|
||||||||||||||||||
|
শিক্ষাব্যবস্থা জনগনকে জনশক্তিতে রূপান্তর করতে হবে
WARNING: Any unauthorized use or reproduction of 'Community' content is strictly prohibited and constitutes copyright infringement liable to legal action.
|
লেখকের আগের লেখাঃ
|
দুই ধরণের বিদেশি বাংলাদেশে কর্মরত আছেন । যারা বলেন দেশে যোগ্যতা সম্পন্ন মেধা বা দক্ষতা সম্পন্ন মানুষ পাওয়া যায় না বলে তারা বিদেশ হতে কর্মী বা কর্মকর্তা আনতে বাধ্য হন তারা আংশিক সত্য কথা বলেন । যেমন ধরুন স্কুল শিক্ষক । এই দেশে অনেক সাহেবী স্কুল আছে যেখানে শিক্ষকতা করার জন্য বিদেশী হতে শিক্ষক আমদানি করা হয় । স্কুলে শিক্ষকতা করার জন্য এই দেশে শিক্ষক পাওয়া যায় না তা কেন বিশ্বাস করতে হবে? কয়েকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আছে যাদের বিদেশ প্রীতি প্রবাদ তুল্য । তাদের ধারণা সাদা চামড়ার বা বিদেশী তকমাধারি শিক্ষক নিয়োগ দিলে তাদের গ্ল্যামার বাড়বে, শিক্ষার্থীদের কাছ হতে লাগামহীন ফী নেওয়া যাবে এবং সেই অর্থের একটি বড় অংশ লুটপাট করে শিক্ষা সফরের নামে সপরিবারে বিদেশ বিলাস ভ্রমণ করা যাবে । যে সব বিদেশী এই সব বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকুরি করেন তাদের মধ্যে কিছু পন্ডিতজন আছেন সত্য কিন্তু বেশ কিছু আছেন যারা নিজ দেশে চাকুরি না পেয়ে এই দেশে সপরিবারে এই সব বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজ করেন, এমন কী তারা বাংলাদেশের ইতিহাস পর্যন্ত পড়ান । তাদের মোটা অংকের বেতন দেওয়া হয়, কাগজে কলমে অনেক সময় পরিমাণটা কম দেখানো হয় । সাথে থাকার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের খরচে একটি এপার্টমেন্ট ভাড়া করে দেওয়া হয় । আর এই সব ব্যক্তিরা কোন কারণ ছাড়া বাংলাদেশের নানা বিষয়, সরকার এবং ব্যক্তি নিয়ে কটূক্তি করেন । তাদের কাছে শিক্ষামন্ত্রণালয় অথবা বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন ক্ষমতাহীন প্রতিষ্ঠান । সরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রতি এমন অবজ্ঞা সুলভ মন্তব্য অন্য কোন দেশে সম্ভব নয় । এই সব ব্যক্তি সম্পর্কে কোথাও অভিযোগ জানানোর কোন উপায় নেই কারণ এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যারা পরিচালনা করেন তাদের হাত অনেক লম্বা ।
এই সবের পাশাপাশি বাংলাদেশে অন্যান্য ক্ষেত্রে যে এত বিপুল সংখ্যক বিদেশি কর্মরত আছেন তারও কিন্তু যৌক্তিকতা আছে । একাধিক শিল্পোদোক্তা আর ব্যবসায়ীর কাছে জানতে চেয়েছিলাম তারা কেন দেশী কর্মকর্তা বা কর্মচারি নিয়োগের পরিবর্তে বিদেশিদের দ্বিগুন বেতন দিয়ে নিায়াগ দেন । তাদের উত্তর অনেকটা অভিন্ন । তারা বলেন দেশে দক্ষ জনশক্তির প্রচন্ড অভাব । এই বক্তব্যের সাথে দ্বিমত করার কোন অবকাশ নেই । ফিলিপাইনের ত্রিশ লক্ষ শ্রমিক বিদেশে কাজ করেন । তারা নিজ দেশে প্রতি বছর রেমিটেন্স পাঠান নব্বই বিলিয়ন ডলার । আর বাংলাদেশের নব্বই লাখ মানুষ বিশ্বের নানা দেশে কাজ করে দেশে রেমিটেন্স পাঠান ষোল বিলিয়ন ডলার । এর একমাত্র কারণ হচ্ছে বিদেশে বেশীরভাগ বাংলাদেশীরা অদক্ষ শ্রমিক হিসেবে কাজ করেন । তাদের বেতন একজন ফিলিপিনো বা ভারতীয় শ্রমিকের তুলনায় এক তৃতীয়াংশ বা তারও কম। বাংলাদেশ সৌদি আরবে গৃহকর্মী পাঠাতে অনেক বেশী উৎসাহী । অন্যদিকে ফিলিপাইন, ভারত, শ্রীলংকা বা ইন্দোনেশিয়া হতে যাচ্ছে ডাক্তার, প্রকৌশলী বা নার্স । এই সব দক্ষতা যোগাতে সরকারের উদ্যোগ থাকলেও বাংলাদেশের মানুষের তা গ্রহণের অনীহা লক্ষণীয় । এই দেশে একজন শিক্ষার্থী এইচএসসি পাশ করলে কারিগরি শিক্ষার প্রতি তার তেমন আগ্রহ লক্ষ্য করা যায় না । সে ভর্তি হতে চায় বিশ্ববিদ্যালয়ে । পড়তে চায় বিবিএ বা এমবিএ । তা না পেলে ট্রিপল-ই বা কম্পিউটার বিজ্ঞান । তাও না পেলে অন্য কোন বিষয় । তার বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া চাই । এই সবের সুযোগ নিয়ে বেশ কিছু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় লাগামহীন ভাবে সার্টিফিকেট বাণিজ্য করছে । আর কিছু আছে যেনতেন ভাবে জোড়া তালি দিয়ে কিছু ক্লাস করিয়ে শিক্ষার্থও হাতে একটি মূল্যহীন সার্টিফিকেট তুলে দিচ্ছে । এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে গেলে তারা সঙ্গে সঙ্গে আদালতের শরণাপন্ন হয় এবং একটি স্টে-অর্ডার নিয়ে বছরের পর বছর তাদের কুকর্ম চালিয়ে যায় । দেশে এই রকম বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ডজনখানেক হবে । বেসরকারি পর্যায়ে ভাল বিশ্ববিদ্যালয়ও আছে তবে তার সংখ্যা হাতে গোনা । সরকারি বা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় হতে যে সকল গ্র্যাজুয়েট পাশ করে বের হচ্ছে, তাদের একটি উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বেকার যার অন্যতম কারণ তাদের মনোভাবগত (অঃঃরঃঁফব) সমস্যা । নতুন কিছু শেখার প্রতি তাদের অনাগ্রহ আছে । তারা বুঝতে অপারগ বিশ্ববিদ্যালয় বা কলেজ পর্যায়ে যা শেখানো হয় তার উপর নির্ভর করে বাস্তব জগতে বেশী দূর যাওয়া যায় না । দেশ দুনিয়া সম্পর্কে তাদের অজ্ঞতা সীমাহীন । অধিকাংশই দৈনিক পত্রিকা পড়ে না । ভাষার জ্ঞানের যথেষ্ট অভাব আছে । ডিজিটাল বাংলাদেশের যুগে কম্পিউটার জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা অমার্জনীয় । কোন বিষয় পরিষ্কার ভাবে উপস্থাপনা করতে দক্ষতার অভাব আছে । প্রয়োজনে তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নিতে দ্বিধাগ্রস্থ থাকে । তারা সব সময় অফিসে কাজ করতে আগ্রহী । মাঠে ময়দানে (ড়হ ংরঃব) কাজ করতে তারা নারাজ । এই সবের ঘাটতির জন্য একক ভাবে তাদের দায়ী করাটা অন্যায় হবে । আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা পরীক্ষা নির্ভর হওয়াতে এই অবস্থা হয়েছে । শ্রেণী কক্ষে একজন শিক্ষকের দায়িত্ব হচ্ছে একজন শিক্ষার্থীর জ্ঞানের রাজ্যটাকে প্রসারিত করার জন্য তাকে উৎসাহিত করা বা জ্ঞানের দরজাটাকে খুলে দেওয়া যা আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় অনুপস্থিত । এর ফলে বাংলাদেশে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা জ্যামিতিক হারে বাড়ছে আর তাতে ইন্ধন জোগাচ্ছে এক শ্রেণীর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান । সরকার কারিগরি শিক্ষা আর বিশেষায়িত শিক্ষার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় বা কলেজের অনুমোদন দেয় । শুরুতেই এই সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বিবিএ আর এমবিএ প্রোগ্রাম খোলার জন্য ব্যস্ত হয়ে পরে যা কাম্য নয় । ভারতে ঝাড়–দার পদের জন্য এখন এমবিএ পাশ করারাও আবেদন করছে । বাংলাদেশে আগামীতে তেমনটি ঘটলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না । তা যদি হয় তা হলে মেধা ও তারুণ্যের যে অপচয় হবে তা হবে অমার্জনীয় ।
এই মুহূর্তে বাংলাদেশের সব চেয়ে বড় সম্পদ হচ্ছে এর তরুণ জনগোষ্ঠী । জাতিসংঘের হিসাব মতে বাংলাদেশের চল্লিশ ভাগ মানুষের বয়সের বয়স ২৬ বছরের নীচে । এই মানুষগুলোকে জনসম্পদে রূপান্তর করতে পারলে বাংলাদেশকে আর পিছনে ফিরে তাকাতে হবে না । এটি করতে হলে শুধু মাত্র বিশ্ববিদ্যালয় নির্ভর শিক্ষা ব্যবস্থার উপর নির্ভর করলে হবে না । গুরুত্ব দিতে হবে কারিগরি আর বৃত্তিমূলক শিক্ষার উপর । একজন মোটর মেকানিক বা নার্স দেশে বা বিদেশে মাসে যা আয় করে অনেক সময় একজন বিশ্ববিদ্যালয় গ্র্যাজুয়েট তা করতে পারে না । বাংলাদেশে বর্তমানে তৈরী পোষাক শিল্পের রমরমা অবস্থা । কুড়ি বছর পর সেটি আর হয়তো থাকবে না । এই দেশে এখন উঠতি শিল্পের মধ্যে আছে ঔষধ, স্বাস্থ্য, জাহাজ তৈরী, পোলট্রি, খুচরা যন্ত্রপাতি তৈরী, আইটি, ইলেক্ট্রনিক্স যন্ত্রপাতি সংযোজন খাত ইত্যাদি । ভারতে বিশ্বের প্রায় সকল গাড়ী প্রস্তুতকারি প্রতিষ্ঠান তাদের সংযোজন কারখানা স্থাপন করেছে । বাংলাদেশে দক্ষ জনশক্তি ও উপযুক্ত অবকাঠামোগত সুবিধা দিলে তেমন প্রতিষ্ঠান এ’দেশে স্থাপিত না হওয়ার কোন কারণ নেই । মনে রাখতে হবে আগামী এক দশকে বাংলাদেশের বড় প্রতিদ্বন্ধী হয়ে উঠতে পারে মায়ানমার । তাদের অথবা ভারতের সাথে পাল্লা দিতে হলে আমাদের দক্ষ জনশক্তি তৈরি করার কোন বিকল্প নেই । শিক্ষাঙ্গন হতে ধান্ধাবাজ আর ফেরেব বাজদের বিদায় করতে না পারলে শিক্ষা ক্ষেত্র প্রসার ও উন্নয়নে সরকারের সকল প্রচেষ্টা ব্যর্থ হতে বাধ্য । সেটি করার জন্য চাই শিক্ষা প্রশাসনের সাথে যেই সব মন্ত্রণালয় বা প্রতিষ্ঠান আছে তাদের আরো শক্তিশালী করা । স্কুল হোক আর বিশ্ববিদ্যালয় বিদেশী শিক্ষক বা কর্মকর্তা নিয়োগ করতে হলে তা যাচাই বাচাই করা ও প্রয়োজনীয়তা নির্ণয় করার জন্য চাই কঠোর আইন । এমন আইন বিশ্বের সকল দেশে আছে । বর্তমানে নিয়োগের জন্য বোর্ড অব ইনভেস্টমন্টে হতে অনুমোতি নেওয়ার নিয়ম আছে । অনেক ক্ষেত্রে তাও মানা হয় না । আমাদের দেশে যত বড় প-িতই হোক না কেন তার পক্ষে ভারতে গিয়ে শিক্ষকতা করা সহজে সম্ভব নয় । কিন্তু ঠিক তার উল্টোটা ঘটে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে । যে ব্যক্তি নিজ দেশে চাকুরী পায় না সে এই দেশে এসে বড় বেতনের চাকুরি বাগিয়ে বেশ বহাল তবিয়তে থাকেন । আর তাকে যত বেতন দেয় অনেক ক্ষেত্রে তার সমপরিমাণ অর্থ চাকুরিদাতারা বিদেশে পাচার করেন বলে অভিযোগ আছে । শিক্ষা ক্ষেত্রে এমন অরাজক অবস্থা দূর করতে না পারলে বিদেশ থেকে মানুষ এসে আমাদের দেশের মানুষের চাকুরি নিয়ে যাবে আর দেশ হতে বছরে কয়েক বিলিয়ন ডলার সমপরিমাণ অর্থ বৈধ অথবা অবৈধ পথে বিদেশে পাচার হবে । এই দেশের ব্যবসায়ী বা শিল্পোদ্যোক্তাদের দেশপ্রেম নিয়ে কোন সন্দেহ নেই । তাদের কারণেই বাংলাদেশ একটি কৃষি নির্ভর দেশ হতে এখন সেবা ও ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প নির্ভর দেশে উন্নিত হয়েছে । এই দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে বেসরকারি খাতের অবদান অপরিসীম । তারা যদি এই দেশের শিক্ষাখাতের দিকে একটু নজর দেন তা হলে রাতারাতি পরিবর্তন হতে পারে অনেক কিছুরই । ভারতের টাটা শিল্পগোষ্ঠী হতে পারে তাদের জন্য একটি বড় উদাহরণ । স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করে তাকে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান হিসেবে ব্যবহার না করে সেগুলোকে দেশের কল্যাণে সহায়তা করলে এক দশকেই পাল্টে যেতে পারে দেশের সার্বিক চিত্র । পুরো বিষয়ের সার্বিক পরিবর্তন করতে চাইলে প্রয়োজন সংশ্লিষ্ট সকল মহলের সম্মিলিত উদ্যোগ আর সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান সমূহের কঠোর নজরদারি ।
লেখক: বিশ্লেষক ও গবেষক । ৯ অক্টোবর, ২০১৬