ধারাবাহিক উপন্যাসঃ কাক-জ্যোৎস্নায়
কাক-ভোর (পর্ব-২১)
শাশ্বত
স্বপন
একদিন কালী দুপুর বেলা পাশাকে বলে, উল্কা এ পর্যন্ত সাতশ টাকার বেশী হয়েছে,
পালানো যাবে না ? চল কালকেই দু’জনে পালাই।পালানো ছাড়া যে উপায় নেই, তা দুই
ধর্মই বলে দেয়। পাশা কালীকে বোঝায় সে এখনও ব্যবসা ভাল বুঝে না। আয়ও বেশী
করতে পারে না। তাই এ অবস্থায় পালানো ঠিক হবে না। ত্রিজগতে যার আপন বলতে কেউ
নেই, সে কালীকে নিয়ে কোথায় পালাবে। এতিম খানায় মানুষ হয়েছে সে। ৮ম শ্রেণীতে
থাকা অবস্থায় সমস্যাবহুল এতিম খানা ত্যাগ করে বালিগাঁও বাজারে স্বল্প
পরিচিত এক দোকানে এসে কাজ করত। সে কালীদের দোকানে জীবনের স্রোতধারায় ভেসে
এসেছে। সে এ বাড়ীর সবাইকে ভালবাসে। তুলসীকে ঠাকুমা, শেফালীকে মাসীমা, আর
কালীপদকে মেসোমশাই বলে ডাকে । জয় অনিতা ওদেরকে সে খুব আদর করে। পাশার আচার
ব্যবহার এ বাড়ীর সকলকে আকৃষ্ট করে। সে ভাবে, সে যদি হিন্দু ঘরে জন্ম নিত
তবে সুন্দর মনের এই কালীকে বিয়ে করতে পারত। কালীপদের মাধ্যমে দিগলী বাজারেই
দোকান দিতে পারত। কিন্তু এ অবস্থায় এ সমাজ কি মেনে নেবে? বিশেষ করে হিন্দু
সমাজ, যেখানে বহিরাগত প্রবেশ নিষেধ--বর্ণভেদ আর কুসংস্কার একসাথে মিলে
বিরাট বটবৃক্ষ সমান রহস্য তৈরী করেছে।
যে মাসী-মেসো তাকে এত ভালবাসে তাদের সাথে সে এত বড় বেঈমানী কি করে করবে ?
না, সে কালীকে নিয়ে পালিয়ে যাবে না। এদিকে কালী প্রেমের আগুন নিয়ে ভয়ংকর
চিন্তা ভাবনা শুরু করেছে। পালানোর চিন্তা ছাড়া আর যেন তার কোন কাজ নেই। এক
মাত্র পাশা তার মনের দু:খ বুঝতে পারে ।
খেলার মৌসুমে সাবুদ, তোতা, আর সজিব এর সাথে বেড়িয়ে সে বুঝতে পেরেছে তারা কি
চায়? তোতার সাথে হুন্ডায় চড়েছে। সে বারবার ব্রেক করে । ফলে তার বুক তোতার
পিঠে লেগে যায়। পড়ে যাবার ভয়ে সে তোতাকে ভয়ে জড়িয়ে ধরে। সেদিন ওড়নাটা
মাটিতে পড়তেই শফিক স্যার কালীর বুকের দিকে তাকিয়ে রইলো--যেন সে কোনদিন দেখে
নাই, এত বড়...। তানিকে একদিন এই স্যার তার থাকার রুমে জড়িয়ে ধরে। বুয়া
দেখেছে বলে রক্ষে । তানি কলংকের বোঝা নিয়ে গত পরশু স্কুল ত্যাগ করলো।
স্যারও হলো বরখাস্ত।
অথচ পাশা কত ভাল। তার সামনে ভিজা কাপড় পরিবর্তন করলেও সে ফিরে তাকায় না। আর
তাই পাশার সামনে কালীর লজ্জা বা ভয় জন্মায় না। সে পাশার কাছ থেকে পায়নি কোন
ঘৃনা--পায়নি ছলনার কোন চিহ্ন। পাশা এপর্যন্ত কালীর কাছে যা ওয়াদা
করেছে--সবই পালন করেছে। সে মুসলমান অথচ ধর্ম নিয়ে কোন তর্ক করে না। নামায
পড়ে না। কালী কখনও তাকে নামায পড়তে দেখেনি। সে স্রষ্ঠাকে স্মরণ করে কিনা,
কালী শুনে নাই। সব নামাযিরাই বেহেস্তে যেতে চায়, হুর চায়, স্রষ্ঠার
সান্নিধ্য লাভ করতে চায়। অথচ কালীকে সেদিন পাশা বলে দিল, আমি বেহেস্ত
চাইনা- হুরও চইনা। আমি নামায পড়ি না--কোন পাপও করিনা। পাপ বলতে আমরা যা
বুঝি বা ভাবি আমি তার ধার কাছে নেই। সময়ের প্রয়োজনে জীবনের জন্য এ বেঁচে
থাকা। আমি আমৃত্যু এ পৃথিবীর বুকে বাঁচার মত বাঁচতে চাই। কোন ক্ষতিতে অথবা
না পাওয়ার বেদনাতে সে স্রষ্টাকে কখনও দায়ী করে না--কোনদিন করবে না। আপন
গতিতে যেভাবে তার এদেহ চলছে--এটাই তার জীবন। যা ঘটছে তা জীবন পথের পাথেয়,
যা ঘটেনি তা তার এ জীবন পথের নয়--অন্য জীবন পথের। সে অন্য প্রানির মত একটি
প্রাণী। যে যার প্রাণ নিয়ে ব্যস্ত, সেও ব্যস্ত। হিংসা লোভ নিয়ে সে ভাবে না।
সময়ের জন্য এগুলো অতি প্রয়োজনীয়-- জীবনের জন্য নয়। এগুলো না হলেও জীবনে
চলে।
ধর্ম পালন করা ব্যক্তিদের সান্নিধ্যে কালী গিয়াছে। খেলার সাথী রিপন বয়সে
কালীর বড়। সে কুরআন দু’বার খতম দিয়াছে। তার মাথায় সব সময় টুপি থাকে। মুখে
ছাগলা দাঁড়িতো আছেই। কালী তাকে নিয়ে বেশ রঙ্গ করে। রিপন আগে ভীষন দুষ্ট
ছিল। অথচ আজ সে হুজুর বনে গেছে। সে কালীকে বেহেস্ত- হুর, কুরআন শরীফ
ইত্যাদি অনেক বিষয়ে জ্ঞান দিচ্ছে। যখন কালীর বুকের ওড়না পড়ে গেল তখন হা করে
তাকিয়ে রইলো। কালীও পরীক্ষা করছে, রিপন আসলে এখনও সত্যিকারের হুজুর হয়েছে
কিনা। সে কথা ঘুরিয়ে জঘন্য সব কথা শুরু করলো। কথার ফাঁকে সে তার মনের কথা
বলে ফেলল, চল কালী দু‘জনে ক্ষেতের ভিতরে যাই।
কেন ?
কেন তুই বুঝিস না। তুইও যা চাস--আমিও তা চাই।
কও কি রিপন ভাই। আল্লায় দেখবো না। তোমার পাপ হবে না। আমাকে ইয়ে করলে
বেহেস্তেও যেতে পারবেনা-- হুরও পাবেনা ।
দূর তোর বেহেস্ত । তুই আমার বেহেস্ত। তুই আমার হুর। রিপন ওকে জড়িয়ে ধরতেই
কালী দৌড়ে বাড়ি চলে আসে।
রিপন আবেগ সামলাতে না পেরে ধর্ম বিকৃতি শুরু করেছিল। মানুষ কামনায়, লালসায়
লালায়িত হয়ে আপন গতি থেকে কত দূরে ছিটকে যায় কালী তা বুঝতে পাড়ে। অথচ পাশা
...। যে চায় তাকে কালী কিছু দিতে চায় না। যে চায় না তাকেই কালী মুঠি মুঠি
দিতে চায়।
ফাগুণ মাসের কোন এক তারিখে কালিপদ তার বাড়ীতে কৃষ্ণের ‘নৌকা বিলাস’
পালাগানের আয়োজন করেছিল যে পুরুষটি কৃষ্ণ সেজেছে কালী তাকে সকল পুরুষ থেকে
শ্রেষ্ঠ মনে করেছিল। কৃষ্ণরূপী মানুষটি যখন মেকাপ উঠাবে তখন কালীকে নারিকেল
তেল আর গামছা নিয়ে আসতে বলল্ । কালী কথামত কাজ করল। তারপর কালীকে দুই পা
টান করে বসতে বলল। কালী তাই করল। সে দুই উরুর উপর শুয়ে পড়ল। কৃষ্ণ মানুষটি
মুখে তেল মেখে-গামছা দিয়ে ঘষে মেকাপ উঠানোর পদ্ধতি কালীকে শিখায়ে বলল,
এভাবে মেকাপ উঠাও। রাত প্রায় তখন ৩ টা বাজে। নৌকা বিলাস উপভোগ করে যে যা
বাড়ী চলে যাচ্ছে। কালী একাকী উত্তর ঘরে মেকাপ উঠাচ্ছে কৃষ্ণের। সে দেবতার
ছায়া ভেবে কিছু বলতেও সাহস পাচ্ছে না। দুই উরুতে মাথা দিয়ে চাপ দিচ্ছে।
কালীর কষ্ট হচ্ছে, লজ্জায় কিছু বলতেও পারছে না। সে সময় কালী ছিল অষ্টম
শ্রেণীর ছাত্রী।কৃষ্ণ মানুষটি কনুই দিয়ে দুই উরুর সন্ধিস্থলে সুরসুরি দিতে
লাগল। হঠাৎ হঠাৎ করে বুকের স্তন্যেও হাত লাগাতে লাগল। কি এক সুপ্ত
অনুভূতিতে কালীর সাড়াদেহে শিহরণ জেগে উঠল। পরম ভালোলাগার চরম অনুভূতির
তৃপ্তি সব কিছু ভূলিয়ে দেয়। কৃষ্ণ উরু থেকে উঠে মুখে চুমো দিয়ে বলল্,
দীর্ঘজীবী হও। কালী সহসা কথা বলে উঠল, দীর্ঘজীবী নয়, আমাকে সুন্দর করে
দাও--কালো রং তুমি নিয়ে যাও। কৃষ্ণ ‘দাও বলে’ তাকে জড়িয়ে ধরল। কালী কিছুই
বলল না। তার কেমন জানি বিশ্বাস হল, কালত্ব দূর হতেও পারে। সে আবেগাপ্লুত
কৃষ্ণকে জড়িয়ে ধরল। কালী হারিয়ে গেল কোন এক রহস্যময় আনন্দে। হঠাৎ ঘরে
কৃষ্ণের ভাই সুবল আর রাধা এল কৃষ্ণকে ডাকতে। কৃষ্ণ হতভম্ব হল রাধার ধমকে,
ছিঃ তুমি যেখানে-সেখানে যা ইচ্ছা কর। তুমি কৃষ্ণের চরিত্র কর অথচ কৌরবদের
মত....
রাধা আর কিছু বলল্ না। কালী দেখল তার ব্রা ছিঁড়ে গেছে। প্যান্ট খুলে আছে।
আর একটু সময় পরে তারা এলে সে এক অসতী নারী হত। এ তার বিরাট ক্ষতি বয়ে আনতে
পারত। আজীবন এক অপরাধে সে জ্বলত। সে গায়ের দিকে তাকাল। না, সুন্দর হয় নাই,
তার কাছে নিজেকে আরো কালো, কুৎসিৎ মনে হচ্ছে।
এর চেয়ে পাশা কত ভাল। সে কৃষ্ণ নয়, হুজুরও নয়। সে ক্ষণে উদাসীন, ক্ষণে
সচেতন, ক্ষণে জ্ঞানী, ক্ষণে একজন সত্যিকারের প্রেমিক।
(চলবে)
ARNING:
Any unauthorized use or reproduction of 'Community' content
is strictly prohibited and constitutes copyright infringement liable to
legal action.
[প্রথমপাতা] |