প্রথমপাতা  

সাম্প্রতিক সংবাদ 

 স্বদেশ

আন্তর্জাতিক

বাংলাদেশ কমিউনিটি

লাইফ স্টাইল

এক্সক্লুসিভ

বিনোদন

স্বাস্থ্য

বর্তমানের কথামালা

 শিল্প-সাহিত্য

 প্রবাসপঞ্জী 

আর্কাইভ

যোগাযোগ

 

 

 

(মতামতের জন্যে সম্পাদক দায়ী নয়।)

 

 

রাহমান মনি                                          

 

 

জাপানে প্রধানমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলন মিডিয়ার ভূমিকা

 

 

 

 

 পত্রিকায় লিখালিখি্র কাজটা শুরু হয়েছিল শ্রদ্ধেয় শফিক রেহমান এর হাত ধরে নব্বই দশকের শুরুতে ‘যায় যায় দিন’ এর মাধ্যমে। যদিও তার আগে সাপ্তাহিক পত্রিকার দিকপাল বীর মুক্তিযোদ্ধা শ্রদ্ধেয় শাহাদাত চৌধুরী সম্পাদিত ‘বিচিত্রা’ তে চিঠিপত্র কলাম এবং প্রবাস বিভাগে লিখার হাতেখড়ির কাজটা সেরে নেয়া হয়েছিল।

এরপর প্রিয় সম্পাদক গোলাম মোর্তোজার হাতে পড়ে এবং তাঁরই দিক নির্দেশনায় আজকের রাহমান মনি।

গোলাম মোর্তোজার ভাইয়ের হাত ধরেই শাহাদাত চৌধুরীর সম্পাদনায় সাপ্তাহিক ২০০০ এর টোকিও প্রতিনিধি এবং পরবর্তীতে গোলাম মোর্তোজা ভাইয়ের সম্পাদনায় ২০০৭ সালে প্রতিষ্ঠা লগ্ন থেকে ‘সাপ্তাহিক’ জাপান প্রতিনিধি এবং ২০০৯ সালে জাপান পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নিবন্ধন লাভ।

সেই সুবাদে অক্টোবর ২০০৯ সালে প্রথম জাপানের প্রধানমন্ত্রী ইয়ুকিও হাতোয়ামার সংবাদ সম্মেলনে যাই। সেই থেকে শুরু। এরপর পর নাওতো কান, ইয়োশিহিকো নোদা, শিনজো আবে হয়ে সর্বশেষ ৫ মার্চ ’২১ শুক্রবার বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ইয়োশিহিদে সুগার সম্মেলন নিয়ে গত ১২ বছরে সর্বমোট ৩৯ বার সংবাদ সম্মেলনে যোগ দিয়েছি। যদিও এই ৩৯ বারের মধ্যে ভাগ্যে মাত্র ১ বার-ই সুযোগ ঘটেছিল প্রধান মন্ত্রীকে সরাসরি প্রশ্ন করার। আর ২ বার লিখিত প্রশ্নের। আর ঘটবেই বা কি করে, প্রধানমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলনে সর্বোচ্চ ১০ জন বিদেশী সাংবাদিক উপস্থিত থাকতে পারেন। সাধারনত ৫/৬ জন থাকেন। করোনাকালীন সময়ে মাত্র ৩ থেকে সর্বোচ্চ ৫ জন।

জাপানের প্রধানমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলন বলে কথা বিশ্বের নামী দামী সব জায়ান্টস সংবাদ সংস্থাগুলি উদগ্রীব হয়ে পড়ে উপস্থিত থেকে সংবাদ সংগ্রহ এবং দ্রুততম সময়ে তা প্রচার করার জন্য। সেখানে প্রধানমন্ত্রীকে প্রশ্ন করার সুযোগ আমার মতো একজন ক্ষুদে সংবাদ কর্মীর ভাগ্যে জুটবেই বা কি করে ?

কট্টর জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী জাপানী জাতী নিজ দেশীয় সংবাদ মাধ্যমকেই বেশী গুরুত্ব দিয়ে থাকে। কারন, এখানকার সরকার নির্ধারিত হয় জনগনের প্রত্যক্ষ ভোটের মাধ্যমে। তাই, জনগনের প্রতি দায়বদ্ধতা এবং জবাবদিহিতা খুব বেশী থাকে। এখানে দায়িত্বপ্রাপ্ত কোন মন্ত্রীর মুখ দিয়ে বের হওয়া একটি কথাও অপ্রাসঙ্গিক বা অনভিপ্রেত হয়ে থাকে তাহলে পরক্ষনেই সেই মন্ত্রীকে পদত্যাগে বাধ্য করা হয়। আর, এই ব্যপারে সংবাদ মাধ্যমের ভূমিকা থাকে অগ্রগণ্য।

তোষামোদি সংবাদ বা তোষামোদি বিচার ব্যবস্থা অথবা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কর্তৃক তোষামোদি কিংবা পক্ষপাতমূলক আচরণ পেয়ে বা দেখে জাপানী জনগণ অভ্যস্ত নয়।

আর এই কারনেই জাপান ক্ষমতাসীন দলের তৎকালীন কিং মেকার খ্যাত শিন কানেমারু আর্থিক সুবিধা গ্রহনের মাধ্যমে সাগাওয়া কিউবিন কেলেঙ্কারি, নির্মাণ প্রতিষ্ঠান থেকে আয়কৃত অর্থের উপর ধার্যকৃত কর ফাকি দেয়ার স্ক্যান্ডাল মাথায় নিয়ে দল ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় জেলে যেতে হয়েছিল। প্রধানমন্ত্রী থাকা অবস্থায় টোকিওর আকিহাবারাতে শিনজো আবে’র নির্বাচনী জনসভায় মঞ্চের পাশেই আবের পদত্যাগ চেয়ে প্রতিবাদ জানাতে পারে।

ফুকুশিমা পারমাণবিক দুর্ঘটনা নিয়ে বিতর্কিত মন্তব্যের জেরে ২ জন মন্ত্রীকে পদত্যাগ করতে হয়েছিল। এর একজন ফুকুশিমায় গিয়ে কাউকে না দেখে বলেছিলেন কোন লোকজন নেই মনে হচ্ছে একটা বিরানভূমি। ব্যাস, আর যায় কোথায়! মিডিয়া ধরে বসলো। বললো, এতে করে স্থানীয়দের অনুভূতিতে আঘাত করেছেন মন্ত্রী। পদে থাকা একজন দায়িত্বশীল ব্যক্তির কাছ থকে তা আশা করা যায় না এবং তিনি এই পদের যোগ্যতা হারিয়েছেন। এই পদে থাকার আর কোন নৈতিক অধিকারই তার নেই। কাজেই পদত্যাগ-ই এর একমাত্র সমাধান।

এরপর ফুকুশিমা পারমাণবিক দুর্ঘটনা নিয়ে বিতর্কিত মন্তব্যের জেরে জাপানের পুনর্গঠনবিষয়ক মন্ত্রী মাসাহিরো ইমামুরা পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। ২০১৭ সালের এপ্রিল মাসে জাপানের আইনপ্রণেতাদের এক সভায় মাসাহিরো ইমামুরা বলেছিলেন, ২০১১ সালের ওই ভূমিকম্প ও সুনামি দেশটির উত্তর-পূর্বাঞ্চলে আঘাত হানায় এক অর্থে ভালো হয়েছিল। কারণ, তা টোকিওতে আঘাত হানলে আরও বেশি অর্থনৈতিক ক্ষতি হতো।

মন্ত্রীর এ বক্তব্য নিয়ে দেশজুড়ে সমালোচনার ঝড় ওঠে। সংবাদমাধ্যমে সাধারণ মানুষের বিক্ষোভের খবর প্রচারিত হতে থাকে। একপর্যায়ে মন্ত্রীর বক্তব্যের জন্য দুঃখ প্রকাশ করেন প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে।

আত্মপক্ষ সমর্থনে ইমামুরা বলেন, ‘তোহোকু এলাকায় মোট ২২ হাজার ৫০০ কোটি ডলারের ক্ষতি হয়েছে। কিন্তু টোকিওতে হলে ক্ষতির পরিমাণ অবিশ্বাস্য অঙ্কের হতো। আমি শুধু এটিই বোঝাতে চেয়েছি’।

কিন্তু তা বলেও শেষ রক্ষা হয়নি মন্ত্রী ইমামুরার। পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন। আর এর পেছনে মিডিয়ার ভুমিকা ছিল জনগণের আকাঙ্ক্ষার প্রতিচ্ছবি। জাপানী মিডিয়া এদেশের জনগনের নাড়ির স্পন্দন বুঝে। সেই অনুযায়ী পরিচালিত হয়।

শুরু করেছিলাম জাপানের প্রধানমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলন, মিডিয়ার ভুমিকা নিয়ে।

হ্যা, জাপানের প্রধানমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলনের ৩৯টি-তে অংশ নিয়ে আজ পর্যন্ত দেখিনি প্রধানমন্ত্রীকে প্রশ্ন করার সময় কোন সাংবাদিক বিভিন্ন বিশেষণে বিশোষিত করে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন। প্রশ্ন করার করার সময় কোন স্তুতি গেয়েছেন।

প্রধানমন্ত্রী পদটিই সন্মানজনক। তাই, তাকে সম্বোধন করার সময় অতিরিক্ত কোন বিশেষণে বিশোষিত করার প্রয়োজন হয় না। তিনি এমনিতেই মাননীয় তাই, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলার প্রয়োজন হয়না। সাংবাদিকরা প্রশ্ন করার সময় সরাসরি প্রধানমন্ত্রী সম্বোধন করেই প্রশ্ন করেন।

আমরা বাংলাদেশীরা বিশেষণ দিতে যেমন পছন্দ করি তেমনি নিতেও পছন্দ করি। তাইতো আমাদের সাংবাদিক ভাইরা যখন প্রধানমন্ত্রীকে প্রশ্ন করেন তখন বিশেষণের ভারে ভারাক্রান্ত হওয়া আসল প্রশ্নটি আর বুঝা যায়না। স্তুতির মাঝে হারিয়ে যায়।

আর তাদের স্তুতিতে প্রশ্নের উত্তরদাতা প্রায়শ লাইনচুত্য হয়ে যান। ধান বানতে শিবের গীত গাওয়া শুরু করেন।

অথচ এই এক যুগ ধরে প্রধানমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলনে অংশ নিয়ে আসছি। আজ পর্যন্ত কোন প্রধানমন্ত্রী কে দেখিনি বা তার মুখ থেকে শুনিনি তার পূর্বসূরির কোন সমালোচনার কথা। বিরোধী দলের কোন ব্যর্থতার কথা।

এইসব দেখে আমার কাছে মনে হয় জাপানে প্রধানমন্ত্রী যখন সংবাদ সম্মেলন করেন তখন তিনি ভুলে যান যে তিনি নির্বাচিত একটি দলের প্রধান হিসেবে প্রধানমন্ত্রী। তিনি মনে করেন তিনি জাপানের প্রধানমন্ত্রী। যারা তাকে ভোট দিয়েছেন এবং যারা তাকে ভোট দেননি তাদের সবার প্রধানমন্ত্রী।

প্রধানমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলন’র বিষয়বস্তু পূর্বেই জানিয়ে দেয়া হয়ে থাকে। তাই, অংশ নেয়া সাংবাদিকগন পূর্বপ্রস্তুতি গ্রহন করতে পারেন এবং নিদিষ্ট দিনে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের উপর এবং সংশ্লিষ্ট বিষয়াদির উপর-ই প্রশ্ন করে থাকেন। প্রধানমন্ত্রীও কেবল প্রশ্নেরই উত্তর দিয়ে থাকেন। অপ্রয়োজনীয় কোন প্রসংগ টেনে নিজেও বিনোদনের খোরাক হন না এবং অংশ নেয়াদেরও খোরাক যোগান না।

হতে পারে জাপানের প্রধানমন্ত্রীর প্রতিটি মিনিট ছকে বাঁধা। হিসেব করে ব্যয় করতে হয়। অযথা, অপ্রয়োজনে ব্যয় করার মতো বিলাসিতা করার সুযোগ কম। আবার এমনও হতে পারে নিদিষ্ট বিষয়ের বাহিরে তারা কিছু বলতে চান না।

প্রধানমন্ত্রী সঞ্চালকের উপর সম্পূর্ণ নির্ভর করেন কার প্রশ্ন নিবেন। প্রশ্ন করার জন্য যে কোন সাংবাদিক-ই হাত তুলতে পারেন। সঞ্চালক যাকে সুযোগ দিবেন কেবল মাত্র সে-ই শুধুমাত্র নিজের পরিচয় দিয়ে প্রশ্ন করে থাকেন।

তবে হ্যা, এখানে সঞ্চালক দুইজনকে সব সময় সুযোগ দিয়ে থাকেন। তার একজন এনএইচকে ( জাপান ব্রডকাস্টিং কর্পোরেশন ) এবং অপরজন নিক্কেই শিনবুন ( জাপান অর্থনীতি )। এরপর অন্যান্য।

এনএইচকে সরকারী সংস্থা হলেও প্রশ্ন করার সময় কোন রকম তোষামোদি করেন না। বরং চেপে ধরেন।

প্রধানমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলন সরাসরি সম্প্রচারে এই পর্যন্ত সাংবাদিকদের টেলিভিশনের পর্দায় আনার রেওয়াজ ছিল না। সুগা প্রশাসন প্রথমবারের মতো সরাসরি সম্প্রচারে সাংবাদিকদের টিভি পর্দায় আনার রেওয়াজ শুরু করেন। এর অন্যতম কারন হচ্ছে, সুগা প্রধানমন্ত্রী হওয়ার আগে ৮ বছর আবে প্রশাসনের মুখপাত্র হিসেবে কাজ করা কালীন সাংবাদিকদের সাথে একটা নিবিড় সম্পর্ক গড়ে ওঠে। প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর সুগা তা ভুলে যাননি।

এতদসত্বেও প্রধানমন্ত্রী সুগা কে দুঃখ প্রকাশ করে সংসদে প্রকাশ্যে মাথা নত করতে হয়েছে ছেলে সংক্রান্ত মিডিয়ায় প্রকাশিত সংবাদ পরিবেশনের কারনে।

গতমাসে সাপ্তাহিক ম্যাগাজিন ‘শুকান বুনশুন’ এ প্রকাশিত হয় সুগা পুত্র সেইগো যিনি একটি ভিডিও প্রযোজনা সংস্থার কর্মকর্তা , তার দেয়া বিভিন্ন ব্যয়বহুল নৈশ ভোজে সংস্কৃতি মন্ত্রনালয়ের অন্তত ১১ জন কর্মকর্তা যোগ দিয়েছিলেন এবং সেইসব নৈশ ভোজে জনপ্রতি ৭০০ ডলারেরও বেশী খরচ করা হয়েছিল। উদ্দেশ্য ছিল সংস্থার স্যাটেলাইট সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের সাথে সুসম্পর্কের মাধ্যমে ব্যবসায়িক উন্নতি করা।

এই হ’লো জাপান মিডিয়ার ভুমিকা। যেখানে জনস্বার্থের জন্য রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ব্যক্তিকেও নুন্যতম ছাড় দেয়া হয়না।

rahmanmoni@gmail.com

 

 

ARNING: Any unauthorized use or reproduction of 'Community' content is strictly prohibited and constitutes copyright infringement liable to legal action. 

[প্রথমপাতা]