ধারাবাহিক উপন্যাসঃ কাক-জ্যোৎস্নায়
কাক-ভোর (পর্ব-২০)
শাশ্বত
স্বপন
একদিন দূর সম্পর্কের কানাই কাকা কালীকে বলল, তোকে দু’একদিনের মধ্যে
মুন্সিগঞ্জ থেকে বরপক্ষরা দেখতে আসবে। তুই একটু সেজে-গুঁজে থাকিস। কালী তাই
করল। সে জানে এ সম্ভন্ধও ঠিক হবে না। তার চিন্তা নেই, উল্কা তো আছে। হ্যাঁ,
ঠিক পরদিন দুপুরে কালী বাড়ির পাশে পেয়ারা কাছের নিচে দাঁড়িয়ে ক্লাশমেট
দিলীপ ও আনিসের সাথে কথা বলছিল। মা কালীর কাছে এসে কানে কানে বলছে, বরপক্ষরা
দক্ষিণের রাস্তা দিয়ে এ বাড়ীতে আসছে। কালী মায়ের সাথে ঘরে ফিরে এল।কালীকে
সাজাতে দীপা, নাসরিন ছাড়া আর কেউ এল না। পাড়াপড়শীরা জানে, এই মেয়েকে কেউ
নেবে না। বিয়ের সম্ভন্ধ ঠিক হলেও গুজবে বিয়ে ভেংগে যাবে। তুলসী কালীকে
বরপক্ষদের সামনে আনলেন। কালী এখন কাপড় পরিহিতা। বরপক্ষ থেকে বয়স্ক একজন
জিজ্ঞাসা করল ,
নাম?
উষা রানী হালদার।
উষা। আমিও গল্পে দু’এক জায়গা ছাড়া সর্বত্র শুধু কালী আর কালী...। কেন ?
আমারও অভ্যাস হয়ে গেছে। এই অভ্যাসের কারণেই কি কালী ডাকি ? না, অন্য বৃহৎ
এক কারণ আছে, আর এই কারণেরও শাখা-প্রশাখা আছে। কালীর হাতের লেখা চাওয়া হল।
কালী দ্রুত লিখে দিল। বেশ কিছু প্রশ্নের উত্তর কালী পটাপট বলে দিল। তার কোন
জড়তা নেই। বরের বাবাতো অবাক ! রূপে আর গুণে তার মনে হল, সত্যিই এ কিশোরী
দেবী কালী। দেবী কালীর কাছে হিন্দুরা অনেক কিছু দাবী করলেও দেবী কালী তাদের
বাড়ীতে ভর করুক, এটা কেউ চায় না। উপস্থিত এই বরের বাবাও না। বরের বাবা
প্রশ্ন করলেন,
আচ্ছা, মা বলতো এগার হাজার এগারশতে কত হয়?
কালী বলতে পারছে না। তার খুব খারাপ লাগছে। ইচ্ছে করছে এখান থেকে উঠে যেতে।
কিন্তু সমাজ যেন তাকে এই সময়ের শিকলে বেঁধে ফেলেছে।
ঠিক আছে লিখেই বল।
জ্বি, বার হাজার একশ।
বাহ্! এইতো হয়েছে। তোমরা কেউ কিছু জিজ্ঞাসা করবে?
তার সাথে যারা এসেছে তারাও প্রশ্ন করার জন্য তৈরী। একজন প্রশ্ন করল,
বলতো মা, চার হাতা কালীর সমগ্র দেহ কিভাবে সাড়ে তিন হাত মন্দিরে ঢুকানো যায়?
কালী উত্তর দিতে পারল না। কালীর তো চার হাতই থাকে। অতএব কালী মূর্তি কতটুকু
উঁচু তা তো বলা হয় নাই। প্রশ্ন অবান্তর, হাড়ি-পাতিল, সন্তান লালন-পালন আর
শয্যাসঙ্গের সাথে এসব প্রশ্নের কি সম্পর্ক ? কালী সম্পর্ক খুঁজে পায় না।
তেত্রিশ কোটি একটি দেব-দেবী থাকতে শুধু দেবী কালীকে নিয়ে কেন প্রশ্ন করা হল
? সে কালো বলে ? তার দেহ, চেহেরা দেবী কালীর সদৃশ্য বলে। এবার বরপক্ষরা কেউ
হাত, তার দেহ, কেউ পায়ের তলা ইত্যাদি পর্যবেক্ষণ শুরু করল।
নাসরিন বলে উঠল, বাপের জন্মে মাইয়া মানুষ দেখেন নাই। আপনাদের মা-বোন নেই।
এভাবে মেয়ে দেখে, না গরু দেখে। কালীরে নেংটা করে দেখাও ঠাকুমা, তবে সবাই মনে
শান্তি পাবে।
বরপক্ষ থেকে যুবক ছেলেটি বলে উঠল, এমন দজ্জাল মেয়ে জীবনেও দেখিনি। মেয়ে
মানুষ এমন হয় ? কোন দেশে আসলামরে ভাই।
বরপক্ষ থেকে আরেকজন ওকে চুপ থাকতে বলল। দীপা বলে উঠল, বাংলাদেশেই আসছেন।
মেয়ের কি দেখেছেন,আমাদের বাড়ীতে এমন ভাবে দেখলে ঝাটাপিটা করতাম। ইচ্ছা করেতো
জুতা দিয়া পিটাই। মাইয়া দেখতে আসছেন নাকি গাভী দেখতে আসছেন। বরপক্ষ থেকে
একজন বলে উঠল, এ মেয়েতো ভারী পাজী ! এদের বিয়ে করব কে?
এরপর যা হবার তাই হয়েছে। নাসরিন, দীপা মা-বাবার বকা খেয়েছে। এরপরও কালীর
সম্ভন্ধ এসেছে এবং বরাবরের মত তারা প্রশ্ন শেষে আগের মতই চুল থেকে শুরু করে
পীঠ-আঁচল-হাত-পা-মাথা-আঙ্গুল-হাতের রেখা-হাঁটার গতি-কাপড় উঠিয়ে হাঁটু
পর্যন্ত দেখে।তবুও যেন শান্তি পায় না। মনে হয়, আর কিছু বাকী রয়ে গেল।
নাসরিন, দীপা, শিখা--ওরা তিনজনেই উপস্থিত ছিল। সেদিনের মা-বাবার বকুনির কথা
ভেবে তারা ওখান থেকে উঠানে চলে এল। বান্ধবী কালীকে এভাবে দেখছে বলে তাদের
প্রচন্ড রাগ হচ্ছে। দীপারা বর্ণে পাল এবং দীপা সুন্দরী বলে কোন বরপক্ষ
বাহ্যিক এক নজর দেখেই চলে যায়। কিছু জিজ্ঞাসাও করে না। অভিভাবকদের সাথে
দেনা-পাওনা নিয়ে আলোচনা করে।তবে কিছু বরপক্ষ তাদেরকেও নিখুঁতভাবে দেখেছে।
তবে কালীকে যেভাবে দেখে সেভাবে নয়। আর নাসরিন মুসলমান ও সুন্দরী বলে এভাবে
দেখার প্রশ্নই উঠে না। যত সমস্যা সব নিম্নবর্ণে আর দরিদ্রে সমাজে। ধর্মের
যত কুসংস্কার সব দরিদ্র আর নিম্নবর্ণের মানুষরাই বহন করে। আর ভালোবাসা,
প্রেম, বিয়ে এই তিনটি কালোর উপর ভীষণ ক্ষুব্ধ। কালোর উপর
প্রেম-ভালোবাসা-বিয়া সহজে গড়ায় না।
দীপা, নাসরিন, শিখা আজ কিছুই বলতে পারছে না। বরপক্ষরা কালীর পিছন দিক দেখার
ইচ্ছা পোষণ করলে কালী রেগে যায়। প্রচন্ড জোড়ে চিৎকার করে উঠে-আমি মানিনা
এসব নিয়ম--
রাগে-ক্ষোভে সে নিজের কাপড়-চোপর ছিঁড়ে ফেলতে শুরু করে। কালী সুলতান আর ওদের
মাঝে কোন তফাৎ খুঁজে পায় না। সুলতান মাস্তান টাইপের ছেলে। চুল আর হাঁটার
স্টাইল দেখলেই বুঝা যায় সে বখাটে। মেয়েদের পথে-ঘাটে দেখলেই উস্কানী দেয়।
কোন ছেলে ভালবেসে প্রত্যাখিত হলে অথবা ছ্যাকা খেলে সুলতানের শিষ্য হয়ে যায়।
সুলতানকে কেউ ধমক দিতে সাহস করে না।নির্বাচনের সময় তার প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম
বলে সে চেয়ারম্যানের ছত্রছায়ায় থাকে। সে কালীকে একদিন সরাসরি পাটক্ষতে আসতে
আহবান করেছিল । সিকান্দার হাঁটু ,পীঠ কিছু দেখেনি। তাকে কখনও ম্পর্শও করেনি।
শুধু পরিধানের উপর যা দেখার মত--নরম মাংসল দেহ আর অন্য দু’টি পরম আকর্ষনীয়
বস্তু-- যা সবার জন্য ধ্রুব।
দুই/তিন মাস পরে সিরাজদিখান থানার রাইজদিয়া গ্রাম থেকে তাকে দেখতে এল।
এখানেও প্রায় একই কাজ হল। তবে কিছু ব্যতিক্রম কথাবার্তা শুনা গেল। মনে হয়
তারা কালীর সম্পর্কে অনেক কিছু জানে। বরের কাকা কি করে জেনেছিল কালী সাইকেল
চালাতে পারে। হোন্ডায় করে ছেলেদের সাথে ঘুরে বেড়ায়। ভলিবল, সাঁতার আর দৌঁড়ে
তার তূলনা নেই। মনে হয় সুলতান, মোহন অথবা বাদল--ওদের কেউ এসব নিউজ দিয়েছে।
সিকান্দার বলেছিল, তাকে এ দেহ একবার ভোগ করতে না দিলে সে কালীর বিয়ে ভেঙ্গে
দেবে। সে কালীর বিশাল স্তন্যের মাঝে শান্তি খুঁজতে চায়। সুলতান, মোহন,
বাদল-ওদের ধারণা বড় ভাইয়ের দল সজীব, সাবুদ, তোতা ওরা কালীকে ভোগ করে। কারণ
কালী ওদের সাথে হোন্ডায় চড়ে বেড়ায়। হেসে হেসে কথা বলে। কে যেন গুজব ছড়িয়েছে
সাবুদের সাথে ক্লাব ঘর থেকে কালী দুপুর বেলা একা বের হয়েছে। অনেকে এটাও
ছড়িয়েছে কালী দুই/তিনবার প্রেগনেট হয়েছিল। তাই সুলতানদের দুঃখ তারা কিশোর
গ্রুপ কালীকে একটু ভোগ করতে পারল না। কালী বড়দের সাথে হেসে বেড়ায় আর তাদের
দেখলে দেমাগ দেখায়। মুখ কালো করে পথ বদলায়। মোহন ওর উপর বেশী রেগে আছে। সেই
ঘুষির কথা কাউকে সে বলেনি। বলেছে বুকে হাত দিয়ে বড় তৃপ্তি পেয়েছে। বাদল
বলেছে, সে অনেক জায়গা ছুঁয়ে দেখেছে। ইচ্ছে করলে মুন্সিগঞ্জ থেকে খেলা শেষে
ফেরার পথে আরো কিছু করতে পারত।
এবারের বরপক্ষের কাকা কালীকে আপনি সম্মোধন করে প্রশ্ন করল-
আপনি তো শুনেছি সাইকেল চালাতে পারেন। হোন্ডাও পারেন ?
-- না-
-- সাঁতার, ভলিবলে আপনি বেশ সুদক্ষ। আপনাদের বাড়ীতে আপনার অনেক পুরস্কার
দেখলাম। আপন মেধাগুনে ইচ্ছে করলে তো ক্রিকেট, ফুটবলও খেলতে পারেন ?
কালীর ইচ্ছে হচ্ছিল এক ঘুষি মেরে বেটার নাকটা ফাটিয়ে দেয়। কিন্তু সে যে নারী।
সে ধর্মের শিকলে, সমাজের শিকলে, সময়ের শিকলে বন্ধি। ছেলেরা ফুটবল, ক্রিকেট
খেলে। তারা কেন পারবে না ? তারাও পারবে। তবে এ সমাজ তাতে অভ্যস্ত নয়। এ
প্রশ্ন করার মধ্যে সূক্ষ্ম ব্যঙ্গ আছে।
কালীও স্বতস্ফুর্ত জবাব দিল।
-- হ্যাঁ, পারি, ইচ্ছে করলে ক্রিকেট, ফুটবল খেলতে পারি। কিন্তু আপনারাতো
সহ্য করতে পারবেন না। শুকর খাওয়াতে যারা অনভ্যস্ত--তারা শূকর দেখলেই খিটখিট
করে।
পরিস্কার যুক্তিপূর্ন জবাব। কিন্তু এটা তো যুক্তি তর্কের সময় নয়। এটা
লজ্জাচর্চার সময়। লজ্জা নারীর ভূষণ। তাই কালীর প্রতিটি কথায় লজ্জিত থাকা
উচিত ছিল। পারলে কান্নার প্রতীক প্রমাণ করা উচিত ছিল। তাহলে হয়তোবা করুনা
পাওয়া যেতেও পারে। বরের কাকা চোখ বড় করে, ঠোঁট ফাঁক করে হাবার মত হা করে
রইল। বাইরে থেকে নেপথ্য কণ্ঠস্বর, “মুখ বন্ধ করেন--মাছি যাবে”। তারপর যা হয়।
কালীর বাবার আপ্যায়ন খরচ আর কালীর হাতে ৫১ অথবা ১০১ টাকা জমা পড়ে।
(চলবে)
ARNING:
Any unauthorized use or reproduction of 'Community' content
is strictly prohibited and constitutes copyright infringement liable to
legal action.
[প্রথমপাতা] |