প্রথমপাতা  

সাম্প্রতিক সংবাদ 

 স্বদেশ

আন্তর্জাতিক

বাংলাদেশ কমিউনিটি

লাইফ স্টাইল

এক্সক্লুসিভ

বিনোদন

স্বাস্থ্য

বর্তমানের কথামালা

 শিল্প-সাহিত্য

 প্রবাসপঞ্জী 

আর্কাইভ

যোগাযোগ

 

 

 

 

 

 

চির উন্নত মম শির


আবদুল মান্নান
 


 

১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট যখন ঘাতকরা বঙ্গবন্ধুর ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়ীতে তাঁকে সপরিবারে হত্যা করে তখন তাদের প্রধান ও একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বশূন্য করা এবং ত্রিশ লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত বাংলাদেশকে একটি মিনি পাকিস্তানে রূপান্তর করা । এই কাজে তাদের সহায়তা করেছিল সেই সময়কার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসন এবং পাকিস্তানের সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা । এই কাজে ভিতর থেকে তাদের সহায়তা করেছিল বঙ্গবন্ধুর কাছের কিছু মানুষ আর সামরিক বাহিনীর কিছু অফিসার । বিএনপি’র প্রতিষ্ঠাতা জেনারেল জিয়া যাকে বঙ্গবন্ধু পুত্রবৎ স্নেহ করতেন তাকে ঘাতকরা বঙ্গবন্ধুকে ক্ষমতাচ্যুত করার কথা মার্চ মাসেই বলেছিলেন । জিয়া রাষ্ট্রের একজন অনুগত অফিসারের দায়িত্ব পালন না করে বঙ্গবন্ধু হত্যায় ঘাতকদের গ্রীণ সিগনাল দিয়েছিলেন । ঘাতকরা মনে করেছিল বঙ্গবন্ধুর তিন ছেলে ভবিষ্যতে তাঁর অবর্তমানে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে আসতে পারেন সুতরাং তাদেরও হত্যা করতে হবে । সেই যুক্তিতে ঘাতকরা শিশু রাসেলকেও হত্যা করে । বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে শেখ ফজলুল হক মনি অন্যান্য আত্মি স্বজনদের বেলায়ও একই কথা সত্য । শেখ ফজলুল হক মনি একজন ভাল সংগঠক ছিলেন । সেই সময় বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা, শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা ঘটনা চক্রে দেশের বাইরে অবস্থান করার কারণে বেঁচে যান । শেখ হাসিনার স্বামী ডঃ ওয়াজেদ মিয়া একটি গবেষণা বৃত্তি নিয়ে জার্মানিতে অবস্থান করছিলেন । শেখ রেহানা বড় বোন শেখ হাসিনার সাথে ৩০ জুলাই জার্মানিতে ডঃ ওয়াজেদ মিয়ার কাছে গিয়েছিলেন । সাথে শিশু জয় ও পুতুল ।
১৫ আগস্টের আগে ডঃ ওয়াজেদ মিয়া সকলকে নিয়ে বেড়াতে গিয়েছিলেন বেলজিয়ামে । ছিলেন বেলজিয়ামে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত সানাউল হকের বাসায় । বঙ্গবন্ধু সানাউল হককে খুব স্নেহ করতেন এবং বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনেকের আপত্তি সত্বেও তাকে বেলজিয়ামে রাষ্ট্রদূত করেছিলেন । সম্ভবত বঙ্গবন্ধুকে হত্যার খবর সকলের আগে পৌঁছেছিল ওয়াশিংটনে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরে । ঢাকা ও ওয়াশিংটনের সময়ের ব্যবধান দশ ঘন্টা । বঙ্গবন্ধুকে যখন হত্যা করা হয় তখন ওয়াশিংটন সময় বেলা ৩টা । লন্ডনে তখন রাত বারটার মতো হবে । বঙ্গবন্ধুকে হত্যার খবরটা দেশের বাইরে যে সব বাংলাদেশি কূটনীতিকরা
পান তাদের মধ্যে লন্ডন মিশনের কূটনীতিকরা অন্যতম । তাদের একজন ফারুক চৌধুরী (এখনো জীবিত) । তিনি খুব ভোরে এই দুঃসংবাদটি জামার্নিতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হুমায়ূন রশীদ চৌধুরীকে (সাবেক স্পিকার) জানান । সম্ভবত তার ধারণা ছিল ডঃ ওয়াজেদ মিয়া তাঁর পরিবার নিয়ে এ’সময় জার্মানিতে অবস্থান করছেন । হুমায়ূন রশীদ চৌধুরী সাময়িক ধাক্কাটা সামলে নিয়ে বেলজিয়ামের রাজধানী ব্রাসেলসে সানাউল হককে ফোন করেন এবং ফারুক চৌধুরী হতে প্রাপ্ত সংবাদটুকু তাকে জানান । অনুরোধ করেন শেখ হাসিনা ও অন্যান্যদের জার্মানির সীমান্ত পর্যন্ত পৌঁছে দিতে । হুমায়ূন রশিদ চৌধুরী তাঁর এক প্রবন্ধে লিখেছেন সানাউল হক তাতে রাজি হলেন না । তিনি আরো লিখেছেন সানাউল হকের কথায় মনে হচ্ছিল তিনি শেখ হাসিনা সহ তাঁর পরিবারের সদস্যদের পারলে তার বাড়ী হতে তখনই বের করে দেন । সেই সানাউল হক পরবর্তিকালে ঢাকায় ফিরে বঙ্গবন্ধু পরিষদের সদস্য হয়েছিলেন । বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পরই আওয়ামী লীগে হাইব্রীড নেতা কর্মীদের জন্ম শুরু হয় । হুমায়ূন রশীদ চৌধুরী নিজ দায়িত্বে জার্মানির সীমান্ত পর্যন্ত গাড়ী পাঠিয়ে শেখ হাসিনা ও অন্যান্যদের তাঁর বাড়ীতে নিয়ে আসেন । তখন পর্যন্ত শেখ হাসিনা বা পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা জানতেন না ঢাকায় কী হয়েছে । যখন জানলেন হুমায়ূন রশীদ চৌধুরীর ভাষায় তাঁর বাড়ীতে এক হৃদয় বিদারক দৃশ্যের অবতারনা হয়েছিল । পরিবারের সকলেই যে শেষ হয়ে গেছেন তা জানতে জানতে তখন রাত হয়ে গেছে । এই সময় বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রী ডঃ কামাল হোসেনও সেখানে উপস্থিত ছিলেন । শেখ হাসিনাকে যখন জানানো হলো এই ঘটনার মূল হোতা খন্দকার মোশতাক তখন তিনি তা বিশ্বাসই করতে চান নি কারণ বঙ্গবন্ধুর সাথে মোশতাকের ঘনিষ্ট সম্পর্ক । সে’সময় জার্মানিতে ভারতীয় রাষ্ট্রদূত জনাব রহমান হুমায়ূন রশীদ চৌধুরীর সাথে দেখা করে শেখ হাসিনা ও অন্যান্যদের কুশলাদি জানতে চান । তিনি তাদের সাথে দেখাও করেন এবং বলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী তাদের ভারতে পাঠিয়ে দিতে বলেছেন । শেখ হাসিনা ও অন্যান্যরা স্বল্পতম সময়ের মধ্যে দিল্লিতে চলে যান । সব ব্যবস্থা ভারত সরকার করে । এর কিছুদিন পর হুমায়ূন রশীদ চৌধুরীকে ওএসডি করা হয় । শেখ হাসিনা ও অন্যান্যারা জার্মানি হতে সরাসরি দিল্লিতে আসেন । ইন্দিরা গান্ধী তাদের ভারতে রাজনৈতিক আশ্রয় দেন এবং ডঃ ওয়াজেদ মিয়ার জন্য একটি গবেষণা মূলক কাজের ব্যবস্থা করে দেন । সে সময় ইন্দিার গান্ধী শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানাকে মাতৃ¯েœহে আগলে নিয়েছিলেন । শেখ হাসিনার পক্ষে দেশে ফেরা সম্ভব ছিল না কারণ জেনারেল জিয়া তাদেও তাদেও সকলের দেশে ফেরার উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিলেন ।
১৯৮১ সনে ফেব্রুায়ারি মাসের ১৫ ও ১৬ তারিখ ঢাকায় আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয় । বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চার নেতা হত্যার পর আওয়ামী লীগ তখন অনেকটা নেতৃত্ব শূন্য । যে ক’জন সিনিয়র নেতা ছিলেন তারা হয়তো দলে নিষ্ক্রিয় অথবা হালুয়া রুটির আশায় জিয়ার দলে ভিড়ে গেছেন । আওয়ামী লীগের একাংশ মহিউদ্দিন আহমদের নেতৃত্বে বাকশালে ফেরত যেতে প্রস্তুত । মধ্যম সারির অনেক ত্যাগী নেতা হয় জেলে অথবা দেশত্যাগ করেছেন । কর্মীরা অনেকটা ছত্রভঙ্গ । মোটামুটি আওয়ামী লীগ নামের দেশের প্রাচীনতম ও মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দলটি বিলুপ্ত হওয়ার পথে । কাউন্সিলে ঠিক হলো দলটিকে যদি পুনরুজ্জীবিত করতে হয় তা হলে নেতৃত্বে বসাতে হবে বঙ্গবন্ধুর রক্তের কোন এক উত্তরসূরীকে । জীবিতদের মধ্যে তাঁর জেষ্ঠ্য কন্যাকেই সকলে নির্বাচিত করলেন । ফেব্রুয়ারির ১৭ তারিখ রাতে লন্ডন হতে আওয়ামী লীগের এক নেতা মাহবুবুর রহমান সংবাদটি শেখ হাসিনাকে টেলিফোনে দেন । প্রথমদিকে খবরটি শুনে শেখ হাসিনা কিছুটা হলেও অবাক হয়েছিলেন কারণ তিনি বঙ্গবন্ধুর কন্যা হওয়া সত্ত্বেও কখনো আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত ছিলেন না । তারপর নিজেকে সংযত করে ঠিক করলেন দিল্লির পাঠ চুকিয়ে তিনি ঢাকায় ফিরবেন । ১৯৮১ সালের ১৭ই মে এক ঝড়ো হাওয়ার ও গুড়ি গুড়ি বৃষ্টির মধ্যে শেষ বিকেলে বঙ্গবন্ধু কন্যা দিল্লি হতে ঢাকা ফিরেন । তখন বিমান বন্দরে লাখো মানুষের ঢল । ১৯৭৫ সালের ৩০ জুলাই যখন তিনি ঢাকা ছাড়েন তখন তার সবই ছিল । আর দীর্ঘ প্রবাস জীবন শেষে যখন দেশের মাটিতে পা রাখলেন তখন তিনি একজন প্রকৃত অর্থেই সর্বহারা । কোথাও কেউ নেই । গোল বাধলো যখন তিনি ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের সেই ঐতিহাসিক বাড়ীতে যেতে চাইলেন তখন । ঠিক করেছিলেন তিনি সেখানে গিয়ে বাড়ীটি পরিষ্কার করে সেখানে মিলাদ পড়াবেন । জিয়া কোন অবস্থাতেই শেখ হাসিনাকে তার জীবদ্দশায় সেই বাড়ীতে প্রবেশ করতে দেন নি । শেখ হাসিনা দলের নেতা কর্মীদের নিয়ে রাস্তায় বসে মিলাদ পড়েছেন ।
শেখ হাসিনার দেশে ফেরাটা বাংলাদেশের রাজনীতি ও আওয়ামী লীগের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ টার্নিং পয়েন্ট । তিনি দেশে ফিরে ছত্রভঙ্গ আওয়ামী লীগের ক্রান্তিকালে দলের হাল না ধরলে দলের অস্থিত্ব হুমকীর সম্মূখীন হয়ে পরতো । কারণ জিয়া কখনো চান নি আওয়ামী লীগ আবারো একটি শক্তিশালী দল হিসেবে দাঁড়াক । টোপ দিয়ে তিনি তাঁর দলে আওয়ামী লীগের অনেককে ভাগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন । দলে রয়ে গিয়েছিলেন যারা বঙ্গবন্ধুর একনিষ্ঠ অনুরাগী ও দেশের মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধারণ করতেন তারা । শেখ হাসিনা দলকে পুনঃগঠন করার জন্য দেশের এক প্রান্ত হতে অন্য প্রান্তে ছুঠে গিয়েছেন । জীবন হানির ঝুঁকি নিয়েছেন কয়েকবার । তাঁর উপর আস্থা রাখতে না পেরে ডঃ কামাল হোসেন, মিজানুর রহমান, সরদার আমজাদ হোসেন, মোল্লা জালালউদ্দিন-এর মতো নেতারা দল ত্যাগ করে হয় নতুন দল গঠন করেছেন অথবা অন্য দলে যোগ দিয়েছেন । জিয়ার মৃত্যুর পর এরশাদ ক্ষমতা দখল করলে নব্বইয়ের দশকে এরশাদ বিরোধী আন্দোলন দানা বাঁধতে শুরু করে । শুরুতে বেগম জিয়া এই আন্দোলনের নেতৃত্বে থাকলেও আন্দোলন তেমন একটা গতি পাচ্ছিল না । বেগম জিয়া কখনো আন্দোলনের নেতৃ নন । আন্দোলনে গতি আসে যখন শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ এই আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত হয় । ১৯৯০ সালের ডিসেম্বও মাসে এরশাদের পতন হলে ১৯৯১ এর নির্বাচনে জয়ী হয়ে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করবে তা অনেকটা নিশ্চিত ছিল কিন্তু দলের অনেক কৌশলগত ভুলের কারণে তা সম্ভব হয় নি । সেই নির্বাচনে বিএনপি নির্বাচন পরিচালনায় অনেক বেশী দক্ষতার পরিচয় দিয়েছিল । ১৯৯৬ সালে নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়ী হয়ে আনোয়ার হোসেন মঞ্জু ও আ.স.ম আবদুর রবের সহায়তায় সরকার গঠন করে । সেই সরকারের সবচেয়ে বড় অবদান ছিল দীর্ঘ একুশ বছর পর বঙ্গবন্ধুর খুনীদের বিচার শুরু করা । অবশ্য সেই বিচার শেষ হওয়ার আগেই শেখ হাসিনার সরকারের মেয়াদ শেষ হয়ে যায় । ক্ষমতায় আসেন বেগম জিয়া । মুখ থুবড়ে পরে মামলার কার্যক্রম । সেই মামলা শেষ হয় ২০১০ সালের জানুায়ারি মাসে যখন আবার শেখ হাসিনা ক্ষমতায় ।
২০০৮ সালের নির্বাচনে অওয়ামী লীগ তথা শেখ হাসিনার অঙ্গিকার ছিল ক্ষমতায় গেলে তিনি একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করবেন । তিনি তাঁর কথা রেখেছেন । এই বিচার না করতে অথবা বিচারের রায় বাস্তবায়ন না করতে অনেক ধরণের দেশীয় ও আন্তর্জাতিক চাপ ছিল । সেই সব চাপকে উপেক্ষা করে তিনি সেই বিচার ও বিচারে দন্ড বাস্তবায়ন অব্যাহত রেখেছেন । পিতার মতো তিনি সকল প্রতিকূলতার মাঝেও পিতার মতো মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছেন । তাঁর অবর্তমানে এর কোনটাই সম্ভব হতো না । তিনি ফিরে এসেছিলেন বলেই বাংলাদেশ এখন বিশ্বে উন্নয়নের এক রোল মডেল । দেশকে একটি মিনি পাকিস্তান হওয়া হতে রক্ষা করেছেন । শেখ হাসিনা স্বীকৃত হয়েছেন উন্নয়নশীল দেশের একজন সফল নেত্রী হিসেবে । তাঁর মাঝে দেশের মানুষ আগামীদিনের একটি সমৃদ্ধ বাংলাদেশ দেখতে পায় । তবে তাঁর সামনে বিপদও কম নয় । সেই সব বিপদ সম্পর্কে তিনি কতটুকু ওয়াকিবহাল তা বলা মুস্কিল । তবে আবারো বলি তাঁর চারপার্শ্বে একটি অদৃশ্য দেয়াল তোলার চেষ্টা হচ্ছে বলে অনেকে মনে করেন । সেই সম্পর্কে তিনি সচেতন হবেন তা তাঁর শুভাকাক্সিক্ষরা প্রত্যাশা করেন । অনেক দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হবে । শেখ হাসিনার দীর্ঘায়ু কামনা করি ।

লেখক : বিশ্লেষক ও গবেষক । মে ১৬, ২০১৬ ।

 

 

 

WARNING: Any unauthorized use or reproduction of 'Community' content is strictly prohibited and constitutes copyright infringement liable to legal action. 

 

[প্রথমপাতা]

 

 

 

লেখকের আগের লেখাঃ

 [......লেখক আর্কাইভ]