বঙ্গবন্ধু উপাধিতে ভূষিত করেছিল । সেই
বঙ্গবন্ধু ১৯৭৪ সালে দিল্লিতে রাষ্ট্রীয় সফরের সময় ভারতের প্রধানমন্ত্রী
ইন্দিরা গান্ধীর সাথে দুই দেশের মধ্যে বিরাজমান সীমান্ত সংক্রান্ত সমস্যা
নিরসন কল্পে একটি চুক্তি করেছিলেন যাতে বলা হয়েছিল এক দেশের ভিতর যে অন্য
দেশের ছিটমহল আছে তার একটি স্থায়ী সমাধান হওয়া উচিত । এই ছিটমহল জনিত সমস্যা
সৃষ্টি করে গিয়েছিলেন ইংরেজ সাহেব সিরিলি রেডক্লিফ সেই ১৯৪৭ সনে দেশ
বিভাগের সময় । তাকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল ভার বর্ষকে ফালি ফালি করে দেয়ার ।
তা নির্দয় ভাবে করেছিলেন । রেডক্লিফ কখনো বোঝার চেষ্টা করেন নি তিনি যে
হাজার বছরের শ্বাসত বাংলাকে পাকিস্তান আর ভারতের মধ্যে ভাগ করছেন তাতে
বাঙালিদের কী কী মানবিক বিপর্যয় ঘটতে পারে । ঠিক তাই ঘটেছিল । শুধু পরিবারই
বিভক্ত হয় নি এক দেশের স্থল ভূমি অন্যদেশে রয়ে গিয়েছিল । এর ফলে সেই ১৯৪৭
সন হতে এই ভূমি বা ছিট মহলের বাসিন্দারা মানবেতর জীবন যাপন করছিল । তারা
যেন নিজে দেশ পরাবাসী । তাদের পক্ষে এই দীর্ঘ সময় ধরে স্বাভাবিক জীবন যাত্রা
বজায় রাখা সম্ভব ছিল না । শিক্ষা স্বাস্থ্যের মৌলিক চাহিদা হতে তারা ১৯৪৭
সন হতে বঞ্চিত ছিল । দেশ ভাগ হওয়ার পর পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী মালিক
ফিরোজ খান নুন আর ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু এক বৈঠকে এই সমস্যার
একটি বাস্তবমূখী সমাধানের অঙ্গিকার করেছিলেন কিন্তু তার কাজ আর বেশী দূর
এগোয়নি । ১৯৭৪ সনে বঙ্গবন্ধু আর ইন্দিরা গান্ধী এই চুক্তিতে আবদ্ধ হয়েছিলেন
যে নুন-নেহেরুর চুক্তির ধারাবাহিকতায় দুই দেশের মধ্যে এই ছিটমহল জনিত
সমস্যার তড়িত সমাধান প্রয়োজন । যেহেতু বিষয়টি জমির অদল বদল সংক্রান্ত সেহেতু
এই ধরণের চুক্তি বাস্তাবয়নে সংবিধানের বাধ্যবাদকতার কারণে সংসদে তা পাশ
করিয়ে নিতে হয় । বাংলাদেশ কোন সময় নষ্ট না করে বিষয়টি আমাদের জাতীয় সংসদেই
নিষ্পত্তি করে বেরুবাড়ি আর আঙ্গুরপোতা ভারতের কাছে হস্তান্তর করে । এটি
বঙ্গবন্ধুর উদারতার পরিচয় । কিন্তু ভারত এই দীর্ঘ সময় ধরে তা করতে ব্যর্থ
হয় । এই চুক্তি সম্পাদন হওয়ার পরই বঙ্গবন্ধু আর ইন্দিরা গান্ধি ঘাতকদের হাতে
নিহত হন । তারপর দীর্ঘ বিরতি ।
২০০৯ সনে সরকার গঠনের পর শেখ হাসিনা চেষ্টা শুরু করেন দু’দেশের মধ্যে
অমীমাংসিত সমস্যা গুলি সমাধানের, যার মধ্যে এই ছিটমহল বিনিময় সমস্যা গুলি
অন্যতম । শুরুতে কিছুটা সুবিধা ছিল কারণ ভারতের কেন্দ্রে ছিল কংগ্রেস
নেতৃত্বাধীন ইউপিএ সরকার আর পশ্চিম বঙ্গে বাম ফ্রন্ট । ঐতিহাসিক ভাবে
কংগ্রেস এবং বাম ফ্রন্টকে আওয়ামী লীগ ঘনিষ্ট হিসেবে দেখা হয় । কিন্তু
বিধিবাম, ২০১০ সালের পশ্চিম বঙ্গের নির্বাচনে বাম ফ্রন্টের ভরাডুবি ঘটে এবং
মমতা বন্দোপাধ্যায় নেতৃত্বাধীন তৃণমূল কংগ্রেস বিজয় লাভ করে । তারপর ভারতের
তৎকালিন প্রধানমন্ত্রী চেষ্টা করেছিলেন দুটি প্রধান সমস্যার সমাধান করার
কিন্তু কেন্দ্রে ইউপিএ সরকার হতে তৃণমূল ও সিপিএম ইতোপূর্বে তাদের সমর্থন
প্রত্যাহার করে নিলে কেন্দ্র সরকারও নড়বড়ে হয়ে পরে । দুদেশের মধ্যে
বিরাজমান সমস্যা সমাধানের বিষয়টা অনেকটা হিমাগারে চলে যায় । তারপরও ভারতের
কেন্দ্র সরকার চেষ্টা করেছিল অমীমাংসিত বিষয় গুলির সমাধান করতে, যার মধ্যে
ছিল এই ছিটমহল বিনিময় জনিত সমস্যা আর তিস্তার পানি বন্টন । বাংলাদেশ লাগোয়া
ভারতের অন্যান্য রাজ্য গুলি এই সমস্যা গুলির দ্রুত সমাধান প্রত্যাশা করলেও
বাধ সাধেন পশ্চিম বঙ্গের মূখ্যমন্ত্রী মমতা বন্ধোপাধ্যায় । তিনি ঘোষণা করেন
এই চুক্তি গুলি বাস্তবায়ন হলে তার রাজ্য ক্ষতিগ্রস্থ হবে । একটি সস্তা
রাজনৈতিক চাল । এমনি কী ২০১১ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ডঃ মনমোহন সিং
বাংলাদেশ সফরে এলে শেষ মুহূর্তে মমতা তাঁর সফর সঙ্গী হতে অস্বীকার করেন ।
সেই যাত্রায় বহু প্রত্যাশিত এই দুটি সমস্যা নিয়ে আর কোন অগ্রগতি হয় নি ।
২০১৪ সালের লোক সভা নির্বাচনে কংগ্রেসের ভরাডুবি হয়ে বিজেপি ক্ষমতায় এসে
নরেন্দ্র মোদি সরকার গঠন করলে পুরো বিষয়টা নিয়ে এক চরম অনিশ্চয়তা দেখা দেয়
। বিজেপিকে একটি হিন্দুত্ববাদি দল হিসেবে দেখা হয় এবং মনে করা হয়েছিল যেহেতু
আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার কংগ্রেসের বন্ধু ছিল সেহেতু বিজেপি আওয়ামী
লীগের শত্রু হিসেবে আবির্ভূত হবে । এতে বাংলাদেশের আওয়ামী লীগ বিরোধী মহল
বেশ উৎফুল্লই হয়েছিল । কিন্তু গত দু’বছরের কার্যকলাপে নরেন্দ্র মোদি প্রমাণ
করেছেন তিনি জাত রাজনীতিবিদ । দলের উর্ধ্বে উঠে দেশের স্বার্থকে বড় করে
দেখতে জানেন । উপলব্দি করেছেন ভারত এখন আর ষাটের দশকে নেই । দেশটি এখন একটি
উদীয়মান পরাশক্তি । জাতিসংঘে স্থায়ী পদের জন্য চেষ্টা করছে । তার জন্য এই
অঞ্চলের সব দেশেরই সমর্থন চাই । যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি বারাক ওবামা
এলেন ভারতে । দীর্ঘ দিন ধরে চলে আসা দুদেশের মধ্যে বিরাজমান শীতল সম্পর্ক
উষ্ণ হলো । মোদি ক’দিন পর যাবেন চীনে । বললেন বাংলাদেশে আসছি তবে খালি হাতে
নয় । কিছু সমস্যার সমাধানতো করতেই হবে । মমতাকে নানা কৌশলে বাগে আনলেন ।
ইতোমধ্যে বাংলাদেশের সাথে দীর্ঘ দিনের অমীমাংসিত সমূদ্র সীমা চিহ্নিত করণ
সমস্যাটি আন্তর্জাতিক আদালতের মাধ্যমে সমাধান হয়েছে । মমতা জানিয়ে দিলেন
তিনি ছিটমহল বিনিময় অথবা স্থল সীমান্ত সীমানা চিহ্নিত করন চুক্তি
পার্লামেন্টে উত্থাপন অথবা তা পাস করনোতে বাধ সাধবেন না । কিছুটা মিন মিন
করে আপত্তি জানালো অহম বিজেপি । বললেন চুক্তি হতে আসামকে বাদ দিতে হবে ।
রাজ্যের মূখ্য মন্ত্রী গগৌ বললেন এই চুক্তিতে অবশ্যই আসামকে অন্তর্ভূক্ত
করতে হবে । শেষতক বিজেপির সভাপতি অমিত শাহ্র মৃদু ধমকে রাজ্যের বিজেপি চুপসে
গেল ।
বুধবার পার্লামেন্টের উচ্চ কক্ষ রাজ্য সভায় বিলটি উত্থাপিত হলে তা বিনা
বাধায় গৃহিত হয় । পরদিন তা লোক সভায় উত্থাপিত হয় এবং অভূতপূর্ব ভাবে কোন
বিরোধিতা ছাড়া ৩৩১ ভোটে দীর্ঘ ৬৮ বছরের প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে সর্বসম্মত
ভাবে বিলটি পাশ হয় । আরো একবার প্রমাণিত হলো যদি দুটি প্রতিবেশী রাষ্ট্রে
দূরদৃষ্টি সম্পন্ন নেতৃত্ব থাকেন তা হলে তাদের মধ্যে অনেক কঠিন সমস্যারই
সহজ সমাধন সম্ভব । ১৯৭৪ সালের ইন্দিরা-মুজিব চুক্তি পাসের ফলে দু’দেশে আটকে
পড়া প্রায় পনের হাজার জনগণের দীর্ঘদিনের দূর্দশার লাঘব হবে । ভারতের রাজ্য
সভা ও লোক সভায় এই বিলটি পাশ হওয়ার জন্য দুদেশের কূটনীতিকে অবশ্যই বাহ্বা
দিতে হবে । ভারতের নরেন্দ্র মোদি, কংগ্রেস নেত্রী সোনিয়া গান্ধি, পশ্চিম
বঙ্গের মূখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায় রাষ্ট্রনায়কোচিত মনের পরিচয় দিয়েছেন
। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ধৈর্য্য ধরে এবং ভারতের উপর
কূটনৈতিক চাপ বজায় রেখে প্রমাণ করেছেন শান্তিপূর্ণ উপায়ে সমাস্যা সমাধানের
চেষ্টা করলে তার ভাল ফল পাওয়া যেতে পারে । এখন বাকি রইলো তিস্তার পানি
বন্টন চুক্তি । কিছুদিন আগে মমতা বন্দোপাধ্যায় বাংলাদেশ সফরে এলে শেখ হাসিনা
ও সাংবাদিকদের বলেছেন এই ব্যাপারে তাঁর উপর আস্থা রাখতে । আস্থা অবশ্যই আছে
। পশ্চিম বঙ্গ তথা ভারত সরকারকে বুঝতে হবে বাংলাদেশের সাথে সু-সম্পর্ক বজায়
রাখলে তাদেরই লাভ বেশী । ইতোপূর্বে উত্তর-পূর্ব ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদী
সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলি বাংলাদেশ সরকারের পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষ মদদে এই অঞ্চলে
নিয়মিত সন্ত্রাসী কর্মকান্ড চালিয়েছে । শেখ হাসিনা সরকার গঠন করলে তা
পুরোপুরি বন্ধ করা হয় । অদূর ভবিষ্যতে চট্টগ্রাম বন্দরকে ভারত একটি
ট্রানজিট বন্দর হিসেবে ব্যবহার করতে পারে । লাভ ভারতেরই বেশী । এটি তাদের
উপলব্দি করতে হবে ।
স্থল সীমান্ত সমস্যাটির সমাধান হওয়ার কারণে দু’দেশের মধ্যে বন্ধুত্বের পারদ
অনেক উপরে উঠে গেছে । তিস্তার পানি বন্টন চুক্তি হয়ে গেলে দু‘দেশের
সম্ভাবনার অনেক স্বর্ণ দুয়ার খুলে যাবে । বঙ্গবন্ধুর রেখে যাওয়া একটি
গুরুত্বপূর্ণ কাজ তার কন্যার আমলেই শেষ হলো । এমন আরো যে সব কাজ আছে তাও
দ্রুত শেষ হবে বলে প্রত্যাশা করছি । সকল পক্ষকেই উষ্ণ অভিনন্দন ।
লেখক: গবেষক ও বিশ্লষক । মে ৯, ২০১৫
WARNING:
Any unauthorized use or reproduction of 'Community' content
is strictly prohibited and constitutes copyright infringement liable to
legal action.
[প্রথমপাতা] |
লেখকের আগের লেখাঃ
[......লেখক আর্কাইভ]
|