[প্রথমপাতা]
|
ঝরা পাতার গান
- শাশ্বত স্বপন
-
কুয়াশার অন্ধকারে হাজার বছর ধরে শীত
কন্যা আসে ষড়ঋতুর লীলা বৈচিত্রের হেমন্তের ফসলে আঁকা মেঠো পথ ধরে। স্থান,
কাল ভেদে এ শীত কন্যার রূপ নানা অঞ্চলের দেব-দেবীর মত নানা সজ্জায় সজ্জিত
হয়। হেমন্তের মাড়াই করা ধান বড় বড় কড়াওয়ালা মাটির হাড়িতে রাখতেই শীত রূপসী
শীতের নানা উপকরণ কুয়াশার চাদরে ঢেকে এনে রাখে গৃহস্তের আঙ্গিনায়; কড়াওয়ালা
মাটির হাড়িতে টোকা দিয়ে বলে, ‘এই গৃহস্থ আমি এসেছি ; চল, পিঠা-পুলি-পায়েস
বানাই।’
হেমন্ত আর বসন্তের মাঝে শীত আসে শূন্য মাঠের পথে, নিরবে। প্রকৃতি যেন,
মানুষের মত কাঁপতে থাকে ভীত সন্ত্রস্ত পদভারে। বৃক্ষ তার সমস্ত পত্র অর্ঘ
হিসাবে অর্পন করে শীত দেবীর পদতলে। গাছে পাতা নেই, ফুল নেই, মাঠে ফসল নেই।
প্রকৃতি যেন ধ্যানমগ্ন ভিক্ষু সন্নাসীর মত সব সম্পদ দান করে দীর্ঘ উপাসের
মধ্য দিয়ে পরম বৈরাগ্য লাভ করে। শীতের রাত যেন, শেষ হতে চায় না। নির্ঘুম
একটা রাত যেন, হাজার বছরের রাত। কুয়াশাচ্ছন্ন সকাল; কোনদিন সারাদিনেও সূর্য
নেই; শুধু মাঝে মাঝে কুয়াশার মধ্য দিয়ে হালকা লাল আভায় উঁকি দিয়ে যায়।
পাহাড় দেশের মেঘ যেন, কুয়াশা রূপ নিয়ে শীত দেবীর রথে চড়ে দূর কোন পাহাড়
থেকে প্লাবিত হয়ে আসে ভাটি বাংলার দেশে।
প্রতিবেশী কারো কাঁপানো, ভাঙ্গা গলার ডাক শুনে হাড় কাঁপানো শীতে আমি চাদর
মুড়ী দিয়ে দরজা খুলতেই একরাশ কুয়াশা ঢুকে পড়ল আমার ঘরে। দরজা-জানালা সব
বন্ধ করলেও কুয়াশা ঢুকে খড়-ধঞ্চে-পাটখড়ীর বেড়া-ছন-ছাউনির ফাঁকে ফাঁকে।
‘কামে যাইবা না, ধর তোমার পান্তা-পিয়াজ-মরিচ আর কাস্তে-কোদাল...।’ ঠোঁট
ফাঁটা হাসির ফাঁকে কত কথাই না বলে যায় বীনা। কথার সাথে সাথে মুখ থেকে বের
হওয়া কুয়াশা যেন, না বলা হৃদয়ের কথা অকপটে বলে দেয়। ঘুম ভাঙ্গা হাসিতে কত
কথাই না তারে বলি। কে সে মোর, কেন এত আপন, আত্মার সে কি আত্মীয়--আমি জানি
না। শুধু তারে না দেখলে মন যেন, কেমন করে। এই তারে দেখি, প্রকৃতির মত নানা
রংয়ে, ঢংয়ে, হাসি কান্নায়। কি আশার আলো নিয়ে কুয়াশার অন্ধকারে
কাস্তে-কোদাল, পান্তা-মরিচ-পিয়াজ নিয়ে মাঠে চলি নিরবে, একাকী। দু’হাতে
কুয়াশা ঠেলে ধীর পায়ে এগিয়ে চলি ঘন শিশির মাখা মেঠো ঘাসের পথ ধরে। চোখে ঘুম
লেগে থাকে। কত বেলা বুঝা যায় না।
শীত আসার সঙ্গে সঙ্গে গ্রাম বাংলার জলাশয় শুকিয়ে আসে। আমারি মত কর্মমুখর
মানুষগুলি শীতের সকালে কাজের টানে ছুটে চলে মাঠ-ঘাট-হাওর-বাওর-বিলে। কাজের
সাথীরা মাঝে মাঝে মাঠের কাজ না করে অথবা কাজ ফেলে কোথা যেন, ছুটে যায়। হঠাৎ
কোন সাথীর ডাক শুনি, ‘কুইক্কা, যাবিনি, ভুইগদার বিলে, কাইলকা দুলাইললা মেলা
মাছ ধরছে, যাবিনি?’ গ্রামে যারা বাস করেন তারা জানেন, খোকা থেকে কোকা, কোকা
থেকে কুইক্কা--কিভাবে নামের বিবর্তন হয়। যাই হোক, নিজের ক্ষেতের কাজ ফেলে
ছুটি চলি সাথীদের সাথে। গ্রাম বাংলার হাওর-বাঁওর-ছোট
নদী-নালা-খাল-বিল-ডোবায় মাছ ধরার হিরিক পরে যায়। ভুইগদার বিলে মাছ ধরতে
কতবার গিয়েছি। ছয় সাত মাইল হাঁটাপথ। শীত যেন কোথায় পালিয়ে যায় আমার দেহ
থেকে। কি টান, কি উদ্দাম--ঠান্ডা পানির মধ্যে মাছ ধরা। শিং মাছের কাঁটা
ফুটে কত ক্ষত হয়েছে হাত-পা। বিষকাঁটালী বিরুৎ গাছের পাতা-ডগা দিয়ে কত ঘষেছি
ক্ষতস্থান। পল, টাকজাল, জালি, ক্ষেতজাল, টেডা, বড়শী ইত্যাদি দিয়ে টেংরা,
বউজ্জা, শিং, মাগুর, কই, পুটি, শৈল টাকি--কত না মাছ ধরেছি! বৃহত্তর
ময়মনসিংহের ‘বিল বাওয়া’ উৎসবের মত আমাদের এই অঞ্চলেও ‘মাছের হরিলুট’ উৎসব
হত। ঝুড়িতে, সিলভারের হাড়িতে অথবা গামছার আঁচলে মাছ বেঁধে রান্নার স্বাদ
নিয়ে কত গল্পই না করেছি সাথীদের সাথে। বিক্রমপুর অঞ্চলের কিছু কিছু
বিল-ঝিল-হাওরের গভীর পানি হেমন্তের পরেও থাকে। গ্রীষ্মের চৈত্রমাসে সব
শুকিয়ে আসে। কি যাদুর টানে অথবা কি রহস্যময় আনন্দে মাঘ মাসের শীতেও মাছ
ধরতে শীত অনুভব হয় না। যেটুকু অনুভব হয়, দু’একটা সিং, কই ধরার পর তাও চলে
যায়। মাঝে মাঝে আকিজ বিড়ি, রমনা বিড়ি অথবা যে কোন সুখটানে কোথা যেন শীত চলে
যায়। বিল থেকে আসার পথে কলমী শাক, সরিষা পাতা নিয়ে আসি বাড়ীতে, সবাই খুশী
হবে বলে। হরিলুটের মাছ পাড়া-প্রতিবেশী, আত্নীয়-স্বজনদের মাঝে ভাগ করে দেওয়া
হত। বড় ভাগটা থাকত বীনাদের জন্য। গায়ের কোন পুকুরে মাছ ধরার ডাক পড়লে
বীনাকে পুকুর পারে থাকতে বলি। নানা ভংগিতে মাছ ধরি আর ওর হাসি মাখা মুখটা
দেখি। মাছ ধরার সেরা কৃতিত্ব নিয়ে শুকনো কাঁদার চটচটে পায়ে মাটির ঘরের
আঙিনায় জুড়ী-ডোলার সব মাছ ফেলি। ছোট মাছগুলো রেখে সব দেই প্রতিবেশীদের
বিলিয়ে। ঠোঁট চাপা, মুখ ভেংচি আর কথা কাঁটার ভংগি দেখে বুঝি, এই ভাগাভাগি
বীনার পছন্দ হয়নি। বলি তারে, ‘আরে, অগো নাচানাচি আর দোয়ায়ইতো এত মাছ
ধরলাম।’ বলে সে, ‘তাই বইলা, সব বড় মাছ হেগো দিবা।’
মনে পড়ে, কাজের সন্ধানে কয়েকবার যেতে হয়েছে সুনামগঞ্জের জামালগঞ্জ। বর্ষায়
দিগন্তবিহীন হাওর--কূল নাই, কিনারা নাই--এযেন, সাগর। শীতের আগমনে ছোট ছোট
নদী-নালা-খাল-বিল হাওর থেকে যেন, জেগে উঠে ফসলের মাঠ।
নদী-নালা-খাল-বিল-পুকুর-ডোবা মিলেই এ সুবিশাল হাওর। শীতকালে হাওরের সীমানায়
দাঁড়িয়ে অবিশ্বাস্য চোখে আমি তাকিয়ে থাকি। ভাবি, হাওরের পানি কোথায় চলে
যায়। দেখি, চারদিকে মাছ ধরার মেলা; কোন কোন নৌকার খোলা, মাছে পরিপূর্ণ।
কোথাও হাঁটু পানি; গরু-মহিষ সেই পানি পেরিয়ে যাচেছ সবুজ তৃণভুমিতে। বিল-ঝিল
হাওরের অতি আপন বৃক্ষ হল হিজল গাছ; মাসের পর মাস পানিতেই কেটে যায় এদের
জীবন। শকুন, ভূবন চিল মাছ শিকারের ফাঁকে হিজল গাছের ডালে ডালে বিশ্রাম করে।
ঝাঁকে ঝাঁকে পানকৌড়ি, বক, শালিক ইত্যাদি জানা-অজানা বিদেশী পরিযায়ী পাখিরা
ভীড় করে হিজল গাছে, জেগে উঠা জলাশয়ে খুঁজে খাবার। কাজের অবসরে আনমনে ভাবতে
থাকি--বর্ষাকালের জলডুবা হাওর আর শীতকালে সেই হাওরে ঢেউ খেলানো সবুজ ফসলের
মাঠ--প্রকৃতির কি বিচিত্র খেলা!
রূপসী বাংলার হাওর-বাঁওর-বিল-নদী-নালা-খাল শীতকালে অতিথি পাখিদের কলকাকলীতে
মুখরিত হয়। শ্রীমঙ্গলের হাওরের বাইক্কা বিল, সুনামগঞ্জের হাকালুকি,
রাজশাহীর চলন বিল অথবা দিনাজপুরের রাম-সাগর, চট্রগ্রামের ফয়েজ লেক অথবা
করতোয়া, নাগর, বাঙ্গালী, ইছামতি, বুড়িগঙ্গা, ধলেশ্বরী, মাতামুহুরী,
কপোতাক্ষ, সুরমা, কর্ণফুলি, তুরাগ, কুশিয়ারা, নাফ, কির্ত্তনখোলা, পশুর
ইত্যাদি জলধারায় মাছ ধরা অথবা নৌকার কত না ম্মৃতি মনে পড়ে। শুকনো নদ-নদীর
শাখার বদ্বীপে, ঘাটে অথবা নদীর কূল ঘেঁষে ক্ষনস্থায়ীভাবে গড়ে ওঠে
গ্রাম-গঞ্জ-বন্দর । বর্ষায় সব প্লাবিত হয়ে একাকার হয়ে যায়। আবার শীতের
অপেক্ষায় জেগে থাকা মানুষেরা অন্য জায়গায় ছুটে চলে।
গায়ে ফিরে বীনাকে নানা দেশের নানান গল্প বলি। গল্পের স্রোতে ভেসে এক সময়
বলে উঠে, ‘তুমি কেমনে সাজাও এত কথার মেলা, এত সুন্দর করে!’ নদী ভাঙ্গা আর
নদী গড়ার মধ্যেই আমাদের জীবন। পদ্মা নদীর পারে আমাদের মত আরো কিছু পরিবারের
বসতি। এক রাতের ভাঙ্গনে নদী আমার পরিবারের সব কেড়ে নিয়ে গেছে। আর বীনার
পরিবারের বীনা আর ওর বাবা ছাড়া কেউ বাঁচেনি। স্কুলের বোডিং-এ আমি ছিলাম,
তাই বেঁচে গেছি। বীনার বাবা সব হারিয়ে বীনাকে ওর নানীর কাছে রেখে কোথা যেন
চলে গেছে। আমাদের দু’জনার নানী বাড়ি শরীয়তপুরের জাজিরার পূর্ব নাওডোবায়,
উত্তর-দক্ষিণে দুই পুকুর আর পূর্ব-পশ্চিমে চার ঘর বেষ্টিত একই উঠোনে।
দু’জনার সম্পর্কের বিষয়ে সবাই জানে। আমার নানী আমার ভবঘুরে জীবন মাটির ঘরের
মুলি বাঁশের বেড়ায় বাঁধার জন্য শীতকালের সময়টাকেই বেছে নিয়েছে। দুই নানীর
বকা খেতে খেতে শীতের এক বিকালে ‘কবুল’ করে কাঁশ আর নাড়া দিয়ে নতুন ছাউনি
করা ধঞ্চে-পাটখড়ী বেড়ার মাঝে মুলিবাঁশের দরজা ঠেলে দুজনে ঢুকলাম। ঢুকলাম না
বলে, বলা যেতে পারে, দুই নানী ঘাড় ধাক্কা দিয়ে ঢুকিয়ে দিয়েছে এবং বলে
দিয়েছে, এই শীতেই যেন, নাতির গন্ধ পাওয়া যায়, আচারের ব্যবস্থা তারাই করবে।
আসলে আমার ভবঘুরে, বাউল জীবন নিয়ে আমার নানী বড়ই উদ্বিগ্ন ছিল। কত তাবিচ
কবচ যে আমার হাত-গলা-মাজায় দিয়েছে--তা গুনে শেষ করা যাবে না। মসজিদের হুজুর
আর মাজারের খাদেমের পানি পড়া আর নাই বললাম। শুনেছি, হিন্দু পাড়ার শিব-কালী
মন্দিরের ঠাকুরের দেওয়া তাবিজ, পানি পড়াও নানী আমায় দিয়েছে। বনজঙ্গলে ঘুরি
বলে, শ্মশান-জঙ্গলের শিব-মা কালী যেন, আমায় রক্ষা করে। প্রকৃতির বিশাল অথচ
ক্ষূদ্র অংশ বীনা, তার কাছ থেকে ছুটে চলি অন্য প্রকৃতিতে, আবার ফিরে আসি
তার কাছে। বিনা বাঁধায়, সহজেই বিনাকে পেয়েছি বলে, নাকি, ভবঘুরের সূতার টানে
আস্তে আস্তে বীনা প্রকৃতির গদ্য আমার কাছে ফুরিয়ে যেতে থাকে; আমি আরো গভীর
গদ্যে হারিয়ে যেতে থাকি।
হাইস্কুল পর্যন্ত লেখাপড়া জানা, কর্মঠ, গল্পপটু, গাতক, বই পড়ুয়া--সাথীদের
কাছে আমি ইত্যাদি গুনে পরিচিত। তাই ওরা, যে যেখানে, যতদূরে, যে কাজেই যায়
আমাকে স্মরণ করতে ভুল করে না। আমিও জায়গা পছন্দ হলে ওদের সাথে যে কোন কাজে
চলে যাই। সালাম, বাবুল, শম্ভু, দুলাল--এদের সাথে শীতের রাতে বেশ কয়েকবার
গিয়েছিলাম জঙ্গলের বনপথে। পদ্মা নদীর শাখা বেস্টিত বিশাল জঙ্গলের মহল। ঘাস,
বাঁশ, গাছ ইত্যাদি কাটতে হবে--তুলতে হবে বড় বড় নৌকায়। নির্জন, ভীতিকর
জায়গা। সারি সারি শাল-গজারী গাছ, নদীর কাছে ঝাউবন, কাঁশচর। কাঁশ, বাঁশ আর
খড়ঘেরা দু’একটা ঘর--বনের ভিতর মাঝে মাঝে দেখা যায়। দু’একটা জনবিরল বন্য
গ্রাম আর ছোট ছোট টিলা আছে আশেপাশে। শীতের বিকাল। ঘন ছায়া পড়েছে বিস্তীর্ণ
জঙ্গলে। বনের মাথায় উঁচু গাছের পাতায় পাতায় অল্প অল্প কুয়াশা জমেছে। নির্জন
শীতের সন্ধ্যা। কোথা থেকে মটর শাকের সুন্দর গন্ধ ভেসে আসছে। বিশাল আকৃতির
বট আর ভেটকী গাছ--জড়াজড়ি করে আছে, গভীর আলিঙ্গনে। শত শত লতাগুল্মের গাছ
বিশাল বটগাছকে জড়িয়ে আছে। ডালে ডালে পাখির বাসা। শীতের তীব্রতা আস্তে আস্তে
বাড়ছে, এ বনপথে। পাখির বাচ্চারা এখন বেশী চেঁচামেচি করছে--হয়তো ক্ষুধায়,
হয়তো পিতা-মাতার দেরীতে ফেরা অথবা না ফেরার কারণে; কারণ কিছু পাখি শিকারী
সারাদিন বনে ঘুরাফেরা করে। মা-বাবার পালকের উষ্ণতা বড় বেশী প্রয়োজন এই শীতে
কারণ বাচ্চা পাখির পালক পূর্ণভাবে গজিয়ে ওঠে না। শীতকালে দিন নয় থেকে দশ
ঘন্টা। প্রকৃতির রূপ দেখতে দেখতেই সময় ফুরিয়ে যায়।
নদীর কাছে দীর্ঘ বনঝাউ, কাঁশবনের মাঝে সারি সারি গজারি, বাবলা, বন্য কাঁটা
বাঁশ, বেত ঝোপ। সন্ধ্যায় বাতাসে বন্যপুষ্প ও তৃণগুল্মোর সুগন্ধ, পাখির
কিচিরমিচির ডাক, বনের ডোবার অগভীর জলে ফুটন্ত লিলি ফুল--বাতাসে সুবাস ছড়িয়ে
দেয়। শীতকালে আমাদের অঞ্চলে লিলি ফুল হেমন্ত কালে দেখা যায়। নির্জন আকাশতলে
দিগন্তব্যাপী জোৎস্না রাতে বনপুষ্পের সুবাশ, ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক, শীতের মধ্যে
শিয়ালের পাক্কা হুয়া ডাক--রাত্রির পরিবেশে আমাকে যে কোথায় নিয়ে যায়।
নির্ঘুমে আমরা সবাই। বিড়ি-সিগারেটের ফাঁকে গাছ ও ঘাস কাটার হিসাব শেষ করে
বনের শুকনো ডাল-পাতা জ্বালিয়ে, আগুনের চারিদিকে পাটি, গামছা বিছায়ে বসে
শীতের গান আর সেই সাথে বনমুরগী, বনহাঁস অথবা বনজলের মাছ পুড়াইয়া ভাত অথবা
মুড়ি-পিয়াজ-তেল দিয়ে খাওয়া। আহা! সে কি স্বাদ, কি শান্তি এই ঘন কুয়াশা
রাত্রিতে। মনে হয়, পিকনিক অথবা মাসুদ রানা সিরিজের কোন কাহিনীর নির্জন
দ্বীপের ছবি। রাতের শীত বাড়লে অথবা শীতের ভোরে ধনে পাতার ভর্তা দিয়ে ভাত
খাওয়া। শীতের পার্বণের কত স্বাদ নিয়েছি কত সাথীদের বাড়ী গিয়ে; অন্যের ক্ষেত
থেকে পিয়াজ তুলে আনতে গিয়ে ধরাও পড়েছি। গ্রামে থাকলে মা হয়তো শুঁটকী,
মটরশুটি, শীম, আলু, ধনে পাতার ভর্তা দিয়ে চিতের পিঠায় মেখে দিত। মায়ের কথা
মনে হলে শীত যেন, আরো বেড়ে যায়। পূরাণের গঙ্গা (পদ্মা নদী) দেবী যে,
মা-বাবা সহ সবাইকে নিয়ে গেছে, দূরে থাকলে--তা মনে হয় না। বরং মনে হয়, বাড়ি
গেলেই মাকে দেখতে পাব।
উদীয়মান চন্দ্রের গোলাকার বৃত্তের নিচের পরিধি যেন বাঁশের চিকন পাতা ছোঁয়া
দিয়ে যায়। আগুনের কাছে থাকলে শান্তি, দূরে গেলেই কনকনে শীত। মনে পড়ে,
উত্তরবঙ্গের পথে--এখানকার মত ওখানেও খড়ের ঘর; তার মেঝে জমির সাথে সমতল;
ঘরের বেড়া শুকনো ঘাস, পাটখড়ি, বনঝাউয়ের ডাল-পাতা; কোথাও কোথাও কাঠ, বাঁশ,
বনঝাউয়ের সরু সরু গুঁড়ির বেড়া; তার উপর মাটি দিয়ে লেপা। এখনো সেই ঘরের
কাটাখড়, অর্ধকাচা ঘাস, মুলি বাঁশের গন্ধ নাকে ভেসে আসে। শীতের রাতের গরুর
গাড়ীতে যাত্রার কথা ভাবলে হাত পা গুটিয়ে আসে। জামা-কাপড়-কম্বল সব ঠান্ডায়
বরফ হয়ে যায়। শুয়ে থাকা পাশে শীত কম থাকলেও অন্য পাশে কাত হয়ে শুতে গেলে
মনে হয়, মাঘ মাসের জলডোবায় ডুব দিয়েছি।
এই বন পথে প্রতিদিন সূর্যের উদয় দেখি, দেখি দূরের টিলা, জঙ্গল; আবার সন্ধায়
বন ঝাউ, দীর্ঘ ঘাস (বাঁশ) তথা বনশীর্ষ লাল আভায় মাখিয়ে সূর্য ঘুমিয়ে যায়।
ফিরে আসি কিছু কাচা টাকা হাতে নিয়ে। আবার ছুটে চলি লাউয়া ছড়ায়, চিম্বুক
পাহাড়ে, ভাওয়াল বনে অথবা অন্য কোথাও। রাতের চর বন আর ভাওয়াল বন একই রূপ
ধারন করে। নিঃশব্ধ অরন্যভূমি, নিস্তব্ধ জনহীন নিশীথ রাত্রি, চকচকে সাদা
বালু, কোথাও দো-আঁশমাটি মিশানো বন, দিনের রৌদ্রে কাচা শুকনা কাঁশবনে জোৎসার
আলো পড়ে অপার্থিব সৌন্দর্যের অপূর্ব মহিমায় ভরে দেয় আমার দৃষ্টির দিগন্ত।
জল ডোবায় সাদা-বেগুনি কলমী ফুলের সমারোহ আর এই ভিজা বালু-দো-আঁশ মাটিতে
সাদা সাদা (কেউ বলে এর নাম দুধলি ফুল) ফুল--বড় মিষ্টি সুগন্ধ ছড়ায় আশেপাশে।
গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি পড়ছে হঠাৎ করে। এ সময় বৃষ্টি! অবাক হলাম, এটা কি মাস?
কখনো কখনো পৌষ মাসে কিছু কিছু বৃষ্টি পড়ে। মাঘ মাসে বৃষ্টি নাই। সবাই বন
পথে সাপের ভয়ে গান গেয়ে অথবা হাততালি দিয়ে পথ চলে। আমি সবাইকে ‘শীতনিদ্রা’
সম্পর্কে বললাম--দেহের তাপমাত্রা শীতের সাথে উঠা-নামার কারনে সাপ-ব্যাঙ এখন
দেখা যাবে না।
গায়ের চির চেনা পথে রোদের ছোঁয়ায় কুয়াশা কাটে। জমানো শিশিরে রাস্তাঘাট ভিজে
যায়। গাছে গাছে অবিরাম চলে ঝরা পাতার খেলা। পাখিরা শশব্ধে উড়ে যায়। বাগানে
ডালিয়া, চন্দ্র মল্লিকা, গাঁদা ফুল ফুটে। নানা জাতের ধান কাটা শুরু হয় কোন
কোন মাঠে। আলু, সরিষা, মুগ, মসুর ইত্যাদি ফসলে; ফুলকপি, বাঁধাকপি, শীম,
পিয়াজ, রসুন ইত্যাদি সবজিতে বাড়ীর আঙিনা, শুকনো ডোবা বিল ভরে যায়
সৌন্দর্যে। পুকুরের হাঁটু ময়লা পানিতে ছোটদের ছোট ছোট মাছ, ব্যাঙাচি ধরার
খেলা। গায়ের বধূয়ার কলসী কাঁখে নদীর ঘাটে যাওয়া। নতুন জামাই বেড়াতে আসলে
অথবা নতুন বউ দেওর, ননদদের সাথে নিয়ে বাপের বাড়ী ‘নাইওর’ আসলে খেজুর রস আর
পিঠার সুবাস ছড়িয়ে পড়ে পাড়াময়। মাটির সরাতে, বেতের থালে, কলাপাতায় অথবা
পিতলের প্লেটে সাজানো থাকে গ্রাম বাংলার বাহারি রকমের পিঠা--পাকান পিঠা,
ভাপা পিঠা, কুসলি পিঠা, চিতই পিঠা, পাটিসাপটা পিঠা, নকসা পিঠা, পাতা পিঠা,
জামাই পিঠা, আন্দসা, কাটা পিঠা, চুটকি পিঠা, মুঠা পিঠা, চ্যাপা পিঠা,
জামদানী পিঠা, হাঁড়ি পিঠা, ঝুড়ি পিঠা, ফুলঝুরি পিঠা, বিবিখানা পিঠা, মাছ
পিঠা, হৃদয় পিঠা, গোলাপ ফুল পিঠা, পেঁচানো পিঠা, ফুল পিঠা, শাহী বিবিখানা
পিঠা ইত্যাদি আরো কত রকমের পিঠা; মা, বোন, বউদের পিঠাশৈলী আর রাত-দিনের
অক্লান্ত পরিশ্রম সকলের স্বাদ, তৃপ্তি আর স্বস্তির মধ্যদিয়ে পিঠাশৈলী আর
পরিশ্রম সার্থক হয়। এত রকমের পিঠা খেয়ে কতবার হারিয়ে গিয়েছি কত
স্বপ্নরাজ্যে। জামাইয়ের সাথে শালা-শালী, বিয়াইয়ের সাথে বিয়াইনরা মেতে উঠে
গ্রাম-বাংলার মুখে মুখে প্রচলিত ‘ধাঁধা মিলাও--পিঠা খাও’ উৎসবে।
কুয়াশার ভোরে ‘গাছি’র কাঁধে মধুবৃক্ষ খেজুর গাছের রস। কতবার গিয়েছি ‘গাছি’র
বাড়ী। খেজুরের রস থেকে গুড় বানানোর সে কি শিল্প--পাতলা ঝোলা গুড়, নলেন গুড়,
দানা গুড়, পাটালী গুড়--আমি আনমনা হয়ে যাই গুড়ের সুগন্দে। সমগ্র দেশ, বিশেষ
করে উত্তরবঙ্গ-দক্ষিণবঙ্গ আমার চোখের সামনে কুয়াশা ঘেরা মনে হয়। এই আমার
মামাবাড়ী--শরিয়তপুরের জাজিরা--খেজুর রস আর সরিষা--এ রকম প্রাকৃতিক সৌন্দর্য
বাংলার অন্য কোথাও দেখিনি। মনে হয়, আমি যেন মৌমাছির মত সরিষার ফুলে ফুলে
উড়ে বেড়াচ্ছি, প্রকৃতিকে ত্রিমাত্রায় ধারণ করে গদ্য পুঁথির মালা গেঁথে
চলেছি।
গায়ে ফিরে শুনি, কন্যা সন্তান জন্ম দিয়ে বীনা চলে গেছে না ফেরার দেশে।
কাঁদি আর ভাবি, কত করে বলেছিল, ‘তুমি আর ঘন জঙ্গলে যাইও না; ফিরতে দেরী
অইব; বাচ্চার মুখ দেইখা তারপর যাইও; বনে গেলে তোমার কোন কালেই সময় জ্ঞান
থাকে না।’ তখন ভেবেছি, পাঁচ মাসের পোয়াতি, থাকুম তো দুই মাস, সংসারে
টাকাওতো দরকার। উড়নচন্ডি ছিলাম, বিয়ের আগে তেমন টাকা-পয়সা জমানো হয়নি।
মানুষের কটুকথা আর দুই নানী বকাবকিতে রোজগারের সব টাকা আর বীনার জন্য কেনা
শাড়ী, চুড়ী আর বাচ্চার জন্য ছোট জামা-কাপড় সব উঠানে ফেলে চলে এলাম দক্ষিণে।
প্রকৃতি আর আমার কবি মন আমাকে সত্যিই বাউল করেছে।
সারাদিন হাঁটতে হাঁটতে আর কাঁদতে কাঁদতে উত্তরের বালুপথ আর নদীর তীর ধরে
পদ্মা নদীর তীরে এসে বসলাম। গোদারা ঘাটের মাঝিরা আমার বাবাকে, আমাকে চেনে।
তিন পুরুষের যাতায়াত এ নদী দিয়ে। পদ্মা বিধৌত উর্বর মাটির সন্তান আমি এবং
আমার পূর্ব পুরুষ। এ নদীকে কেন্দ্র করে এর কাছাকাছি শরীয়তপুর, চাঁদপুর ও
বিক্রমপুর-এ হাজার বছর ধরে আমাদের পিতৃগণ ও মাতৃগণের বসবাস। আমার জন্মস্থান
বিক্রমপুরের লৌহজং-এ। নদী পার হয়ে দিঘলী বাজারে এসে কিছু চিড়া-মুড়ি খেয়ে
কদম বাবার মেলায় চলে এলাম। কদম বাবার মেলা শীত প্রকৃতির আরেক অকৃত্রিম রূপ।
নানা জাতের মাঘের পাগল এখানে এসে মাস খানিক ভীড় করে গান করে। ব্যবসায়ীরা আর
ভক্তরা খুশী থাকলে এ মেলা সাত থেকে দশ দিন পর্যন্ত চলে। নানা রকমের পসরা
সাজিয়ে বসে দোকানীরা। নানা স্বাদের মুড়ী, চিড়া, খইয়ের মোয়া, সন্দেশ, নাড়ু,
বাতাসা, কদমা, মিষ্টি খই, চিনি মাখানো ছোট ছোট গোল মিষ্টি, নিমকী, গজা কত
না স্বাদের, গন্ধের খাবার। মাঘ মাসের শীতের মেলায় মানুষের ভীড়ে একটুও শীত
লাগে না। ছোট্ট বেলায় তাই আগুন না জ্বালিয়ে উষ্ণতার জন্য মেলায় চলে যেতাম।
বিপদ-আপদ-মঙ্গল-রোগ মুক্তি-পরকাল কামনায় শরৎ-হেমন্তের গ্রাম্য বাংলার
শাশ্বত সাংস্কৃতিক রূপের সাথে অগ্রহায়ণ-পৌষ মাসে শুরু হয় নানান পাগলের
মেলা, পীর-মুর্শীদের ওরস, ওয়াজ মাহফিল। এ সময়ে ফসলে ফসলে ছড়িয়ে থাকে
মাঠ-ঘাট-পথ-আঙ্গিনা-ঘর-গোলা। মুসলমানরা প্রথম ফসল দিয়ে মাজার, দরগায় শিন্নি
দেয়; কেউবা কোন কিছু পাবার আশায়, কারো রোগ মুক্তি কিংবা মঙ্গল কামনায়
পীর-মুর্শীদ বা পাগল বাবার জন্য প্রথম ফসল মানত করে রাখে। গাঁয়ের কোন কোন
বাড়িতে ‘ক্ষেতের বত্ত’ পূজা শুরু হয়। মানুষের দ্বারে দ্বারে ভাগ্যলক্ষ্মী
কার্তিক-অগ্রহায়ণের কাঁধে চড়ে পৌষ-মাঘে ঘুরে বেড়ায়, মাঠ-ঘাট শস্য শ্যামলায়
ভরে দেয়। আর তাইতো, সনাতন জাতি, উপজাতি ও অন্যান্য ধর্ম জাতির মধ্যে অসীম
রহস্যের প্রতি কৃতজ্ঞতায় নিজেদের তৈরী বিশ্বাসের মিথগুলোকে গড়ে তোলে
নিজেদের মতো করে।
কোন কোন স্কুলে শুরু হয় বার্ষিক-ক্রীড়া অনুষ্ঠান। বড় রাস্তায় গাড়ি হাঁকিয়ে
মাইক বাজিয়ে কোন স্কুলের শিক্ষা সফর অথবা কোন ক্লাব, সংঘের সদস্যরা বনভোজনে
ছুটে চলে--নাচে, গানে, আনন্দে আত্নহারা হয়ে। ঘন কুয়াশায় দিনের বেলায়ও হেড
লাইটের আলোয় গাড়ী চলে শহরে। সচ্ছল মানুষেরা দেহের উপর আরামের বোঝা চাপিয়ে
অথবা নানা রংয়ের টুপি, জ্যাকেট, হাত মোজা, পা-মোজা, কোট-টাই পরিধান করে
শীতকে হাসি দিয়ে মুখে বরন করে। অসচ্ছল, দরিদ্রদের হয় একটি চাদর, নয়তো একটি
জামা, কারো মাফলার থাকে, কারো টুপি, কেউবা একটি লুঙ্গী গায়ে দিয়ে আরেকটি
ছিঁড়া লুঙ্গী গায়ে জড়ায়ে রাখে--এরা সর্বদা আগুনের কাছে থাকতে চেষ্টা করে
অথবা হাড় কাঁপানো শীতে ফুটপাতে কুড়ানো কাগজ পুড়ায়ে উষ্ণতা অনুভব করে। তাই
মনে হয়-এ শীত যেন মানুষের হাতে গড়া এ বুর্জোয়া সমাজে বিত্তবানদের জন্য
পোশাক প্রদর্শনী আর নিঃস্বদের জন্য সহিষ্ণুতার অগ্নিপরীক্ষা। শহরে কাজে
আসলে কবি জসিম উদ্দিনের কবিতা মনে পড়ে, ‘‘তুমি যাবে ভাই--যাবে মোর সাথে
আমাদের ছোট গাঁয়ে...।’’
শীতের বনতল; শীতের সকাল-দুপুর-বিকাল-সন্ধ্যা; শীতের জোৎস্না রাত্রির চাঁদ,
দিনের সূর্য; শীতের নির্জনতা আর স্থান কাল-পাত্র ভেদে সৌন্দর্যেয়
বৈচিত্রতা; নির্জন আকাশতলে দিগন্তব্যাপী কত রুপে, কত সাজে যে শীত কন্যা
সাজে, এ বাংলার প্রকৃতিতে। সৌন্দর্য পিয়াসীর চোখ অথবা কবির মন হারিয়ে যায়
বারে বারে প্রকৃতির নদী-নালা-খাল-বিল-হাওর-বাঁওর-মাঠে-ঘাটে অথবা অন্য
কোথাও, কোন কুয়াশার বাঁকে। মনে প্রশ্ন জাগে, হে শীতকন্যা, অনার্য যুগে অথবা
যখন আর্যরা এদেশে এসেছিল তখন কি তুমি এ রকম ছিলে; চন্দ্রগুপ্তের
রাজত্বকালে, গ্রীক সম্রাট সেলুকাসের দূত মেগাস্থেনিস ভারতে থাকা কালে; অতীশ
দীপংকরের সময়ে, লক্ষন সেন, মোঘল আমলে অথবা নিকট অতীতে?
আমি বিস্মিত ! কে তুমি সৃষ্টি করেছ এ প্রকৃতিকে? সাজায়েছ এ ঋতু নানা
বৈচিত্রে। আমি সৌন্দর্যের শাশ্বত সমুদ্রের ধারায় অবগাহন করি অবলীলায়। আমি
ধন্য, হে শীত কন্যা; আমি অভিভূত, হে শীত প্রকৃতি।
ARNING:
Any unauthorized use
or reproduction of
'Community' content is
strictly prohibited
and constitutes
copyright infringement
liable to legal
action.
[প্রথমপাতা] |
লেখকের আগের লেখাঃ
|