প্রথমপাতা  

সাম্প্রতিক সংবাদ 

 স্বদেশ

আন্তর্জাতিক

বাংলাদেশ কমিউনিটি

লাইফ স্টাইল

এক্সক্লুসিভ

বিনোদন

স্বাস্থ্য

বর্তমানের কথামালা

 শিল্প-সাহিত্য

 প্রবাসপঞ্জী 

আর্কাইভ

যোগাযোগ

 

 

 

 

 

 

আমি আমার মায়ের কথ বলছি

 


আবদুল মান্নান
 

 

মায়ের কাছে জানতে চাইলে তাঁর বয়স কত তিনি একটু চিন্তা করে বলেন ষাট বা সত্তর হতে পারে । আমার ছোট ভাই নানা রকম গবেষণা করে বের করেছে মায়ের বয়স কম পক্ষে পঁচানব্বই । বার্ধক্যজনিত সমস্যা ছাড়া আল্লাহ‘র রহমতে মা ভাল আছেন । তাঁর ছয় ছেলেমেয়ে আর নাতি নাতনিদের নাম বলতে পারেন । মায়ের বয়স যখন আশি, তখন তাঁকে হজে নিয়ে গিয়েছিলাম । কেউ বিশ্বাস করেন নি আমার মা হজ করতে পারবেন । তিনি হজের সব করণীয় কোন রকম সমস্যা ছাড়া শেষ করেছেন । সকলের মায়ের মতো আমার মা জগতের শ্রেষ্ঠ মা । বাবাতো ছিলেনই । ছেলে মেয়েদের মানুষ করার জন্য দুজনে অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন যদিও তাদের কেউই স্কুলের গন্ডি পার হন নি । দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপান বার্মা দখল করলে আমার বাবা এক কাপড়ে রেঙ্গুন ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন কারণ বার্মিজরা ভারতীয় বংশোদ্ভূত মানুষদের কখনো ভাল চোখে দেখত না । দেশে ফেরার পর ছোটখাট ব্যবসা শুরু করে বাবা বিয়ে করেন । আমাদের পরিবারকে সব সময় আমি নিম্ন মধ্যবিত্ত বলে মনে করি । বাঙালিদের মধ্যে মধ্যবিত্তের সংখ্যা তখন হাতে গোনা । সংসারে অনেক টানাপোড়েন সত্ত্বেও বাবা আমাদের পড়া লেখাকে সব সময় গুরুত্ব দিয়েছেন । শহরের সেরা স্কুলের একটিতে ১৯৫৩ সালে ভর্তি হয়েছিলাম । সে সময় ওই স্কুলের বেতন ছিল মাসে বাইশ টাকা । ১৮৫৩ সালে প্রতিষ্ঠিত স্কুলটির বাংলার শিক্ষক ছাড়া সব শিক্ষকই ছিলেন বিদেশী কারণ স্কুলটি মিশনারি ছিল । একটি বনেদি ইংরেজি মাধ্যম স্কুল হলেও কখনো স্কুলে আমাদের সাহেব বানানোর চেষ্টা করা হয় নি যেমন আজকালকের নব্য ধনীদের জন্য প্রতিষ্ঠিত তথাকথিত ইংরেজি মাধ্যম স্কুলগুলোতে করা হয় । স্কুলে গানের মাস্টার ছিল । ভাল স্কাউট আর ব্যন্ড দল ছিল । বড় দুটি মাঠে নিয়মিত খেলা হতো । বিকেলে স্কুল হতে ফিরে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজ মাঠে খেলার আসর । মা বলে দিয়েছেন সূর্য ডোবার আগেই ঘরে ফিরে হাত মুখ ধুয়ে নামাজ পরে পড়তে বসতে হবে । এই নিয়মের ব্যত্যয় ঘটা সম্ভব ছিল না । সে দিন রাত পৌনে একটায় হাতিরঝিল হয়ে একটি টিভি অনুষ্ঠান শেষ করে বাসায় ফিরছিলাম । ঝিলের এক জায়গায় দেখি দু’জন ছেলে আর একজন মেয়ে ওই মাঝ রাতে বসে আড্ডা দিচ্ছে । আমার মা দেখলে নিশ্চয় মূর্ছা যেতেন । কেউ এমন ঘটনার সমালোচনা করলে অনেকে বলবেন রাত বিরাতে মেয়েরা যেখানে ইচ্ছা সেখানে যাবে তাতে আপনার কী ? বাংলাদেশে এখন স্বঘোষিত পরিবেশবাদী আর নারীবাদীরা বেশ সক্রিয় । নারীবাদীরা অনেকেই জানেন না যে বিশ্বের সব চাইতে উদার দেশ বলে পরিচিত যুক্তরাষ্ট্রের বড় বড় শহরে রাত্রিকালিন কারফিউ বলে একটি আইন চালু আছে । শহর ভেদে এই আইনের অধীনে ১৬ হতে ১৮ বছরের নিচে কোন তরুণ বা তরুণী নির্ধারিত সময়ের পর অভিভাবক ছাড়া রাস্তায় একলা চলতে পারে না ।
আমার মায়ের শখের অর্ধডজন দুধেলা গরু ছিল । সেই গরুর দুধের বেশ কদর কারণ মা’র চিন্তায় কখনো আসেনি দুধে পানি মিশিয়ে বিক্রি করা যায় । অন্যরা এক টাকায় দেড় সের দুধ বিক্রি করলেও আমার মায়ের কাছ হতে সেই দুধ পাড়ার লোকজন টাকায় পাঁচ পোয়া করে কিনত । দু’এক বাড়িতে আমি নিজে কখনো কখনো দুধ পৌঁছে দিতাম । মুরগি ছিল কয়েকটি । পাড়ার কেউ কেউ একটাকায় বার হতে পনেরটা ডিম নিয়ে যেত । আমাদের জন্যও বরাদ্দ থাকতো । হঠাৎ করে সড়ক দূর্ঘটনায় বাবার মৃত্যু হলে আমাদের পরিবারটি আর্থিক সংকটে পরে যায় । আমি চারশত পঞ্চাশ টাকায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রভাষক পদে চাকুরি করছি । আমার ওই যৎসামান্য আয় আর মায়ের দুধ ডিম বিক্রির আয় দিয়ে সংসারের সব কাজ আগের মতো চালু রাখতে মা সব সময় তৎপর ছিলেন । শুধু একটা ডিমকে ওমলেট করে মা চার ভাইকে ভাগ করে দিতেন । মাঝে মধ্যে মাছ মাংস রান্না হতো । ছোট তিন ভাইয়ের মধ্যে দু’ভাই স্কুলে পড়াশোনা করছে । এক ভাই কলেজে সদ্য ভর্তি হয়েছে । বাবা যে’দিন মারা যান সবচেয়ে ছোট ভাইটার সেদিন স্কুলে বার্ষিক পরীক্ষা ছিল । তাকে পরীক্ষা দিতে পাঠিয়েছি । না ফেরা পর্যন্ত বাবার জানাজার জন্য অপেক্ষা করেছি। তার বড়টা ক্যাডেট কলেজে পড়ে । আগের দিন কলেজ অধ্যক্ষকে বলে কয়েক ঘন্টার জন্য বাড়ী এসেছে । বাবার জানাজা শেষে ফিরে যাবে । সে ভাই যখন সেনা বাহিনীতে কমিশন্ড প্রাপ্ত হলো তখন আমি যুক্তরাষ্ট্র সরকারের বৃত্তি নিয়ে উচ্চশিক্ষার্থে সে দেশে অবস্থান করছি । ছোট ভাই মিলিটারি একাডেমিতে যেতে একগাদা কাপড় চোপড় বানাতে হবে । মা নিজের হাতের বালা বিক্রি করে সেই ব্যবস্থা করলেন । সে ভাই গত বছর সেনাবাহিনীর একজন শীর্ষ পর্যায়ের অফিসার হিসেবে অবসর নিয়েছেন । আর সবার ছোটটি সরকারি কলেজের অর্থনীতির একজন অধ্যাপক । তাদের বড়টি ব্যবসা করে আর সে আর তার স্ত্রী সার্বক্ষণিক মায়ের দেখাশোনা করে । আমার একজন বন্ধুর মায়ের কথা বলি । অসম্ভব ভাল মহিলা ছিলেন । বন্ধুর বাবা একজন সৎ সরকারি অফিসার হিসেবে অবসর নিয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন । নয় ছেলে মেয়ে । সকলে উচ্চশিক্ষিত । তাদেও একজন সরকারের বড় কর্মকর্তা হয়েছিল । মাকে ঢাকা রেখে ছোটটা ছাড়া সকলে বিদেশে । ছোটটা বিয়ে করলো । বউ বিয়ের পর সাফ জানিয়ে দিল তার পক্ষে ‘বুড়ি’র সাথে এক বাসায় থাকা সম্ভব নয় । কাছেই তারা পৃথক বাসা নিল । ঢাকার একটা হাসপাতালে সেই মায়ের মৃত্যু হয় । পাশে তখন নয় ছেলে মেয়ের কেউ ছিল না ।
দূর্ভাগ্য আজকালের সব মা আমার মায়ের মতো হতে পারেন না বা হতে চান না । বিশেষ করে শহুরে মায়েদের তা হওয়াও সম্ভব না বাস্তব কারণেই । অনেক ক্ষেত্রে মা-বাবা উভয়ে চাকুরি করেন । ছেলে মেয়েদের সাথে সময় কাটানোর সময় তাদের নেই । রাত বিরাতে সন্তান পার্টিতে যাবে তাতে তাদের তেমন কোন আপত্তি নেই । ক’দিন পর রমজান মাস শুরু হবে । দেখা যাবে এই ঢাকা শহরে ভোর রাতে সেহরি পার্টি হচ্ছে বিভিন্ন হোটেল রেস্তোরায় । সেখানে উঠতি বয়সের ছেলে মেয়ের উপস্থিতি চোখে পরার মতো । অনেকেই আসবে মা বাবার অনুমতি নিয়ে । ফ্রেন্ডের পার্টি বলে কথা । বাঙালির হাতে এখন কাঁচা পয়সা । বেশীর ভাগই অবৈধ পথের আয় । চোরাকারবারি, টাউট, বাটপার, হুন্ডির কারবারি, সোনা চোরাচালানি, ভূমি দস্যু, বিদ্যা ব্যবসায়ী সকলের কাছে এখন অঢেল টাকা । কথায় বলে টাকা থাকলে কুত্তা (কুকুর) কিনতে মন চায় । এরা একটু শর্দি কাশি হলে সিঙ্গাপুর ব্যাংকক দৌঁড়ায় । একজনকে জানি যার কন্যার বিয়ের কার্ড কিনতে সপরিবারে কোলকাতা ছুটেছিলেন । কার্ড সকলের পছন্দ হতে হবেতো ।
এই যে সমাজে এত অনাচার তার অনেকটাই কমানো সম্ভব ছিল বাবা মায়েরা তাদের ছেলে মেয়েদের ব্যাপারে একটু সতর্ক হলে । বলছিনা আমার মায়ের মতো ছেলে মেয়ে মানুষ করার জন্য তাদের এত কষ্ট করতে হবে । এই যুগে সেটা আশা করাটাও অন্যায় হবে । তবে এই সময়ের বাবা মায়েরাতো সন্তানদেও কল্যানে কিছু অনুশাসনতো বলবৎ করতে পারেন । রেইনট্রি হোটেলের ঘটনা নিয়ে দেশে এখন বেশ তোলপার চলছে । সেই ঘটনার সাথে যারা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে জড়িত তাদের অপরাধ অমার্জনীয় এবং প্রত্যেকেরই এই ঘটনার জন্য প্রযোজ্য সর্বোচ্চ শাস্তি পাওয়া উচিৎ । তবে তাদের অভিভাবকরাও এই সাজার বাইরে থাকা উচিৎ নয় । কেমন বাবা যে তার ছেলেকে দিনে হাত খরচ হিসেবে দুই লক্ষ টাকা দেয়? একজনের জন্য একজন সশস্ত্র বডিগার্ডও আছে । আমি গত দু’বছর ধরে সরকারের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করছি । রেওয়াজ ছিল আমার ব্যক্তিগত নিরাপত্তার জন্য একজন গানম্যান দেওয়ার । সেই গানম্যান আমার পাওয়া উচিৎ এই কথাটা এখন পর্যন্ত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সর্বোচ্চ পর্যায়ে দায়িত্বরত কাউকে আমার দপ্তর বুঝাতে পারে নি, আমিও না । তাদের ধারণা রাস্তা ঘাটে কত মানুষই তো সন্ত্রাসীদের গুলিতে মারা পরছে । তার সাথে আর একটি নাম যোগ হতে অসুবিধা কোথায় ! রেইট্রি হোটেলের ঘটনার সাথে যে মেয়েগুলি জড়িত ছিল তাদের দু’জনেরই বাবা মা আছেন । তারা তাদের সন্তানদের কেমন শিক্ষা দিলেন যে রাত বিরাতে বন্ধুদের জন্মদিনের পার্টিতে হাজির থাকতে হবে । আমি এই সব ব্যাপারে একটু সেকেলে । অনেকে আমাকে আমার মন্তব্যের জন্য মুন্ডুপাত করবেন । কিন্তু যখন ছেলে মেয়ে মানুষ করার প্রশ্ন আসে আমার চিন্তা ধারা আমার মায়ের চিন্তা ধারায় এসে ঠেকে । রেইনট্রির দূর্ঘটনার শিকার দু’জন মেয়েই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী । ব্যতিক্রমি কিছু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা বাদ দিলে বেশ কিছু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় তাদের ছাত্র ছাত্রীদের জন্য স্মার্ট হওয়ার কিছু অলিখিত ফর্মূলা জারি করেছে । ইংরেজি মাধ্যম স্কুল গুলোও পিছিয়ে নেই । বাংলার ক্লাসের বাইরে বাংলা বললে বহিষ্কার নিশ্চিত । এতে নাকি ইংরেজি ভাল শেখা যায় । ইংরেজি শেখার এমন সহজ পদ্ধতি আগে জানা ছিল না । বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে (ব্যতিক্রম ছাড়া) ছাত্রছাত্রীদের স্মার্ট হতে হলে রাত বিরাতে পার্টি করতে হবে । মাদক সেবন স্মার্টনেসকে একটু এগিয়ে নিতে সাহায্য করবে । কথায় কথায় বলতে হবে I hate politics. GB me. এই সব সমস্যাযে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে নেই তা কিন্তু নয় তবে তার সংখ্যা তুলনামূলক ভাবে কম ।
সব বাবা মায়েদের কাছে একটা আবেদন, বাস্তব কারণেই আপনারা অর্ধ শতাব্দী বা তারো বেশী আগের বাবা মায়েদের মতো হয়তো হতে পারবেন না, সমাজও হতে দিবে না । তারা সেকেলে ছিলেন কারণ কালটাও সেকাল ছিল । সেকালের অনেক কিছুই এখন অচল । কিন্তু নিজের ছেলে মেয়েদের প্রতি একটু নজর রাখলে সমাজের অনেক সমস্যার জন্মই হতো না । তা যদি করতে পারেন তাতে আপনাদেরই লাভ । তা না হলে আপনাদের সন্তানরা কোন ঘটনা দূর্ঘটনার জন্ম দিলে তখন মানুষ বলতে পারবে বাপতো সোনার চোরাকারবারি সন্তান কী ভাবে ভাল হবে? সকলে ভাল থাকবেন । আমার মায়ের জন্য দোয়া করবেন যেন তাঁর কথা সব সময় বলে যেতে পারি ।

লেখক: বিশ্লেষক ও গবেষক । মে ২২, ২০১৭

 

 

WARNING: Any unauthorized use or reproduction of 'Community' content is strictly prohibited and constitutes copyright infringement liable to legal action. 

 

[প্রথমপাতা]

 

 

 

লেখকের আগের লেখাঃ

 

 

 [......লেখক আর্কাইভ]