প্রথমপাতা  

সাম্প্রতিক সংবাদ 

 স্বদেশ

আন্তর্জাতিক

বাংলাদেশ কমিউনিটি

লাইফ স্টাইল

এক্সক্লুসিভ

বিনোদন

স্বাস্থ্য

বর্তমানের কথামালা

 শিল্প-সাহিত্য

 প্রবাসপঞ্জী 

আর্কাইভ

যোগাযোগ

 

 

 

 

সুতোর টানে-৬

 


 

সুলতান সালাহ্উদ্দীন আহমেদ
 

 


লাশ কাটা ঘরে

 

যুদ্ধের মধ্যে এক অদ্ভুত অনুভূতির জন্ম হয়েছিল। অচেনা ভাবনায় মন ভরে থাকতো। ‘স্বাভাবিক’ জীবনে ফিরে আসা কিংবা নিজেকে স্বাভাবিক রাখা খুব সহজ ছিল না বা সেটা করার চেষ্টাও করিনি। কেমন যেন একটি ঘোরের মধ্যে দিন কাটতো। তারপরও পড়াশোনা এবং ঢাকা মেডিকাল কলেজের ব্যস্ততার মধ্যে দিয়ে অনেকটাই নিজেকে মানিয়ে নেয়ার চেষ্টা করছিরাম।

ঢাকা মেডিকাল কলেজে ভর্তির ভাইবা বোর্ডে যখন গেলাম তখন সামনে বেশ কয়েকজন প্রফেসর ছিলেন। তখন সবেমাত্র যুদ্ধ শেষ হয়েছে। এক প্রফেসর আমার কাছে জানতে চাইলেন, যদি এবার ভর্তি হতে না পারো তাহলে কি করবে?

আমি বললাম, আবার আসবো।

তিনি আবারও বললেন, যদি সেবারও না হয় তাহলে?

আমি বললাম, তার পরেরবার আসবো।

এভাবে তিনবার বলার পর শেষ পর্যন্ত বিরক্ত হয়ে তিনি বললেন, হলো তো, এবার যাও।

আমি বললাম, যতোক্ষণ পর্যন্ত আপনি না নেবেন ততোক্ষণ পর্যন্ত আসতেই থাকবো স্যার।

ঢাকা মেডিকাল কলেজে চান্স পাওয়ার পর আমরা ফজলে রাব্বি হলে ঢুকি। ফিজিওলজির এক টিচার ছিলেন জালু ভাই। তার সঙ্গে আমার প্রথম দেখার ঘটনাটা বেশ মজার। একদিন রাত প্রায় দুইটার দিকে জালু ভাই আমাকে ডাকতে লাগলেন, এই সালাহ্উদ্দীন, তুই কি ঘুমিয়েছিস… ঘুমিয়েছিস?

আমি ঘুম থেকে উঠে বললাম, ঘুমিয়েছিলাম কিন্তু এখন জেগে গেছি।

তখন তিনি আমাকে বললেন,ও আচ্ছা, তাহলে তুই ঘুমা।

এই ছিল তার সঙ্গে আমার প্রথম সাক্ষাৎ!

জালু ভাই পাশ করে গিয়েছিলেন তারপরও তিনি আমার রুমে থাকতেন। তার কিন্তু থাকার কথা নয়। মাঝে মাঝে তার সঙ্গে ঝগড়া হলে আমাদের রুমের আর এক সিনিয়র ভাই ছিলেন যিনি তার জিনিসপত্র ফেলে দিতেন। জালু ভাই ওগুলো কুঁড়িয়ে নিয়ে আসতেন। তিনি বলতেন, রাগ করিস না আর মাত্র কয়েকটা দিনই থাকবো। তোদের সঙ্গে চলবো।

যেহেতু আমার কবিতা লেখার এটকু স্বভাব ছিল, তখন প্রেমিকাকে চিঠি লেখার প্রয়োজন হলে অনেকে আমার কাছে আসত। একই মেয়ে তখন দুটো ছেলের সঙ্গে প্রেম করছিল। এটা আমি জানলাম কারণ একই চিঠি একই ভাষায় আগেও আমি অন্যের নামে দেখেছিলাম।

মেডিকালে চান্স পাবার পর প্রথম দিকে পড়াশোনার দিকে ঝোঁক কমে গিয়েছিল। পরীক্ষার প্রায় ছয় মাস আগে আমি, হুয়ায়ুন, ওয়াহিদসহ আমরা কয়েকজন মিলে মিটিংয়ে বসলাম। আলোচনার বিষয়- যেভাবে এতোদিন পড়াশোনা করেছি, এখন পাশ আর হবে না।

আমি বললাম, যেভাবেই হোক পাশ করতে হবে। আর পাশ করতে হলে মরা কাটতে হবে। অর্থাৎ লাশ কাটতে হবে। কারণ প্র্যাকটিকাল পরীক্ষায় ফেল করলে সব শেষ! অ্যানাটমি না পড়লে হয় না। কিন্তু লাশ এমনি এমনি পাওয়া যাবে না। চুরি করতে হবে! যে কথা সেই কাজ। রাতে লাশ মর্গ থেকে বের করে চার তলায় তুলে কেটে-কুটে, পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে আবার সকালে রেখে আসতাম। সে সময় আমাদের জ্ঞানের অবস্থা এতো খারাপ ছিল যে লিভার ডান দিকে না বাম দিকে থাকে তাই জানতাম না।

কাশেম স্যার তখন ছিলেন অ্যানাটমি ডিপার্টমেন্টের হেড। তিনি ব্যাপারটা আঁচ করতে পেরে মর্গে তালা ঝুলিয়ে দিলেন। আগে তো ভেতরে ঢুকতে পারতাম কিন্তু তালা দেবার পর তা অসম্ভব হয়ে পড়ল।

সেই সময়টাতে আমাদের ক্যান্টিনের মালিকের এক আত্মীয় এসেছিল। সে ছেলেটা আমাদের খুব পছন্দ করত। এর প্রমাণ পেতাম যখন আমরা সবাই মিলে চা-সিঙ্গারা খেয়ে বিল দেয়ার সময় সে বিল অর্ধেক বলত।

লাশ আনার জন্য আমাদের মোটা তাজা কাউকে প্রয়োজন ছিল, কেননা ছাদ থেকে দড়ি দিয়ে নেমে ওখান থেকে লাশ চুরি করতে হবে। এই কাজে সেই ছেলেকে কাজে লাগালাম। সে ছাদ থেকে দড়ি দিয়ে নেমে লাশ তুলে চার তলায় নিয়ে আসতো। আমরা ওখানে প্র্যাকটিস করতাম। এরপর পরীক্ষা হলো এবং অ্যানাটমিতে পাশ করলাম।

ক্লাসে আমাদের বন্ধু শহীদ ফার্স্ট বেঞ্চে বসার জন্য এতো পাগল ছিল যে, কেউ যদি তার সামনে বসত তাহলে তাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিত। আমরা বসতাম লাস্ট বেঞ্চে। ফাস্ট রোতে শহীদ, খোরশেদ, লেবু এরা সবাই বসার জন্য অস্থির। আর আমরা পিছনে বসতাম বড় ভাইদের সঙ্গে। সেখানে অনেক ধরনের মজা হতো।

 

 

[লেখক পরিচিতি

আমেরিকার নোভা সাউথইস্টার্ন ইউনিভার্সিটি, ইউনিভার্সিটি অফ মায়ামিসহ বেশ কিছু ইউনিভার্সিটির শিক্ষক ডা. সুলতান সালাহ্উদ্দীন আহমেদ মানব সেবার ব্রত নিয়ে চিকিৎসা পেশাকে বেছে নেন। দেশে এবং প্রবাসে তিনি তার পেশায় আন্তরিকতা এবং সততার জন্য প্রশংসিত হয়েছেন।

তিনি কলেজ ছাত্র অবস্থায় মুক্তিযুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন। মুক্তিযুদ্ধের সময় বন্দী শিবিরে অমানুষিক নির্যাতনের শিকার হন। মুক্তিযুদ্ধে তার উদ্ভাবিত হাতে তৈরি সাইক্লোস্টাইল মেশিনে মুক্তিযুদ্ধের অনেক জরুরি এবং গোপন তথ্য নিয়মিত প্রকাশিত হয়। এই মেশিন পরবর্তী সময়ে তাকে আন্তর্জাতিক খ্যাতি এনে দেয়। গবেষক ও আবিষ্কারক হিসেবেও দেশে-বিদেশে স্বীকৃতি পেয়েছেন তিনি। একজন মানুষের জীবন কতোটা বৈচিত্র্যময় হতে পারে তার একটি চমৎকার উদাহরণ হতে পারে এই বইটি। জীবনের দুঃসময়ে ভেঙে না পড়ে তা কাটিয়ে ওঠার প্রেরণা হিসাবে বইটি কাজ করবে। জীবনকে নিয়ে নতুন করে ভাবার অনেক উপকরণ ছড়িয়ে আছে সীমিত কলেবরের এই বইটির পাতায় পাতায়। ব্যক্তিজীবনে সুলতান সালাহ্উদ্দীন আহমেদ একমাত্র মেয়ে ও স্ত্রীকে নিয়ে মায়ামিতে বসবাস করেন
।]


 

 

WARNING: Any unauthorized use or reproduction of 'Community' content is strictly prohibited and constitutes copyright infringement liable to legal action। 

 

 

[প্রথমপাতা]