[প্রথমপাতা]

 

 

 

ধারাবাহিক প্রেমের গল্প

শ্যাওলা-কাঁটা-বেড়া

  

 

- শাশ্বত স্বপন -

 

৪র্থ পর্ব

আবেগ মানুষকে এমন পথে চালিত করে যে পথে বাস্তব জীবন ক্ষণিকের জন্য হারিয়ে যায়: যখন ফিরে আসে তখন শুধরানোর হয়তো আর কোন পথ থাকে না। প্রেম মানে অপেক্ষায় থাকা। প্রেম মানেই সময়কে অপব্যবহার করে ভিন্ন চিন্তা বা কল্পনা করা। কিন্তু সময়ই জীবন এবং জীবন অতি ক্ষণস্থায়ী। সময় ও অপেক্ষা কিংবা সদ্ব্যব্যবহার ও অপব্যবহার পরস্পর বিপরীতধর্মী কাজেই প্রেম ও জীবন বিপরীতধর্মী। জীবন থেকে প্রেমের উৎপত্তি--প্রেম থেকে জীবন নয়। মোটা মোটা বই পড়ে সুজন আর শুভ হয়ে উঠেছিল দার্শনিক। বড়রাও ওদের যুক্তিতে হার মানত। শুভ বন্ধু-বান্ধবকে এসব যৌক্তিক কথা বুঝাত, তর্ক করত। কিন্তু ইন্দ্রানীর প্রেমে পড়ার পর তার সব যুক্তি ধূলোতে মিশে গেছে। কখন যে সে এমন হয়ে গেল--তা সে নিজেও জানে না। তার এখন প্রেমের জন্য জীবন। সে ইন্দ্রানী ছাড়া কিছু বুঝে না--কিছু বুঝতেও চায় না। তাদের প্রেমের গল্প গ্রামের আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা, কারো কাছে অজানা নয়। মুখে মুখে হাস্য রসিকরা বলে বেড়ায়, হিন্দু লাইলী আর মুসলমান মজনু--নয়া লাইলী-নয়া মজনু।

কাশবনের ভিতর দিয়ে ছুটতেই কাশপাতায় শুভর হাত কেটে গেল। উ-হু! শব্দটা ছড়িয়ে পড়ল কাশবনে। দু’জনেই থেমে গেল। শুভ হাতের রক্ত দিয়ে ইন্দ্রানীর কপালে রক্ত সিঁদুর মেখে দিল। তাকাল কিছুক্ষণ। ভাবল, বাঙালীত্ব নাকি হিন্দুত্ব। কেন জানি, তার মনে হল, সে ইন্দ্রানীকে ধর্মের নিয়মের চিহ্ন দিয়ে আলাদা করে দিচ্ছে। হ্যাঁ, এটা হিন্দুত্ব। সে চাকু দিয়ে কাঁটা স্থানটিতে আরো কাটল। ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হল। সে রক্ত সে ইন্দ্রানীর পায়ে আলতার মত মেখে দিল। মনে মনে সামাজিক নিয়মের ছকটাকে শত ছিন্ন করে বঙ্গোপসাগরে নিক্ষেপ করল।
-- কি করছ এসব!
--গভীর প্রেমের চর্চা করছি। যদি তোমাকে স্বাধীন করার জন্য আমার দেহের সমস্ত রক্তের প্রয়োজন হয়, আমি দেব--নিঃশর্তে দেবো--দেবো ভালোবাসার গভীর বিশ্বাসে। আমাকে ভালবেস তুমি--আমারী মত করে।
--শুভ, আমি তো আমার জীবনের চেয়েও বেশি ভালবাসি তোমাকে। কত আত্মীয়-স্বজন আমাকে বুঝিয়েছে। গলায়, হাতে, মাজায় কত তাবিজ-কবচ পড়িয়েছে। কোন কিছুইতো ছিনিয়ে নিতে পারেনি তোমার ইন্দ্রানীকে। কোনদিনও জীবন্ত অবস্থায় নিতে পারবে না।
--তুমি ছিলে আমার অতীত, তুমি আমার বর্তমান, তুমি হবে আমার ভবিষ্যৎ। তুমি আমার সময়, তুমি আমার সাধনা--আমার অর্ধেক জীবন।
--শুভ !

ইন্দ্রানী ওর ওড়না ছিঁড়ে কাঁটা স্থানটা বেঁধে দিল। শরতের আকাশ মেঘমুক্ত। একেবারে স্বচ্ছ আয়নার মত। সেই স্বচ্ছ নীলকাশে সাদা ভেজা ভেজা তুলার মত মেঘের ভেলা--সবার মন প্রাণকে ছুঁয়ে দেয়--ভাবুক করে তুলে। না, শুভ কিংবা ইন্দ্রানী--কাউকে শরতের এই মুহূর্ত ভাবুক করছে না। আকাশ, বাতাস, মাঠ-শষ্য নিয়ে তাদের ভাবার সময় নেই। শৃঙ্খলিত বর্ডার তারা জোড়পায়ে পেরিয়ে যেতে চায়। শুভ বলে চলেছে, ‘কুইক...।' ইন্দ্রানী হাঁপাচ্ছে, প্রচন্ড হাঁপাচ্ছে। বুকের ওড়না বারবার খসে পড়ছে। হৃদকম্পনের সাথে কাঁপছে তার বাড়ন্ত বুক। শুভর সেদিকে খেয়াল নেই। সে শক্ত করে ইন্দ্রানীর হাত ধরে আছে। সূর্যাস্তের এই সময়ে কৃষকেরা ক্লান্তদেহ নিয়ে ঘরে ফিরে যাচ্ছে। রাখালও গরুর পাল নিয়ে গোয়ালে ফিরে যাচ্ছে। জনশূন্য মাঠ। হঠাৎ ইন্দ্রানী হুমড়ী খেয়ে পড়ে গেল। শুভ থামল। কপালে, চিবুকে, গলায়, বুকে ঘামের ঘন পানি বিন্দুগুলি যেন এ সময়ের, এ সমাজের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করছে। সমাজের প্রতি ঘামের মধ্য দিয়ে যেন ঘৃনা বের হচ্ছে। শুভ ইন্দ্রানীকে উঠাল। দূর থেকে আযান ভেসে এল। আল্লা হু আকবর আল্লা ...। শুভ পকেট থেকে সুইচ গিয়ার বের করে পেছনে তাকাল। সুজন বেঈমানী করে সব বলে দিয়েছে না তো? কখনও না। ও বলবে না। তাহলে শুভর সন্দেহ হচ্ছে কেন? দেখল আশেপাশে কেউ আছে কিনা। ইন্দ্রানী হাঁপাচ্ছে। আযানের ধ্বনি যেন শুভকে ভয় পাইয়ে দিয়েছিল। যদিও সে স্বেচ্ছায় কোনদিন নামায-রোজা পালন করেনি। দু’একবার করেছিল সামাজিকতা রক্ষার্থে আর ভবিষ্যতে করবে কিনা সেটাও সামাজিকতার স্থান, কাল ও পাত্রের উপর নির্ভর করছে। তাই বলে সে নাস্তিক নয়--সৃষ্টিকর্তার প্রতি তার বিশ্বাস ও ভয়--দুই’ই আছে। আবার মাঝে মাঝে সন্দেহও জাগে। সব বিশ্বাসেই একটু না একটু সন্দেহ থাকবেই। যে ব্যক্তি বলে তার কোন একটা বিশ্বাসে সামান্য সন্দেহ ছিল না, বর্তমানেও নেই, ভবিষ্যতেও থাকবে না--তবে সে একটা মিথ্যাবাদী। মুক্ত মন মাত্রই ভুল-শুদ্ধের ছড়াছড়ি। নিজের অজান্তে, নিজের বিরুদ্ধে মন অনেক কাজ করে বসে। কারণ মনের কোন ধর্ম নেই--বরং ধর্মই তার উপর জোর করেই চাপিয়ে দেওয়া হয়। হয়তো এক সময় মন তা মেনে নেয়--তবে পূর্ণভাবে মানতে পারে কি?

 

 

 

ARNING: Any unauthorized use or reproduction of 'Community' content is strictly prohibited and constitutes copyright infringement liable to legal action. 

[প্রথমপাতা]

 

 

 

 

 

লেখকের আগের লেখাঃ