|
ক্ষুব্ধ, লজ্জিত এবং
ক্ষমাপ্রার্থী
আবদুল মান্নান
খান সাহেব ওসমান আলী
নারায়ণগঞ্জের একজন কৃতী পুরুষ ছিলেন। ১৯৪৯ সালে আওয়ামী মুসলিম লীগ (পরে
আওয়ামী লীগ) গঠনে যে সকল রাজনীতিবিদ অসামান্য অবদান রেখেছিলেন তাঁদের মধ্যে
খান সাহেব ওসমান আলী অন্যতম। নারায়ণগঞ্জের মানুষ এখনো তাকে শ্রদ্ধাভরে
স্মরণ করে। তাঁর পুত্ররা রাজনীতিতে তেমন একটা সক্রিয় না হলে পৌত্ররা হয়েছেন
এবং দুর্ভাগ্যজনক হচ্ছে তারা প্রায়শ খারাপ কাজের জন্য সংবাদপত্রের শিরোনাম
হন। পরিবারটির প্রতি বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার একটি দুর্বলতা আছে কিন্তু
এই পৌত্রদের কর্মকা-ে তাঁকেও মাঝে মধ্যে বিব্রত হতে হয়। সবশেষ অঘটনটি
ঘটিয়েছেন জাতীয় পার্টি হতে নারায়ণগঞ্জের নির্বাচিত সংসদ সেলিম ওসমান
প্রকাশ্যে নারায়ণগঞ্জের পিয়ার সাত্তার লতিফ স্কুলের প্রধান শিক্ষক শ্যামল
কান্তি ভক্তকে ইসলাম ধর্ম অবমাননার অভিযোগে প্রকাশ্যে তাঁর ছাত্র-ছাত্রী ও
স্থানীয় জনগণের সামনে কান ধরে উঠবস করিয়ে। ঘটনাটি শুধু চরম লজ্জাজনকই নয়-এই
একটি ঘটনা পুরো শিক্ষক সমাজকে চরমভাবে অপমানিত করেছে এবং বহির্বিশ্বে
বাংলাদেশের সুনামের ওপর কালিমালিম্পন করেছে। শিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্ত আদৌ
ইসলাম ধর্ম নিয়ে অবমাননাকর কোন কটূক্তি করেছিলেন কী না তার কোন সত্যতা পাওয়া
যায় নি। প্রাপ্ত সংবাদ বিশ্লেষণ করলে মনে হয় উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে মসজিদের
মাইকে গুজব ছড়িয়ে একজন শিক্ষককে এই চরম অপমানের মুখোমুখি করা হয়েছে। এই
ন্যাক্কারজনক ঘটনা নিয়ে যখন সারা দেশে তোলপাড় চলছে ঠিক তখনই হাসপাতালের বেডে
শুয়ে শিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্ত চিঠি পেলেন তাঁকে স্কুলের প্রধান শিক্ষকের
পদ হতে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। বরখাস্তের জন্য চারটি কারণের মধ্যে একটি
কারণ হচ্ছে ছুটি ছাড়া কর্মস্থলে অনুপস্থিত। প্রকাশ্যে শিক্ষক শ্যামল
কান্তির চরম অপমাননাকর ঘটনার দৃশ্যটি সামাজিক গণমাধ্যমের বদৌলতে দেশের
মানুষ দেখেছে। ওই রকম একটি ঘটনার পর কোন একজন সুস্থমস্তিস্কের মানুষের পক্ষে
শারীরিক ও মানসিকভাবে সুস্থ থাকা সম্ভব নয়। শ্যামল কান্তিকে সাময়িক
বরখাস্তের পর স্কুল ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি ফারুকুল ইসলামের বোন পারভীন
আক্তারকে প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। বিভিন্ন গণমাধ্যম সূত্রে
জানা গেছে ব্যবস্থাপনা কমিটির কোন কোন সদস্য বহুদিন ধরে চেষ্টা করছিলেন
শ্যামল কান্তি ভক্তকে সরিয়ে পারভীন আক্তারকে প্রধান শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ
দিতে। আর তা করার জন্য এই জঘন্য ঘটনার সূত্রপাত করা হয়েছে।
শিক্ষামন্ত্রী, আইমন্ত্রী, যোগাযোগ মন্ত্রী, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীসহ
দেশের অনেক শ্রদ্ধাভাজন শিক্ষাবিদ ও বিবেকবান মানুষ এই ঘটনার নিন্দা করেছেন
এবং মন্ত্রিবর্গ ঘোষণা করেছেন এই ঘটনার সুষ্ঠু বিচার হবে এবং দোষী ব্যক্তি
বা ব্যক্তিদের আইনানুগ শাস্তি হবে। দেশের সর্বোচ্চ আদালত সরকারের ওপর রুল
জারি করেছেন কেন সেলিম ওসমানের বিরুদ্ধে এই ঘটনার জন্য শাস্তিমূলক ব্যবস্থা
নেওয়া হবে না তার কারণ দর্শাতে। এরই মধ্যে শাহবাগ চত্বরে
ছাত্র-শিক্ষক-মানবাধিকার কর্মীরা এই ঘটনার প্রতিবাদে সমাবেশ করেছেন,
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা বৃহস্পতিবার মানববন্ধন করেছেন। তবে এটাও ঠিক এই
ঘটনার জন্য সেলিম ওসমান বা অন্য কারো শাস্তি হবে তা অনেকে মনে করেন না কারণ
খান সাহেব ওসমান আলীর পৌত্ররা অনেক ক্ষেত্রে নিজেদের আইনের ঊর্ধ্বে মনে
করেন।
শিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্ত ইসলাম ধর্ম নিয়ে অবমানাকর উক্তি করেছেন তা
মসজিদের মাইকে প্রচার করা হয় যা ছিল নিছক গুজব। বেশ কিছুদিন ধরে এই ধরনের
গুজব ছড়ানোর জন্য দেশের অনেক স্থানে মাইক ব্যবহার করা হয়। অনেক মুসলিম
প্রধান দেশে আজান ছাড়া মাইক ব্যবহার নিষিদ্ধ। তাও আবার আওয়াজটা নিয়ন্ত্রিত
থাকে যাতে অন্যের অসুবিধা না হয়। বাংলাদেশে গত কয়েক বছর ধরে মসিজেদের মাইক
ব্যবহার করে গুজব ছড়িয়ে সাম্প্রদায়িক ও সামাজিত সম্প্রীতি নষ্ট করার একটি
সংষ্কৃতি শুরু হয়েছে। এর একটি ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছিল ২০১৩ সালে যখন চার
দলীয় জোট অসাংবিধানিক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে দেশের
বিরুদ্ধে পেট্রোল বোমা যুদ্ধ আর লাগাতার হরতাল ও অবরোধ ঘোষণা করেছিল। ২০১৩
সালের এপ্রিল মাসের ১১ তারিখ চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি উপজেলার ভোজপুরে স্থানীয়
আওয়ামী লীগ একটি হরতাল বিরোধী মিছিল বের করে। মিছিলটি ভোজপুর পৌঁছালে
স্থানীয় মসজিদের মাইক হতে ঘোষণা দেওয়া হয় মসজিদের ইমাম সাহেব আওয়ামী লীগ
কর্মীদের দ্বারা আক্রান্ত। আগে হতে প্রস্তুত থাকা কয়েক শত জামায়াত শিবির
কর্মী মিছিলটির উপর সশস্ত্র হামলা চালিয়ে বেশ কয়েকজনকে পিটিয়ে হত্যা করে।
আহত হয় মিছিলে অংশগ্রহণকারী শখানেক মানুষ। পোড়ানো হয় প্রায় অর্ধশত
মোটরসাইকেল, পুলিশের আর ফায়ার ব্রিগেডের গাড়ি। এমন অমানবিক হত্যাকা- দেশের
মানুষ কখনো দেখেনি। বলাবাহুল্য এমন একটি ভয়াবহ ঘটনার এই পর্যন্ত কোন বিচার
হয় নি। এক সময় মাইক ব্যবহারের ওপর একটি নিয়ন্ত্রণ ছিল। কোন অনুষ্ঠানে মাইক
ব্যবহার করতে হলে জেলা প্রশাসনের দপ্তর হতে অনুমতি নিতে হতো। এখন সেই সবের
কোন বালাই নেই। অনেক জেলায় সারা রাত ওয়াজ মাহফিলের মাইক লাগিয়ে এলাকার
মানুষের ঘুম হারাম করা হয় এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে ধর্মের নামে অধর্মের কথা
বলা হয়।
সেলিম ওসমান যখন নারায়ণগঞ্জে তার অপকর্মটি করেন তখন প্রধানমন্ত্রী দেশের
বাইরে। পিতার মতো কন্যাও শিক্ষকদের অসম্ভব সম্মান করেন যা সুযোগ পেলেই তিনি
প্রকাশ্যে বলে থাকেন। দেশের সচেতন মানুষ আশা করে তিনি দেশে ফিরলে এই
ন্যাক্কারজনক ঘটনার সুষ্ঠু বিচার হবে এবং দোষী ব্যক্তি তার কৃত অপকর্মের
জন্য উপযুক্ত শাস্তি পাবেন। সব চেয়ে দুর্ভাগ্যজনক বিষয়টি ছিল যখন সংসদ
সদস্য সেলিম ওসমান শিক্ষক শ্যামল কান্তিকে কান ধরে উঠবস করাচ্ছিলেন তখন
উপস্থিত জনগণ ‘জয় বাংলা’ আর ‘জয় বঙ্গবন্ধু’ স্লোগান দিচ্ছিল। এই দুই
স্লোগানের এমন অপমান এর পূর্বে কখনো দেখা গেছে বলে শুনিনি। এরই মধ্যে সেলিম
ওসমানের কিছু বশংবদ সমর্থক সামাজিক গণমাধ্যমে প্রচার করা শুরু করেছে সেলিম
ওসমানের কারণেই নাকি ওই দিন শ্যামল কান্তি ভক্ত গণধোলাই হতে বেঁচে গেছেন।
সেলিম ওসমানের সামান্যতম বিবেক বুদ্ধি থাকলে তিনি সাহস করে ওই শিক্ষকের
সামনে দাঁড়িয়ে বলতে পারতেন কারো সাহস থাকলে আগে আমার উপর আঘাত করো, আমিই
একজন সম্মানিত শিক্ষককে রক্ষা করবো। তার সেই সাহস বা ইচ্ছা কোনটাই ছিল না।
শ্যামল কান্তি সত্যি সত্যি যদি কোন অপরাধ করেও থাকেন তার আইন অনুযায়ী
ব্যবস্থা নেওয়ার অনেক রাস্তা খোলা আছে। আর বাংলাদেশে একজন ধর্মীয় সংখ্যালঘু
শিক্ষক অন্য ধর্ম নিয়ে কটূক্তি করবেন তা একজন পাগলও বিশ্বাস করবে না। বরং
উল্টোটা ঘটতে প্রায়ই দেখা যায়। সব চেয়ে বেশি হতাশ করেছে স্থানীয় পুলিশ।
তারা বলেছে এই ব্যপারে তাদের কিছু করনিয় নেই। জনগণের অর্থে এমন নপুংসক
পুলিশ লালন পালন করার কী প্রয়োজন থাকতে পারে? সব কথার শেষ কথা দেশের মানুষ
এই ঘটনা সুষ্ঠু তদন্তপূর্বক দোষী ব্যক্তিদের শাস্তি হোক তা দেখেতে চায়।
ব্যক্তিগতভাবে আমি একজন শিক্ষক। সংসদ সদস্য সেলিম ওসমানের শিক্ষক শ্যামল
কান্তি ভক্তকে চরম অপমান শুধু একজন ব্যক্তির অপমান ছিল না। তিনি সকল শিক্ষক
সমাজকে অপমান ও লাঞ্ছিত করেছেন। এই ঘটনায় একজন শিক্ষক হিসেবে আমি ক্ষুব্ধ,
লজ্জিত এবং তাঁর কাছে ক্ষমা প্রার্থী। সর্বশেষ সংবাদে জানা গেছেযে
শিক্ষামন্ত্রীর নির্দেশে শ্যামল কান্তি ভক্তকে পুনর্বহাল করা হয়েছে এবং
স্কুলের ব্যবস্থাপনা কমিটি ভেঙে দেওয়া হয়েছে । মানুষ এখন পুরো বিষয়ের
সম্মানজনক সমাপ্তি প্রত্যাশা করে ।
লেখক: গবেষক ও বিশ্লেষক । মে ১৯, ২০১৬
WARNING:
Any unauthorized use or reproduction of 'Community' content
is strictly prohibited and constitutes copyright infringement liable to
legal action.
[প্রথমপাতা] |
লেখকের আগের লেখাঃ
[......লেখক আর্কাইভ]
|