|
||||||||||||||||||
|
ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান-ইতিহাসের বাঁক পরিবর্তন
WARNING: Any unauthorized use or reproduction of 'Community' content is strictly prohibited and constitutes copyright infringement liable to legal action.
|
লেখকের আগের লেখাঃ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সব সময় নিজের জীবনকে নিয়তির উপর ছেড়ে দেবেন না ক্ষুব্ধ, লজ্জিত এবং ক্ষমাপ্রার্ö
|
বাঙালি ও বাংলাদেশের ইতিহাসে ঊনসত্তরের গণআন্দোলন ও গণঅভ্যুত্থান একটি মাইলফলক। এই মাইলফলককে পিছনে ফেলে বাঙালি নিজ দেশকে স্বাধীন করার জন্য একাত্তরে যুদ্ধ করেছিল। ঊনসত্তরের গণআন্দোলনের কৃতিত্ব যদি কোন একটি একক গোষ্ঠীকে দিতে হয় তাহলে তা প্রাপ্য এই দেশের ছাত্র সমাজ এবং ছাত্র নেতৃত্বের। বর্তমান ছাত্র নেতৃত্বকে সে সময়ের ছাত্র নেতৃত্বের সাথে কোনভাবেই তুলনা করা যাবে না। ঊনসত্তরের গণআন্দোলন ও গণঅভ্যুত্থানকে যারা সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন তাদের মধ্যে ছাত্রলীগ হতে ছিলেন সিরাজুল আলম খান, নূরে আলম সিদ্দিকি, আবদুল কুদ্দুস মাখন, তোফায়েল আহমেদ, শাহজাহান সিরাজ, আ স ম আবদুর রব, খালেদ মাহমুদ আলী, আবদুর রউফ। ছাত্র ইউনিয়ন হতে এসেছিলেন (মস্কো ও পিকিং পন্থি) মাহবুব উল্লাহ, সাইফুদ্দিন আহমেদ মানিক, মোস্তফা জামাল হায়দার, মাহবুবুল হক দোলন, নাজিম কামরান চৌধুরী। গণআন্দোলনটা শুরু হয়েছিল আইয়ূব বিরোধী আন্দোলন হিসেবে। এই ছাত্র নেতৃবৃন্দ আন্দোলন পরিচালনার জন্য গঠন করেছিল ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ। উল্লেখ্য শেষের দু’জন মোনায়েম খানের অনুগত এনএসএফ-এর কেন্দ্রীয় নেতা হলেও তারা ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। মোনায়েম খানের সাথে তাদের মতপার্থক্য সৃষ্টি হলে তাদের নেতৃত্বে এনএসএফ দ্বিখন্ডিত হয়ে যায়। নাজিম কামরান চৌধুরী ছিলেন জিন্নাহ হলের (পরবর্তী সময়ে সূর্যসেন হল) ছাত্র ও ডাকসুর সাধারণ সম্পাদক। ডাকসুর ভিপি ছিলেন তোফায়েল আহমেদ। সিরাজুল আলম খান এই আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত থাকলেও তিনি লোকচক্ষুর অন্তরালে থাকতে বেশি পছন্দ করতেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়াও প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা এই আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। ঢাকার বাইরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের ভূমিকাও স্মরণযোগ্য। আদমজী আর টঙ্গীর শ্রমিকরা এই আন্দোলনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর দূর্ভাগ্যবশত এই ইতিহাস সৃষ্টি করা ছাত্র নেতৃবৃন্দের অনেকেই প্রতিক্রিয়াশীল বা ভিন্ন রাজনীতির সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়েন। কেউ কেউ রাজনীতি ছেড়ে ব্যবসা বাণিজ্য শুরু করেছেন। এদের দু’একজন মৃত্যুবরণ করেছেন। এদের মধ্যে এখনো রাজনীতিতে বেশ সক্রিয় আছেন তোফায়েল আহমেদ।
পূর্ব বাংলায় সকল রাজনৈতিক আন্দোলনে আওয়ামী লীগ জোরালো ভূমিকা রাখলেও নানা কারণে ঊনসত্তরের গণআন্দোলন অথবা তার পূর্ববর্তী সময়ের আইয়ূব বিরোধী আন্দোলনে আগের মতো সক্রিয় ভূমিকা রাখা তাদের পক্ষে সম্ভব ছিল না কারণ এই সময়ে আওয়ামী লীগের প্রথম কাতারের সকল নেতাই কারাগারে ছিলেন। আর তখন শেখ মুজিবকে (তখনো তিনি বঙ্গবন্ধু উপাধিতে ভূষিত হন নি) আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় জড়িয়ে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে ঢাকা সেনানিবাসে সামিরক ট্রাইবুনারের মুখোমুখি করা হয় । ১৯৬৩ সালে আওয়ামী লীগের সভাপতি হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী সুদূর বৈরুতে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। ১৯৫৭ সালে আওয়ামী লীগের প্রথম সভাপতি মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানি আওয়ামী লীগ হতে বের হয়ে ন্যাপ গঠন করেন। ১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু ছয় দফা ঘোষণা করলে আওয়ামী লীগের তৎকালীন সভাপতি আবদুর রশিদ তর্কবাগিশও আওয়ামী লীগ হতে বের হয়ে পাল্টা আওয়ামী লীগ গঠন করেন। এটি আওয়ামী লীগের জন্যও বেশ একটি কঠিন সময় ছিল । তবে ইতোপূর্বে কর্মীদের উপর ভর করে আওয়ামী লীগ যে ভাবে শত ঝড় ঝাপটা মোকাবেলা করে উঠে দাঁড়িয়েছিল একই ভাবে দলটি উঠে দাঁড়িয়েছিল ষাটের দশকে ।
১৯৫৮ সালে জেনারেল আইয়ূব খান পাকিস্তানে সামরিক আইন জারি করলে প্রথম দিকে তিনি তেমন কোন রাজনৈতিক প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হন নি। কারণ সে সময় পাকিস্তানে দলীয় রাজনীতি তেমন একটা শক্তি সঞ্চার করতে পারে নি। রাজনৈতিক দলগুলোও ছিল আঞ্চলিক। পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা রাজনৈতিক দল হিসেবে মুসলীম লীগ পরিচিত থাকলেও পাকিস্তান সৃষ্টি হওয়ার পর তা অনেকটা অকার্যকর হয়ে পড়ে। পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ ১৯৪৮ সালে সেপ্টেম্বর মাসে বিনা চিকিৎসায় কোয়েটায় (মতান্তরে বিকল এম্বুলেন্সের ভিতর, করাচিতে) করুণভাবে মৃত্যুবরণ করলে মুসলীম লীগের হাল ধরার মতো তেমন কোন দক্ষ নেতা ছিলেন না। কিছুদিন জোড়াতালি দিয়ে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখলেও ১৯৫৮ সাল নাগাদ মুসলীগ লীগ অনেকটা বিলীন হয়ে যায়। এ’সময় আওয়ামী লীগই একমাত্র রাজনৈতিক দল ছিল যেটি পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর বাঙালিদের প্রতি বৈষম্যমূলক ও বড়ভাই সুলভ আচরণের প্রতিবাদ করতে পেরেছিল। এই আওয়ামী লীগই ১৯৪৯ সাল হতে পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসনের দাবি করে আসছে। এই সময় পাকিস্তানে কমিউনিস্ট পার্টির কর্মকান্ড নিষিদ্ধ ছিল। তবে তারা ন্যাপ বা অন্যান্য নামে রাজনীতি করার চেষ্টা করেছে। শক্তিশালী কোন ভূমিকা রাখার তেমন একটা সক্ষমতাও তাদের ছিল না। আইয়ূব খান সামরিক আইন জারি করে প্রথমে যে কাজটি করেন তা হচ্ছে আওয়ামী লীগসহ সকল রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠান। দেশে সকল ধরনের রাজনৈতিক কর্মকান্ডও নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। কোন নেতা আদালত হতে জামিন নিয়ে মুক্তি পেলে তাঁকে অনেক সময় কারা ফটক হতেই আটক করা হতো। অধিকাংশ সময় এটি জুটতো আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দের ভাগ্যে।
ষাটের দশকের মাঝামাঝি সময়ে পাকিস্তানে আইয়ূব বিরোধী আন্দোলন দানা বাঁধতে শুরু করে। ১৯৬৬ সালে পশ্চিম পাকিস্তানের লাহোরে বিভিন্ন বিরোধী দলের সমন্বয়ে গঠিত একটি জাতীয় কনফারেন্স অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে প্রথমবারের মতো শেখ মুজিব বাঙালির মুক্তির সনদ ছয় দফা পেশ করেন এবং বলেন এই ছয় দফা বাস্তবায়ন হলে শুধু বাঙালিরাই লাভবান হবে না পাকিস্তানের সব প্রদেশের মানুষ সমানভাবে লাভবান হবেন। দেশে ফিরে তিনি চট্টগ্রামের লালদীঘি ময়দানে প্রকাশ্য জনসভায় ছয় দফা ঘোষণা করেন যা জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে গ্রহণ করে। কিন্তু পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী এই ছয় দফাকে পাকিস্তানের অখ-তাকে বিনষ্ট করার এক গভীর ষড়যন্ত্র হিসেবে আখ্যায়িত করে এবং ১৯৬৬ সালের ৮ মে নারায়ণগঞ্জের এক জনসভা হতে শেখ মুজিবকে গ্রেপ্তার করা হয়। শেখ মুজিবকে গ্রেফতারই ছিল আইয়ূব খানের পতনের প্রথম ধাপ। এই গ্রেফতারের প্রতিবাদে সারা দেশে আওয়ামী লীগের নেতা কর্মীরা জঙ্গি মিছিল বের করে। পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের বিরোধী দলের সদস্যরা এই গ্রেফতারের প্রতিবাদ করেন। শেখ মুজিব ছাড়াও দেশের বিভিন্ন জেলা হতে নেতাদের গ্রেফতার অব্যাহত থাকে। জেল থেকে শেখ মুজিব বিরোধী দলের নেতাদের ওপর চলমান নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হিসেবে ৭ জুন সারা দেশে হরতাল পালনের আহ্বান জানান। এই সময় ঢাকা হতে প্রকাশিত দুটি বাংলা দৈনিক সরকারের নির্যাতনের বিরুদ্ধে জোরালো ভূমিকা রাখে। প্রথমটি দৈনিক ইত্তেফাক আর অন্যটি দৈনিক আজাদ। ছয় দফা প্রচারের ক্ষেত্রে দৈনিক ইত্তেফাকের ভূমিকা ছিল বেশ জোরালো। সকল বাধা উপেক্ষা করে ৭ জুন সারাদেশে হরতাল পালন করা হয়। আইয়ূব খানের ধারণা ছিল শেখ মুজিবকে একটি রাষ্ট্রদ্রোহিতামূলক মামলায় ফাঁসানো গেলে তিনি তাঁর রাজনৈতিক কর্মকান্ড দমন করতে পারবেন। ১৯৬৮ সালের জুন মাসের ১৯ তারিখ আইয়ূব খানের নির্দেশে শেখ মুজিবসহ তাঁর সঙ্গে আটক তাঁর রাজনৈতিক সহকর্মী ও বেশ কিছু সামরিক বাহিনী ও বেসামরিক প্রশাসনের বাঙালি সদস্যদের বিরুদ্ধে পূর্ব বাংলাকে পাকিস্তান হতে বিচ্ছিন্ন করতে ষড়যন্ত্র করার অভিযোগ এনে রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিব এবং অন্যান্য (আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা নামে খ্যাত) ঋজু করে ঢাকা সেনানিবাসে এক সামরিক ট্রাইবুনালে তাঁদের বিচার শুরু কওে যা ইতোপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে। বিচারে দোষী সাব্যস্ত হলে মৃত্যুদন্ড নিশ্চিত।
পাকিস্তানের সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য পূর্বে উল্লেখিত ছাত্র নেতারা ১৯৬৯ সালে ৫ জানুয়ারি ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন করেন। এর পূর্বে অবশ্য পৃথক পৃথক ভাবে ছাত্র লীগ ও ছাত্র ইউনিয়ন আইয়ূব বিরোধী আন্দোলন করে আসছিল। এই প্রথমবার সকল ছাত্র সংগঠন ও ডাকসু একই প্লাটফর্মে এসে আইয়ূব সরকারের বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন গড়ে তুলতে সক্ষম হয়। প্রণীত হয় এগার দফা যার অন্যতম ছিল শেখ মুজিবসহ সকল রাজবন্দিকে মুক্তি ও আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার। এগার দফার মধ্যে ছয় দফাও অন্তর্ভুক্ত করা হয়। সেই আন্দোলনে ছাত্র ও শ্রমিকদের অংশগ্রহণ ছাড়াও দেশের সকল শ্রেণীর সাধারণ মানুষ অংশগ্রহণ করে। খুব দ্রুত গতিতে ঢাকাসহ দেশের বড় বড় শহরের সকল রাজপথ চলে যায় ছাত্র জনতার দখলে। অন্যদিকে সরকারের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাদের নির্যাতনের মাত্রা বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়। সভা সমাবেশের ওপর নির্বিচারে গুলি চলতে থাকে।
আগরতলা মামলার শুনানি শুরু হওয়ার পর হতেই দ্রুত পূর্ব বাংলার পরিস্থিতি সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে থাকে। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতাদের নির্দেশই হয়ে উঠে প্রশাসনিক নির্দেশ। বেলা দশটা হলেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কলাভবনের সামনের বটতলায় ঢাকা শহরের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা জড়ো হতে শুরু করে ছাত্র নেতৃবৃন্দ কী নির্দেশ দেয় তা শোনার জন্য। সভা শেষে শিক্ষার্থীরা যাতে কোন মিছিল বের করতে না পারে তার জন্য প্রায় প্রতিদিনই ঢাকা শহরে ১৪৪ ধারা জারি করা হতো আর রাতে থাকতো কারফিউ। তাতেও কিন্তু ছাত্র সমাজ দমে যায় নি। মিছিল ঠিকই বের হতো আর প্রয়োজনে কারফিউ ভাঙ্গা হতো। অন্য দিকে পুলিশ আর ইপিআর নির্বিচারে মিছিলের উপর গুলি চালাতে দ্বিধা বোধ করতো না। ১৯৬৯ সনের ২০ জানুয়ারি ঢাকা মেডিকেল কলেজের সামনে এমন এক ছাত্র মিছিলে পুলিশ গুলি করলে ছাত্র ইউনিয়ন নেতা আসাদুজ্জামান নিহত হন। একই দিন শহরের অন্যান্য এলাকায় পুলিশের গুলিতে নিহত হন সাংবাদিকসহ চার জন। আসাদের মৃত্যু একটি গণআন্দোলনকে গণঅভ্যুত্থানের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যায়। পুলিশ আসাদের লাশ নিয়ে যায়। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ পরদিন ঢাকায় এবং ২৪ তারিখ সারাদেশে হরতাল আহ্বান করে। ২৪ জানুয়ারি হরতাল চলাকালে ঢাকায় ছাত্র মিছিলে পুলিশ গুলিবর্ষণ করলে ঢাকা নব কুমার ইনস্টিটিউটের নবম শ্রেণীর ছাত্র মতিউর রহমান মল্লিক নিহত হয়। মতিউর ছাড়াও এদিন কমপক্ষে আরো তিনজন নিহত হয়। এদিন উত্তেজিত জনতা সরকারের মালিকানাধীন দৈনিক পাকিস্তান ও ইংরেজি দৈনিক মর্নিং নিউজ ভবনে অগ্নিসংযোগ করে। সরকার প্রাদেশিক রাজধানী ঢাকার ওপর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। তলব করা হয় সেনাবাহিনী। ২৪ ঘন্টার জন্য জারি করা হয় কারফিউ। কিন্তু এত কিছুর পরও আন্দোলনে কোন প্রভাব পড়ে নি বরং প্রতিটি মৃত্যুর সাথে আন্দোলন আরো তীব্র হচ্ছিল। পূর্ব বাংলা ছাড়াও পশ্চিম পাকিস্তানের বিভিন্ন শহরেও আইয়ূব বিরোধী আন্দোলন দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে।
২৪ জানুয়ারি ঘটনার পর খুব দ্রুত পূর্ব বাংলার বেসামরিক প্রশাসন ছাত্র সংগ্রম পরিষদের হাতে চলে যেতে থাকে । অন্য দিকে জনগণের উপর সরকারের বেপরোয়া নির্যাতনের মাত্রাও দ্রুত বাড়তে থাকে । বিভিন্ন শহরে সেনা বাহিনী নামানো হয় । সেনা বাহিনী, ইপিআর, পুলিশ নির্বিচারে গুলি করতে থাকে ছাত্র জনতার নিরস্ত্র মিছিলের উপর । মৃত্যুর মিছিল দীর্ঘ হতে থাকে । ছাত্রদের নেতৃত্বে এই আন্দোলনে সমাজের সর্বস্তরের মানুষ সমর্থন জানায় এবং আন্দোলনকে বেগবান করতে তাতে শরিক হন । ১৯৬৯ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি ঢাকা সেনা নিবাসে সেনারক্ষীদের গুলিতে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার অন্যতম অভিযুক্ত সার্জেন্ট জহুরুল হক নিহত হন। ১৮ই ফেব্রুয়ারি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড: সামসুজ্জোহাকে সেনা বাহিনী বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ফটকের কাছে গুলি করে হত্যা করে । সেই উত্তাল সময়ের অগ্নিষ্ফুলিঙ্গ সারা দেশে ছড়িয়ে পরে । আইয়ূব খান মনে করেছিলেন তিনি শেখ মুজিবকে মুক্তি দিলে পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত হতে পারে। ২২ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানের লৌহমানব হিসেবে খ্যাত ফিল্ড মার্শাল আইয়ূব খান আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করে শেখ মুজিব সহ সকল অভিযুক্তদের মুক্তি দিতে বাধ্য হন । ২৩ ফেব্রুয়ারি কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ রেস কোর্সেও বিশাল জনসভায় শেখ মুজিবকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করে । বাংলার মানুষ বঙ্গবন্ধুকে তাদের মাঝে পেয়ে নব উদ্যোমে বাঙালির মুক্তি সংগ্রামের সূচনা করেন । পূর্ব বাংলার ছাত্র নেতৃত্ব পাকিস্তানের এই অংশের সম্পূর্ণ বেসামরিক নিয়ন্ত্রণ তাদেও হাতে নিয়ে নেয় । তাদের সাথে এখন বঙ্গবন্ধু আছে । ভয়কে তারা জয় করতে শিখেছে । শেষ চেষ্টা হিসেবে আইয়ূব খান একটি সমঝোতা বৈঠকের মাধ্যম পরিস্থিতির সামাল দেওয়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন । অবস্থা বেগতিক দেখে আইয়ূব খান ২৪ মার্চ পাকিস্তানের শাসনভার সেনা প্রধান ইয়াহিয়া খানের কাছে হস্তান্তর করেন । সেই রাতেই ইয়াহিয়া খান পাকিস্তানে দ্বিতীয়বারের মতো সামরিক আইন জারি করে পাকিস্তানের কফিনে শেষ পেরেকটা ঠুকে দেন । ঊনসত্তরের গণআন্দোলন বাঙালির সহস্র বছরের সংগ্রামের ইতিহাসে একটি কালোত্তীর্ণ অধ্যায় । গণঅভ্যুত্থানের সকল শহীদদের স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধ ।
লেখক: বিশ্লেষক ও গবেষক । জানুয়ারি ২০, ২০১৭