ধারাবাহিক উপন্যাসঃ কাক-জ্যোৎস্নায়
কাক-ভোর (পর্ব-১৭)
শাশ্বত
স্বপন
কালীকে বিয়ে দেবার জন্য কালীর মা-বাবা, মামা-মামী ও অন্যান্য
আত্মীয়-স্বজনরা উঠে পরে লেগেছেন । কত বড় বোঝা কালীপদের উপর। মামা-মামী
কালীকে বেড়াতে যেতে বললেও, সে কোথাও বেড়াতে যেতে চায় না। যেখানেই যায়
সেখানেই গায়ের রং আর চেহারা নিয়ে সমালোচনা উঠে। কালো হওয়া যেন তার কত বড়
অপরাধ। পুরুষরা তার চেয়েও কালো, আরো কুৎসিত আছে, কোথাও তাদের নিয়ে সমালোচনা
হয় না। কালীপদও কালো কুচকুচে, তাকে নিয়ে তো সমালোচনা হয় না। কালী পেয়েছে
তার বাবার গায়ের রং। জয় অবশ্য একটু ফর্সা, তার চেহেরা মোটামুটি ভাল। আরো
তিন ভাই-বোন আছে। এক ভাই ও এক বোন কালীর মতই কালো। তবে চেহেরা ভালো। অনিতার
চেহেরা ঠিক মায়ের মত। পাত্রপক্ষরা যৌতুক ছাড়াই নিয়ে যাবে। কিন্তু কালীকে
বিয়ে না দিলে অনিতাকে তো বিয়ে দেওয়া সমাজে সইবে না। তাছাড়া আরও কালো বোন
আছে। তাকেও বিয়ে দিতে অনেক টাকা লাগবে।
পুরুষ ল্যাড়া, অন্ধ, কুষ্ঠ রোগী, কালো নিগ্রোদের মত হলেও তাদের কিনতে হয়
বররূপে। অথচ নারী অন্ধ, ল্যাংড়া কিংবা কালো হলে কি দুর্ভোগ পোহাতে হয়।
সুন্দরী মেয়ের বিয়ে হলেও যৌতুক, বন্ধ্যাত্ব অথবা অন্য কোন কারণে হতে হয়
লাঞ্ছিত।আজো বহু নারীরা হাজার জ্বালা-যন্ত্রণা সহ্য করেও জীবন্মৃত হয়ে
বেঁচে আছে । স্বামীত্যাগী নারী, সে আর এক সামাজিক চিড়িয়া। স্বামী ত্যাগ করে
বিয়ে করলেও (বিয়ে বসলেও) নূরজাহান কিংবা হাজার অসহায় নারীর মত এ সমাজ বিচার
করে ধর্মীয় বিধানের অপব্যবহার করে। যারা অসহায়,যাদের পিঠে কিল বসালে
নিউটনের তৃতীয় সূত্রের মত প্রতিক্রিয়া হয় না, তাদের উপর চলে রাষ্ট্রীয় আইন
বিরুদ্ধ ফতুয়া। তবে সব নারী এ অন্ধকারের শিকার নয়, কিছু নারী অবশ্যই
ব্যতিক্রম। আর এই ব্যতিক্রম না থাকলে মহাজ্ঞানীদের তৈরী উপদেশের আর পুরুষের
তৈরী পার্থিক আইনের কি মূল্য রইল।
কালোত্বের, কর্ণবৈষ্যম্যের আর নারীত্বের পাপধারী কালীকে বরপক্ষরা দেখতে এসে
ভীড় করা মেয়েদের কাউকে পছন্দ করে নেয়। যেন, এই গাভীটা পছন্দ হয়নি, ঐ গাভীটা
পছন্দ হয়েছে। বরপক্ষরা সরাসরি অপছন্দের কথা বলতে পারেন না।পাহাড় আকৃতির
যৌতুক চেয়ে বুঝিয়ে দেন, আপনার গাভীটাকে পছন্দ হয়নি। দেখা যায়, এই বরপক্ষরা
পছন্দ করা গাভীটার বাড়ীতে হেসে হেসে মিষ্ঠি মুখ করছেন। হ্যাঁ, কালীর
বান্ধবী শিখাকে ওরা বরের জন্য পছন্দ করেছেন এবং আগামী মাসে বিয়ে হবে।
সুন্দরী মেয়ের কাছে যৌতুক হার মেনে একেবারে বস্তা থেকে ম্যানিব্যাগ হয়ে
গেছে। বরপক্ষদের কন্যা ছাড়া আর কোন দাবী নেই। তবে ইচ্ছে করে কন্যা পক্ষ যদি
কিছু দেয়, তাতে তারা বেজার হবে না। শিখার বাবা মহাখুশী। চৌদ্দ বছরের মেয়েকে
বিয়ে দিচ্ছেন একত্রিশ বছর বয়সী ছেলে সাথে। কালীদের সাথে বরপক্ষদের গোত্রটা
মিল হলেও একটু জাপসা। কিন্তু শিখাদের সাথে গোত্রমিল স্পষ্ট। ভাল ছেলে, বিএ
পাশ করেছে, ব্যবসা করে। বেশ সম্ভান্তই বলা চলে। তাছাড়া ঘরের ঝামেলাও পাতলা
হবে। মেয়েকে বিদায় করতে পারলেই পিতারা যেন স্বর্গে যান, নাকে তেল দিয়ে
ঘুমাতে পারেন। মেয়ে যদি পিতার সংসারে নরক সৃষ্টি করে, ঘুম কেড়ে নেয়, তাহলে
পিতা কেন তাকে জন্ম দেয়? শিশু অবস্থায় মেরে ফেলতে পারে না? প্রাচীন আরবে
নারী শিশুদের নাকি জন্মের পরে কবর দেওযা হত।
শিখার স্বপ্ন ছিল পরিমলকে নিয়ে সে ঘর বাঁধাবে। সে পরিমলের পরিবার, তার
চরিত্র, তার ব্যবহার সব কিছুর সাথে পরিচিত। সে একটু একটু করে পরিমলকে
চিনেছে। তার পছন্দ মতই সে বিয়ে করতে চেয়েছে। পরিমল বসুপালের দোকানে কাজ
করত। সে শিখাকে কথা দিয়েছিল, যখন প্রতি মাসে তিন হাজার টাকা কাজ করতে
পারবে, তখন সে শিখাকে বিয়ে করবে। সেদিনের কথা শুনে শিখা আবেগ প্রবণ হয়ে
পড়েছিল। জড়িয়ে ধরে ছিল পরিমলকে। স্বপ্ন দেখেছিল অনাগত দিনের। স্বপ্ন স্থায়ী
হয়নি। শিখার বাবা তাকে জোর করেই বিয়ে দিল। পরিমলের নামে শিখার কাছে এমন সব
কুৎসা রটানো হল--যা শুনে সে অজ্ঞান হয়ে পড়েছিল। বিয়ের রাতে শিখাকে নিয়ে
পরিমল পালিয়ে যেতে চেয়েছিল। ভীতু শিখা সে সাহস সঞ্চয় করতে করতে বিয়ের
পিঁড়িতে বসে পড়ে। বিয়ে হয়ে গেল। পরিমল উদাসীন পথিকের দলে মিশে গেল।
তিন মাস যেতে না যেতেই বিশ্বস্রষ্টা শিখার স্বামীকে পরলোকে নিয়ে গেলেন।
শিখা বিধবা হল। স্রষ্টা শিখার স্বামীকে স্বর্গে, নয়নো নরকে ঢুকাবে। আর
শিখা, তার কি হবে? সে জন্য ধর্মের আশ্রয় নিতে হবে না। স্রষ্টার দেওয়া চোখ
দিয়ে বাস্তবেই দেখা যাবে। শিখার স্বামী ছিল পাঁচ বছর ধরে অসুস্থ। বিয়ে করলে
সুস্থ্য হতে পারে ভেবে, করালো বিয়া এবং সুস্থ্য হল। এমন সুস্থ্য হল যে,
স্রষ্টা তাকে তার কাছে চিরতরে না নিয়ে পারলেন না। শ্বশুর বাড়ীতে বিয়ের পর
পরিমলকে নিয়ে বেশ কথা উঠেছিল। অনেক কটাক্ষ সহ্য করেছে শিখা। এখন আর কেউ
কটাক্ষ করে না। শিখা এখন বাপের বাড়িতে সাদা কাপড় পরিধান করে। কোন কসমেটিক্স
জিনিস ব্যবহার করে না। শোকে শোকে ঠিকমত তার খাওয়া হয় না। একবার ঘুমন্ত
অবস্থায় কালী শিখাকে সাজিয়েছে। ঘুম থেকে উঠতেই কালী ওর মুখের সামনে একটা
আয়না ধরে। শিখা আয়নাতে নিজের চেহেরা দেখে কেঁদে ফেলে। সে বলতে থাকে,
কাকা-কাকী সবাই আমাকে অলক্ষ্মী বলছে। শ্বশুর বাড়ীর সবাই বলে, ছিঃ অলক্ষ্মী
বউ. তিন মাস না যেতেই স্বামীটাকে খেল। সে যেন আমার জন্যই মারা গেল। আমার
আপন মা-বাবাও আমাকে...।
শিখা কালীকে মনের দুঃখ এমন ভাবে বলছে, মনে হয়, কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে তার নিজের
অপরাধের শাস্তি দাবী করছে। স্বামীকে যেন সেই মেরেছে। একটা মিথ্যা জনে জনে
উচ্চারিত হলে তা সত্য বলেই মনে হয়। আর তা যদি হাজার হাজার বছর ধরে মানুষের
মনে বিশ্বাসের সাথে বসতি গড়ে, তা হয় আরো সত্য, জীবনের চেয়ে সত্য। এমন বিরাট
বিরাট মিথ্যার হিমালয় এ পৃথিবীর বুকে চিরস্থায়ী ঠাঁই করে নিয়েছে।
-- কিরে, তুই আমাকে চিনিস না। মনে হয় জজ সাহেবের কাছে দুঃখের কথা বলছিস।
কোন লাভ হবে না। আমার মত হাসবি-খেলবি। দশজনের সাতে কথা বলবি। এই শিখা দেখ,
তোকে কত সুন্দর লাগছে।
--আর সুন্দর দিয়ে কি হবে? আমার জীবনটা নষ্ট হয়ে গেল।
-- কি বলিস, আলী বক্স এর মত কামলায় দুইটা বিয়ে করেছে। হোসেন চাচা এত কালো
অথচ বুড়া বয়সেও সুন্দরী এক মেয়ে বিয়ে করেছে। এক চোখ কানা দুলাল মিয়াও দুইটা
বিয়ে করেছে ২য় বারেও পন্চাশ হাজার টাকা, দুই ভরি স্বর্ণ যৌতুক পেয়েছে। ওরা
বিয়ে করতে পারলে আমরা পারব না কেন? আমি তো নিজেই দুইটা বিয়ে করব। প্রথমটার
সাথে মারামারি করব। তারপর জানি, আমাকে ছেড়ে দেবে। তারপর আবার বিয়ে করব।
দরকার হলে সারাজীবন বিয়ে করতে থাকব-- যতদিন কালোত্ব আর ধর্মত্বের কুসংস্কার
দূর না হবে।
কালী শিখার সাথে প্রথমে তামাসা করলেও হঠাৎ কেমন জানি ক্ষেপে উঠল। শিখা
স্মিত একটু হাসলেও পরে কালীর প্রতি খুবই মনোযোগী হয়।
--এইসব সাদা কাপড় পুইড়া ফেল। তোর কাকার বউ মারা যাবার পর তোর কাকা সাদা
কাপড় পড়েছে? নিরামিষ খেয়েছে ? খায়নি । আমরা কেন খাব? কোন কথা কানে নিবি না।
এখনো তোর সন্তান হয়নি। কত ছেলেরা এখনও তোর দিকে তাকিয়ে থাকে। তুই আবার বিয়ে
করবি।
-- আবার বিয়া ? হুঃ...
-- কেন হুঃ কেন?
--পরিমলও আমাকে দেখতে পারে না। চিনেও চিনে না ।
--থাক, তুই আবার লেখাপড়া কর।
--কি হবে আর পড়ালেখা করে?
--বেশী বুঝিস না। সাদা কাপড় খোল। নিরামিষ নয়, আমিষই খাবি।
কালী বলতে বলতে শিখার কাপড় খুলে ফেলে। শিখা ওকে জড়িয়ে কাঁদতে থাকে। বলতে
থাকে,
মা-বাবা পিটিয়ে বাড়ী ছাড়াবে। সমাজ যে আরো খারাপ বলবে। সমাজে মা-বাবা,
কাকা-কাকী মুখ দেখাবে কি করে।
কালী ওকে টু-পীচ পড়াতে গিয়ে থেমে যায়। সে শিখার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে।
ভাবে, আমরা সবাই মা-বাবার কাছে বন্ধি, মা-বাবা সমাজের কাছে বন্ধি, সমাজ
ধর্মের কাছে আর ধর্ম সময়ের শক্ত শিকলে বন্ধি। এতসব বন্ধি দশা থেকে আমরা কি
ভাবে, কখন ছাড়া পাব। সেই দিন কি সামনে আসবে?
ARNING:
Any unauthorized use or reproduction of 'Community' content
is strictly prohibited and constitutes copyright infringement liable to
legal action.
[প্রথমপাতা] |