[প্রথমপাতা]

 

 

 

ধারাবাহিক প্রেমের গল্প

শ্যাওলা-কাঁটা-বেড়া

  

 

- শাশ্বত স্বপন -

 

৩য় পর্ব

বিকাল বেলা। বান্ধবীর বাসায় যাবার ভান করে ইন্দ্রানী চলে আসে আম বাগানের পেছনে। পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী, শুভর বন্ধু সুজন ওখানে অপেক্ষা করছে। ইন্দ্রানী সুজনকে দেখতে পেয়ে চারদিকে তাকাল। দেখল, আশেপাশে তৃতীয় কোন ব্যক্তি আছে কিনা না, কেউ নেই। সুজন ইন্দ্রানীকে লোক চক্ষুর আড়ালে ধানক্ষেতের কাছে নিয়ে আসে। দু’জন বসে পড়ে। সন্দেহ, কেউ বোধ হয় ক্ষেত নিড়াচ্ছে। না, কেউ নেই। একটা শিয়াল বাড়ন্ত ধান ক্ষেতে ইতঃস্তত ঘুরে বেড়াচ্ছে। সে ইন্দ্রানীকে দক্ষিণের ধঞ্চে ক্ষেতের আড়ালে শুভর কাছে নিয়ে এল। এখানে দু’একটা কথা বলে তারা পালিয়ে আসে। যে গ্রামের মাঠ দিয়ে তারা ছুটছে--সে গ্রামের নাম ফুলকচি। শুভ এ গ্রামে আগে কখনো আসেনি। ছুটতে ছুটতে ইন্দ্রানী হঠাৎ থেমে গেল। শুভর চোখে তাকিয়ে বলল,,.
--কোনদিকে যাবে?
--মেইন রাস্তায় গিয়ে বাসে উঠবে।
--যদি বাড়ির লোক এদিকে খোঁজ করতে আসে?
--এদিকে আসবে না। সবাই ভাববে ঢাকার পথে চলে গেছে।
--আমরা রাতে কোথায় উঠব।
--রিনা আপার বাসায়, লৌহজং এর গাঁওদিয়া গ্রাম।
--আমার কেমন জানি ভয় করছে।
--ভয় করলে চলবে না। এখন আমাদের সাহস দরকার। প্রচন্ড সাহস।
--এতক্ষণে মনে হয় গ্রামশুদ্ধ লোক জেনে গেছে।
--জানুক, সবাই এটাও জানুক, ইন্দ্রানীকে আমি আমার জীবনের চেয়ে বেশী ভালবাসি।
--শুভ, মা বোধহয় অজ্ঞান হয়ে যাবে। ঠাকুরমা শুনলে মরেই যাবে।
--ধর্মান্ধ আর কুসংস্কারচ্ছন্ন মানুষগুলি সব মরে যাক। বেঁচে থাক ধর্মভীরু, শান্তি প্রিয় মানুষেরা। তুমি কি রাগ করলে? আমার মাওতো কাঁদবে। ছোট বোনটি শুনলে ভাইয়া ভাইয়া করে চিৎকার করবে। তুমি তো পলিকে ভাল ভাবেই চেন, একদিন আমাকে না দেখলে কেমন কান্নাকাটি করে। রাতে আমাকে না দেখে হয়তো উপোস করবে, ঘুমাতেও চাইবে না।
--মা-বাবা, ঠাকুরমা, ভাই-বোন কারো কিছু হলে আমি কাঁদবো, খুব কাঁদবো। কিন্তু তাই বলে তোমাকে কিছুতেই হারাতে চাই না। তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচব না বলেই তো বিয়ের তিন দিন আগে তোমার হাত ধরে পালিয়ে এলাম। ধর্ম-কর্ম বুঝি কিন্তু তার আগে বুঝি তোমাকে। মন্দির বলে যদি আমার হৃদয়ে কিংবা বাইরে কিছু থাকে, তবে সেখানে তোমাকেই দেবতা রূপে ভেবেছি। ভগবানের কাছে প্রার্থনা করেছি, তোমাকে--সব কিছুর বিনিময়ে, শুধু তোমাকে।
--ইন্দ্রানী, আমি কারো মৃত্যু কামনা করি না--করা উচিতও না। তবে যারা আমাদের ভালোবাসাকে মেনে নেয় না--মেনে নিতে চায় না--আমার চোখে সর্বদা তাদের সর্বনাশ দেখি। তুমি, আমি যদি একত্রে জীবন-যাপন করতে পারি--তাতে সমাজের কি আসে যায়?
--আমরা দুই ধর্মের, তাই।
--প্রচলিত এই ধর্মগুলি সৃষ্টি হয়েছে কত বছর আগে? পনের শত, দুই হাজার, তিন হাজার বছর আগেই হোক; তার আগে কি ভালোবাসা ছিল না? তখন কিভাবে নারী-পুরুষ ঘর সংসার করত ?
--জানি না।
--ইন্দ্রানী, আমাদের সংসারে ধর্মটা বাইরে--মানে ঈদ, পোশাক-আশাক, খাবার-দাবার, টুপি-দাঁড়ি, নামাজ-রোজা--করতে হয় তাই করা। নইলে সমাজ সমালোচনা করবে। ভিতরে ইউরোপীয় স্টাইল। অতএব, আমাদের সংসারে তোমার কোন ধর্মগত বা সামাজিকতার অসুবিধাই নেই।
--আমাদেরও এমনি--ধর্ম শুধু মা আর ঠাকুরমার কাছে সীমাবদ্ধ। সকাল-বিকাল লক্ষ্মীকে পূজা দিতে হয় বলেই দেওয়া আর বিভিন্ন পূজা-পার্বণ ধর্মগত সামাজিকতা ছাড়া আর কিছুই নয়। আসলে ধর্মে বাঁধা কোথায়? বাঁধা তো সব দেখছি আমাদের যুক্তিহীন, বিশ্বাস নির্ভর সমাজে।
--ঠিক বলেছ ইন্দ্রানী, এ সমাজ থেকে অন্য কোন সমাজে আমাদের যেতে হবে। দূরে, বহুদূরে। যদি হিন্দু সমাজে উঠি বলবো, আমরা হিন্দু। যদি মুসলমান সমাজে উঠি বলবো, মুসলমান। স্থানীয় সামাজিকতা মেনেই আমাদের চলতে হবে। আমাদের দু’জনকে অনেক দুঃখ-কষ্ট সহ্য করতে হবে।
--তবুও শুভ তোমাকে কিছুতেই হারাতে চাই না।
--জীবন বাজী রেখেছি ভালোবাসার জন্য। তোমার জন্য বেঁচে আছি; যদি মরতে হয় তোমার জন্যই মরব।

ইন্দ্রানী শুভকে জড়িয়ে ধরল। দু’জন যেন ধন্য হয়ে উঠল এই সূর্যাস্তের মুহুর্তে। ইন্দ্রানী সারা দেহে কি এক অব্যক্ত ভালোবাসার শিহরণ বয়ে বেড়াচ্ছে। সারা মুখ চুমোতে ভরিয়ে দিল দু’জন দু’জনকে। ঘন ঘন নিঃশ্বাসের ছোঁয়ায় ভালোবাসার তীব্র গন্ধ বাতাসে ছড়িয়ে পড়ছে। ধঞ্চে পাতা ঝিমিয়ে পড়েছে সারাদিনের ক্লান্তি শেষে। ছোট ছোট পাখিরা এখনও খাদ্য খুঁজে বেড়াচ্ছে। দুটি প্রজাপতি তাদের দেহের চারপাশে ঘুরছে। সূর্যটার লাল আভা থেকে যেন তাদের ভালোবাসার প্রতি শুভেচ্ছা বিচ্ছুরিত হচ্ছে। ‘আমি তোমাকে ছাড়া বাঁচব না’--দু’জনই প্রতিধ্বনি করে উঠল। হঠাৎ ইন্দ্রানীর মুখটা কি এক অব্যক্ত ভয়ে ফ্যাকাসে হয়ে উঠল। মুখের রক্তাভ রংটা যেন নিমিষে নীল হয়ে গেল। শুভর হাঁটুর কাছে বসে পড়ল সে। তখনো নিঃশ্বাসে ভালোবাসার তীব্র গন্ধ বের হচ্ছে। শুভও বসে পড়ল। ক্লান্তি শেষ হলে শুভ বলল ‘চল...।’ ইন্দ্রাণী এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল শুভর দিকে। কি সুন্দর গড়ন এই ফর্সা মুখটা। আদর করে বুকে রাখতে ইচ্ছে করছে। মৃদু একটি হাসি দিয়ে ইন্দ্রানী উঠল। ওড়নাটা গুছিয়ে নিল বুকের উপর। তারপর ভালোবাসার মৌসুমী বায়ু--যে বায়ুতে ভালোবাসাকে অসুস্থ্য করার জীবাণু নেই--তারা সে বায়ু পথে ছুটছে নতুন উদ্দমে, নতুন জীবনের সন্ধানে।

 

 

 

ARNING: Any unauthorized use or reproduction of 'Community' content is strictly prohibited and constitutes copyright infringement liable to legal action. 

[প্রথমপাতা]

 

 

 

 

 

লেখকের আগের লেখাঃ