|
পান্থ পৌর্বাপর্য ( প্রথম পর্ব)
এ,কে,এম,নূরুন্নবী
সবে মাত্র দেশ স্বাধীন হলো, তখন
আমি চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র। প্রতি বৃহস্প্রতিবার আমাদেরকে বাংলা স্যার
রচনা পড়াতেন। আজ তিনি দেশ ভ্রমণের অভিজ্ঞতা পড়াতে গিয়ে বলেন,আমি যা বলছি
তা তোমরা খাতায় লিখ। কোন জাতিই উন্নতির শিখরে পৌঁছতে পারে না যতক্ষণ
পর্যন্ত সে জাতি দেশ ভ্রমণ না করে। আজ যারা স্মরণীয় পরিব্রাজক, মিশর
চীন মরক্কো গ্রীস স্পেন প্রভৃতি দেশ থেকে পর্যটক হিসেবে ছুটে এসেছিলেন
তাঁরা নিজ জীবনকে তুচ্ছ জ্ঞান করে, অজানাকে জানার জন্যে দেশ- দেশান্তরে
তারা পাড়ি জমান । এ সকল বিশ্ববিখ্যাত পর্যটকদের মধ্যে উল্লেখ যোগ্য
ছিলেন যারা তারা হলেন ,আলবেরুনী, ফা-হিয়েন, হিউয়েন সাং, ইবনে বতুতা,
দীপঙ্কর, ভাস্কো-দাগামা, কলম্বাস, লিভিংস্টোন, ক্যাপ্টেন কুক,
মার্কোপোলো প্রমুখ । তাদের দুঃসাহসিক পর্যটনের ফলে আজ পৃথিবীর বহু
দুর্গম দেশ-দেশান্তর মানুষের জ্ঞানের পরিধি উন্মুক্ত হয়েছে। কত নামহীন
গিরি নদ,কত অজানা অরণ্য- জনপদ,কত বালুকাময় মরুভূমি ও কত তুষারাচ্ছন্ন
মরুপ্রদেশ আবিষ্কৃত হয়ে আজ মানুষের জ্ঞান ভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করেছে।
অতীতকালে দেশভ্রমণ ছিল অত্যন্ত কষ্টসাধ্য ও ব্যয়সাপেক্ষ । যোগাযোগ
ব্যবস্থা প্রযুক্তি তত উন্নত ছিল না। বিমান পথ রেল পথের কথা তো চিন্তাই
করা যায় না। সমুদ্রে পালের জাহাজ স্থল পথে অশ্বারোহণ অথবা পদব্রজেই তারা
দেশ ভ্রমণ করেছেন। বর্তমানে পরিবহনের নানা সুবিধার ফলে দেশভ্রমণ হয়েছে
আগের চেয়ে অনেক সহজ। দেশ-দেশান্তরে রেলপথ বিস্তৃত হয়েছে। তৈরি হয়েছে
বিশালকায় সেতু। রেল,মোটর,এরোপ্লেন ইত্যাদি প্রচলন হওয়ার ফলে পথের
বাধা-বিপত্তিও প্রায় উধাও। ভ্রমণের জন্যে টুরিস্ট ব্যুরো স্থাপিত হয়েছে।
সেখানে পর্যটন স্থান সম্পর্কে পথের বর্ণনা,মানচিত্র প্রকাশ করে
ভ্রমণার্থীদেরকে নানাভাবে সাহায্য করা হয়।
স্যার যখন রচনা বই থেকে পড়াগুলো লিখে দিলেন, ঠিক তখন কেন যেন মনের মধ্যে
জানার এক অপূর্ব নব জাগরনের হৃদ্বোধ হলো। মনে হলো তখনই বেড়িয়ে পড়ি। মন
বললো বই পড়ে যা জানা যায় না তার চেয়ে অনেক বেশি জানা যায় ভ্রমণ করে।
সেদিন থেকে সিদ্ধান্ত নিলাম বাজে পয়সা নষ্ট না করে সঞ্চয় করব। গত তিন
মাসে আমার কাছে জমা হলো পঁয়তাল্লিশ টাকার মত। আমার সহধ্যায়ীর নানার বাড়ি
দিনাজপুর। ওর মুখে প্রথম শুনেছিলাম দিনাজপুরে ধোপাদের নাকি গাধা আছে।
গাধাকে শুধু নামেই চিনি কোন দিন দেখিনি। তাছাড়া ক্লাসে কোন ছাত্র পড়া
করতে না পারলেই স্যার গালাগালি দিতেন তুই একটা গাধা ।
সেই থেকে গাধাকে দেখার জন্য আমার মনে কৌতুহল ছিল।সেই অজানা,অচেনাকে
জানবার জন্যে আমার অসীম আগ্রহ জাগে। বিপুলা এই পৃথিবী,বিশাল তার আয়োজন।কত
বিচিত্র প্রাণী যে পৃথিবীর বুক জুড়ে রয়েছে তার কতটুকু বা আমাদের জানার
সৌভাগ্য হয়,চারিদিকে সবই অজানা,অচেনা। তাই সে দিন দুর্নিবার আকর্ষণে
রুদ্ধ দুয়ার খুলে আমি বেড়িয়ে পড়ি। ভাবতাম গাধা হয়তো মানুষের মত কিছু হবে।
কারণ স্যার তো কোন দিন বলেননি তুই একটা গাধারমত প্রাণী। তাই ইচ্ছা হলো
যে কোন ভাবেই হোক গাধাকে দেখতেই হবে। পরের দিন স্কুলে গিয়ে বাবলুকে
পেলাম বললাম স্যার যে আমাদেরকে গাধা বলে গালি দেয় তুই কী গাধা দেখেছিস।
ও বললো না দেখিনি তবে শুনেছি ,আমার নানার বাড়ীতে ধোপাদের গাধা আছে আমার
দেখা হয়নি। বললাম চল তোর নানার বাড়ি যাই , ও বললো টাকা পয়সা নেই। যাব
কী ভাবে। আমি বললাম চিন্তা করবি না আমার কাছে পঁয়তাল্লিশ টাকা আছে । চল
গাধা দেখে আসি। ও রাজি হয়ে গেল। মাকে বললাম মা আমি কালকে দিনাজপুর যাব।
মা বললেন কেন?
আমি বললাম গাধা দেখতে।
মা হেসে বললেন সামনে আয়না নিয়ে তোকে দেখলেই তো পারিস।
মা এক দিনের জন্য যাব। পরের দিন ফিরে আসব। দেরী করবিনা কিন্তু। তোর বাবা
শুনলে রাগ করবে।
ঠিক আছে।
পরের দিন রেল স্টেশনে গিয়ে দিনাজপুর যাবার জন্য দুটি টিকেট এক টাকা দিয়ে
কিনেছিলাম । ঠিকঠাকমত আমরা ট্রেনে উঠে পার্বতীপুর স্টেশনে নেমে
দিনাজপুরের ট্রেন ধরে চলে গেলাম। দিনাজপুর নেমে সোজা ধোপার বাড়ি। গিয়ে
দেখলাম গরুর বাচ্চার মত একটা প্রাণী চুপচাপ বসে আছে। আমরা গাধাকে খোঁজা
খুঁজি শুরু করলাম। এমন সময় একজন লোক বাড়ি থেকে বের হয়ে আমাদেরকে
জিজ্ঞাস করলেন এই তোমরা কারা। আমি বললাম আমরা অনেক দূর থেকে এসেছি।
আপনাদের নাকি গাধা আছে তাই দেখার জন্য। উনি বললেন ঐ তো বসে আছে ।ঐটাই
তো আমার গাধা। বাবলু বললো ভাই আপনার গাধাকি কথা বলতে পারে। উনি হেঁসে
বললেন পশু কোন দিন কথা বলে? তা হলে গাধা দিয়ে কী করেন। আমরা গাধাকে বোঝা
টানার জন্য ব্যবহার করি। ওর পিঠে মালামাল দিলে ও নিয়ে যায়। আমরা তার
কাছে যেতেই সে দাঁড়িয়ে গেল। মনে মনে ভাবলাম গাধা হয়তো আমাদেরকে সম্মান
করলো। গাধা হয়তো মনে মনে ভাবছে আমি তো গাধা ,আমাকে দেখার জন্য তারা
এসেছে, তারা আবার কোন গাধা ,হয়তো আমার উত্তর সূরি কোন পূর্ব পুরুষ হবে।
তাই হয়তো দাঁড়িয়ে গাধা আমাদেরকে সম্মান দেখায়। গাধার গায়ে হাত বুলালাম
কিছুই বললো না। এমন কি নড়াচড়া ও করলো না। জোরে একটা পিঠে চড় দিলাম তাও
কিছুই বললো না। এমন কি উল্টে একটা চড় কিম্বা গালাগালিও দিল না। ওর মনে
ও দাঁড়িয়ে আছে। বললাম ওরে গাধা তোকে দেখার জন্য আমরা প্রায় দুশত পঞ্চাশ
মাইল পাড়ি দিয়ে দু গাধা এসেছি। বুঝলাম অতিরিক্ত শান্ত প্রকৃতির প্রাণী
বলেই মানুষ তোকে গাধা বলে। গাধাকে না দেখলে বুঝা যাবে না যে সে কতটা
নিরীহ প্রাণী।
সমাজের মানুষ যদি গাধার মত চরিত্র গ্রহণ করত তা হলে আমাদের সমাজে আজ এত
অশান্তি রাহাজানি খুন খারাপির মত কাজ গুলি সংঘটিত হতো না। যাই হোক
রাতের গাড়ীতে আমরা জয়পুর হাট রেলস্টেশনে রাত তিনটার সময় এসে নেমে পড়লাম।
চুপ চাপ দুজনে স্টেশনে চা খেয়ে ভোরের অপেক্ষায় সময় পার করছি। ভোর হলে
ভাবলাম এখন আমাদের রওনা করা উচিৎ। কারণ বারো মাইল পথ হেঁটে যেতে হবে।
সে সময় ভাল কোন যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল না। ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের কাঁচা
রাস্তা কোন যানবাহন চলা চল করে না। মানুষ পায়ে হেঁটে কিম্বা সাইকেলে
যাতায়াত করে। পাকিস্তানিরা পূর্ব পাকিস্তানে কোন রাস্তা ঘাট,
কালভার্টের কোন উন্নতি করেনি। শুধু পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের শোণিত
শোষণই করেছে। আকাশটা দেখলাম মেঘলা। যে কোন সময় মুষল ধারে বৃষ্টি নেমে
আসবে বলে মনে হচ্ছে।
ফজরের আজান হলো।রাস্তা ঘাটে কোন জনপ্রাণী নেই। আমরা ভয়ে ভয়ে দুজনে ভোরে
রওনা করলাম। হেঁটে বাড়ি পৌঁছতে ছয় ঘন্টা সময় লাগবে। মাঝে মাঝে দু এক
ফোটা বৃষ্টি পড়ছে। আমরা বেলা এগারোটার মধ্যে বাড়ি পৌঁছে গেলাম। বাড়ি
ফিরে মাকে বললাম, মা আমি যখন দিনাজপুর যেতে চাইলাম তুমি বললে কেন যাবি।
আমি বললাম গাধা দেখতে। তুমি বললে তোর মুখটা আয়না দিয়ে দেখলেই পারিস।
তোমার কথাটির উত্তর সে দিন না দিলেও আজ দিব। গাধাকে তুমি যা কিছু ভাবনা
কেন মা আসলে গাধার মত শান্ত প্রাণী পৃথিবীতে আর দ্বিতীয়টি নেই। আজ যদি
আমাদের সমাজের লোকেরা গাধার চরিত্রকে গ্রহণ করত তা হলে আমাদের সমাজে
লোভ লালসা বলে কোন জিনিষ থাকত না। সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে এত রক্তক্ষরণ
হত না।কোন লোক কারো সম্পত্তি জাল করে আত্মসাৎ করত না। কলম চোরেরা কলমের
মার প্যাচে রাষ্ট্রের কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করে বড় বড় দালান কোঠা
স্ত্রীদের নামে তৈরী করত না। কলম চোরদের এই চুরি আমাদের দেশে কোন দিন
ধরা পড়ে না। আমাদের সমাজে মূল্যবোধের এতটা অবক্ষয় হতো না।সীমাহীন
দুর্নীতি সমাজকে গ্রাস করেছে। নীতিহীন,বিবেকহীন লোকেরা সমাজে বিচরণ
করছে।অন্যায় অবৈধ পন্থায় লুটেরা ধনীরা বিত্তের পাহাড় গড়ছে। আজ সমাজে
নৈতিক অবক্ষয় ভাইরাসের মতো বিস্তৃত হয়ে পড়েছে। এমন কি
শিক্ষাঙ্গন,চিকিৎসা সরকারি অফিস এমন কি রাজনৈতিক ক্ষেত্র ও রাষ্ট্রীয়
জীবনে মূল্যবোধের অবক্ষয় ঘটেছে।
টাকা পয়সা ব্যাংক ব্যালেন্ছ খুলে গোপনে টাকা জমা করে। বিদেশে টাকা
পাচার করে। যেন কেউ দেখেও না দেখার ভান করে। ব্যাংকের হাজার হাজার কোটি
টাকা লুটপাট হচ্ছে কই কোন ব্যাংকের বড় কর্তার তো ফাঁসি হলো না। আমাদের
দেশের গরীব চাষী যখন ব্যাংক থেকে দশ হাজার টাকা লোন নেয় আর পরিশোধ করতে
না পারলে তখন তার কোমরে দড়ি বেঁধে টানতে টানতে হাজতে নিয়ে যায়। কই কোন
কলম চোরকে তো কোমরে দড়ি লাগানো হয় না। অনেক কলম চোর তাদের স্ত্রীদের
নামে হাইরাইজ বিল্ডিং তুলেছেন। এ মহিলারা এত টাকা পেল কোথা থেকে। তার
খোঁজ কি কখনও নেয়া হয়েছে। এ সকল মহিলা কার স্ত্রী কোন দিন কী তাদের
খোঁজ নেয়া হয়েছে। একজন কৃষককে কোমরে দড়ি লাগিয়ে আদালতে হাজির করা হল।
অবৈদ্ধ টাকা পয়সায় গড়া উচ্চ দালান কোঠার মহিলাদেরকে হাজতে নেয়া তো দূরে
থাক জিজ্ঞাসা পর্যন্ত করার প্রয়োজন কেউ মনে করেন না।। আসলে আমরা গাধা
শব্দটা যে ভাবেই মানে করি না কেন,গাধা যে নিরীহ শান্ত ও ভদ্র প্রাণী তা
এক বাক্যে সবাইকে স্বীকার করতে হবে। মানুষ যদি গাধার চরিত্রকে গ্রহণ
করত তাহলে আজ আমাদের সমাজ ব্যবস্থা মূল্যবোধের সংকটে পীড়িত হতো না। মনে
পড়ে মা বঙ্গ বন্ধুর কথা,উনি বলেছেন আমাদের দেশের মানুষ সাড়ে সাত কোটি।
আমি কম্বল এনেছি সাড়ে সাত কোটি। আমার কম্বলটি গেল কোথায় ? মানুষ পায়
সোনার খনি আমি পেয়েছি চোরের ক্ষনি।
(অসমাপ্ত)
WARNING:
Any unauthorized use or reproduction of 'Community' content
is strictly prohibited and constitutes copyright infringement liable to
legal action.
[প্রথমপাতা] |
লেখকের আগের লেখাঃ
|