|
পান্থ পৌর্বাপর্য ( দ্বিতীয় পর্ব)
এ,কে,এম,নূরুন্নবী
আমরা বাড়ি পৌঁছতেই মুষলধারায় বৃষ্টি শুরু
হলো। মাঝে মাঝে হালকা হাওয়া বইছে। আমার জীবনে এভাবেই ভ্রমণ যাত্রা শুরু।
এর পর থেকে প্রতি তিন মাস পর পর আমি দেশের বিভিন্ন স্থানে নিয়মিত
নিরুদ্দেশ যাত্রা করতাম। এখনও এ অভ্যাসটি থেকে গেছে সময় সুযোগ পেলেই চলে
যাই। দিন আসে আবার চলেও যায় এর মাঝে জীবন প্রবাহে ঘটে কিছু ঘটনা।যা
বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে যায়। আবার কখনো কখনো এমন কিছু ঘটনা ঘটে, যা জীবন
স্মৃতিতে থেকে যায়। শরীর খুব ক্লান্ত থাকায় সন্ধ্যায় খাবার খেয়ে শুয়ে
পড়লাম। ঘুমিয়ে গেলাম তাড়াতাড়ি। মাঝ রাতে মা ডাকলেন উঠে পড় তাড়াতাড়ি,
ভীষণ ঝড় শুরু হয়ে গেছে। টিনের চালার কটকট শব্দ হচ্ছে। জীবনে অনেক ঝড়
দেখেছি কিন্তু আজ ঝড়ের যে তান্ডবলীলা দেখছি তা কোন দিন দেখিনি। আমার
জীবনে এমন বিভীষিকাময় অভিজ্ঞতা কখনো ছিল না। মনে হলো আজই যেন কিয়ামত হয়ে
যাবে। যেমন মুষল ধারে বৃষ্টি তেমনি নিমর্ম নিষ্ঠুর প্রচন্ড ঝড় বইছে।
মাঝে মাঝে দৈত্যের মত হুংকার দেয় মরণ ছোবল। চারদিকে কানফাটা বজ্রধ্বনি,
বাতাসের শো শো শব্দে মহাপ্রলয়ের অশোনিসংকেত শুনতে পাচ্ছি। কাঁচা ঘর
বাড়ি গাছ পালা ভেঙ্গে যাচ্ছে। হঠাৎ একটা ঝড়ের ঝাপটা এসে আমাদের ঘরের
চালা উড়িয়ে নিয়ে যায়। আমরা ভাই বোন বাবা মা সকলেই মৃত্যুর মুখোমুখি
দাঁড়িয়ে আত্ম চিৎকারে আহাজারি করছি। অল্পক্ষণের মধ্যেই আমাদের ঘরের
মধ্যে বৃষ্টির পানি পড়তে শুরু করে। দেখতে দেখতে ঘরের মধ্যে হাঁটু পানি
জমে যায়।
চারদিকে ঘোর অন্ধকার। বাহিরে যাবার কোন উপায় নেই। ঘরের দরজার কাছে এসে
বাহিরে দেখি পাড়া পড়শী কারও কোন বাড়ি ঘর নেই । সবাই খোলা আকাশের নিচে
দাঁড়িয়ে আছে। মাঝে মাঝে বজ্রচ্ছটায় তাকিয়ে দেখলাম আমাদের আশপাশের এমন
কোন বাড়ি ঘর নেই যাদের টিনের চালা অক্ষত আছে। প্রত্যেক বাড়িতে কান্নার
রোল শুনা যাচ্ছে। যাদের ঘরে তিন চার মাসের সন্তান ছিল তারাই সবচেয়ে বেশি
বিপদ গ্রস্ত হয়েছে। খোলা আকাশের নিচে বৃষ্টির পানিতে মা তার শিশুকে
রক্ষার জন্য উপুড় হয়ে আঁচল দিয়ে আগলে ঢেকে ধরে রেখেছে। তা আর কতক্ষণ
ঢেকে রাখতে পাড়ে। শিশুরা ভিজে চিৎকার কান্না কাটি করছে। ভোর হলো
মানুষের সামনে মহাদুর্যোগ। ঘরে ঘরে মানুষের আত্ম চিৎকার। যাবার কোন
স্থান নেই। সব বাড়ির অবস্থাই একই। চারি দিকে ধ্বংসস্তুপ। যত্রতত্র হাঁস
মুরগি গরু ছাগল মরে পড়ে আছে। স্বজন হারা মানুষ আপনজনকে খোঁজা খুঁজি করছে।
বৃষ্টি ও বাতাস ধীরে ধীরে কমে গেল। মানুষ কিছুটা দীর্ঘনিস্বাস ফেলছে। এ
দুর্যোগের কারণে সে সময়ে নবজাতক শিশুর মৃত্যু ও অসুস্থতার হার বেড়ে যায়।
আনেক জনগোষ্ঠী বাস্ত্তচ্যুত হয়ে গ্রাম ছেড়ে অনেক দূরে আত্মীয়ের বাড়ি চলে
যায়। এ দুর্যোগে দরিদ্র মানুষের সব চেয়ে বেশী ক্ষতি হয়েছে। আমাদের
গ্রামেই প্রায়
তিনজন নারী গর্ভকালীন জটিলতায় আক্রান্ত হয়ে সন্তান প্রসবকালে মারা যান।
বৃষ্টিতে মানুষের সমস্ত কাপড় ভিজা থাকায় ভেজা কাপড় নিয়েই মানুষ দিন
যাপন করেছে। সবচেয়ে অসুবিধা ছিল কোন ল্যাট্রিন নাথাকায় মহিলারা বিপদ
গ্রস্ত ছিল বেশী। তিন দিন পর্যন্ত পানি একই ভাবে স্বস্থানে দাঁড়িয়ে ছিল
। এ সময় মানুষ বাঁশ কেটে মাচা বানিয়ে উপরে টিনের চালা দিয়ে কাটিয়েছে।
জ্বালানি না থাকায় এ তিন দিন মানুষ কোন রান্না করতে পারেনি। শুকনা
খাবার খেয়ে কোন রকম দিন কাটিয়েছে। নলকূপ ডুবে থাকায় কোন বিশুদ্ধ পানি
পান করা সম্ভব হয়নি। মাটির ঘর যা ছিল তা সব ভেঙ্গে পড়েগেছে। এছাড়াও
স্কুলের ছেলে মেয়েদের বই পুস্তক খাতা কলম সবই পানিতে ভেসে গেছে।সেদিন
রাতে এই হৃদয় বিদারক দৃশ্য আমাকে আজও তাড়িয়ে বেড়ায়। স্কুল ও কলেজ জীবনে
অনেক জায়গাতেই গিয়েছিলাম, তবে আজ বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ জীবনে কোথাও যাওয়া
হয়নি। তাই আজ আমার এটাই বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবনে শেষ ভ্রমণ। এর পর যেতে
হবে কর্মক্ষেত্রে।ডিসেম্বরের এক শীতার্ত রাতে চিটাগাং যাব বলে
সিদ্ধান্ত নিয়ে কমলাপুর রেল স্টেশনে এসে বসে আছি। কমলাপুর রেল স্টেশনটি
অপূর্ব দৃষ্টিনন্দন স্থাপত্যরীতিতে তৈরি। ইতিমধ্যেই সৌন্দর্যপিপাসুদের
হৃদয়কে আকৃষ্ট করেছে। স্টেশনটিতে রয়েছে বেশ কয়েকটি অত্যাধুনিক
প্লাটফর্ম। তাছাড়া স্টেশনে বসার জন্য রয়েছে সারিবদ্ধ চেয়ার। এছাড়া
প্ল্যাটফর্মের পিলারগুলোর গোড়াতে বসার জন্যে চমৎকার গোল করে বেদি তৈরি
করা আছে। ট্রেন ছাড়ার আধা ঘন্টা আগে আমি স্টেশনে হাজির হয়েছি। এমন সময়
স্পিকারে বলা হল এক ঘন্টা দেরিতে সুবর্ণ এক্সপ্রেস ট্রেনটি পৌঁছবে।
ভিক্ষুকের উৎপাত তো রয়েছে তার মধ্যে আবার ফেরিওয়ালাদের হাঁক ডাক। নানান
পশরা সাজিয়ে বেচা বিক্রি। লাইটার চিরুনী,সেপ্টিপিন, তিনটি বলপেন,কান
পরিস্কার করা তারের বাকা পাত আটটি একত্রে দশ টাকা। শুনতে শুনতে কান
ঝালাপালা। উত্তর বঙ্গ ও খুলনা থেকে দুটি ট্রেন এসে গেছে। প্লাটফর্মে
লোকজনের ভিড়। আমাদের ট্রেনের কোন সাড়া শব্দ নেই। একজন লাগেজ চোরকে
লোকজন তাড়া করছে। অবশেষে রেলওয়ে পুলিশ তাকে ধরে ফেলেছে। সব কিছু দেখে
সময় কাটছে। কিছুক্ষণের মধ্যে চট্রগ্রামের সুবর্ণ এক্সপ্রেস এসে পৌঁছবে
বলে ঘোষণা শুনলাম। লোকের হুড়োহুড়ি পড়ে গেল। ট্রেনে উঠে নিজ সিটে বসে
পড়লাম। রাত এগারোটায় ঢাকা থেকে চট্রগ্রামের উদ্দেশ্যে সুবর্ণ এক্সপ্রেস
যাত্রা শুরু করল। ট্রেন দুর্দান্ত বেগে ছুটে চলেছে। মনে মনে ঠিক করলাম
চট্রগ্রাম ও কক্সবাজার হয়ে ঘরে ফিরব। আসলে আমার সম্পূর্ণ যাত্রাই ছিল
নিরুদ্দেশ যাত্রা। ঢুলু ঢুলু চোখে আধো আধো ঘুমে আবোল তাবোল স্বপনের মাঝে
কাটে রাত। ভোর হয়ে গেছে বলে মাঝে মাঝে চুমকে উঠে ঘড়ি দেখি। তখন বাজে
রাত দুটা। শরীরটা ক্লান্ত থাকায় মাঝে মাঝে অঘরে ঘুম আসে। টিটি গায়ে হাত
বুলিয়ে বলেন টিকেট টা দিন। সুন্দর ঘুমটার বারো দফা বেজে গেল। মেজাজটা
তিরিক্ষে উঠলো। টিকেট দিলাম।ঘুমাবার চেষ্টা করলাম হলো না। ভাবলাম রাতের
গাড়িতে কে কী করছে এক ঝলক দেখে নিলাম। কেউ হয়তো আমার মত ঝিমাচ্ছেন।
আবার কেউ আড্ডায় সময় কাটাচ্ছেন আবার কেউবা পত্রিকা পড়ছেন। আমার সামনে
বসে আছেন এ বৃদ্ধ ও তার পরিবার। বৃদ্ধের পাশে বসে আছেন মাথায় সিঁদুর পড়া
এক বৃদ্ধা রমনীসহ মোট সাত জন।তিন জন মহিলার মাথায় সিঁদুর দেখে বুঝলাম
উনারা হিন্দু সম্প্রদায়। আলাপ চারিতার্থের মাধ্যমে জিজ্ঞাস করলাম যাবেন
কোথায়।
বলেন তীর্থভ্রমণে চট্রগ্রাম।
সাথে উনারা কারা। বলেন আমার স্ত্রী, পুত্র, পুত্রবধূ, দু মেয়ে ,নাতি।
বেশ ভূষা কথাবার্তায় বুঝলাম উনারা সম্ভ্রান্ত পরিবারের লোক। অনুঢ়া ছোট
মেয়েটির লাবণ্য মূর্ত্তি দেখে অভিভূত হলাম। জ্যোতির্ময় রূপ যেন কল্পনার
পালঙ্কে শশীর সর্বত্র প্রকাশ। নাম জিজ্ঞেস করলাম বলল মাধবী।
পড়াশুনা কর।
জী, করি।
এবারে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা দিব।
তাকে দেখার পর হতে হৃদয়ে জাগে অনাহুত প্রেমের পরশ । বারবার তাকিয়ে
দেখেও মেটে না প্রাণের স্বাদ। অষ্টাদশীর শারীরিক সৌন্দর্য যেন সর্বাঙ্গে
জ্বলজ্বল করছে। যুবতীর অপূর্ব্ব রূপের সৌরভে মন হয়ে উঠে উদাস। মনে মনে
ভাবি আমি মুসলমান আর তারা হিন্দু সম্প্রদায় তাতে তো কোন কাল কিছুই
সম্ভব হবে না।তাকে দেখার পর হতে আমি যেন কেমন বিমোহিত হয়ে গেলাম। বৃদ্ধ
ভদ্র লোক আমাকে জিজ্ঞেস করলেন আপনি কোথায় যাবেন।
আমিও বললাম তীর্থ যাত্রায় ।
কোথায় যাবেন।
চাঁটগায়।
বৃদ্ধ বললেন ভালই হলো এক সাথে ঘুরে দেখা যাবে।
মনে মনে কিছু হিন্দু নাম সংগ্রহ করলাম। যদি জানতে চান তবে বলে ফেলব।
আমার এক সহধ্যায়ীর নাম শ্যামল কুন্ডু। ঠিক করলাম নাম জিজ্ঞাস করলে এ
নামই বলে দিব। চিন্তা করছি বললে কী হয় আর না বললেই বা কী হয়। ঠিক এ সময়
বৃদ্ধ বলেন আপনার নাম ?
বললাম শ্যামল কুন্ডু,
বাবার নাম হরিপদ চট্রপাধ্যায়,
মা জোস্না চট্রপাধ্যায়,
সমস্বরে সবাই হেসে বললেন এটা কেমন করে হয়। আপনি কুন্ডু বাবা
চট্রপাধ্যায় এমন তো হবার নয়। মনে মনে ভাবলাম যা এবার তো ধরা খেয়ে গেলাম।
বললাম আমার ডাক নাম কুন্ডু ।
সবাই কুন্ডু বলেই চিনে।
বৃদ্ধ বলেন ও তাই বলেন।
আমরা তো হতবাক হয়েছিলাম।
কথায় বলে চোরের মন পুলিশ পুলিশ । তাই যাতে আমার প্রতি তাদের মনে সন্দেহ
না থাকে তাই ভাল করে ব্যাপারটা আরও সহজ করে বুঝাবার জন্য বললাম,বাবাদের
মধ্যে জমি জমা বাড়ি ঘর ভাগাভাগির সময় কুন্ডুদের ভিটে বাবা কিনেছিলেন আর
ঐ নতুন ভিটে বাড়িতে আমার জন্ম, তাই সবাই আমাকে কুন্ডু বলে ডাকে। তার পর
থেকে আমার ডাক নাম কুন্ডু হয়েছে। মা বাবা ও কুন্ডু বলেই ডাকেন। কুন্ডু
বললেই সবাই চেনে। সবাই চুপিসারে হাসা হাসি করলেন। মনে মনে বেশ লজ্জা
পেলাম। ইতিমধ্যে আমার সাথে বৃদ্ধের সখ্যতা গড়েছে। তিনি আমাকে তাদের সাথে
তীর্থ ভ্রমণে থাকতে বললেন। আমি প্রথমে না না বললাম। তিনি একেবারে নাছোড়
বান্দা। না তা হবে না তাদের সাথেই আমাকে তীর্থযাত্রায় থাকতে হবে। আমি
না না বললেও তিনি তা মানেন না। তাছাড়া আমি তো মনে মনে তাই চেয়েছিলাম। (অসমাপ্ত)
WARNING:
Any unauthorized use or reproduction of 'Community' content
is strictly prohibited and constitutes copyright infringement liable to
legal action.
[প্রথমপাতা] |
লেখকের আগের লেখাঃ
|