|
||||||||||||||||||
|
একজন মৃতুঞ্জয়ী মহানায়কের কথা বলছি
পদ্মা যমুনা মেঘনা বিধৌত এই গাঙ্গেয় বদ্বীপ অঞ্চলের এক নিভৃত পল্লী
গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় ১৯২০ সালের ১৭ই মার্চ মুজিব নামের যে শিশুটির জন্ম
হয়েছিল কালক্রমে সেই শেখ মুজিব হয়ে উঠেছিলেন বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা
বঙ্গবন্ধু, পরবর্তিকালে স্বাধীন বাংলাদেশের জনক,হাজার বছরের শ্রেষ্ট
বাঙালি। সেই জনককেই একদল ঘাতক ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগষ্ট তাঁরই নিজ বাড়িতে তাঁকে
সপরিবারে হত্যা করেছিল । বিদেশে থাকার কারণে তাঁর দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও
শেখ রেহানা ঘাতকদের বুলেট হতে বেঁচে গিয়েছিলেন । সমসাময়িক ইতিহাসে এমন
নৃশংস হত্যাকান্ডের কোন নজির নেই । অনেকেই ভ্রান্ত ভাবে মনে করেন
বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যাকান্ডটি শুধু মাত্র একদল বিভ্রান্ত বিপতগামী
সেনা কর্মকর্তা আর কতিপয় ষড়যন্ত্রকারী ক্ষমতালিপ্সু আওয়ামী লীগের রাজনীতির
সাথে সম্পৃক্ত রাজনীতিবিদদের কাজ । এই হত্যাকান্ডের অনেক গুলি অসত্য ও
বানোয়াট কারণের সাথে জাতীয় রক্ষীবাহিনীকে সম্পৃক্ত করেন এবং বলেন বঙ্গবন্ধু
সেনাবাহিনীর চেয়ে রক্ষীবাহিনীকে বেশী গুরুত্ব দিতেন এবং তাদের জন্য
প্রতিরক্ষা বাজেটের সিংহভাগ বরাদ্দ করতেন । কেউ কেউ এমন কথাও বলেন
বঙ্গবন্ধু এক সময় সেনা বাহিনী বিলুপ্ত করে দেবেন । বাস্তবে রক্ষীবাহিনী
গঠিত হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধ ফেরত ওই সব মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে যাদের নিয়মিত
সেনাবাহিনীতে যাওয়ার যোগ্যতা ছিল না । আর রক্ষীবাহিনীর জন্য সর্বোচ্চ
বরাদ্দ ছিল প্রতিরক্ষা বাজেটের মাত্র ৯ ভাগ । আর যুদ্ধফেরত এই সব
মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে যদি বঙ্গবন্ধু জাতীয় রক্ষীবাহিনী গঠন না করতেন তা হলে
একটি যুদ্ধ বিধ্বস্থ দেশে বেকারের সংখ্যা কয়েকগুণ বৃদ্ধি পেতো এবং তাতে চরম
সামাজিক সমস্যার সৃষ্টি হতে পারতো । অন্যদিকে একই যুক্তিতে বঙ্গবন্ধু
পাকিস্তান ফেরত সিভিল মিলিটারি বাঙালি সদস্যদেরও স্বাধীন বাংলাদেশের সিভিল
প্রশাসনে ও প্রতিরক্ষা বাহিনীতে আত্মীকরণ করেছিলেন যদিও এদের একটি
উল্লেখযোগ্য সংখ্যক সদস্য মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময় স্বেচ্ছায় পাকিস্তানের
পক্ষে কাজ করেছে এবং বাংলাদেশের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে । পিছন ফিরে থাকালে
মনে হয় এটি বঙ্গবন্ধুর একটি ভুল সিদ্ধান্ত ছিল । বঙ্গবন্ধুকে হত্যার সাথে
যারাই জড়িত ছিলেন তাদের বেশীর ভাগই ছিলেন এই পাকিস্তান ফেরত গোষ্ঠী ।
বঙ্গবন্ধুর বড় দূর্বলতা ছিল তিনি সহজে বাঙালিকে বিশ্বাস করতেন এবং কোন
বাঙালি তাঁকে হত্যা করবেন তা ছিল তাঁর কাছে অবিশ্বাস্য । খুনিদের অন্যতম
মেজর ডালিমের সাথে বঙ্গবন্ধু পরিবারের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল এবং জানা মতে
ডালিম সস্ত্রীক বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার দুদিন আগে ধানমন্ডির বত্রিশ নম্বর
বাড়িতে বেগম মুজিবের রান্না করা রাতের খাবারও খেয়েছিলেন । সেনাবাহিনীর
ডেপুটি চিফ অব ষ্টাফ জেনারেল জিয়াকে যারা কাছ থেকে দেখেছেন তারা জানতেন
তিনি একজন অত্যন্ত উচ্চাভিলাষী সেনা অফিসার ছিলেন । তার স্থলে জেনারেল
সফিউল্লাহকে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সেনা প্রধান করাতে জিয়া অত্যন্ত
ক্ষুব্ধ ছিলেন কিন্তু ধুরন্ধর চালাক জিয়া তা কাউকে বুঝতে দেন নি । জেনারেল
সফিউল্লাহ বিষয়টা বুঝতে পেরে বঙ্গবন্ধুকে কয়েকবার অনুরোধ করেছিলেন তিনি যেন
জিয়াকে সেনাবাহিনী হতে অবসর দিয়ে কোন কূটনৈতিক দায়িত্ব দিয়ে দেশের বাইরে
পাঠিয়ে দেন । বঙ্গবন্ধু বিষয়টিকে তাৎক্ষণিক কোন গুরুত্ব দেন নি । প্রসঙ্গত
বঙ্গবন্ধু জিয়ার জন্যই সেনাবাহিনীতে ডেপুটি চীফ অব স্টাফ পদটি সৃষ্টি
করেছিলেন । ওই পদে তিনিই ছিলেন প্রথম ও শেষ কর্মকর্তা । এটি ছিল বেগম
জিয়াকে জিয়ার ঘরে তোলার পুরস্কার । মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময় জিয়া একাধিক
বার বেগম জিয়াকে ভারতে নিয়ে যেতে লোক পাঠিয়ে ব্যর্থ হয়েছিলেন । বেগম জিয়া
তাদের সাথে যেতে অস্বীকৃতি জানান । তিনি পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর
তত্ত্বাবধানে থাকাটা নিরাপদ মনে করেছিলেন । যুদ্ধ শেষে এ নিয়ে তার স্বামীর
সাথে বড় ধরণের সমস্যার সৃষ্টি হলে বঙ্গবন্ধুর হস্তক্ষেপে তা নিরসন হয় ।
বঙ্গবন্ধু সব সময় বলতেন তাঁর দুই নয় তিন কন্যা । জিয়াকে ডেপুটি চীফ করলেও
তিনি তাতে সন্তুষ্ট ছিলেন না কারণ সেনাবাহিনীর উপর তার তেমন কোন নিয়ন্ত্রণ
ছিল না । কিছু দিনের মধ্যেই বঙ্গবন্ধু জিয়ার এই নাখোশ হওয়ার বিষয়টি উপলব্দি
করেন। তিনি নিহত হওয়ার কয়েক মাস আগে জিয়ার চাকুরি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে
ন্যস্ত করা হয় । ঠিক হয়েছিল তাকে হয় পূর্ব জার্মানি অথবা বেলজিয়ামে
রাষ্ট্রদূত করে পাঠানো হবে । এতেও জিয়া তার নিকটজনদের কাছে বেশ ক্ষুব্দ
প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন । জিয়া যে একজন ক্ষমতালিপ্সু ব্যক্তি ছিলেন তা
বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর যখন এক পর্যায়ে বিচারপতি আবু সায়দাত মোহাম্মদ
সায়েম রাষ্ট্রপতি হন তখন তা তিনি উপলব্দি করেছেন যা তিনি তাঁর
At Bangabhaban-Last Phase
গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন । বিচারপতি সায়েম লিখেছেন
যে, জিয়া শেষের দিকে এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছিলেন যে তিনি তার কাছে
ক্ষমতা হস্তান্তর করতে বাধ্য হয়েছিলেন । জিয়ার এই চরিত্র বুঝা যায় যখন তিনি
২৭ মার্চ ১৯৭১ সালে চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র হতে পঠিত
স্বাধীনতার ঘোষণা পত্রে প্রথমে নিজেকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে ঘোষণা করেন ।
পরবর্তিকালে রাজনীতিবিদদের চাপে পরে তিনি তার ঘোষণায় পরিবর্তন এনে
বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে ঘোষণা করেন । মুক্তিযুদ্ধ কোন সামরিক
অভ’ত্থান ছিল না । জিয়া পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তার চাকুরি ন্যস্ত করার
বিষয়টাকে পূনঃবিবেচনা করানোর জন্য আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের
হাতে পায়ে ধরা শুরু করেন । এ’ব্যাপারে তিনি তার কোর্স মেট ও বন্ধু ঢাকা
সেনা নিবাসের তৎকালিন ষ্টেশন কমান্ডার লেঃ কর্নেল (অবঃ) এম এ হামিদের
সহায়তা নেন। হামিদ প্রকৃত পরিস্থিতি না বুঝে জিয়াকে সহায়তা করার চেষ্টা
করেন । জিয়া বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক সচিব তোফায়েল আহমেদের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর
সাথে সাক্ষাৎ করার সুযোগ পান । জিয়া রাষ্ট্রপতিকে আশ্বস্ত করেন তাঁর প্রতি
জিয়ার আনুগত্য প্রশ্নাতীত এবং বাকি জীবন তিনি একজন সৈনিক হিসেবেই কাটিয়ে
দিতে চান । উদার হৃদয়ের মানুষ বঙ্গবন্ধু জিয়ার কথায় বিশ্বাস করেছিলেন এবং
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় হতে তার চাকুরি পুনরায় সেনা বাহিনীতে বহাল করার
নির্দেশ দেন । সেই জিয়ার সাথে পনেরই আগষ্টের ঘাতকদের অন্যতম কর্নেল রশিদ
(অবঃ) বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পরিকল্পনা নিয়ে সবিস্তারে আলোচনা করেন মার্চ
মাসে। জিয়া ঘাতকদের প্রতি তার প্রত্যক্ষ সমর্থন জানান । শুধু বলেন একজন
সিনিয়র অফিসার হিসেবে তিনি এই কাজের সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত হতে পারবেন না
তবে তারা তাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়নে এগিয়ে যেতে পারেন। শেষতক জিয়াই
বঙ্গবন্ধু হত্যার সবচেয়ে বড় বেনিফিসিয়ারি হয়েছিলেন ।
WARNING: Any unauthorized use or reproduction of 'Community' content is strictly prohibited and constitutes copyright infringement liable to legal action.
|
লেখকের আগের লেখাঃ |