প্রথমপাতা  

সাম্প্রতিক সংবাদ 

 স্বদেশ

আন্তর্জাতিক

বাংলাদেশ কমিউনিটি

লাইফ স্টাইল

এক্সক্লুসিভ

বিনোদন

স্বাস্থ্য

বর্তমানের কথামালা

 শিল্প-সাহিত্য

 প্রবাসপঞ্জী 

আর্কাইভ

যোগাযোগ

 

 

 

 

 

 

বাঙালির মৃত্যুঞ্জয়ী চার জাতীয় নেতা

 


আবদুল মান্নান
 

 

৩ নভেম্বর। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ঘাতকদের গুলিতে বাঙালির চার জাতীয় নেতার নিহত হওয়ার কালোদিন। সভ্যতার ইতিহাসে এটি একটি কালো অধ্যায়। যে কোন দেশে কারাগারকে মনে করা হয় সবচেয়ে নিরাপদ স্থান। অথচ ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর এই দিনে আমাদের মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী চার জাতীয় নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহম্মদ, ক্যাপ্টন মনসুর আলী ও কামরুজ্জামানকে ঘাতকরা কারগারের অভ্যন্তরে নির্মমভাবে গুলি করে হত্যা করে সারা বিশ্বের মানুষকে স্তম্ভিত করে দেয়। ১৯৭৫ - এর ১৫ আগস্টের কালোরাতে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করার পর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে চার জাতীয় নেতাকে হত্যা করা ছিল স্বাধীন বাংলাদেশের শুরুর দিকে ঘটা দুটি বড় ধরনের মর্মান্তিক ঘটনা আর এই দুটি ঘটনার সঙ্গে যারা পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিলেন তারা সকলেই বঙ্গবন্ধুর অত্যন্ত আস্থাভাজন ও কাছের মানুষ ছিলেন। তাদের কয়েকজনকে তো তিনি নিজের সন্তানের মতো ¯েœহ করতেন। ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর তাঁর ও পরিবারের সদস্যদের লাশ যখন ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়ির সিঁড়িতে পড়ে ছিল তখন সন্ধ্যায় ঘাতক খন্দকার মুশতাক যে মন্ত্রিসভা গঠন করেন তাতে বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভার দশজন মন্ত্রী ও ছয়জন প্রতিমন্ত্রীকে রাখা হয়। সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর উপরাষ্ট্রপতি মাহমুদুল্লাহকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। পাকিস্তানের কারাগার হতে বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি দেশে প্রত্যাবর্তন করে যে মন্ত্রিসভা গঠন করেন তাতে তিনি হন প্রধানমন্ত্রী কারণ তিনি আজীবন সংসদীয় গণতন্ত্রে বিশ্বাস করতেন। তিনি প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীকে রাষ্ট্রপতি নিয়োগ করেছিলেন। বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বিদেশে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে প্রচারণা চালিয়েছিলেন। সেই আবু সাঈদ চৌধুরী মুশতাকের মন্ত্রিসভায় পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিয়েছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি জেনারেল ওসমানীকে বঙ্গবন্ধু খুবই শ্রদ্ধা করেতন। তিনি ছিলেন পাকিস্তান সেনাবাহিনী হতে অবসরপ্রাপ্ত একজন কর্নেল। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে ওসমানীকে বঙ্গবন্ধু রাতারাতি জেনারেল পদে পদোন্নতি দেন। সেই জেনারেল ওসমানীকে মুশতাক ২৪ আগস্ট রাষ্ট্রপতির প্রতিরক্ষা বিষয়ক উপদেষ্টা নিয়োগ করেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে জেনারেল জিয়া ছিলেন পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর একজন মেজর। যুদ্ধ শেষ হলে মেজর জিয়াকে বঙ্গবন্ধু কয়েক লাফে মেজর জেনারেল পদে পদায়ন করেন এবং বীরউত্তম খেতাবে ভূষিত করেন। অথচ সেই জিয়া বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-ের সঙ্গে সরসারি জড়িত হয়ে পড়েন। মুশতাক সেনাপ্রধান জেনারেল সফিউল্লাকে সরিয়ে জিয়াকে তাঁর স্থলাভিষিক্ত করলে তা তিনি সানন্দে গ্রহণ করেন। খন্দকার মুশতাকের অনেক প্রলোভন থাকা সত্ত্বেও তার মন্ত্রিসভায় যোগ দিতে যারা অস্বীকার করেছিলেন তাদের মধ্যে ছিলেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহমেদ, ক্যাপ্টন মনসুর আলী, কামরুজ্জামান, আবদুস সামাদ আজাদ, কোরবান আলী, তোফায়েল আহমেদ প্রমুখ। এঁদেরসহ বঙ্গবন্ধুর রক্তের সঙ্গে বেঈমানি করেন নি এমন কুড়িজন আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাকে ২৩ আগস্ট গ্রেফতার করে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে নিক্ষেপ করা হয়। ১৬ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর লাশ টুঙ্গিপাড়ায় আর পরিবারের সদস্যদের ধর্মীয় রীতি-নীতি না মেনে বনানী কবরস্থানে দাফন করা হয়।
বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা মূলত দু’জায়গায় কেন্দ্রিভূত হয়। মুশতাক বঙ্গভবন দখল করেন আর তাকে সার্বক্ষিণক নজরদারিতে রাখেন বঙ্গবন্ধু খুনি ফারুক-রশিদ গংসহ অন্যান্য সেনা কর্মকর্তারা। উল্লেখ্য এই সেনা কর্মকর্তারা মুক্তিযুদ্ধের শেষের দিকে অক্টোবর ও নভেম্বর মাসে পাকিস্তান হতে এসে মুজিব নগর সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করেন এবং এদের কেউই সরাসরি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন নি। ধারণা করা হয় পাকিস্তান সেনাবাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে তাদের পরাজয় নিশ্চিত জেনে স্বাধীন বাংলাদেশের পিঠে ছুরিকাঘাত করতে তাদের মুজিব নগরে পাঠিয়েছিল। ১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে খন্দকার মুশতাক কুমিল্লা হতে নির্বাচিত আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য জহিরুল কাইয়ূমকে কলকাতাস্থ মার্কিন কন্সাল জেনারেলের রাজনৈতিক কর্মকর্তা জর্জ গ্রিফিনের নিকট এই বার্তা দিয়ে পাঠিয়েছিলেন যে বঙ্গবন্ধুকে যদি পাকিস্তান সরকার কারাগার হতে মুক্ত করে দেয় তা হলে তিনি মুক্তিযুদ্ধ বন্ধ করার জন্য কাজ করবেন। এই সংবাদ পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থার কাছে অজানা ছিল না। পরবর্তী সময়ে বঙ্গবন্ধুর ঘাতকরা এই খন্দকার মুশতাকের সঙ্গে যোগাযোগ করেই বঙ্গবন্ধু ও চার জাতীয় নেতাকে হত্যা করেন। বঙ্গভবন ছাড়াও রাষ্ট্র ক্ষমতার দ্বিতীয় কেন্দ্রবিন্দু ছিল ঢাকা সেনানিবাস। জেনারেল জিয়া সেনাপ্রধান পদে অভিষিক্ত হয়ে সেনানিবাসে তার নিয়ন্ত্রণ নিরঙ্কুশ করার চেষ্টা করেন। কিন্তু সেনাবাহিনীকে নিয়ে কর্নেল তাহেরের নেতৃত্বে জাসদ আর এক ভয়ঙ্কর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। জাসদ সেনাবাহিনীর সিপাহীদের মধ্যে গোপনে এই ধারণা প্রচার শুরু করে যে বাংলাদেশের সেনাবাহিনী হবে চীনের আদলে গণবাহিনী যেখানে কোন অফিসার থাকবে না। তাহের ও জাসদের মতবাদ সেনাবাহিনীর একটি অংশের মাঝে বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করে। সেনানিবাসের নানা ধরনের নাটকের মধ্যে আবির্ভাব ঘটে ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোর্শারফের। তিনি একজন খেতাবপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা। তার কাছে সেনাবাহিনীর পেশাদারিত্ব ছিল সর্বাগ্রে। তিনি মনে করতেন বঙ্গবন্ধু হত্যাকারী ঘাতক সেনা অফিসাররা বঙ্গভবনে বসে যা করছেন তা সেনাবাহিনীর শৃঙ্খলার পরিপন্থী। তার কাছে সেনাবাহিনীর শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনাটাই হয়ে উঠে মুখ্য। তিনি তার অনুগত সেনা অফিসার ও সৈনিকদের নিয়ে ২ নভেম্বর এক সেনা অভ্যুত্থান ঘটিয়ে জিয়াকে গৃহবন্দি করে ক্ষমতা দখল করেন। ৪ নভেম্বর খালেদ মোর্শারফ নিজেকে সেনাপ্রধান ঘোষণা করেন। এই ধরনের একটি ঘোলাটে পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে কর্নেল তাহের ও তার অনুসারী সেনা অফিসার আরেকটা অভ্যুত্থান ঘটানোর চেষ্টা করেন এবং ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোর্শারফসহ অনেক সেনা অফিসার ও তাদের পরিবারের নিরাপরাধ সদস্যদের ৭ নভেম্বর হত্যা করেন । এই কাজে তিনি তার মন্ত্রে দীক্ষিত সৈনিকদের দ্বারা গঠিত ‘বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা’কে ব্যবহার করেন। স্বাধীন বাংলাদেশে জাসদ শুধু সেনাবাহিনীকে ধ্বংস করার চেষ্টাই করে নি দেশের অনেক মেধাবী তরুণের স্বপ্নকেও ধ্বংস করেছে। জাসদের সৃষ্টি না হলে হয়তো ১৫ আগস্ট বা ৩ নভেম্বরের হত্যাকা- ঘটতো না।
সেনানিবাসের পরিস্থিতি যখন এমন ঘোলাটে তখন বঙ্গভবনে থাকা ঘাতকরা বুঝতে পারেন তাদের সময় দ্রুত শেষ হয়ে আসছে। ১৫ আগস্টের বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার উদ্দেশ্য শুধু একজন ব্যক্তি বা একটি পরিবারকে নির্বংশ করার জন্য ছিল না। এটি ছিল একটি স্বাধীন দেশকে চিরতরে ধ্বংস করে দেওয়ার প্রথম পদক্ষেপ। আর এই ষড়যন্ত্রে বঙ্গবন্ধুর কাছের মানুষরা ছাড়াও প্রত্যক্ষভাবে মদদ যুগিয়েছিল একটি শক্তিশালী আন্তর্জাতিক মহল যার কেন্দ্রবিন্দুতে পাকিস্তান ছাড়াও ছিল যুক্তরাষ্ট্র। বিংশ শতাব্দীতে বিশ্বে অনেকগুলো দেশে এই ধরনের রক্তপাতের মাধ্যমে ক্ষমতার হাতবদল হয়েছে এবং তার প্রায় প্রত্যেকটির সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র ও তার গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ জড়িত ছিল। খালেদ মোর্শারফ একজন নির্ভীক ও সাহসী মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন তাতে কোন সন্দেহ নেই কিন্তু তিনি রাজনীতির ম্যারপ্যাঁচ বোঝার ক্ষেত্রে ছিলেন সম্পূর্ণ আনাড়ি। তুলনামূলকভাবে তার সহকর্মী জেনারেল জিয়া ছিলেন একজন চতুর ও ধুর্ত সেনা অফিসার যিনি নিজের স্বার্থে যে কোন কিছু করতে পিছপা হতেন না। ষড়যন্ত্র কষা ও তা বাস্তবায়ন কৌশল গঠনে তিনি ছিলেন অদ্বিতীয়। খালেদ মোর্শারফ ২ নভেম্বর অভ্যুত্থান ঘটিয়ে যখন র‌্যাংক ব্যাজ পরতে ব্যস্ত তখন জেনারেল জিয়া সেনানিবাসের সরকারি বাসভবনে বসে তার পরবর্তী পদক্ষেপ কী হবে তা নির্ধারণ করে ফেলেছেন। জিয়া কর্নেল তাহেরের সঙ্গে যোগাযোগ করে তার প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে তাকে বন্দিদশা হতে মুক্ত করতে আকুতি জানান এবং অঙ্গীকার করেন যে তিনি কর্নেল তাহেরের সঙ্গে এক যোগে কাজ করবেন। ততক্ষণে খালেদ মোর্শারফ সেনানিবাসের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছিলেন। সেনানিবাসে যখন এক চরম বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়েছে বঙ্গভবনে ঘাতক সেনা অফিসার ফারুক-রশিদ গং সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন শেষ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পরও বাংলাদেশ যদি আবার বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক উত্তরসূরিদের হাতে চলে যায় তা হলে স্বাধীন বাংলাদেশকে ধ্বংস করার তাদের সকল পরিকল্পনা বিফলে যাবে। তারা সিদ্ধান্ত নেন কারাগারে বন্দি বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক সহকর্মীরা যারা একাত্তরে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তাদের হত্যা করতে হবে। তারা বেঁচে থাকলে বাংলাদেশকে আবার তাদের স্বপ্নের পাকিস্তানে রূপান্তর করার পরিকল্পনা ভেস্তে যাবে। ৩ নভেম্বর রাতে তারা মুশতাকের জ্ঞাতসারেই ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে প্রবেশ করে জাতীয় চার নেতাকে নির্মমভাবে হত্যা করেছিলেন। ঢাকা কারাগারের কারাপ্রধান ঘাতকদের কারাগারের ভিতর অস্ত্র নিয়ে প্রবেশ করার অনুমতি দিতে অস্বীকার করলে মুশতাক ফোনে কারাপ্রধানকে বলেন ঘাতকরা যা করতে চায় তা যেন তাদের করতে দেওয়া হয়। ঘাতকচক্র কারাগারে প্রবেশ করে নির্মমভাবে চার জাতীয় নেতাকে গুলি করে হত্যা করেন। কারাগারে যখন এই হত্যাকান্ড চলছিল তখন ঢাকা সেনানিবাসে চরম বিশৃঙ্খলা। একদিকে সেনাবাহিনীর সকল চেইন অফ কমান্ড ভেঙে পড়েছে অন্যদিকে কর্নেল তাহেরের অনুগত সেনা সদস্যরা সশস্ত্র অবস্থায় চারিদিকে ঘোরাফেরা করছে এবং সেনা অফিসার ও তাদের পরিবারের সদস্যদের ওপর হামলা করছেন। খন্দকার মুশতাক রাষ্ট্রপতির দায়িত্বে থাকলেও কোন কিছুর ওপরই তার নিয়ন্ত্রণ ছিল না। বস্তুতপক্ষে নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে বাংলাদেশে কোন কার্যকর সরকার ছিল না। ৭ নভেম্বর তাহের জিয়াকে বন্দিদশা হতে মুক্ত করেন এই শর্তে তিনি কর্নেল তাহেরের তথাকথিত বিপ্লবের সহযাত্রী হবেন। কিন্তু ধূর্ত জিয়া মুক্ত হয়েই দেশের বিরুদ্ধে সামগ্রিক ষড়যন্ত্রের তার অংশ দ্রুত বাস্তবায়ন শুরু করেন। তিনি পুনরায় সেনাবাহিনী প্রধানের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। আগের দিন খন্দকার মুশতাক প্রধান বিচারপতি এ এস এম সায়েমের কাছে তার ক্ষমতা হস্তান্তর করলেও মূল ক্ষমতা সেনাবাহিনী তথা জেনারেল জিয়ার হাতেই রয়ে যায়। সায়েম একজন সাক্ষীগোপাল রাষ্ট্রপতি থেকে যান। পরে সায়েমকে সরিয়ে জিয়া নিজেই রাষ্ট্রপতি ও প্রধান সামরিক শাসকের পদে অধিষ্ঠিত হন। জেলে চার জাতীয় নেতাকে কী প্রেক্ষাপটে হত্যা করা হয়েছিল তা তদন্ত করার জন্য বিচারপতি সায়েমকে প্রধান করে ৪ নভেম্বর একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছিল। জিয়া ক্ষমতা দখল করে সেই তদন্ত কমিটি বাতিল করে দেন এবং ২৫ নভেম্বর কর্নেল তাহেরসহ জাসদের ১৬ জন শীর্ষপদে থাকা নেতৃবৃন্দকে গ্রেফতার করেন। এক প্রহসনের বিচারের মাধ্যমে ১৯৭৬ সালের ২১ আগস্ট জিয়া কর্নেল তাহেরকে মাত্র ৩৭ বছর বয়সে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করেন। বিশ্বখ্যাত জার্মান-আমেরিকার সমাজ বিজ্ঞানী আন্দ্রে গুন্ডার ফ্রাংকের মতে জেনারেল জিয়া দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় যে ভাবে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় হত্যাকা- ঘটিয়েছেন তা এক কথায় বিরল।
জিয়া ক্ষমতা দখল করে বঙ্গবন্ধু ও জেল হত্যাক-ের সঙ্গে জড়িত ঘাতকদের নিরাপদে দেশত্যাগ করার সুযোগ করে দেন এবং পরবর্তী সময়ে তাদের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশ দূতাবাসে উচ্চপদে পদায়ন করেন। এই ঘাতকরা প্রথমে একটি বিশেষ বিমানে ব্যাংকক যান। ক’দিন পর আর একজন সামরিক কর্মকর্তা ঢাকা হতে গিয়ে তাদের কাছে পাসপোর্ট ও ডলার হস্তান্তর করে আসেন। এই সেনা কর্মকর্তা একজন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন এবং বঙ্গবন্ধু তাকে বিদেশে পাঠিয়ে চিকিৎসা করিয়ে আনেন। ১৯৭৫ সালের জানুয়ারি মাসে বঙ্গবন্ধু তাকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে কূটনৈতিক মর্যাদা দিয়ে পদায়ন করেন। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর তিনি বিভিন্ন দেশে রাষ্ট্রদূত ও বাংলাদেশের পরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি জেনারেল জিয়া ও তার স্ত্রী বেগম জিয়ার খুব কাছের মানুষ ছিলেন। বর্তমানে রাজনীতি হতে অবসর নিয়েছেন।
১৫ আগস্ট ও ৩ নভেম্বরের হত্যাকা-ের মাধ্যমে স্বাধীনতার শত্রুরা বাংলাদেশ ও আওয়ামী লীগকে ধ্বংস করতে চেয়েছিল আর ২০০১ পর্যন্ত নিরবিচ্ছিন্নভাবে সেই চেষ্টাই করা হয়েছে। জিয়া তথাকথিত বহুদলীয় গণতন্ত্র চালুর নামে বাহাত্তরের সংবিধানে নিষিদ্ধ ঘোষিত বাংলাদেশ-বিরোধী ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোকে রাজনীতি করার লাইসেন্স দিয়েছেন। তার স্ত্রী বেগম জিয়া সেই স্বাধীনতা বিরোধীদের বাংলাদেশের শাসনব্যবস্থার অংশীদার হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছেন। ১৯৭৫ হতে ১৯৮১ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ আওয়ামী লীগকে গৃহবন্দি করে রাখা হয়েছে। জিয়া আর এরশাদ দু’জনে মিলে এই কাজটি করেছেন। আওয়ামী লীগের নিবেদিতপ্রাণ নেতা-কর্মীরা দলটিকে বাঁচিয়ে রেখেছেন। ১৯৮১ সালে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা দেশে ফিরে আওয়ামী লীগকে নবজীবন দান করেছেন। ঘাতকদের একাধিক হত্যা প্রচেষ্টা হতে নিজে রক্ষা পেয়ে ১৯৯৬ সালে দীর্ঘ একুশ বছর পর দলকে ক্ষমতায় নিয়ে গেছেন। শেখ হাসিনা এখন শুধু বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বা আওয়ামী লীগ প্রধানই নন তিনি একজন স্বীকৃত বিশ্ব নেত্রী। তবে পিতা যেমন নিজ অজান্তে শত্রু পরিবেষ্টিত ছিলেন শেখ হাসিনাও যে তা হতে মুক্ত তা সম্ভবত বলা যাবে না। বঙ্গবন্ধুর তুলনায় শেখ হাসিনার শত্রু কয়েকগুণ বেশি। তারা যেমন দলের ভিতর আছে ঠিক একইভাবে আছে দলের বাইরে। দলের বাইরের শত্রু যতটুকু বিপদজনক তারচেয়ে অনেক বেশি বিপদজনক দলের ভিতরের বন্ধু বেশে শত্রু। বঙ্গবন্ধু এবং তাঁর রাজনৈতিক সহকর্মীরা সময় থাকতে সতর্ক হন নি। খেসারত দিতে হয়েছে বাঙালি জাতি তথা রাষ্ট্রকে। ২০১৭ বা ২০১৮ তে এসে পঁচাত্তরের পবিত্র রক্ত বৃথা যাক তা এই দেশের মানুষ (স্বাধীনতার শত্রুরা ছাড়া) কেউ চায় না । তা রুখতে হলে প্রয়োজন শেখ হাসিনার হাতকে একশত ভাগ আস্থাভাজন নেতা-কর্মীর দূরদৃষ্টি ও অঙ্গীকার দ্বারা শক্তিশালী করা এবং দলে যে সব অতিথি পাখি ভিড় করেছে তাদের বিতাড়িত করা। ৩ নভেম্বরের শহীদদের প্রতি বিনম্্র শ্রদ্ধা। জয়তু মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ।

 

 

WARNING: Any unauthorized use or reproduction of 'Community' content is strictly prohibited and constitutes copyright infringement liable to legal action. 

 

[প্রথমপাতা]

 

 

 

লেখকের আগের লেখাঃ

 

 

 [......লেখক আর্কাইভ]