|
||||||||||||||||||
|
পান্থ পৌর্বাপর্য (অষ্টাদশ পর্ব) এ,কে,এম,নূরুন্নবী
বায়েজিদ বোস্তামির মাজার থেকে একটি মাইক্রো ভাড়া করে আমরা ফয়েস লেকে
গেলাম। খুলশি এলাকায় ৩৩৬ একর জমির উপর এই কৃত্রিম লেকটির অবস্থান। ১৯২৪
সালে বেঙ্গল রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ রেল প্রকৌশলী ফয়েস এর নামানুসারে এর
নামকরণ করেন ফয়েস লেক।এই লেকের কিনারায় রয়েছে আরো একটি কৃত্রিম লেক।
যা বড় বাটালি হিল পাহাড় সংলগ্ন। বাটালি হিল পাহাড়টি চট্রগ্রামের সবচেয়ে
উঁচু পাহাড়। উচ্চতা ২৮০ ফুট।এই লেক দুটি খনন করা হয় মূলত শহর এলাকায়
পানি সরবরাহের জন্য। আমরা ঘুরে ঘুরে এই অতুলনীয় লেক দুটি দেখলাম। লেকে
ভ্রমণের জন্য রয়েছে নৌকা। দর্শনার্থীর জন্য রয়েছে চিড়িয়াখানা,
রেস্তোরা ও থাকার জন্য রয়েছে রেস্ট হাউস। আগ্রাবাদ বাণিজ্যিক এলাকায়
রয়েছে একটি জাদুঘর।এর পর আমরা চট্রগ্রাম ওয়ার সেমেট্রি স্মৃতি সৌধে
গেলাম। এখানে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নিহত ৪০০ সৈন্যের কবর আছে।
সেখান থেকে আমরা চট্রগ্রাম শহরের ঐতিহ্যবাহী লালদীঘি ও আন্দরকিল্লা
পোঁছলাম। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ১৭৬১ সালে চট্রগ্রামের শাসনভার গ্রহণ
করে। তার পর তারা সেখানে এন্তেকালী কাচারি ঘর, জেলখানা ও ছোট পুকুরটি
কেটে বড় করা এবং পুকুরটির পাশের ঘর দুটি লাল রং করে।আর ঐ ঘরের
পাহাড়াদার দুজনের মাথার পাগড়ীও ছিল লাল।এ থেকে ঐ এলাকার নাম হয় লাল দীঘি।এর
মালিক ছিলেন জমিদার রায় বাহাদুর রাজকমল। তিনি মাঝে মাঝে অবসর যাপন
করতেন এই দীঘির পাড়ের লাল ঘরে। দীঘির পাড়ে বিরাট একটি ময়দান আছে। সেখান
থেকে আমরা রিকেট ঘাটে গেলাম।লালদীঘির কিংবদন্তি নিয়ে চট্রগ্রামের
উইকিপিডিয়া ও মানুষের মুখে মুখে একটি মজার কথা প্রচলিত আছে।তা
হলো,পুকুরের পানির নিচেই ছিল এ বাদশার রাজদরবার। ঐ বাদশা লাল বেগম নামে
এক মেয়েকে বিয়ে করবেন বলে মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলেন।একদিন বাদশা লাল
বেগমকে দেখতে চাইলেন,তাই পাইক পেয়াদা আমলাদেরকে বললেন লাল বেগমকে তিনি
দেখতে চান। কিন্তু খোঁজ নিয়ে জানা গেলো লাল বেগম এক ক্রীতদাসের সাথে
পালিয়ে গেছেন।এ খবর বাদশার জানা ছিল না।তাই রাজ দরবারের সব আমলা ঠিক
করলেন অন্য একজন মেয়েকে ধরে এনে বাদশার সম্মুখে লাল বেগমের অভিনয়
করাবেন। করাও হলো তাই। একজন দিন মজুরের মেয়ে ঐ দীঘিতে গোসল করতে এলে
তাকে পায়ে শিকল বেঁধে নিয়ে যাওয়া হলো পানির নিচে।তার পর তাকে লাল
বেগমের অভিনয় করার জন্য বাদশার সম্মুখে হাজির করা হলো। বাদশা কথা
বললেন মেয়েটির সাথে। কথায় কথায় বাদশা মেয়েটির আসল পরিচয় জেনে গেলেন।বাদশা
ক্ষুব্ধ হলেন। উজির আমলা পেয়াদা সবাই ভয় পেয়ে গেলেন।বাদশা লাল বেগমকে
খোঁজার নির্দেশ দিলেন।সবাই মিলে খুঁজতে লাগলেন লাল বেগমকে। অবশেষে জানা
গেল অন্দর কিল্লা দীঘি থেকে দুশ হাত দূরে পর্তুগীজদের কিল্লায় লাল বেগম
আছে। বাদশা ঐ কিল্লা আক্রমণের নির্দেশ দিলেন।অনেক হতা হত হলো। দীঘির
পানি লালে লাল হয়ে গেল। যুদ্ধে বাদশা পরাজিত হলেন। সবাই পালিয়ে গেলেও
বাদশা দীঘির পাড়ে থেকে যান লাল বেগমকে উদ্ধারের জন্য। লালদীঘির পাড়ে
১৯১০ সালে বৈশাখের ১২ তারিখ আবদুল জব্বার সর্বপ্রথম বলীখেলার অনুষ্ঠান
করেন। তখন থেকে প্রতি বছর বৈশাখের ১২ তারিখ লালদীঘির পাড়ে জব্বারের
বলীখেলা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে।[ বর্তমানে লালদীঘির পশ্চিম পাড়ে একটি
মসজিদ আছে। শহরবাসীর চিত্তবিনোদনের জন্য এখানে একটি সবুজ গাছপালা ঘেরা
পার্ক আছে। এর পর আমরা সেখান থেকে মেধসমুনি আশ্রমে গেলাম। কাকা বাবু
তো আশ্রমে এমন ভাবে আশ্রয় নিলেন যে, আমরা বার বার তাঁকে ইশারা করেও
বের করতে পারছিলাম না। এখানেই আমাদের সন্ধ্যা হয়ে যায়। আমি, মাধবী ও
শিলা আপু সবুজ গাছপালা ঘেরা এক রোমাঞ্চকর স্থানে সময় কাটালাম। মাধবীকে
বললাম মাধবী আমাদের ভালবাসা যেন চির সবুজ হয়। মাধবী বললো , আমাকে কি
তোমার দাজ্জাল মনে হয়। না না মাধবী আমি সে ভাবে কথাটি বলি নেই।
বলেছিলাম সারা দিন কর্মক্লান্ত হয়ে বাসায় তো ফিরতে হবে। আর অবসরের
ফাঁকে তোমাকে যেন আমি বৈচিত্র্যময় একজন সঙ্গি হিসেবে কাছে পাই। কারণ
আবসর সময় টুকু মানুষকে সুন্দর করে। অবসর না থাকলে কি মানুষ গাছে গাছে
ফুলের শোভা দেখতে পেত, দেখতে পেত নদী তরঙ্গের নৃত্যচপল ভঙ্গি,
নক্ষত্রমণ্ডলীর অপরূপ আলোকসজ্জা? এখানেই তো মানুষের লীলারঙ্গ। এখানেই
তো মানুষের নব সৃষ্টির উল্লাস। ও বুঝেছি, এতক্ষণে বুঝলাম।মানুষের
শারীরিকভাবে বাঁচার জন্যে চাই খাদ্য। আর মনের বিকাশের জন্যে চাই মনের
খোরাক। সে খোরাক সে পায় আনন্দ-বিনোদনের মাধ্যমে। দেহ ও মনের
সুখান্বেষণ বিকাশ এর মধ্যদিয়েই মানুষের জীবন হয় উৎকর্ষমন্ডিত। শ্যামল
তোমার পাওনা তুমি আমার কাছ থেকে সব পাবে।তুমি ভিষণ দুষ্ট। শ্যামল আমি
তোমাকে কথা দিলাম আমাদের জীবনটা যেন ছায়াভরা পথে হেঁটে চলে। আমাদের
দিনগুলো যেন অনন্ত সৌন্দর্যের রূপবৈভবে অরণ্যের নিভৃত নির্জনতায় বনে
ঝোপে নতুন ফুল ফোটাবার শিকারে জীবনকে অত্যুজ্জ্বল করে তুলতে
পারি,এটাই হবে আমার অভিপ্রায়। শ্যামল আমি তোমাকে বড্ড বেশি ভাল বেসে
ফেলেছি। তাই আমার বার বার মনে পড়ে "কোথাও আমার হারিয়ে যেতে নেই মানা।"
আমি তোমার মনের বিশালত্বের সমুদ্রে হারিয়ে যেতে চাই। আমার সকল খেয়াল
খুশি তোমার মনের পূর্ণতায় হবে। আর এটাই হবে আমার মহৎ প্রাপ্তি।আমি জানি
ভোগ বিলাসিতায় প্রকৃত সুখ লাভ করা যায় না। প্রকৃত সুখ রয়েছে
আত্মত্যাগের মধ্যে। মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব। এর কারণ মানুষের মনুষ্যত্ব।
মানুষের যে সব কাজ মানবিক গুণাবলীর সাথে সম্পর্কিত সেগুলোর ভিতর দিয়েই
মানুষকে চেনা যায়। পরের জন্য স্বার্থ ত্যাগ করার মধ্যে সে গুণের
শ্রেষ্ঠত্ব প্রকাশ ঘটে।আমি মনে করি অপরের ক্লেশ, অন্তর্বেদনায় যাদের
হৃদয় সহানুভূতিশীল হয়ে ওঠে না,তারা স্বার্থপর ছাড়া আর কিছুই না। তারা
স্বার্থান্ধ। আমি মনে করি তোমার কল্যাণে আমি নিজেকে উৎসর্গ করতে
পারলেই নিজেকে অনন্যসাধারণ মনে করব।তুমি বলো এছাড়া আমি আর তোমার জন্য
কি করতে পারি। মাধবী তুমি জেনে রেখো মানুষের আত্মশক্তিই সবচেয়ে বড়
শক্তি। তোমার নিজের প্রতি তোমার যে আস্থা তাতেই আমি মুগ্ধ। আমি জানি
তুমি একজন শিক্ষিতা জ্ঞানী বুদ্ধীন্দ্রিয় ও আত্মবিশ্বাসী মেয়ে। তোমাকে
আমার জীবনে পাওয়া এটা ভাগ্যের ব্যাপার। মাধবীকে যখন একথাগুলো বলছিলাম
তখন সংবাদ পেলাম কাকা বাবু আশ্রম থেকে বের হয়েছেন। বড় দাদা বললেন, বাবা
আমাদের অনেক সময় নষ্ট করলেন শ্যামল। আমরা আরো দু এক জাগায় যেতে পারতাম।
তা আর হলো না। যাক কাল বাড়ি যেতে চেয়ে ছিলাম সেটাও হলো না। আগামী কাল
আরো কিছু স্থান দেখে তার পর যাব। বৌদি বাবার উপর কিছুটা নাখোশ হলেন।
কাকী মা তো যার পর নেই দাত কিড় মিড় করতে লাগলেন।। অবশেষে কাকা বাবু
বললেন চলো এখন শহরে ফিরে যাই। কাকী মা রাগ করে বললেন,না তোমরা যাও।
আমি যাব না। মন্দিরে রাত কাটাব। সবাই তো হেসে ফেললেন। কারণ কাকী মার
রাগটা ছিল কাকা বাবুর উপর। আমাদের দেখা জায়গা দুটি ছিল চমৎকার। কিছু
সময়ের মধ্যে সেখানকার পুরাকীর্তি ও সভ্যতা এবং জাদুঘর সম্পর্কে জানতে
পেরে আনন্দে মনটা ভরে উঠল। সেখানে রয়েছে অনেক পুরোনো ঐতিহাসিক
নিদর্শন, রয়েছে পাহাড়,পার্ক ক্যাম্প সহ আরো অনেক জানার ও দেখার জিনিস।
এককালে সেখানে বৌদ্ধ ভিক্ষুরা লেখাপড়া ও ধর্মচর্চা করতেন। সেই পুরোনো
আমলের ধ্বংসাবশেষ দেখতে দেখতে গর্ব হল।শত শত বছর আগের ঐতিহ্য আমরা বয়ে
চলেছি। মাধবী ঝটপট করে অনেকগুলো ছবি তুলে ফেলেছিল। আমি ও শিলা আপু
একত্রে দাঁড়িয়ে ছবি তুলেছিলাম। পরে শিলা আপু ক্যামেরা নিয়ে আমার ও
মাধবীর ছবি তুলেছিলেন।জাদুঘরের নিদর্শন গুলো দেখলাম,যা সাজানো গোছানো
ছিল। নানা প্রাচীনকালের হাতিয়ার,তাম্রলিপি,অলঙ্কার,ব্রোঞ্জের
মূর্তি,পোড়ামাটির চিত্রফলক ইত্যাদি দেখে অবাক হলাম। কাকাবাবুর কারণে
সারা দিন আমাদের কারও কোন কিছুই খাওয়া হলো না। দেখতে দেখতে খাবার কথা
যেন একেবারে আমরা সবাই ভুলে গিয়েছিলাম।মাইক্রোতে উঠেই বৌদি বললেন
শ্যামল সারা দিন তো কিছুই খাওয়া হলো না। এ কথা শুনা মাত্রই হাসাহাসির
রোল পড়ে গেল। কাকা বাবু বললেন তাই তো সামনে গিয়ে কিছু খেতে হবে। কাকী
মা তো রাগ সামলাতে পারছিলেন না, তার উপর কাকা বাবু আবার তো খেতে
চাইলেন। কাকী মা এমন অন্তর্দাহ ঝাড়ি দিলেন যে, কাকা বাবু ঐ যে চুপছে
গেলেন তিনি আর কোন কথাই বললেন না। কাকা বাবুর খাবার স্বাদ যেন চিরতের
নি:শেষ হয়ে গেল। আমরা কিছুদূর এসে একটি খাবার হোটেল দেখতে পেলাম। গাড়ি
থেকে সবাই নেমে পড়লাম। হালকা চা নাস্তা করে নিলাম। কাকা বাবু খেলেন না।
তিনি বললেন আমার শরীর টা ভাল না। খেলে অসুবিধা হবে। আসলে কাকা বাবুর এটা
ছিল অভিমানের কথা। কারণ কাকী মা যে ভাবে কাকা বাবুকে ধোলাই দিয়েছিলেন
তাতে না খাবারই কথা। আমি কাকা বাবুর জন্য একটা কেক কিনে এনেছিলাম।
গাড়ির কাছে গিয়ে কাকা বাবুকে বললাম কাকাবাবু আমি আপনার জন্য একটা কেক
এনেছি । কাকাবাবু বললেন তাই নাকি। তা হলে তো ভালই হল। দেও দিনি। কেকটা।
হাতে দিলেই তিনি বললেন পানি এনেছো। জি কাকাবাবু। দেও দিনি পানিটা। এর
মধ্যে সবাই গাড়ির কাছে এসে গেলেন। কাকাবাবু তখনও কেকটা চিবাচ্ছিলেন।কাকী
মা দেখে বললেন,বুড়াটা বলে কিছুই খাবে না। এখন দেখছি একাকি ভালই সাবার
করছে। সবাই যেন হো হো করে হেসে ফেললেন। কাকাবাবুও হেসে ফেললেন। আমরা
রওনা করলাম আমাদের আবাসিক হোটেল অভিমুখে। রাত ৯.৩০ মিনিটে হোটেলে
পৌঁছলাম। এর পর হাত মুখ ধুয়ে খাবার জন্য হোটেলে চলে গেলাম। আমরা
খাবার খেয়ে ফিরলাম। বসে পড়লাম আমাদের আলোচনায়। সবার মন্তব্য জানার
জন্য।বড় দাদা বললেন, জীবন সীমাবদ্ধ ও সংক্ষিপ্ত। শিক্ষার জন্য মানুষকে
জীবনে অনেক কিছুই করতে হয়। তবে মানুষ ইচ্ছে করলেই অনেক সময় অনেক কিছুই
করতে পারে। এর জন্য সময়ের প্রয়োজন । সময় মানুষকে বের করে নিতে হয়।
কারণ মানুষ সময়ের শৃঙ্খলে মানুষের জীবন বাঁধা পরে আছে। একটা নির্দিষ্ট
সময় শেষ হলেই মানুষ মুক্তি পায়। অর্থাৎ মৃত্যুই যার শেষ পরিণাম।আমাদের
ক্ষণস্থায়ী গৌরবময় জীবনকে স্মরণীয় বরণীয় করে তোলার একমাত্র উপায় হচ্ছে
গতিময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে কাজ করা। জীবনের কর্মকান্ডের মধ্যেই মানুষের
যশ,খ্যাতি প্রতিপত্তি নির্ভর করে।জীবনকে সফল ও সার্থক করে তোলার
দায়িত্ব আমাদের নিজের স্কন্ধে বর্তে। মাঝে মাঝে ভ্রমণ করলে কাজের স্পৃহা
পাওয়া যায়। প্রবাদে আছে "সময় ও নদীর স্রোত কারো জন্য অপেক্ষা করে
না।" কাজের পরিমাণ বিবেচনা করে সময়কে ভাগ করে নিলে যথা সময়ে কাজটি
সহজেই সম্পাদন করা যায়। সময়ের কাজ সময়ে না করে ফেলে রাখলে পরবর্তীকালে
তা আর করা হয় না। জীবনের এই সীমাবদ্ধ অবসরে যে ভগ্নাংশটুকু পাওয়া
যায়,তার সদ্ব্যবহারের মাধ্যমেই জীবন সার্থক হয়ে ওঠে। আমরা সীমায়তনে
মধ্যে যে মূল্যবান সময়টুকু পাই তাকে যদি অবহেলায় আলস্যভারে কাটিয়ে
দেই,তা হলে অপচয়ের বেদনা আমাদের জীবনে একদিন মর্মান্তিক দু:খের কারণ হয়ে
দাঁড়াবে।তখন বুক ফাটা আর্তনাদ,অজস্র অশ্রু বর্ষণে কিংবা অনুতাপে সময় আর
ফিরে আসবে না। তাই কবি বলেছেন,
WARNING: Any unauthorized use or reproduction of 'Community' content is strictly prohibited and constitutes copyright infringement liable to legal action.
|
লেখকের আগের লেখাঃ |