মায়ের অভিমান

শাশ্বত স্বপন
একটা চিঠি। সে অনেকদিন আগের কথা, আমার বয়স পাঁচ কি ছয় হবে। হারিয়ে যাওয়া
স্মৃতির ঐ সময়টা খুব একটা কারো মনে থাকার কথা নয়। পরবর্তীতে মা আবার সেই
স্মৃতিটা গল্পের মত বলেছিল এবং কেঁদেছিল, যখন আমি পড়তে পারি। পদ্মা বিধৌত
উর্বর মাটির সন্তান আমি এবং আমার পূর্ব পুরুষ। এ নদীকে কেন্দ্র করে এর
কাছাকাছি শরীয়তপুর, চাঁদপুর ও বিক্রমপুর-এ হাজার বছর ধরে আমাদের পিতৃগণ ও
মাতৃগণের বসবাস। ১৯৪৭এর পরে এবং ১৯৭১ এর পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সময়ে আমাদের
মাতৃ-পিতৃকূলের অধিকাংশ সদস্য ভবিষ্যতের কথা ভেবে ক্রমান্বয়ে ভারতে চলে
যায়। আমার মা বাদে দাদু তার পুরো পরিবার নিয়ে নদীয়ায় চলে যায়। চিরতরে
মা-বাবা হারানোর মত করে মা টানা পাঁচ-সাত কেঁদেছিল।
একটা চিঠি। শেষ পর্যন্ত লিখিত চিঠি নয়, সামান্য কয়েক লাইনের মৌখিক কথাÑযা
মাকে শুনিয়েছিলাম। নদীয়া থেকে আমার দাদু-দিদিমা আমাদের গ্রামের এক ব্যক্তির
কাছে একটা চিঠি দিয়েছিলেন। পদ্মার বালুচরের মানুষ আমার মা, তাদের পরিবারের
কেউ লেখাপড়া জানত না। আর আমার জমিদার পিতৃপুরুষের অধঃপতনের সর্বশেষ এবং
একমাত্র চিহ্ন আমার বাবা। নদীয়ায় যাওয়ার পর আমার ছোট মাসী কিছুটা লেখাপড়া
শিখেছিল। হয়তো দিদিমা ও দাদুর ভাষায় কাঁচা হাতের লিখা চিঠি অথবা অন্য কারো
হাতে লিখা চিঠি দাদু এ গাঁয়ের নীলা দাসের কাছে দিয়েছিল। নীলা দাস কি যেন এক
রহস্যময় ব্যবসা করে এবং প্রায়ই কোলকাতা যাতায়াত করে।
কিভাবে যেন চিঠির খবরটা মায়ের কানে যায়। মা আমাকে নিয়ে নীলা দাসের বাড়ি
যায়। গোধূলী বেলা। বর্ষাকালের প্যাঁক-কাঁদা রাস্তায় আর ভাঙ্গা সাঁকো পার
হয়ে ঐ বাড়ি যেতে আমার খুব কষ্ট হয়েছিল। খালি পায়ে সন্ধাবেলা তার বাড়ি
পৌঁছালাম। নীলা বাসায় নেই। ঐ বাড়ির একজন, মাকে একটা পিঁড়ি দিল। মা এক হাত
ঘুমটা দিয়ে উঠানের এক কোনে ছোট বোন গীতাকে কোলে নিয়ে পিঁড়িতে বসে অপেক্ষা
করছে। রাত হয়ে গেছে। মা বলছে,
তোর বাবা বাসায় আইসা আমাগো না দেখলে ভয়ানক অশান্তি করবো। চল রতন, কাল
আসুমনে।
মা তুমি যাও, আমি চিঠি নিয়া আসুম।
বাবা, আরো রাইত অইলে ভয় পাইবা। ভাঙ্গা সাঁকো রাইতে পার অইতে পারবা না।
পরদিন আমি গিয়েও নীলাকে পেলাম না। বাসায় কারো কাছে চিঠিটা দিয়েও যায়নি।
দু’দিন হল উনি বাসায় ফিরেন না। তারপরের দিন আবার দিনের বেলা মাকে নিয়ে
হাজির হলাম। আজ তাস খেলতে কোথায় যেন গেছেন। প্রতিদিন অনেক লোক নীলার কাছে
আসে, কেউ তাকে পায়, কেউ না পেয়ে ফিরে যায়। আমরাও সারাবেলা অপেক্ষা করে
বাসায় ফিরে এলাম। মা এ কয়টা দিন চিঠির জন্য অনেক কেঁদেছে। কি লিখেছে তার
বাবা-মা এসব ভাবত আর বলত,
রতন, তোর দাদু কি লিখেছেরে? আমাগো ইন্ডিয়া নিয়ে যাবে? রতন, বাবা, চিঠিটা
কারে দিয়ে পড়ামু?
মা, শেলীগো বড় বইনে ইস্কুলে পড়ে। তারে ডাইককা আনুমনে বাড়িতে।
আইচ্চ বাবা, এবছর তোরে ইস্কুলে ভর্তি করামু, তাইলে আমাগো চিঠি লেখা-পড়ার
জন্য আর কারো কাছে যাইতে অইব না।
পরদিন নীলার ঘরের কাছে গিয়ে ডাকতে লাগলাম,
কাকা আইছে?
ঘর থেকে ৪০/৪৫ বছর বয়সী এক লোক বের হয়ে আসে।
তুই হইরার পোলা না?
হ, মায় চিঠ্রির লিগা কানতাছে।
ঘর থেকে এক মহিলা খাবার খেতে খেতে বলছে,
এই পোলা আর অর মায় এই নিয়া চার দিন আইছে, তুমি চিঠিটা আমারে দিয়া গেলেই
পারতা।
আরে, আমিতো বাজারে ওর বাপেরে চিঠি দিয়া দিছি। তর মারে কইছ, তোর দাদু ভাল
আছে। সবাই কাম-টাম পাইছে।
বাড়ি এসে মাকে সব বললাম। বাবা কিছু লেখা-পড়া জানা মানুষ। সে কোনদিন মাকে সে
চিঠির কথা বলেনি। মাও জানতে চায়নি। আর কোনদিন কোন চিঠি মার কাছে আসেনি।
টাকার অভাবে মা কোনদিন নদীয়া যায়নি। দেশান্তরিত অভাবী দাদু-দিদিমাও কোনদিন
এদেশে আসেনি। আজ আর তারা বেঁচে নেই। মা আজ বৃদ্ধা। কোনদিন তার নদীয়া যাওয়া
হয়নি। জ্ঞান হবার পর সব বুঝতে পারলাম। তথ্য গোপন করে বা মিথ্যা তথ্যের উপর
ভিত্তি করে বিবাহ বিষয়টা আগের দিনে খুব বেশি ছিল। বাবার পক্ষ থেকে মিথ্যা
তথ্য দিয়ে মাকে বউ করে আনার পর আর কোনদিন বাপের বাড়ি যেতে দেওয়া হয়নি। আজ
আমি শিক্ষিত কিন্তু চির অভিমানী আমার মা সেই থেকে আর কোনদিন কোন চিঠি আমাকে
পড়তেও বলেনি কোনদিন কোন চিঠি লিখতেও বলেনি।
ARNING:
Any unauthorized use or reproduction of 'Community' content
is strictly prohibited and constitutes copyright infringement liable to
legal action.
[প্রথমপাতা] |