[প্রথমপাতা]

 

 

 

 

ভূপাল বিপর্যয়

 

(কমিউনিটি ডেস্ক): ডিসেম্বর ৩, ১৯৮৪, সময় রাত বারোটার কিছু পর। ভারতের ভূপালবাসীর জন্য ঘটে গিয়েছিল এক মহাদুর্যোগ। এটি ছিল বিশ্বের ভয়াবহতম শিল্প বিপর্যয়। ভারতের মধ্য প্রদেশের শহর ভূপালে অবস্থিত ইউনিয়ন কার্বাইড ইন্ডিয়া লিমিটেড (ইউসিআইএল) এর প্ল্যান্টের ঐ দূর্ঘটনার ফলে বিষাক্ত মিথাইল আইসোসায়ানেট সহ নানা ধরনের বিষাক্ত গ্যাস শহরময় ছড়িয়ে পড়ে। নগরবাসী যখন ঘুমে আচ্ছন্ন তখন তাদের নিরব ঘাতক পৌঁছে গেছে শহরের দ্বারে দ্বারে।

একরাতে শহরের পাঁচ লাখ লোক বিষাক্ত গ্যাসে আক্রান্ত হলেন। সরকারী ভাবে বলা হলো মৃতের সংখ্যা ২২৫৯ কিন্তু মধ্যপ্রদেশ সরকারের হিসেব মতে ৩৭৮৭ জন। কোন কোন হিসেবে বলা হয় মৃতের সংখ্যা ১৫,০০০, আবার কোনটিতে বলা হয় ৮ থেকে ১০ হাজার -এ সবই মাত্র ৭২ ঘন্টার মধ্যে মৃতের হিসাব। পরবর্তীতে গ্যাসের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়ায় প্রান হারান অন্ততঃ আরো ২৫ হাজার মানুষ।

কিন্তু এতেও শহরবাসী মুক্তি পাননি। দুর্ঘটনার ২৫ বছর পরও ৩৯০ টন বিষাক্ত রাসায়নিক পরিত্যাক্ত অবস্থায় রয়ে গেছে ইউনিয়ন কার্বাইডের প্ল্যান্টে। এই পরিত্যাক্ত রাসায়নিক মাটি ভেদ করে মিশে চলেছে ভূ-অভ্যান্তরের পানিতে। এই ভূ-অভ্যান্তরের পানির উপরেই শহরবাসী নির্ভর করে আছে। আর তারা পান করে চলেছে এই বিষাক্ত পানি।

ঘটনাটি নিয়ে প্রচুর মামলা-মোকাদ্দমা হলেও এখনো পর্যন্ত কাউকেই এই ঘটনার জন্য শাস্তি পেতে হয়নি।

১৯৬৯ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ইউনিয়ন কার্বাইড। যার ৫০.৯ শতাংশের মালিকানা ছিল ইউনিয়ন কার্বাইড কর্পোরেশন আর ৪৯.১ শতাংশ ছিল ভারত সরকারের মালিকানাধীন। এটি সাধারন ভাবে কীটনাশক প্রস্তুত করত। ১৯৭৯ সালে কোম্পানীটি মিথাইল আইসোসায়ানেট প্ল্যান্ট চালু করে। কম ঝুঁকিপূর্ণ কিন্তু অধিক খরচ এমন উপকরন বদলে ফেলে প্ল্যান্টে ঝুঁকিপূর্ণ সস্তা রাসায়নিক মিথাইল আইসোসায়ানেট ব্যাবহার শুরু করা হয়। যদিও মিথাইল আইসোসায়ানেট ব্যাবহারের জন্য বিশেষ প্রশিক্ষন ও শর্তাবলী আছে, কিন্তু কোম্পানীটির ভাষ্যমতে তারা এ সবই জানত আর তার জন্য যথাযথ ব্যাবস্থাও নিয়েছিল।

দুর্ঘটনার প্রেক্ষাপট


ক্যামিক্যাল প্ল্যান্টের পাইপলাইনে মাঝে মাঝে রাসায়নিক বর্জ জমা হয়। ইউনিয়ন কার্বাইডের প্ল্যান্টেও অনুরূপ বর্জ পরিস্কার করার জন্য আলাদা পানির পাইপলাইন ছিল। দুর্ঘটনার প্রায় চার ঘন্টা আগে লাইনের রাসায়নিক বর্জ পরিস্কারের জন্য পাইপে পানি প্রবেশ করানো হয়।

মিথাইল আইসোসায়ানেট হচ্ছে পানির সাথে ভয়ঙ্কর বিক্রিয়া সৃষ্টিকারী একটি রাসায়নিক। নিয়ম অনুযায়ী লাইন পরিস্কার করতে হলে মিথাইল আইসোসায়ানেট এর ট্যাঙ্কের পথ অবশ্যই বন্ধ করে দিতে হবে যেটি একটি সময় সাপেক্ষ প্রক্রিয়া। লাইন পরিস্কারের দায়িত্বরত ব্যাক্তিটি সেই পথ রোধের ঝামেলাপূর্ণ কাজটি এড়িয়ে যায়। এদিকে পানি বেরিয়ে যাবার মুখটি রাসায়নিক বর্জে পূর্ণ হয়ে বন্ধ হয়ে যায়। ফলে পানি বের হতে না পেরে তা সরাসরি ট্যাঙ্কের অভিমুখে রওনা দেয়। একসময় তা ট্যাঙ্কের ৪২ টন মিথাইল আইসোসায়ানেট এর রিজার্ভের সাথে বিনা বাধায় মিশে যায়।

সাথে সাথেই ট্যাঙ্কে রাসায়নিক বিক্রিয়া শুরু হয়। রাসায়নিক ক্রিয়া শুরু হবার কারনে ট্যাঙ্কের তাপমাত্রা হঠাৎ অনেকগুন বেড়ে যায়। আর এই উত্তাপের ফলে রাসায়নিক বিক্রিয়ার গতিও যায় বেড়ে। একসময় তাপমাত্রা ২০০ সেন্টিগ্রেডেরও বেশী হয়ে যায়। কিন্তু ট্যাঙ্কটি এত উত্তাপ সহ্য করার মত করে তৈরি করা হয়নি। তখন তা ট্যাঙ্কের জরুরী চাপ নির্গমন পথ দিয়ে বিষাক্ত গ্যাস উদ্গীরন করে শহরের বাতাসে ছড়িয়ে দিতে শুরু করে। শহরে প্রবাহমান দক্ষিন-পূর্বমুখী বায়ূ সারা শহরে বিষাক্ত গ্যাস ছড়িয়ে দেয়।
 


পরদিন সকালে যখন ভূপালবাসী জেগে উঠলেন, তারা তাদের ফুসফুসে মারাত্মক ক্ষত ও পোড়ার অনুভূতি নিয়ে ঘুম থেকে উঠলেন। শহরময় ছড়িয়ে পড়ল আতঙ্ক। সেদিন ভূপাল পরিনত হয়েছিল যেন যমপুরীতে।

ঘটনা নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এফবিআই, ভারত কর্তৃপক্ষ, ইউনিয়ন কার্বাইড সহ নানা সংস্থা তদন্ত করে। তদন্তের ফলাফলে কিছুটা ভিন্নতাও পরিলক্ষিত হয়। ইউনিয়ন কার্বাইড দাবি করেছিল এটা নাশকতা। কিন্তু অন্যকোন সংস্থার তদন্তে নাশকতার কোন সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায়নি।

অনেক তদন্তের পরে এই দুর্ঘটনার পিছনে কিছু কারন সনাক্ত করা হয়। সেগুলো হলো,

-অপেক্ষাকৃত নিরাপদ রাসায়নিক ব্যাবহারের বদলে ঝুঁকিপূর্ণ মিথাইল আইসোসায়ানেট ব্যাবহার করা।
-বিপজ্জনক মিথাইল আইসোসায়ানেট এক সাথে বিশাল ট্যাঙ্কে সংরক্ষন করা। এই ধরনের রাসায়নিক ছোট ছোট ড্রামে সংরক্ষন করার কথা।
-ব্যাবহৃত পাইপলাইনে মরচে ধরা।
-১৯৮০ সালে প্ল্যান্ট বন্ধ হবার পর তার ত্রুটিপূর্ণ রক্ষনাবেক্ষন ও গাফিলতি।
-নিরাপত্তামূলক কোন ব্যাবস্থা না থাকা ও এ ব্যাপারে ত্রুটিপূর্ণ আইন।
-অর্থ বাঁচানোর লক্ষ্যে বিভিন্ন সেইফটি সুইচ বন্ধ রাখা। যেমন, মিথাইল আইসোসায়ানেট ট্যাঙ্কের রেফ্রিজারেশন সিস্টেম বন্ধ রাখা। শুধুমাত্র এই সিস্টেমটি চালু থাকলেই হয়ত এতবড় দুর্ঘটনা এড়ানো সম্ভব হতো।

সরকারী বাধ্যবাধকতার কারনে এই প্ল্যান্টের নকশা পরিবর্তন করেছিলেন ভারতীয় ইঞ্জিনিয়াররা তার সাথে খরচ বাঁচানোর জোর প্রচেষ্টা এই দুর্ঘটনাটি ঘটতে মূখ্য ভুমিকা পালন করেছিল। সমস্যা আরো জটিল করে তুলেছিল প্ল্যান্টের অবস্থান। প্ল্যান্টটি বসানো হয়েছিল ভূপালের মত এমন ঘনবসতিপূর্ণ একটি শহরে যেখানে ছিলনা কোন বিপর্যয় মোকাবিলার পূর্বপ্রস্তুতি, স্বাস্থ্য সুরক্ষার ব্যাবস্থা আবার অর্থনৈতিক দিক থেকেও হতদরিদ্র অবস্থা। বিশ্লেষকরা এই দুর্ঘটনার জন্য যৌথভাবে ইউনিয়ন কারবাইড করপোরেশন ও ভারত সরকারকে দায়ী করে থাকেন। তাদের যথেষ্ট নজরদারি না থাকার কারনেই ভূপালবাসীদের এমন ভয়ঙ্কর অবস্থায় পতিত হতে হয়েছিল।

 

 

 

>>মাছেরা যেদিন ডাঙায় উঠল

>>মহাবিশ্বে অজানা গরম বস্তু!

>>এয়ার ক্র্যাশ ইনভেস্টিগেশনঃ মাঝ আকাশে দুই বিমানের সংঘর্ঘ

>>তেনেরিফেঃ এভিয়েশন ইতিহাসের সবচাইতে বড় দুর্ঘটনা

>>সুপার কন্টিনেন্টের ভাঙাগড়া

>>কিং কোবরা

>>লেক চুজেনজিঃ মনমাতানো একটি লেক

>>রোমানিয়ায় কমিউনিস্ট বিরোধী বিপ্লবের ২০ বছর

>>ঐতিহাসিক নগরী কামাকুরা

>>গ্র্যান্ড ক্যানিয়নের রহস্য

>>একাত্তুরের টুকরো ছবি
>>একাত্তুরের গনহত্যা
>>চ্যানেল স্ক্যাবল্যান্ডস

>>ফ্রিক ওয়েভঃ সমুদ্রের দৈত্যাকার ঢেউ
>>চীন জাপান যুদ্ধ
>>সাপ্পোরোর ইয়ূকি মাতসুরি

>>যশোর রোড
>>ইয়াইয়ামাঃ অবকাশ যাপনের অদ্বিতীয় স্থান
>>ইয়াকুশিমাঃ জাপানের প্রাচীনতম বৃক্ষরাজির দ্বীপ

>>মাতসুশিমাঃ জাপানের অন্যতন দর্শনীয় স্থান
>>ওসাকা ক্যাসেল
>>বিশ্বের ব্যাস্ততম ষ্টেশন শিঞ্জুক

 

 

[প্রথমপাতা]