|
জনকের প্রতি সশ্রদ্ধ
অভিবাদন
আবদুল মান্নান
জীবদ্দশায় বঙ্গবন্ধু বা
তাঁর পরিবার কখনো তাঁর জন্মদিন পালন করতেন না। বস্তুতপক্ষে বঙ্গবন্ধু যে
সময় জন্মেছিলেন, যখন তিনি একজন রাজনৈতিক কর্মী বা নেতা অথবা জাতির জনক তখন
মধ্যবিত্ত বাঙালিদের মাঝে জন্মদিন পালন করার তেমন একটা রেওয়াজ ছিল না।
একাত্তরের উত্তাল মার্চে যখন সারা বাংলাদেশে এক দম বন্ধ হওয়া পরিবেশ তখন
কয়েকজন বিদেশি সাংবাদিক বঙ্গবন্ধুকে ১৭ই মার্চ তাঁর ৫২তম জন্মদিনের শুভেচ্ছা
জানালে তিনি উত্তরে বলেছিলেন ‘আমার জন্ম দিনই বা কী আর মৃত্যু দিনই বা কী’।
সে সময় বঙ্গবন্ধুর এই বাক্যটি ‘দৈনিক আজাদ’ ও ‘দৈনিক পাকিস্তান’ পত্রিকা
বেশ গুরুত্ব দিয়ে ছেপেছিল। আসলে বঙ্গবন্ধুর কত জন্মদিন যে কারাগারে কেটেছে
তার হিসাব করা মুশকিল। এখন দিনটি জাতীয় শিশু দিবস হিসেবে পালিত হয়।
বঙ্গবন্ধু শিশুদের অসম্ভব ভালবাসতেন। স্বাধীন বাংলাদেশে খুব কম অনুষ্ঠান
হয়েছে যেখানে তাঁর সাথে শিশু রাসেল সঙ্গী হয় নি। মাঝে মধ্যে বিদেশেও
বঙ্গবন্ধু রাসেলকে সাথে নিয়ে গেছেন । তাঁর বাকি চার সন্তান এই সৌভাগ্য হতে
বঞ্চিত হয়েছেন কারণ তারা যখন বড় হচ্ছিলেন বঙ্গবন্ধু হয় কোন না কোন রাজনৈতিক
আন্দোলনে জড়িত ছিলেন অথবা কারাবন্দী ছিলেন। পাকিস্তানের ২৩ বছরের শাসনকালে
তিনি ১৮বার জেলে গেছেন, মোট সাড়ে এগার বছর জেলে কাটিয়েছেন। মৃত্যুর মুখোমুখি
হয়েছেন অন্তত দু’বার। বেঁচে থাকলে এই মার্চের ১৭ তারিখ তাঁর ৯৬ তম জন্ম দিন
হতো। তিনি আজ আমাদের মাঝে নেই, আর পাঁচ দশটা জন্ম দিনের মতো এই দিনটি ঘটা
করে তাঁর পরিবারের কেউ হয়তো পালন করবে না কিন্তু জাতি আজ শ্রদ্ধাবনতচিত্তে
তাঁকে স্মরণ করবে কারণ তিনি বাঙালিকে তার হাজার বছরের ইতিহাসে প্রথমবারের
মতো নিজেদের জন্য একটি স্বাধীন দেশ দিয়ে গিয়েছিলেন। তিনি আজ শুধু একজন শেখ
মুজিব, বঙ্গবন্ধু বা জাতির জনকই নন তিনি বাঙালির জন্য মহাকালের মহানায়ক।
এমন একজন মহানায়কের জন্য বাঙালিকে হয়ত হাজার বছর অপেক্ষা করতে হবে। আজকের
দিনটিতে মহানায়কের স্মৃতির প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা। প্রয়াত মহানায়কের প্রতি
জন্মদিনের ভালবাসা।
প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায় বঙ্গবন্ধুর পূর্ব পুরুষ শেখ আওয়াল প্রায় চারশত বছর
পূর্বে ইরাকের বর্তমান রাজধানী বাগদাদ হতে ধর্ম প্রচারের জন্য চট্টগ্রাম হয়ে
পূর্ব ভারতে প্রবেশ করেছিলেন । শেখ আওয়াল কয়েক বছর চট্টগ্রামে ধর্ম
প্রচারের পর ঢাকার অদূরে সোনারগাঁওয়ে স্থানীয় এক মহিলাকে বিয়ে করে সেখানে
বসতি স্থাপন করেন বলে জানা যায়। তাঁর পরবর্তী বংশধররা কোলকাতায় গিয়ে তেজারতি
শুরু করেন । শেখ আওয়ালের পৌত্র জান মাহমুদ ওরফে তেকড়ি কোলকাতা হতে পূর্ব
বাংলায় এসে মধুমতি নদীর তীরে টুঙ্গিপাড়ায় বসতি স্থাপন করে সেখানে ব্যবসা
শুরু করেন । জান মাহমুদের প্রপৌত্র শেখ আবদুল হামিদের সন্তান বঙ্গবন্ধুর
পিতা শেখ লুৎফর রহমান । শেখ পরিবারের আদি পুরুষরা ধর্ম প্রচারের সাথে সাথে
যখন তেজারতিও শুরু করেন তখন তাঁরা ইংরেজ বণিকদের সান্নিধ্যে আসেন। বাড়িতেও
ইংরেজি পড়া লেখা হতো । আগে হতেই তাঁরা আরবি ও ফার্সি ভাষায় বেশ পারদর্শি
ছিলেন, ইংরেজদের সান্নিধ্যে এসে তাঁরা ইংরেজি ভাষাও রপ্ত করে ফেলেন। আর
বাংলাদেশে কয়েক পুরুষ ধরে থাকতে থাকতে সকলে এক সময় সম্পূর্ণ বাঙালি হয়ে
পরেন । তবে বংশ পরিচয় সম্পর্কে বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে একটি ভিন্ন
চিত্রও পাওয়া যায়। তিনি তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছেন তাঁর পূর্বপুরুষ “শেখ
বোরহানউদ্দিন (শেখ আওয়ালের প্রপৌত্র) কীভাবে এই মধুমতির তীওে এসে বসবাস
করেছিলেন কেউই তা বলতে পারে না ”। বঙ্গবন্ধু আরো লিখেছেন তাঁর পূর্বপুরুষ
মোটামুটি বিত্তশালী ছিলেন এবং নিজেকে তাঁর আত্মজীবনীতে তিনি একজন মধ্যবিত্ত
পরিবারের সন্তান হিসেবে তুলে ধরেছেন। শেখ পরিবারে যে পড়া লেখার চর্”া ছিল
তা তাঁর পিতা শেখ লুৎফর রহমানের এন্ট্রেন্স (এসএসসি সমত’ল্য) পাস করা হতে
বুঝা যায়। সে আমলে বাঙালি মুসলমানের এন্ট্রেন্স পাশ করাকে বেশ সম্মানের সাথে
দেখা হতো। বাড়িতে রাখা হতো তিনটি দৈনিক ও দুটি মাসিক পত্রিকা। এতে বুঝা যায়
শেখ পরিবারে সব সময় পড়া লেখার চর্চা ছিল । শেখ লুৎফর রহমান মাদারীপুরের
দেওয়ানি আদালতের মুন্সেফ কোর্টে সেরেস্তাদার ছিলেন। তাঁর সময় আদালতে
সেরেস্তাদার বেশ গুরুত্বপূর্ণ পদ । বিচারকের পর তিনি হতেন আদালতের দ্বিতীয়
গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। তাঁর দায়িত্ব ছিল অনেকটা আদালতের গুরুত্বপূর্ণ
নথিপত্র সংরক্ষণ করা ও বিচারক চাইলে তা তাঁকে যোগান দেওয়া।
শেখ লুৎফর রহমান ও সায়েরা খাতুনের বড় ছেলে শেখ মুজিব। জন্মেছিলেন ১৯২০
সালের ১৭ই মার্চ সেই অজপাড়াগাঁ টুঙ্গিপাড়ায় রাত ৮টায়। বাবা মা আদর করে
ডাকতেন খোকা বলে। কে জানত সেই খোকাই একদিন বদলে দিবেন এই উপমহাদেশের
মানচিত্র ? সে সময় বাঙালি সমাজে বাল্যবিয়ে বেশ প্রচলিত ছিল। শেখ মুজিবের
বয়স যখন ১৩ তখন তাঁর সাথে ৩ বছর বয়সি তাঁর চাচাতো বোন ফজিলাতুন্নেছার সাথে
তাঁর বিয়ে রেজিস্ট্রি হয় । এই খবর তিনি শুনেছিলেন মুরুব্বিদের কাছে।
ফজিলাতুন্নেছা পরবর্তীকালে বেগম মুজিব। বঙ্গবন্ধু আদর করে ডাকতেন রেণু বলে।
এক অসাধারণ মহিলা । তিন শত প্রতিকূল অবস্থায়ও বঙ্গবন্ধুর কাছে থেকে তাঁকে
সাহস যুগিয়েছেন। ফজিলাতুন্নেছা ৫ বছর বয়সেই তাঁর পিতা মাতা উভয়কেই হারান।
শেখ মুজিবের মা সায়েরা খাতুনই তাঁকে লালন পালন করেন নিজের সন্তানের মতো করে।
টুঙ্গিপাড়ার শেখ মুজিব শৈশবে ছিলেন বেশ ডানপিটে। পাড়ার উঠতি বয়সের
ছেলেপেলেরা ডাকতো মুজিব ভাই বলে । স্কুলের শিক্ষকদের তিনি বেশ সম্মান
করতেন। স্কুল জীবনে হামিদ মাস্টার সম্পর্কে তাঁর মন্তব্য শুনে বুঝা যায়
তিনি তাঁকে কতটা শ্রদ্ধা করতেন। শিক্ষকদের সম্মান করা শেখ পরিবারের রক্তে
আছে যা বুঝা যায় বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা যখন তাঁর শিক্ষকদের সম্পর্কে
প্রকাশ্যে বেশ সম্মানসূচক মন্তব্য করেন। অবশ্য সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়ের
বরিষ্ঠ শিক্ষকদের মর্যাদার প্রশ্নে প্রধানমন্ত্রীর সাথে অনভিপ্রেতভাবে
কিছুটা হলেও দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে যা কেটে যাবে বলে সকলের প্রত্যাশা।
অবিভক্ত ভারতবর্ষে পূর্ব বাংলার পড়া লেখা, রাজকর্ম, আইন আদালত,
আনন্দ-বিনোদন সবই ছিল অনেকটা কোলকাতাকেন্দ্রিক। বঙ্গবন্ধু মাদারীপুরে স্কুল
জীবন শেষ করে ভর্তি হয়েছিলেন কোলকাতার ইসলামিয়া কলেজে (বর্তমানে মওলানা
আজাদ কলেজ )। সেখানেই তাঁর রাজনীতিতে হাতেখড়ি যদিও স্কুলে পড়ার সময়
ফরিদপুর-মাদারীপুরের অনেক রাজনৈতিক কর্মসূচিতে তিনি নিয়মিত অংশগ্রহণ
করেছেন। তাঁর নেতা ছিলেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দি, আবুল হাশিম, শেরে বাংলা
এ কে ফজলুল হক (তাঁর সাথে অনেক বিষয়ে তাঁর মতপার্থক্যও ছিল)। কোলকাতায় তরুণ
শেখ মুজিব নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসুর সাথে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনেও
অংশগ্রহণ করেছেন। হলওয়েল মনুমেন্ট ভাঙায় গাঁইতি চালিয়েছেন। আবার জিন্নাহ্র
দ্বিজাতি তত্ত্বের ফলশ্রুতিতে কোলকাতায় ভয়াবহ দাঙ্গার সূত্রপাত হলে তিনি
সেই দাঙ্গায় হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে ক্ষতিগ্রস্থদের তাঁর সতীর্থদের নিয়ে
সহায়তায় এগিয়ে এসেছেন। পাকিস্তান আন্দোলনে তিনি রাজপথের একজন কর্মী হিসেবে
কাজ করেছেন। মুসলীম লীগের নেতাদের সাথে গ্রামে গঞ্জে ঘুরেছেন। অন্যদিকে
শহীদ সোহরাওয়ার্দি, আবুল হাশিম, শরৎ চন্দ্র বসু, চিত্তরঞ্জন দাসের স্বাধীন
বাংলা সৃষ্টির ধারণার সাথে একাত্ম ছিলেন। কিন্তু নানা ঐতিহাসিক কারণে সেই
ধারণা বেশি অগ্রসর হয় নি। আবার পাকিস্তান সৃষ্টি হওয়ার রেশ না কাটতেই শেখ
মুজিব বুঝে গিয়েছিলেন সৃষ্ট পাকিস্তানে বাঙালিদের জন্য কোন সুখবর নেই। ১৯৪৮
সালেই গঠন করেছিলেন পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ। যা বস্তুত পক্ষে সেই
সময়ের পাকিস্তান সরকার ও মুসলীম লীগ বিরোধী প্রথম সংগঠন। এর এক বছর পর
প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ ।
বঙ্গবন্ধু কখনো ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতিতে বিশ্বাস করতেন না। রাষ্ট্রভাষা
আন্দোলন হোক বা ছয় দফা আন্দোলন তিনি সব সময় জনগণের অধিকার আদায়ের জন্য
আন্দোলন করেছেন। তাইতো তিনি তাঁর একাত্তরের ৭ই মার্চের ভাষণে বলতে পেরেছেন
“আমি প্রধানমন্ত্রীত্ব চাই না । আমরা এ দেশের মানুষের অধিকার চাই”।
বঙ্গবন্ধু একজন ইতিহাস সচেতন মানুষ ছিলেন, ৭ই মার্চের সেই বক্তৃতা তার একটি
উৎকৃষ্ট উদাহরণ। ১৯ মিনিটের সেই বক্তৃতায় তিনি বাঙালির দীর্ঘ ২৩ বছরের
বঞ্চনার ইতিহাসের অদ্যপান্তকে ঠিকই তুলে এনেছিলেন। মন্ত্রীত্বের চেয়ে দলকে
বেশী ভালবাসতেন। মন্ত্রীত্ব ছেড়ে দলের সাধারণ সম্পাদক হওয়া তাঁর কাছে অনেক
বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল। সাহস ছিল তাঁর চরিত্রের প্রধান বৈশিষ্ট্য। একাত্তরে
পাকিস্তানে তাঁর বিচার শুরু হলে তিনি বিচার চলাকালীন সময়ে একবারও বলেন নি
তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা চান নি। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা চলাকালে ঢাকা
সেনা নিবাসের খোলা আদালতে সাংবাদিক ফয়েজ আহমেদকে (তখন তিনি দৈনিক আজাদেও
রিপোর্টার) বলতে পেরেছিলেন ‘ফয়েজ, বাংলাদেশে থাকতে হলে শেখ মুজিবের সাথে
কথা বলতে হবে’। সেনা কর্তৃপক্ষের নিষেধাজ্ঞার কারণে ফয়েজ আহমেদ চেষ্টা
করছিলেন তাঁর সাথে কথা না বলতে। সাহস, দূরদৃষ্টি, উদারতার এক জ্বলন্ত
উদাহরণ যে ব্যক্তিটি সেই শেখ মুজিব, বাংলার বন্ধু, বিশ্বের নিপীড়িত মানুষের
বন্ধু, বঙ্গবন্ধু, মহাকালের মহানায়কের আজ জন্ম দিন। কোন কেক কাটা হবে না।
কোন আনন্দ ফুর্তি হবে না । জাতীয় শিশু দিবস হিসেবে দিনটি পালিত হবে ।
শিশুরা ছবি আঁকবে । তা দেখে বঙ্গবন্ধুর সন্তানরা তাঁদেও ছোট ভাই রাশেলের
কথা মনে করে হয়তো নিরবে অশ্রু ফেলবেন । কেউ আনবে না কোন উপহার। যে ব্যাক্তি
একটি জাতিকে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র উপহার দেয় তাঁর জন্ম দিনে কোন উপহার
দেওয়ার সক্ষমতা কারো নেই। জনকের প্রতি সশ্রদ্ধ অভিবাদন।
লেখক: বিশ্লেষক ও গবেষক । মার্চ ১৬, ২০১৬
WARNING:
Any unauthorized use or reproduction of 'Community' content
is strictly prohibited and constitutes copyright infringement liable to
legal action.
[প্রথমপাতা] |
লেখকের আগের লেখাঃ
[......লেখক আর্কাইভ]
|