প্রথমপাতা  

সাম্প্রতিক সংবাদ 

 স্বদেশ

আন্তর্জাতিক

বাংলাদেশ কমিউনিটি

লাইফ স্টাইল

এক্সক্লুসিভ

বিনোদন

স্বাস্থ্য

বর্তমানের কথামালা

 শিল্প-সাহিত্য

 প্রবাসপঞ্জী 

আর্কাইভ

যোগাযোগ

 

 

 

 

  ধারাবাহিক উপন্যাস   

 

কাক জ্যোৎস্নায় কাক ভোর

শাশ্বত স্বপন

 

পর্ব-২

অস্তায়মান গোধূলীর সূর্য্যটা দিগন্তে মিশে গেছে। তবে পশ্চিমাকাশে সূর্যের রক্তিম আভা তখনও শ্মশানের শেষ অগ্নির মত জ্বলছে। ঠাকুর বাড়ীর ভিতরে ও বাহিরে ধীরে ধীরে নিরবতা নেমে আসছে। পুরানা ভগ্ন দালানের দেয়াল ঘেঁষে বটগাছ পূর্ব ঐতিহ্য আর হারানো স্মৃতি নিয়ে আকাশ পানে চেয়ে আছে। মনে হয়, অতীতের গল্প আকাশকে শুনাচ্ছে; যেন, ইথারে ইথারে সে গল্প ছড়িয়ে যায়, সবখানে। নাম না জানা কোন পাখি হয়তো এই দেয়ালের উপর বসে আনমনে মলত্যাগ করেছিল, কিছু মল দেয়ালে লেগেছিল। দেয়ালকে আশ্রয় করে সেই কবে এই বটগাছ জন্মেছিল--কেউ তা বলতে পারে না। শুরুতে দেয়াল বটগাছকে আশ্রয় দিয়েছিল, এখন বটগাছ দালানসহ দেয়ালকে আষ্টে-পিষ্টে জড়িয়ে রেখেছে, যেন দেয়াল বটগাছকে ছেড়ে ভেঙ্গে-চুঁড়ে পড়ে না যায়। মনে হচ্ছে, বটগাছ অকৃত্রিম কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছে। মাটির উপর সমান্তরাল বটগাছের মোটা দুই শিকড়ের মাঝে জং ধরা পুরাতন টিনের চাল এর ছাউনি দেওয়া ছোট মন্দিরে কয়েকটা দেব-দেবীর মূর্তি স্মিত হাসিতে চেয়ে আছে দক্ষিণ দিকে। যেন, কোন পূজারী কিবা তাদের প্রেমে ভক্ত প্রিয়জন চরণ ধুলি নিতে আসবে। ঠিক তাই-ই। এই দক্ষিণের স্যাঁতস্যাঁতে মাটির উপর পা ফেলে ফুটফুটে জ্যোৎন্সার মত নিষ্পাপ একটি তের বৎসরের পিতৃহারা বালক প্রতি সন্ধ্যায় ধূপ-শিখা আর সামান্য অর্ঘাদি নিয়ে পুজা করে। অর্ঘাদি নিবেদন করে কি যেন বলতে থাকে বিড়বিড় করে। পূজার শেষে দেবীর চরণে লুটিয়ে পড়ে। বালকটির উপনয়ন হবার পর, ওর বিধবা মা ওকে পূজার ব্যাপারে সাহায্য করে।

এই পুরাতন বনঝোপে ঘেরা ঠাকুর বাড়িতে ওরা দু’টি প্রাণী--মা ও ছেলে টিনের একটি ঘরে বৃষ্টির সময় বৃষ্টিতে ভিজে, জ্যোৎন্সা রাতে চাঁদের আলো উপভোগ করে দিন যাপন করে আসছে অনেক বছর ধরে। মন্দিরের পুরানা দালানের ইট-আস্তর প্রায়ই খসে পড়ে। তাছাড়া ওখানে অনেক বিষধর সাপ বাস করে। উত্তরে কালীদের ছোট পুকুর পর্যন্ত বিশাল বনঝোপ, সেখানে রাত তো দূরের কথা দিনের বেলায়ও মানুষ যেতে সাহস করে না। সাপ হয়তো এই ঝোপ থেকেই পুরনো দালানে গিয়াছে। তাই কল্যাণরা দালানে থাকে না, দালান থেকে দক্ষিণের একটু দূরে টিনের ছাউনি আর মুলিবাঁশের তৈরী ভাঙ্গা ঘরে বাস করে ।

এক সময় পুরো ঠাকুরবাড়ী লোকে পরিপূর্ণ ছিল। ঘরে ছেলে-মেয়েদের চিৎকার, রান্না ঘরে বাবুর্চি-রাধুনীর চিৎকার, উঠানে বউ-শ্বাশুরীর খোশগল্প, বাইরে মনিব ও চাকরের সশব্দ কথোপকথন। আজ আর সেই দিন নেই--নেই সেই কোলাহল। সব থেমে গেছে ধীরে ধীরে। বিরাট আয়োজনে এখন আর কোন পূজা হয় না। হিন্দু সম্প্রদায়ের মাথায় সাম্প্রদায়িক ভূত চেপেছে ক্রমাগত সবাই কোলকাতা চলে যাচ্ছে অথচ কোলকাতার যবনদের মাথায় হিন্দু ভূত চাপা সত্ত্বেও কোন যবন আমাদের গ্রামে এসেছে বলে শুনি নাই।

বাংঙ্গালী হিন্দুদের ধারণা এদেশে যবদের সাথে থাকা যাবে না। ভারতে সুখ-শান্তি ভরপুর। মানুষের মৌলিক চাহিদাগুলির দাম অপেক্ষাকৃত কম। কিন্তু কেউ বুঝতে চায় না সেখানে কত বেকার, কত বর্ণ-বৈষম্য, পয়সা রোজগারের কি অবস্থা! কি জানি, হয়তো হিন্দুদের স্বর্গপুরী ভারতেই অবস্থিত। কেননা দেব-দেবীর যত আজব গল্প আর অবিশ্বাস্য পূজা-অর্চনার কারখানাতো সেখানেই, যেখান থেকে রামরাখীর মত স্বার্থতত্ত্ব তৈরী হয়, হচ্ছে। ভাবতে ইচ্ছে করে, রাম অবতার কি মৌলবাদীদের স্বর্গের লোভ দেখিয়েছে? নয়তো ৫০০ বছরের পুরনো মসজিদ কি করে ভাঙ্গে? কাশী, গয়া, বৃন্দাবন যেমন রয়েছে তেমনি রয়েছে বোম্বের মত পাতিস্বর্গ--যেখানে নগ্ন, অর্ধনগ্ন হুর-পরীদের ছড়াছড়ি। আর এই পাতিস্বর্গের শিকড় বাড়তে বাড়তে এদেশের আনাচে-কানাচে এসে গেছে। ভারতের হাজার হাজার দ্রব্যতে বাংলার বাজার জমজমাট। হিন্দি গান ছাড়া আমাদের পেটের ভাত হজম হতে চায় না, সকাল হতে চায় না, কোন অনুষ্ঠান সম্পন্ন হতে চায় না। জীবন চলার পথে হিন্দী ফিল্ম আর হিন্দি গান। অথচ তারপরও বকেই চলেছি ভারতকে। ভারতের রেশ ধরে মাঝে মাঝেই এখানে শুরু হয় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। এখানেও হিন্দু, বৌদ্ধদের মন্দির ভাঙ্গা হয়। দুই দেশে কারা মসজিদ, মন্দির ভাঙ্গে? ধার্মিকরা? আসলেই ধার্মিকরা? মোটেও না, সব রাজনীতির খেলা। এদেশের সংখ্যালঘু হিন্দুরা হুজুগে-ভীতু। গাছের একটা পাতা পড়ার শব্দ শুনলে যেমন ভীতু হরিণেরা লম্ফ দিয়ে উঠে, হিন্দুরা তেমনি সামান্য একটা গুজব শুনতে পেলেও পোটলা-পুটলী বাঁধার চিন্তা করে ফেলে। ভাবেও না গুজবটা সত্য না মিথ্যা। ভাববে কি, পারেতো ক কে কনকসার কং বানিয়ে ছড়াতে থাকে। এভাবে চলতে থাকলে কল্যাণরাও একদিন কোলকাতা চলে যাবে। যাবেই তো, হাজার বছর ধরে চলা ধর্মীয় সামাজিকতার বিষয়, কাজ করে বেঁচে থাকার কথাওতো ভাবতে হবে। কায়স্থ ব্রাক্ষণের ছেলে কল্যাণ--পূজাই যদি না ঘটে তবে পয়সা পাবে কোথায়? বর্ণ-বৈষম্য নামক নিন্দিত কুসংস্কার রক্ষা করে কল্যাণের মা সবিতা যদি ছেলের জন্য কায়স্থ ব্রাক্ষণের মেয়েই না পায়, তবে কূল রক্ষা করার জন্য তথাকথিত রামস্বর্গ ভূমিতে তো যেতেই হবে। ইচ্ছে করলেও তিনি নিম্নবর্ণের কোন হিন্দু মেয়ের সাথে তার পুত্রের বিবাহ দিতে পারেন না। গোঁড়া হিন্দু সমাজ থু থু দেবে। সুযোগ বুঝেই ফতোয়ার মত শাস্ত্রীয় বিচার শুরু হয়ে যাবে। লোকে তাদের নিন্দা করবে। কুমার যদি মূর্তি, হাড়ি-পাতিল বিক্রি করতে না পারে, তবে মূর্তির স্বর্গে তো যাবেই; যেখানে অজস্র মূর্তি সে বিক্রি করতে পারবে।

‌‌'শ্রীবৃক্ষ বোধযামী ত্বাং যাবৎ পূজা করোম্য হম...’--সংস্কৃত পাঠ শেষে কল্যাণ মন্দিরে পূজা করার পর নমস্কার দিল। ঠিক এসময়ে পাশে কারো আগমনের নূপুর বেজে উঠল। মাটি থেকে সদ্য পুজারী মাথা উচুঁ করে বলল, ‘কিরে কালী, এই সন্ধ্যাবেলা এখানে কেন আসছিস?’ কালী কোন উত্তর না দিয়ে মন্দিরের মাটির উপর ভাসমান স্বচ্ছ ঘটের জল মাথায় ছুঁয়ে দিয়ে হাতটা পেছনে নিয়ে গেল। ম্মিত হাস্যে কল্যানের চরণ ধূলি গ্রহণ করল। কল্যাণ কালীর দু’হাত ধরে উঠাল তারপর কালীর মুখের কাছে মুখ নিয়ে বলল্, ‘কিরে ব্রাহ্মণ জ্ঞানে নমস্কার দিলি, নাকি দেবতা জ্ঞানে’। এগার বছরের এই বালিকার লজ্জা হাসিতে অনড় দেব-দেবীর মূর্তীরা যেন ঈষৎ লজ্জা পেল। বটবৃক্ষের শাখা থেকে একরাশ পাতা ওদের দু’জনার উপর ঝড়ে পড়ল। বাতাস বইতে লাগল গুনগুন সুরে। কালীর কণ্ঠ থেকে ব্যক্ত হল --‘তা জানিনা কল্যাণদা, দিতে হয় তাই দিলাম।’ মনে মনে কালী বলতে লাগল কিছু অব্যক্ত কথা--যা বালিকারা সহজে ব্যক্ত করতে চায় না। সে জানে না, একজন বিধর্মী ছেলেকে পাওয়ার চেয়ে ব্রাহ্মণের ছেলে পাওয়া অনেক কঠিন, কারণ গোঁড়া হিন্দু সমাজ কোনদিন মেনে নেয়নি, আজও নিতে চায় না।

হাতে একরাশ চুল, কানে দুল, ছোট কালো কচি পায়ে নূপুর, চুলগুলো মেঘের চেয়েও কালো আর মুখখানি হৃদয়ের সত্যিকারের ভালোবাসার মত পবিত্র। ‘ঠোঁট রাঙ্গা হাসি’ যেন সদ্য পূজারীকে প্রশ্ন করতে চায় ‘বলতো আমি কেমন ?’ কালী কল্যাণের ঘাড়ে দু’হাত রেখে দুষ্টু ভংগীতে বলতে লাগল, ‘ঠাকুর মশাই, আজ শনিবার। ঠাকুরমার তুলসী তলায় শনিধ্বনি দিয়ে ঠাকুরমাকে শনি পাপ থেকে রক্ষা কর।
--ও হ্যাঁ, আমার মনে ছিল না। তুই একটু দাঁড়া, এক্ষূণি আমি ঘরের মধ্যে এগুলো রেখে আসি।
কালী শাড়ীর আঁচলটা কোমড়ে এঁটে বলল,
-- কল্যাণদা, আমার কাছে ধূপটা দাও। তুমি এগুলো নাও।

এগুলো মানে পূজোতে দেওয়া বাতাসা আর পেঁপের টুকরা। কল্যান বাতাসা আর এক টুকরা পেঁপে হাতে নিয়ে বলল,
-- কালী, হা-কর।
কল্যাণ আজ আর স্বর্গীয় বাবার ধুতি পড়েছে দুই ভাঁজ করে আর গায়ে পড়েছে ডোরা কাটা গেঞ্জি। কালী পড়েছে গোলাপী পাইড় দেয়া শাড়ী। দু’জনের মুখে মিষ্টি হাসি। কালীদের বাড়ী কল্যাণদের বাড়ী থেকে এক ছোট্র পুকুর আর এক বনঝোপ দূরে। শেফালী ও তুলসী কল্যাণকে খুব আদর করে। গতবারের দূর্গা পূজার আগে শেফালী ওকে একটি শার্ট ও একটি লুঙ্গি দিয়েছে। বাড়ীর কাছাকাছি এসে কালী কল্যাণের হাত চেপে ধরল,
--একটা কথা বলব,
-- কি কথা ?
--আমাকে পূজা করতে শিখাবে ? তুমি যখন পূজা কর, আমার খুব ভাল লাগে। মনে হয়, আমি যদি--, কল্যাণদা, দেব-দেবীর কাছে তুমি কত কি বলো।তারা তোমাকে কি বলে ?
-- অনেক কিছু বলে।
-- কি বলে?
--তোকে বলা যাবে না। তুই আরো বড় হ--তখন বুঝবি।
-- তুমি বুঝি বড়। এই মেপে দেখনা তোমার কান পর্যন্ত আমার মাথা ঠেকেছে।
-- ধাৎ হাঁটতো-


[চলবে]

 

 

 

ARNING: Any unauthorized use or reproduction of 'Community' content is strictly prohibited and constitutes copyright infringement liable to legal action. 

[প্রথমপাতা]

 

 

 

 

 

লেখকের আগের লেখাঃ