|
ফিরে দেখা ঊনসত্তরের
গণঅভ্যুত্থান
আবদুল মান্নান
স্বাধীন বাংলাদেশের
ইতিহাসে কিছু ব্যক্তির নাম, সময়কাল, ঘটনাপঞ্জি সময়ের বিচারে অবিচ্ছেদ্ধ হয়ে
আছে । এই সবের মাঝে বাহান্নর ভাষা আন্দোলন, ৫৪ সালের যুক্তফ্রন্টের
নির্বাচন, ৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন, ৬৬ সালের ছয় দফা আন্দোলন, ৬৮ সালের
আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, ৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান, ৭০ সালের সাধারণ নির্বাচন ও
তাতে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ধ্বস নামানো বিজয়, ৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ অন্যতম
। এই সব ঘটনা বা আন্দোলনের সাথে অঙ্গাআঙ্গি ভাবে জড়িয়ে আছে মাওলানা আবদুল
হামিদ খান ভাসানি, শেরে বাঙলা এ কে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দি আর
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাম । আর আছে এই দেশের কালজয়ী ছাত্রনেতারা ।
এই সব সময়কাল বা ঘটনা হয় বাংলাদেশের ইতিহাসের বাঁক পরিবর্তনে সহায়তা করেছে
অথবা দেশকে তার স্বাধীনতার অভীষ্ট লক্ষ্যের দিকে নিয়ে গেছে । তবে বলতে হয়
বাংলাদেশের স্বাধীনতার চূড়ান্ত লড়াইটা শুরু হয়েছিল ৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের
মধ্য দিয়ে আর সেই অভ্যুত্থানের সূচনা হয়েছিল পাবিস্তানের সামরিক শাসক আইয়ুব
বিরোধী আন্দোলনকে কেন্দ্র করে । এই আন্দোলনের সুচনা করেছিল এই দেশের
প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনগুলি যার নেতৃত্বে ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয়
ছাত্র সংগঠন বা ডাকসু। তাদের নেতৃত্বে গঠিত হয়েছিল ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ।
এই পরিষদে ছিল পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ আর ছাত্র ইউনিয়নের উভয় গ্রুপ (মেনন-মতিয়া)
। পরবর্তিকালে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সকল কর্মসূচীর সাথে একাত্মতা প্রকাশ
করে তাতে যোগ দেয় মোনায়েম খানের পেটোয়া ছাত্র সংগঠন হতে বের হয়ে আসা
মাহবুবুল হক দুলন ও নাজিম কামরান চৌধুরীর নেতৃত্বে এনএসএফ-এর একটি অংশ ।
উল্লেখ্য এই সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের সহ-সভাপতি
ছিলেন ছাত্রলীগের তোফায়েল আহমদ (ইকবাল হল, পরবর্তি কালে সার্জেন্ট জহুরুল
হক হল ও এনএসএফ-এর নাজিম কামরান চৌধুরী (জিন্নাহ হল পরবর্তি কালে সূর্য সেন
হল) । বলে রাখা ভালো সে সময় ডাকসুর প্রতিনিধি নির্বাচিত হতো পরোক্ষ ভোটে আর
ছাত্রাবাসওয়ারি রোটেশনের ভিত্তিতে । ৬৯ এর গণঅভ্যুত্থানের পুরোভাগে ছিল এই
দেশের ছাত্র নেতৃবৃন্দ যাদের মধ্যে তোফায়েল আহমদ ও নাজিম কামরান চৌধুরী
ছাড়াও ছিলেন সিরাজুল আলম খান, শামসুদ্দোহা, সায়ফুদ্দিন আহমেদ মানিক,
মোস্তাফা জামাল হায়দার, খালেদ মোহাম্মদ আলী, আবদুর রউফ, মাহবুব উল্লাহ,
মাহবুবুল হক দুলন প্রমূখরা । (কারো নাম বাদ পরলে তা অনিচ্ছাকৃত) । তবে বলে
রাখা ভাল সিরাজুল আলম খানের আচরণ এখনকার মতো তখনও ছিল বিভ্রান্তিমূলক ও
রহস্যাবৃত । ছাত্র নেতারা গঠন করেছিলেন ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ । এদের বাইরে
৬৮ হতে ৬৯ পর্যন্ত ছাত্র জনতার আন্দোলনের সাথে আর যে সকল ছাত্র নেতৃবৃন্দ
যুক্ত থেকেছেন তাদের মধ্যে নূরে আলম সিদ্দিকি, আবদুল কুদ্দুস মাখন, আ স ম
আবদুর রব, শাহজাহান সিরাজ, রাশেদ খান মেনন ও মতিয়া চৌধুরী অন্যতম । ওই
মাপের ছাত্র নেতা বাংলাদেশে আর জন্ম গ্রহণ করেনি । আগামীকে করবে তেমন আলামত
এখন আর দেখা যায় না । কেমন ছিল সে সময়কালের ছাত্র নেতৃত্ব তা বর্তমান সময়ের
ছাত্র নেতৃবৃন্দ কল্পনাও করতে পারবে না । এই সময় বঙ্গবন্ধু সহ আওয়ামী লীগের
অধিকাংশ নেতৃবৃন্দ জেলে ছিলেন । একমাত্র উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক নেতা যিনি
মুক্ত ছিলেন তিনি হচ্ছেন মাওলানা ভাসানী । তাঁকেও মাঝে মধ্যে আটক করা হতো ।
৬৯ এর গণঅভ্যুত্থানের সূত্রপাত হয়েছিল মূলত আইূব খান বিরোধী আন্দোলন হিসেবে
যেমনটি শুরুতে বলেছি । শুরুতে এই আন্দোলনে পশ্চিম পাকিস্তানের ছাত্ররাও
সামিল ছিল । কিন্তু বাঙালি ছাত্রদের মতো তাদের কোন বড় মাপের ছাত্র নেতা না
থাকার কারণে তারা পুরো সময় এই আন্দোলনের সাথে থাকতে পারে নি । সুতরাং ৬৯ এর
গণআন্দোলনের এবং পরবর্তিকাওে গণঅভ্যুত্থানের মূল চালিকা শক্তি ছিল এই দেশের
প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনগুলো ।
১৯৫৬ সালের ২৩ মার্চ পাকিস্তানের প্রথম সংবিধান কার্যকর হয় । এর আগে ১৯৫৪
সালে পাকিস্তানের সংবিধান প্রণয়নের জন্য একবার চেষ্টা করা হয়েছিল । কিন্তু
পাকিস্তানের সামরিক-বেসামরিক আমলারা কখনো চায় নি পাকিস্তানের শাসন ব্যবস্থা
একটি গণতান্ত্রিক সাংবিধানিক কাঠামোর মধ্যে পরিচালিত হোক । তারা মনে করতো
তাই যদি হয় তাহলে তারা জিন্নাহ্ সৃষ্ট পাকিস্তানে যে অবারিত ক্ষমতা ভোগ করছে
তা খর্ব হয়ে যাবে । পাকিস্তানের বর্তমান চরম দুর্দশার জন্য সে দেশের সামরিক
বেসামরিক আমলাতন্ত্র সমান ভাবে দায়ী । সেই যাত্রায় সংবিধান প্রণয়নের
প্রচেষ্টাকে ভন্ডুল করে দিয়েছিল পাকিস্তানের সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্রই ।
অনেক চেষ্টার পর ১৯৫৬ সনে একটি সংবিধান প্রণয়ন হলো এবং এই সংবিধানের আওতায়
১৯৫৮ সনে একটি জাতীয় সংসদ নির্বাচন হবে তা নির্ধারিত হয়েছিল । কিন্তু আবারো
সেই সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্রের ষড়যন্ত্র । ১৯৫৮ সনের ৭ই অক্টোবর
পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইসকান্দার মির্জা প্রধানমন্ত্রী মালিক
ফিরোজ খান নুনকে বরখাস্ত করে পাকিস্তানের নতুন সংবিধান বাতিল করে দেশে
সামরিক শাসন জারি করেন আর সেনা প্রধান আইয়ুব খানকে প্রধান সামরিক আইন
প্রশাসক নিযুক্ত করেন । ঠিক কুড়ি দিনের মাথায় আইয়ুব খান ইসকান্দার মির্জাকে
উৎখাত করে নিজে ক্ষমতা দখল করে পাকিস্তানে এক কালো অধ্যায়ের সূচনা করেন ।
সকল সামরিক শাসকের মতো আইয়ুব খানও ক্ষমতা দখল করে ঘোষণা করেন তিনি
পাকিস্তানকে রক্ষা করতে ত্রাতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন এবং স্বল্পতম সময়ে
বেসামরিক ব্যক্তিদের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তর করে ব্যারাকে ফিরে যাবেন ।
কিন্তু সেই আইয়ুব খানকে ক্ষমতা হতে উচ্ছেদ করতে ৬৯ এর গণঅভ্যুত্থানের
প্রয়োজন হয়েছিল । প্রাণ দিতে হয়েছিল কয়েকশত মানুষকে । ১৯৬৫ সনের পাক-ভারত
যুদ্ধের পর এটি নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল যে পশ্চিম পাকিস্তানের শাসক গোষ্ঠী
পূর্ব বাংলার নিরাপত্তা বা স্বার্থের ব্যাপারে সম্পূর্ণ উদাসীন । এই উপলব্দি
হতেই শেখ মুজিব (তখনো তিনি বঙ্গবন্ধু উপাধিতে ভূষিত হন নি ) ১৯৬৬ সালে
বাঙালির মুক্তির সনদ ৬ দফা উত্থাপন করেন । এই ৬ দফাকে পাকিস্তানের শাসক
গোষ্ঠী পাকিস্তান ভাঙ্গার একটি পরিকল্পনা হিসেবে মূল্যায়ন করে এবং এক
পর্যায়ে শেখ মুজিবকে গ্রেফতার করে । তাঁর বিরুদ্ধে রুজ্জু করা হয় আগরতলা
ষড়যন্ত্র মামলা যার মূল প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল শেখ মুজিব ও তাঁর রাজনৈতিক
সতীর্থরা পূর্ব বাংলাকে পাকিস্তান হতে বিচ্ছিন্ন করতে ভারতের সহায়তায়
ষড়যন্ত্রে লিপ্ত । ১৯৬৮ সনের ২১ এপ্রিল ঢাকা সেনা নিবাসে শেখ মুজিব ও তাঁর
সতীর্থদের একটি বিশেষ ট্রাইবুনালে বিচার শুরু হয় । বিচারটি
রাষ্ট্রদ্রোহিতার এবং এর অবধারিত শাস্তি মৃত্যুদন্ড।
যদিও আইয়ুব খান ক্ষমতা দখল করেছিলেন দ্রুত ক্ষমতা ছাড়বেন বলে নানা ছলচাতুরি
করে তিনি তার অগণতান্ত্রিক শাসন দশবছর পর্যন্ত প্রলম্বিত করে ১৯৬৮ সনে
‘উন্নয়নের এক দশক’ উদযাপন নামে এক তামাশার উৎসবের আয়োজন করেন । এটি নিশ্চিত
ভাবে বলা যায় যে আইয়ুব খানের এই দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় থাকাটা সম্ভব হয়েছিল
পাকিস্তানের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে অনৈক্য, সন্দেহ এবং সীমাহীন ক্ষমতা আর
বৈষয়িক লোভ । এমন কী বঙ্গবন্ধু যখন ৬ দফা ঘোষণা করেন তখন তাকে কেন্দ্র করে
আওয়ামী লীগেও ভাঙ্গন দেখা দেয় । কিন্তু বঙ্গবন্ধু তাঁর লক্ষ্যে অবিচল থাকেন
। আইয়ুব খান যখন তার ‘দশক’ পালন করছেন তখন ঢাকা সেনা নিবাসে শেখ মুজিবকে
ফাঁসিতে ঝুলানোর জন্য একটি তামাশার মামলা আর তার বিচার চলছে । এই সময়
মাওলানা ভাসানী পাকিস্তানের রাজনীতিতে এক অনবদ্য ভূমিকা পালন করেন । তিনি
আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে দানা বাঁধা শ্রমিক-ছাত্র-জনতার আন্দোলনের পুরোভাগে চলে
আসেন । উল্লেখ্য এই সময় অন্যান্য রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ হয় জেলে অথবা গা
বাঁচিয়ে চলছেন । পূর্ব বাংলা ছাড়াও পশ্চিম পাকিস্তানেও আইয়ুব খান বিরোধী
আন্দোলন দানা বাঁধতে শুরু করে । ১৯৬৮ সালের ১৩ নভেম্বর আইয়ুব খান পিপলস
পার্টির প্রধান ও তাঁর এককালের পররাষ্ট্র মন্ত্রী জুলফিকার আলি ভুট্টোকে
গ্রেফতার করেন । দ্রুততম সময়ে অন্যান্য বিরোধী দলের নেতাদেরও তিনি কারাগারে
নিক্ষেপ করেন । এই সময় আইয়ুব খান বস্তুত পক্ষে নিজের জন্য নিজের অজান্তেই
একটি ভয়াবহ আগ্নেয়গিরি সৃষ্টি করছিলেন । এই সময় আইয়ুব খানের স্বৈরশাসন
অবসান কল্পে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও জোট নানা কর্মসূচী দিতে থাকে এবং দেশে
গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনার দাবি উত্থাপন করে । তবে সব কিছুকে
ছাড়িয়ে যায় ১৯৬৯ সালে ছাত্রদের ঘোষিত এগারো দফা কর্মসূচী । এত কিছুর মধ্যেও
আইয়ুব খানের আচরণ ছিল অনেকটা বেপরোয়া কারণ তার পিছনে ছিল পাকিস্তানের সুবিধা
ভোগী সামরিক-বেসামরিক আমলা আর যুক্তরাষ্ট্র ও চিনের সমর্থন। ১৯৬৮ সনের ৭
ডিসেম্বর আইয়ুব খান তার নিজের গঠিত কনভেনশন মুসলিম লীগের এক কর্মী সম্মেলনে
বলেন ‘বিক্ষোভ করে সরকারকে টলানো যাবে না’ । তিনি সব সময় মনে করতেন ক্ষমতা
দখল করে তিনি পাকিস্তানে একটি বিপ্লব সাধন করেছেন । ১৯৬৯ সালের ১৪ই জানুয়ারি
ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ দুটি সভায় মিলিত হয়ে আনুষ্ঠানিক ভাবে এই এগারদফা
কর্মসূচি ঘোষণা করে যাতে আওয়ামী লীগের ছয় দফা ছাড়াও অন্তর্ভূক্ত করা হয় (১)
প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটে প্রত্যক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে সংসদীয় গণতন্ত্র
প্রতিষ্ঠা ও (২) আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার সহ সকল রাজনীতিবিদকে
মুক্তি ও মামলা প্রত্যাহার ।
ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ তাদের এগারো দফা কর্মসূচি ঘোষণা করেই তাদের দায়িত্ব শেষ
করেনি একই সাথে তারা তাদের রাজপথের আন্দোলনকেও বেগবান করে । পিছন ফিরে
তাকালে আজ মনে হয় ঊনসত্তরে বাংলার দামাল ছাত্ররা পাকিস্তানের রাষ্ট্রশক্তির
বিরুদ্ধে শুধু এক মারাত্মক চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছিলেন তাই নয় বরং একাত্তরে
দেশ স্বাধীন করার মধ্য দিয়ে তাদের সেই চ্যালেঞ্জ তারা বাস্তবায়ন করেছিলেন ।
ঊনসত্তরের গণআন্দোলন ছিল জিন্নাহ্র পাকিস্তানের কফিনে শেষ পেরেক আর সত্তরের
নির্বাচন ও একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ ছিল সেই কফিনের শেষকৃত্যানুষ্ঠান ।
ঊনসত্তরের গণআন্দোলনের বড় টার্নিং পয়েন্ট ছিল ২০ জানুয়ারি ছাত্র ইউনিয়ন নেতা
(মেনন) আসাদুজ্জামান আসাদের মৃত্যু । এদিন কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের
আহ্বানে ঢাকার সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্র ধর্মঘট পালিত হয় । সকাল এগারোটা
নাগাদ বিশ্ববিদ্যালয় কলাভবনের সামনে ছাত্রদের এক সমাবেশের পর কেন্দ্রীয়
ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বে এক ছাত্র মিছিল বের হয় । মিছিলটি কেন্দ্রীয়
শহীদ মিনার হয়ে চানখারপুল পৌঁছালে পুলিশ আর ইপিআর (তৎকালিন সীমান্ত
রক্ষীবাহিনী) বিনা উস্কানিতে মিছিলের উপর গুলি বর্ষণ ও টিয়ারগ্যাস সেল
নিক্ষেপ করে । আহত করে অসংখ্য ছাত্র-ছাত্রীদের । ঢাকা মেডিকেল কলেজের সামনে
গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন আসাদুজ্জামান আসাদ । এই এক রাজপথের সৈনিক আসাদের
মৃত্যু ছাত্রজনতার রাজপথের আন্দোলনকে গণঅভ্যুত্থানে রূপান্তর করে । ছাত্র
সংগ্রাম পরিষদের ডাকে সারা দেশে দিনের পর দিন হরতাল পলিত হতে থাকে ।
অন্যদিকে সরকার ১৪৪ ধারা, কারফিউ, গণগ্রেফতার সহ নানা দমন পিড়নের মাধ্যমে
দেশের জনগণের উপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে ব্যর্থ চেষ্টা করে ।
রাস্তায় নামানো হয় সেনাবাহিনী । ২৪ জানুয়ারি হরতাল চলাকালে ঢাকার নব কুমার
ইনস্টিটিউশনের নবম শ্রেণীর ছাত্র মতিউর রহমান মল্লিক পুলিশের গুলিতে নিহত
হয় । রাতে কারফিউ ভঙ্গ করে ছাত্র জনতা রাজপথে মিছিল বের করলে সেনাবাহিনী আর
ইপিআর নির্বিচারে গুলি বর্ষণ করে অসংখ্য মানুষকে হয় হত্যা করে অথবা আহত করে
। তেজগাঁও এলাকায় শিশুকে দুগ্ধপানরত অবস্থায় নিহত হয় আনোয়ারা বেগম নামের
একজন মা । টঙ্গি আর আদমজীতে নিহত বা আহত হন অসংখ্য শ্রমিক ও খেটে খাওয়া
মানুষ । এই আন্দোলনের একটি বড় দিক ছিল অধিকাংশ ক্ষেত্রে জনগণ পুলিশ হোক বা
সেনাবাহিনী, তাদের হাত হতে নিহত বা আহত ব্যক্তিদেরকে ছিনিয়ে নিত এবং প্রায়
সময় পল্টন ময়দানে তাঁদের জানাজা হতো এবং তাতে প্রায়ই মাওলানা ভাসানী ইমামতি
করতেন । এক পর্যায়ে বিক্ষোভরত জনতা প্রেস ট্রাস্টের পত্রিকা দৈনিক মর্ণিং
নিউজ ও দৈনিক পাকিস্তানের প্রকাশনা ভবন ও প্রেসে অগ্নিসংযোগ করে । দৈনিক
পাকিস্তান সরকারের পত্রিকা হলেও মাঝে মধ্যে তারা চেষ্টা করতো জনগণের পক্ষে
কথা বলতে। ঊনসত্তরের গণ-আন্দোলনে সমর্থন যুগিয়ে এক ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন
করে দৈনিক ইত্তেফাক, দৈনিক সংবাদ ও অধুনা লুপ্ত দৈনিক আজাদ । আইয়ুব খানের
আস্তাভাজন হামিদুল হক চৌধুরীর পত্রিকা পাকিস্তান অবজার্ভারের ভূমিকা ছিল ধরি
মাছ না ছুঁই পানির মতো ।
যে আন্দোলন এদেশের ছাত্ররা আইয়ুব বিরোধী আন্দোলন হিসেবে শুরু করেছিলেন সেই
আন্দোলনই আসাদের মৃত্যুর পর ২৪ জানুয়ারি তা গণ-অভ্যুত্থানে রূপান্তরিত হয় ।
এই দিনই মতিউর শহীদ হয়েছিলেন । এই আন্দোলনের ষ্ফুলিঙ্গ দ্রুত পশ্চিম
পাকিস্তানেও ছড়িয়ে পরে । আইয়ুব খান হয়তো বুঝতে পেরেছিলেন দেশের শাসন ক্ষমতা
তার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে । তিনি আরো বেপরোয়া হয়ে উঠেন । ঊনসত্তরের
১৫ ফেব্রুয়ারি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার অন্যতম অভিযুক্ত সার্জেন্ট জহুরুল
হককে ঢাকা সেনা নিবাসের কারাগারে গুলি করে হত্যা করা হয় । এই হত্যার
প্রতিবাদে উন্মত্ত জনতা আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার প্রধান বিচারপতি এস এ
রহমানের সরকারি বাসভবন (বর্তমান বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গনে) আর সরকারি
কৌশলীদের বাসভবনে অগ্নিসংযোগ করে তা সম্পূর্ণ ভষ্মিভূত করে । বিচারপতি এস এ
রহমান কোন রকমে দেয়াল টপকে জীবন রক্ষা করেন । অন্যরাও অনুরূপ ভাবে পালিয়ে
জীবন বাঁচান । ১৮ ফেব্রুয়ারি সেনাবাহিনীর গুলিতে নিহত হন রাজশাহী
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ডঃ সামসুজ্জোহা । ২০ জানুয়ারির পর পূর্ব বাংলা ও
পশ্চিম পাকিস্তানে পুলিশ, সীমান্ত রক্ষীবাহিনী আর সেনাবাহিনীর গুলিতে প্রায়
তিনশত মানুষ প্রাণ দেয় যার অধিকাংশই ছিল পূর্ব বাংলায় । এই আন্দোলনে
ছাত্র-জনতার সাথে টঙ্গি আর আদমজী এলাকার শ্রমিকরা ওৎপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন
এবং অকাতরে নিজের জীবন উৎসর্গ করেছেন । ছাত্রজনতার তীব্র গণ-আন্দোলনের মুখে
আইয়ুব খান ১৯৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করে
এবং মামলায় অভিযুক্ত সকল বন্দিদের মুক্তি দিতে বাধ্য হন।
শেষ রক্ষা হিসেবে আইয়ুব খান রাজনৈতিক নেতাদের নিয়ে চলমান রাজনৈতিক সংকট
নিরসনে ১৯৬৯ সনের ২৬ ফেব্রুয়ারি রাওয়ালপিন্ডিতে একটি গোল টেবিল বৈঠক আহ্বান
করেছিলেন যা সংকট নিরসনে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয় । পাকিস্তানের বেসামরিক শাসন
ব্যবস্থা সম্পূর্ণ ভেঙ্গে পরলে আইয়ুব খান ২৫ মার্চ পাকিস্তানের শাসন ভার
দেশের সেনা প্রধান জেনারেল ইয়াহিয়া খানের হাতে তুলে দেন । ইয়াহিয়া খান
বস্তুত পক্ষে জিন্নাহ্র পাকিস্তানের জানাজায় ইমামতি করেছিলেন । পিছন ফিরে
তাকালে এখন এটি কল্পনা করাও অনেক সময় দুরুহ হয়ে পরে কেমন ছিল সেই অগ্নিঝড়া
দিনগুািল । ঊনসত্তরের গণআন্দোলনের বা গণঅভ্যুত্থানের মূল নায়ক ছিলেন এই
দেশের ছাত্র-জনতা আর মেহনতি মানুষ । নেতৃত্বে ছিল ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ।
সামনে থেকে সেনাপতির ভূমিকা পালন করেছেন আজকের তুখোড় পার্লামেন্টেরিয়ান
তোফায়েল আহমদ । সেই আন্দোলনের রজপথের একজন সৈনিক হিসেবে এখনো গর্ববোধ করি ।
ঊনসত্তরের গণআন্দোলনের সকল শহীদদের প্রতি রইলো বিনম্র শ্রদ্ধা ।
লেখক: বিশ্লেষক ও গবেষক । জানুয়ারি ২৩, ২০১৬
WARNING:
Any unauthorized use or reproduction of 'Community' content
is strictly prohibited and constitutes copyright infringement liable to
legal action.
[প্রথমপাতা] |
লেখকের আগের লেখাঃ
[......লেখক আর্কাইভ]
|