প্রথমপাতা  

সাম্প্রতিক সংবাদ 

 স্বদেশ

আন্তর্জাতিক

বাংলাদেশ কমিউনিটি

লাইফ স্টাইল

এক্সক্লুসিভ

বিনোদন

স্বাস্থ্য

বর্তমানের কথামালা

 শিল্প-সাহিত্য

 প্রবাসপঞ্জী 

আর্কাইভ

যোগাযোগ

 

 

 

 

 

 

 

একজন মৃতুঞ্জয়ী মহানায়কের কথা বলছি

 


আবদুল মান্নান

 

পদ্মা যমুনা মেঘনা বিধৌত এই গাঙ্গেয় বদ্বীপ অঞ্চলের এক নিভৃত পল্লী গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় ১৯২০ সালের ১৭ই মার্চ মুজিব নামের যে শিশুটির জন্ম হয়েছিল কালক্রমে সেই শেখ মুজিব হয়ে উঠেছিলেন বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু, পরবর্তিকালে স্বাধীন বাংলাদেশের জনক,হাজার বছরের শ্রেষ্ট বাঙালি। সেই জনককেই একদল ঘাতক ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগষ্ট তাঁরই নিজ বাড়িতে তাঁকে সপরিবারে হত্যা করেছিল । বিদেশে থাকার কারণে তাঁর দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা ঘাতকদের বুলেট হতে বেঁচে গিয়েছিলেন । সমসাময়িক ইতিহাসে এমন নৃশংস হত্যাকান্ডের কোন নজির নেই । অনেকেই ভ্রান্ত ভাবে মনে করেন বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যাকান্ডটি শুধু মাত্র একদল বিভ্রান্ত বিপতগামী সেনা কর্মকর্তা আর কতিপয় ষড়যন্ত্রকারী ক্ষমতালিপ্সু আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত রাজনীতিবিদদের কাজ । এই হত্যাকান্ডের অনেক গুলি অসত্য ও বানোয়াট কারণের সাথে জাতীয় রক্ষীবাহিনীকে সম্পৃক্ত করেন এবং বলেন বঙ্গবন্ধু সেনাবাহিনীর চেয়ে রক্ষীবাহিনীকে বেশী গুরুত্ব দিতেন এবং তাদের জন্য প্রতিরক্ষা বাজেটের সিংহভাগ বরাদ্দ করতেন । কেউ কেউ এমন কথাও বলেন বঙ্গবন্ধু এক সময় সেনা বাহিনী বিলুপ্ত করে দেবেন । বাস্তবে রক্ষীবাহিনী গঠিত হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধ ফেরত ওই সব মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে যাদের নিয়মিত সেনাবাহিনীতে যাওয়ার যোগ্যতা ছিল না । আর রক্ষীবাহিনীর জন্য সর্বোচ্চ বরাদ্দ ছিল প্রতিরক্ষা বাজেটের মাত্র ৯ ভাগ । আর যুদ্ধফেরত এই সব মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে যদি বঙ্গবন্ধু জাতীয় রক্ষীবাহিনী গঠন না করতেন তা হলে একটি যুদ্ধ বিধ্বস্থ দেশে বেকারের সংখ্যা কয়েকগুণ বৃদ্ধি পেতো এবং তাতে চরম সামাজিক সমস্যার সৃষ্টি হতে পারতো । অন্যদিকে একই যুক্তিতে বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান ফেরত সিভিল মিলিটারি বাঙালি সদস্যদেরও স্বাধীন বাংলাদেশের সিভিল প্রশাসনে ও প্রতিরক্ষা বাহিনীতে আত্মীকরণ করেছিলেন যদিও এদের একটি উল্লেখযোগ্য সংখ্যক সদস্য মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময় স্বেচ্ছায় পাকিস্তানের পক্ষে কাজ করেছে এবং বাংলাদেশের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে । পিছন ফিরে থাকালে মনে হয় এটি বঙ্গবন্ধুর একটি ভুল সিদ্ধান্ত ছিল । বঙ্গবন্ধুকে হত্যার সাথে যারাই জড়িত ছিলেন তাদের বেশীর ভাগই ছিলেন এই পাকিস্তান ফেরত গোষ্ঠী । বঙ্গবন্ধুর বড় দূর্বলতা ছিল তিনি সহজে বাঙালিকে বিশ্বাস করতেন এবং কোন বাঙালি তাঁকে হত্যা করবেন তা ছিল তাঁর কাছে অবিশ্বাস্য । খুনিদের অন্যতম মেজর ডালিমের সাথে বঙ্গবন্ধু পরিবারের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল এবং জানা মতে ডালিম সস্ত্রীক বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার দুদিন আগে ধানমন্ডির বত্রিশ নম্বর বাড়িতে বেগম মুজিবের রান্না করা রাতের খাবারও খেয়েছিলেন । সেনাবাহিনীর ডেপুটি চিফ অব ষ্টাফ জেনারেল জিয়াকে যারা কাছ থেকে দেখেছেন তারা জানতেন তিনি একজন অত্যন্ত উচ্চাভিলাষী সেনা অফিসার ছিলেন । তার স্থলে জেনারেল সফিউল্লাহকে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সেনা প্রধান করাতে জিয়া অত্যন্ত ক্ষুব্ধ ছিলেন কিন্তু ধুরন্ধর চালাক জিয়া তা কাউকে বুঝতে দেন নি । জেনারেল সফিউল্লাহ বিষয়টা বুঝতে পেরে বঙ্গবন্ধুকে কয়েকবার অনুরোধ করেছিলেন তিনি যেন জিয়াকে সেনাবাহিনী হতে অবসর দিয়ে কোন কূটনৈতিক দায়িত্ব দিয়ে দেশের বাইরে পাঠিয়ে দেন । বঙ্গবন্ধু বিষয়টিকে তাৎক্ষণিক কোন গুরুত্ব দেন নি । প্রসঙ্গত বঙ্গবন্ধু জিয়ার জন্যই সেনাবাহিনীতে ডেপুটি চীফ অব স্টাফ পদটি সৃষ্টি করেছিলেন । ওই পদে তিনিই ছিলেন প্রথম ও শেষ কর্মকর্তা । এটি ছিল বেগম জিয়াকে জিয়ার ঘরে তোলার পুরস্কার । মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময় জিয়া একাধিক বার বেগম জিয়াকে ভারতে নিয়ে যেতে লোক পাঠিয়ে ব্যর্থ হয়েছিলেন । বেগম জিয়া তাদের সাথে যেতে অস্বীকৃতি জানান । তিনি পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে থাকাটা নিরাপদ মনে করেছিলেন । যুদ্ধ শেষে এ নিয়ে তার স্বামীর সাথে বড় ধরণের সমস্যার সৃষ্টি হলে বঙ্গবন্ধুর হস্তক্ষেপে তা নিরসন হয় । বঙ্গবন্ধু সব সময় বলতেন তাঁর দুই নয় তিন কন্যা । জিয়াকে ডেপুটি চীফ করলেও তিনি তাতে সন্তুষ্ট ছিলেন না কারণ সেনাবাহিনীর উপর তার তেমন কোন নিয়ন্ত্রণ ছিল না । কিছু দিনের মধ্যেই বঙ্গবন্ধু জিয়ার এই নাখোশ হওয়ার বিষয়টি উপলব্দি করেন। তিনি নিহত হওয়ার কয়েক মাস আগে জিয়ার চাকুরি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ন্যস্ত করা হয় । ঠিক হয়েছিল তাকে হয় পূর্ব জার্মানি অথবা বেলজিয়ামে রাষ্ট্রদূত করে পাঠানো হবে । এতেও জিয়া তার নিকটজনদের কাছে বেশ ক্ষুব্দ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন । জিয়া যে একজন ক্ষমতালিপ্সু ব্যক্তি ছিলেন তা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর যখন এক পর্যায়ে বিচারপতি আবু সায়দাত মোহাম্মদ সায়েম রাষ্ট্রপতি হন তখন তা তিনি উপলব্দি করেছেন যা তিনি তাঁর At Bangabhaban-Last Phase গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন । বিচারপতি সায়েম লিখেছেন যে, জিয়া শেষের দিকে এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছিলেন যে তিনি তার কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে বাধ্য হয়েছিলেন । জিয়ার এই চরিত্র বুঝা যায় যখন তিনি ২৭ মার্চ ১৯৭১ সালে চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র হতে পঠিত স্বাধীনতার ঘোষণা পত্রে প্রথমে নিজেকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে ঘোষণা করেন । পরবর্তিকালে রাজনীতিবিদদের চাপে পরে তিনি তার ঘোষণায় পরিবর্তন এনে বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে ঘোষণা করেন । মুক্তিযুদ্ধ কোন সামরিক অভ’ত্থান ছিল না । জিয়া পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তার চাকুরি ন্যস্ত করার বিষয়টাকে পূনঃবিবেচনা করানোর জন্য আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের হাতে পায়ে ধরা শুরু করেন । এ’ব্যাপারে তিনি তার কোর্স মেট ও বন্ধু ঢাকা সেনা নিবাসের তৎকালিন ষ্টেশন কমান্ডার লেঃ কর্নেল (অবঃ) এম এ হামিদের সহায়তা নেন। হামিদ প্রকৃত পরিস্থিতি না বুঝে জিয়াকে সহায়তা করার চেষ্টা করেন । জিয়া বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক সচিব তোফায়েল আহমেদের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর সাথে সাক্ষাৎ করার সুযোগ পান । জিয়া রাষ্ট্রপতিকে আশ্বস্ত করেন তাঁর প্রতি জিয়ার আনুগত্য প্রশ্নাতীত এবং বাকি জীবন তিনি একজন সৈনিক হিসেবেই কাটিয়ে দিতে চান । উদার হৃদয়ের মানুষ বঙ্গবন্ধু জিয়ার কথায় বিশ্বাস করেছিলেন এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় হতে তার চাকুরি পুনরায় সেনা বাহিনীতে বহাল করার নির্দেশ দেন । সেই জিয়ার সাথে পনেরই আগষ্টের ঘাতকদের অন্যতম কর্নেল রশিদ (অবঃ) বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পরিকল্পনা নিয়ে সবিস্তারে আলোচনা করেন মার্চ মাসে। জিয়া ঘাতকদের প্রতি তার প্রত্যক্ষ সমর্থন জানান । শুধু বলেন একজন সিনিয়র অফিসার হিসেবে তিনি এই কাজের সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত হতে পারবেন না তবে তারা তাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়নে এগিয়ে যেতে পারেন। শেষতক জিয়াই বঙ্গবন্ধু হত্যার সবচেয়ে বড় বেনিফিসিয়ারি হয়েছিলেন ।
বঙ্গবন্ধুর হত্যাকান্ডের সাথে প্রতক্ষ্যভাবে যারা জড়িত ছিলেন তাদের অধিকাংশই সরাসরি পাকিস্তানি সেনা গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই এর সাথে অথবা অন্য কোন গোয়েন্দা সংস্থার সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন । জিয়াও এক সময় এই সংস্থার হয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে কাজ করেছেন । ১৫ই আগষ্টের আগে সে সময় ডিজিএফআইয়ে কর্মরত মুক্তিযোদ্ধা অফিসার মেজর (অবঃ) জিয়াউদ্দিন একাধিক সাক্ষাৎকারে বলেছেন সেনাবাহিনীতে যে একটি ষড়যন্ত্র হচ্ছে তা নোট আকারে বঙ্গবন্ধুর নিকট গোপর নথি হিসেবে তারা পাঠিয়েছিলেন । সেই নোট বঙ্গবন্ধুর হাতে এক রহস্যজনক কারণে পৌঁছায় নি । এর অন্যতম কারণ হচ্ছে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার আগের দিনগুলোতে তিনি পাকিস্তান ফেরত ষড়যন্ত্রকারীদের দ্বারা পরিবেষ্টিত হয়ে গিয়েছিলেন । বঙ্গবন্ধুর মিলিটারি সেক্রেটারি ব্রিগেডিয়ার মাশরুল হক ও ব্যক্তিগত নিরাপত্তা কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জামিল ছিলেন পাকিস্তান ফেরত সামরিক কর্মকর্তা । তারা কেউই মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন নি । রাষ্ট্রপতি (বঙ্গবন্ধু) ভিজিলেন্স টিমের প্রধান ডিআইজি এ বি এস সফদার একাত্তরে পাকিস্তানের গোয়েন্দা বিভাগের প্রধান ছিলেন । রাষ্ট্রপতির তিনজন এডিসি ক্যাপ্টেন শরীফ আজিজ, ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মোশাররফ ও লেফটেন্যান্ট গোলাম রাব্বানি কেউই মুক্তিযোদ্ধা কর্মকর্তা নন । তারা সকলেই পাকিস্তান ফেরত । রাষ্ট্রপতির ব্যক্তিগত নিরাপত্তার দায়িত্ব ছিল সরাসরি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের হাতে । বঙ্গবন্ধুকে হত্যার সময় স্বরাষ্ট্র সচিব ছিলেন আবদুর রহিম যিনি একাত্তরে পূর্ব পাকিস্তান স্পেশাল ফোর্সের পরিচালক ছিলেন । এই ফোর্স গঠিত হয়েছিল রাজাকার, আলবদর, আল শামস ও শান্তি কমিটির সদস্যদের নিয়ে । পঁচাত্তরে পুলিশের আইজি তছলিম উদ্দিন একাত্তরে পাকিস্তান পুলিশের আইজি ছিলেন । সেনা গোয়েন্দা ডিজিএফআই’র প্রধান আবদুর রউফ পাকিস্তান ফেরত সেনা কর্মকর্তা । এসবি’র প্রধান ইএ চৌধুরী একাত্তরে ঢাকা জেলার এস পি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন । জাতীয় নিরাপত্তা সংস্থা এনএসআই এর প্রধান আবদুল হাকিম একাত্তরে নোয়াখালির এসপি’র দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন । এনএসআই এর তিনজন ডেপুটি ডিরেক্টর এম এন হুদা, মুসা মিয়া চৌধুরী ও একেএম মোসলেমউদ্দিন সকলেই একাত্তরে পাকিস্তানের সেবা করেছেন । বিডিআর এর প্রধান মেজর জেনারেল খলিলুর রহমান একজন পাকিস্তান ফেরত সেনা কর্মকর্তা । সুতরাং এটা বুঝতে অসুবিধা হয় না বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার ষড়যন্ত্রের জাল বিছানোর কাজ অনেক আগে হতেই শুরু হয়েছিল ।
হত্যাকারীদের কেউ কেউ সরাসরি পাকিস্তানের সেনা গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই এর সাথে যোগাযোগ রাখতেন । ১৯৭৩ সালের প্রথম দিক থেকেই পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি (পরে প্রধানমন্ত্রী) জুলফিকার আলী ভুট্টো বঙ্গবন্ধু সরকারকে উৎখাত করার জন্য গোপনে বঙ্গবন্ধু বিরোধীদের অর্থ যোগান দেয়া শুরু করেন । বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টির (এম-এল) সাধারণ সম্পাদক কমরেড আবদুল হক ১৯৭৪ সালের ১৬ই ডিসেম্বর পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ভুট্টোকে উদ্দেশ্য করে লিখেন “আমার প্রিয় প্রধানমন্ত্রী ....গণবিচ্ছিন্ন পুতুল মুজিবের বিরুদ্ধে ব্যবহারের জন্য আপনার নিকট অর্থ, অস্ত্র ও বেতারযন্ত্রের জন্য আবেদন করছি ।” আবদুল হকের এই আবেদন ভুট্টো অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করেন এবং তার উপর মন্তব্য করেন ‘এই সৎ ও কার্যকর ব্যক্তিটিকে প্রার্থীত সাহায্য দেয়া হোক’ । বর্তমানে বাংলাদেশে আবদুল হকের মৃত্যু দিবস ঘটা করে পালন করা হয় । ভুট্টো পুরো অপারেশন পরিচালনা করার জন্য আবদুল মালেক নামক তার একান্ত আস্থাভাজন একজনকে দায়িত্ব অর্পণ করেন । মালেক ভুট্টোর এই ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নের জন্য তার উপদেষ্টা মন্ডলির সদস্য মাওলানা কাউসার নিয়াজিকে নিয়ে আরব দেশগুলি সফর করেন । মার্কিন গবেষক ষ্টানলি উলপার্ট তার Zulfi Bhutto of Pakistan  গ্রন্থে এই সব তথ্য সবিস্তারে বিবৃত করেছেন ।
বঙ্গবন্ধু হত্যার সাথে সরাসরি জড়িত ছিল ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাসের সিআইএর ষ্টেশন চীফ ফিলিপ চেরী । এই প্রসঙ্গে কয়েক বছর আগে প্রখ্যাত মার্কিন সাংবাদিক লরেঞ্জ লিফসুলজ ধারাবাহিক ভাবে একটি জাতীয় দৈনিকে বর্ণনামূলক ফিচার লিখেছিলেন । লিফসুলজ দীর্ঘদিন ধরে এই অঞ্চলে অধুনা লুপ্ত ফার ইস্টার্ন ইকোনমিক রিভ্যুর হয়ে সাংবাদিকতা করেছেন এবং বাংলাদেশের রাজনৈতিক ঘটনা প্রবাহ কাছ থেকে দেখেছেন । লিফসুলজ কর্ণেল তাহের হত্যা মামলায় সাক্ষ্য দিতে ঢাকা আসলে এই বিষয়টি নিয়ে আমি তাঁর সাথে দীর্ঘ আলাপ করেছি । তিনি বলেছেন এই বিষয়ে তিনি দীর্ঘদিন গবেষণা করছেন এবং আগামীতে তিনি আরো লেখার ইচ্ছা রাখেন । তিনি এও বলেন একজন পেশাদার সাংবাদিকের কাজ নয় অসত্য তথ্য পরিবেষণ করা । বঙ্গবন্ধু হত্যাকারিদের সাথে তার (ফিলিপ চেরী) নিয়মিত যোগাযোগ ছিল এবং এই বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালিন পররাষ্ট্র সচিব (মন্ত্রী) হেনরি কিসিঞ্জার অনুমোদন দিয়েছিলেন। ১৯৭৪ সালে কিসিঞ্জার ঢাকা সফর করেন । বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার আগের সপ্তাহে মার্কিন রাষ্ট্রদূত ইউজিন বোষ্টার একাধকিবার বঙ্গবন্ধুর সাথে বত্রিশ নম্বর বাড়িতে সাক্ষাৎ করেন । একাত্তরে প্রেসিডেন্ট নিক্সন ও হেনরি কিসিঞ্জার সরাসরি পাকিস্তানের পক্ষ অবলম্বন করেছিলেন। খোন্দকার মোশতাকের মাধ্যমে বাঙালির মুক্তিযুদ্ধকে বানচাল করতে তারা তৎপর ছিলেন । তাজউদ্দিনের বিচক্ষণতায় তা সফল হয় নি । স্বাধীন বাংলাদেশের অভুদ্যয়কে কিসিঞ্জার তার ব্যক্তিগত পরাজয় মনে করতেন । বঙ্গবন্ধু হোয়াইট হাউসে প্রেসিডেন্ট জেরাল্ড ফোর্ডের সাথে দেখা করতে গেলে কিসিঞ্জার দুই রাষ্ট্রপ্রধানের বৈঠকে উপস্থিত থাকতে অস্বীকৃতি জানান। কিসিঞ্জার বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতা হতে বঙ্গবন্ধুর বিদায় চাইবেন তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই । বর্তমানে বঙ্গবন্ধু কন্যাযে ক্ষমতায় আছেন তাও যুক্তরাষ্ট্রের জন্য তেমন পছন্দের নয় যা তাদের বিভিন্ন কর্মে দিবালোকের মতো পরিষ্কার । যুক্তরাষ্ট্রের অভিপ্রায় বাংলাদেশ একটি জঙ্গি রাষ্ট্র হয়ে উঠুক ফলে এই দেশে তারা গণতন্ত্র রফতানি করতে সক্ষম হবে যেমন তারা মধ্যপ্রাচ্যে করেছে।
বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর যারা মোশতাকের উপদেষ্টা মন্ডলির ও পরবর্তিকালে তার মন্ত্রীসভার সদস্য হয়েছিলেন তারা সকলেই বঙ্গবন্ধুর অত্যন্ত কাছের আস্থাভাজন মানুষ ছিলেন । পনেরই অগাষ্ট বঙ্গবন্ধুর অত্যন্ত আস্থাভাজন এবং সাবেক রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী যিনি যুক্তরাজ্য সফর করছিলেন তিনি বঙ্গবন্ধুর মৃত্যু সংবাদ শুনে মন্তব্য করেন ‘মোশতাক গণতন্ত্রে বিশ্বাস করেন। তিনি দেশে গণতান্ত্রিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হবেন’ । আবু সাঈদ চৌধুরী মোশতাক মন্ত্রীসভার পররাষ্ট্র মন্ত্রী হয়েছিলেন । মোশতাক মন্তব্য করেছিলেন ‘যারা এই কাজটি করেছেন তারা দেশপ্রেমিক সেনা সদস্য এবং সূর্যসন্তান’ । মাওলানা ভাসানি ও আবদুর রহমান তর্কবাগিশ দু’জনই একসময় আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন । বঙ্গবন্ধু তাদেও পিতৃবৎ সম্মান করতেন । তারা দু’জনই মোশতাকের সাফল্যের জন্য দোয়া করেছিলেন এবং বঙ্গবন্ধুর হত্যাকে সমর্থন দিয়েছিলেন। আবদুল মালেক উকিল, জাতীয় সংসদেও স্পিকার ছিলেন । লন্ডন হতে মন্তব্য করেছিলেন ‘ফেরাউনের পতন হয়েছে । দেশ একজন স্বৈরাচারের হাত হতে মুক্ত হয়েছে।’ তার ছেলে বর্তমানে সরকারের একটি দায়িত্বপূর্ণ পদে অধিষ্টিত । কেউ কেউ হয়তো বন্দুকের নলের ডগায় মোশতাক মন্ত্রী সভার শপথ নিয়েছিলেন । নেন নি চার জাতীয় নেতা । তারা নির্ভয়ে কারাগারে গিয়েছিলেন । নিজের জীবন দিয়ে তাঁরা প্রমাণ করেছিলেন তাঁরা মৃতুঞ্জয়ী । বঙ্গবন্ধু সহ এঁরা সকলে মহকালের মাহানয়ক । ঘাতকদের হাতে তাঁদের মৃত্যু ইতিহাসে তাদেরও অমর করে রেখেছে । আজকের এই দিনে পনেরই আগষ্টের সকল শহীদদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা ।

লেখক: বিশ্লেষক ও গবেষক । অগাষ্ট ১২, ২০১৭

 

 

 

WARNING: Any unauthorized use or reproduction of 'Community' content is strictly prohibited and constitutes copyright infringement liable to legal action. 

 

[প্রথমপাতা]

 

 

 

লেখকের আগের লেখাঃ

[......লেখক আর্কাইভ]