|
(মতামতের জন্যে সম্পাদক দায়ী নয়।}
রাহমান মনি
শ্রদ্ধাঞ্জলি–
স্মৃতির মনি কোঠায় মুন্সিগঞ্জ এর ধোপা স্যার
বনাম তাঁর নারায়ণ চন্দ্র দাস ( ভুল হলে
ক্ষমা প্রার্থী ) কিন্তু ধোপা স্যার নামেই সমধিক প্রসিদ্ধ। আমরা যারা তাঁর
ছাত্র ছিলাম তাদের বেশীরভাগই তাঁর প্রকৃত নাম জানতাম না বলেই আমার বিশ্বাস।
ধোপা স্যার হিসেবে মুন্সিগঞ্জ শহর এলাকার সবাই তাঁকে একনামেই চিনতেন ।
বলছিলাম মুন্সিগঞ্জ জেলা ( তৎকালীন মহকুমা ) শহরের প্রাণকেন্দ্র মাঠপাড়ার
বর্তমান ‘মাঠপাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়’ যা পূর্বে ধোপা স্যারের স্কুল নামেই
প্রতিষ্ঠিত ছিল।
শুধু মাঠপাড়া কেন, আশেপাশের গ্রামগুলো খালইস্ট , কোটগাও , হাসপাতাল পাড়া ,
দক্ষিন কোটগাও , কলেজ পাড়া , জমিদার পাড়া এমন কি মালপাড়া থেকেও ধোপা
স্যারের স্কুলে শিক্ষাজীবনের হাতেখড়ি সেড়েছেন। কারন, সে সময় অত্র এলাকায়
আজকের মতো এতো বিদ্যালয়ও ছিল না।
মুন্সিগঞ্জ শহরের অনেকেই ধোপা স্যারের মোটা বেতের বারির আঘাত না খেলেও ধোপা
স্যারের কথা জানেন না এমন লোক খুঁজে পাওয়া মুশকীল হবে।
মুন্সিগঞ্জ এর খালইস্ট মৌজায় ১৯৭০ সালে ২৪ শতাংশ জমির উপর আনুষ্ঠানিক ভাবে
মাঠপাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপিত হলে এর শুরুটার ইতিহাস স্থানীয়
মুরব্বীদের কারোর কাছ থেকেই জানা যায়নি। মুরব্বিদের কাছ থেকে জানা যায় ধোপা
স্যার ই এই স্কুলটির প্রতিষ্ঠার অনুপ্রেরণা বললে ভুল হবে না।
সে সময় স্কুলটির পূর্ব পার্শ্বে ছিল তৎকালীন মহকুমা পুলিশ অফিসারের
কার্যালয় , উত্তরে একটি পুকুর , পশ্চিমে ক্রীড়াবিদ পরিবার নওশের উজ্জামান
নওশের ( ঢাকা মোহামেডান ক্লাবের প্রাক্তন অধিনায়ক , ১৯৭৪ সালে ঢাকা লীগের
সর্বোচ্চ গোলদাতা ) ভাইদের বাসা এবং দক্ষিনে হরগঙ্গা কলেজ হয়ে মুনশির হাট
যাবার রাজপথ এবং রাস্তার ওপারে বড় মাঠ যা বর্তমানে মুন্সিগঞ্জ জেলা
স্টেডিয়াম।
আজকের ত্রিতল ভবন মাঠপাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠালগ্নে এমনটি ছিলনা।
ছোট পরিসরে একটি চালতা গাছের নিচে ছালা বিছিয়ে তার উপর বসে ক্লাশ করতাম।
কোন টেবিল চেয়ার ছিলনা। শিক্ষক হিসেবে ছিলেন একমাত্র ধোপা স্যার। আজ যেখানে
১৩ জন কর্মরত শিক্ষক হিসেবে ক্লাশগুলোতে পাঠ দিয়ে যাচ্ছেন।
ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায়, অত্র বিদ্যালয়ের নিকটবর্তী কোন বিদ্যালয় না থাকায়
১৯৭০ সালে অত্র এলাকার গন্যমান্য ব্যক্তিদের সহযোগিতায় একটি প্রাথমিক
বিদ্যালয় স্থাপনের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। পরিকল্পনা মোতাবেক ১৯৭০ সালে
স্বল্প সংখ্যক শিক্ষার্থীদের নিয়ে বেসরকারী পর্যায়ে একটি প্রাথমিক
বিদ্যালেয়র কার্যক্রম শুরু করা হয়। পরবর্তীতে জাতিরজনক বঙ্গবন্ধু শেখ
মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি পদে থাকা অবস্থায় বাংলাদেশের সকল
প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণ করেন। ১৯৭৩ সালে মাঠপাড়া সরকারী প্রাথমিক
বিদ্যালয়টি জাতীয়করণের আওতাভূক্ত হয়।
জাতীয়করণ করার পর ধোপা স্যারেরও কপাল পুড়ে। এরপর কিছুদিন তিনি বিভিন্ন বাসা
বাসায় গিয়ে পাঠদান অব্যাহত রাখেন। বিদ্যালয় থেকে অব্যাহতি পেলেও এলাকাতে
তিনি ধোপা স্যার হিসেবেই প্রসিদ্ধ থাকেন। বয়সজনিত কারনে এক পর্যায়ে তাও ছেড়ে
দিতে হয় স্যার কে।
আমার শ্রদ্ধেয় পিতা মরহুম আলহাজ্ব মোঃ ফজলুর রহমান যিনি মুন্সিগঞ্জ-এ টিও
সাব ( টি ,এ, ও বা থানা এগ্রিকালচার অফিসার ) নামে পরিচিত, একদিন আমাকে নিজ
হাতে গোসল করিয়ে ভাল একটি পোশাক পড়িয়ে চিরুনি দিয়ে মাথা আঁচড়িয়ে একটি সিলেট-
পেন্সিল এবং সীতানাথ বসাক এর একটি আদর্শলিপি হাতে দিয়ে ১৯৭১ সালের জানুয়ারি
মাসের কোন একদিন ধোপা স্যারের স্কুলে নিয়ে স্যারের হাতে দিয়ে বললেন
“মাস্টার মশাই আপনার হাতে দিয়ে গেলাম, মাংস আপনার আর হাড্ডি আমার”।
তার কিছুদিন আগে ছোট মামা , হরগঙ্গা কলেজের তৎকালীন ভি,পি , ছাত্রনেতা, বীর
মুক্তিযোদ্ধা প্রয়াত এডভোকেট মোক্তাদির হরগঙ্গা কলেজের ভাইস প্রিন্সিপ্যাল
এবং ছাত্রাবাস প্রভোস্ট হাসমত উল্লাহ স্যারের কাছ থেকে এক শুক্রবার বিকেলে
আসর নামাজের পর হাতেখড়ি দিয়ে নিয়ে আসেন।
ধোপা স্যার দাদুর বয়সী এবং ভগ্ন স্বাস্থ্যের অধিকারী হলেও তাঁর তেজোদিপ্ত
কণ্ঠস্বর শুনলে পিলে চমকে যেতো। তার উপর স্যারের বেশভূষা, চোখে মোটা ফ্রেম
এর কালো চশমা। হাতে মোটা বেত নিয়ে যখন কাছে আসতেন তখন যে কারোর-ই কাপড় নষ্ট
হয়ে যাওয়ার কথা। আমার কিন্তু তা হ’তো না। কারণটাতে পরে আসছি।
স্যারের বেতটা ছিল একটু ভিন্ন। ধরার জায়গাটাতে মোটা কাপড় দিয়ে শক্ত করে
বাঁধা ছিল ধরার সুবিদার্থে । আর , মোটা কাঁচের কালো চশমার ফ্রেমটি কেনার পর
তার রক্ষণাবেক্ষণ এবং মেরামতের কাজগুলো নিজ হাতেই সেরে নিতেন বলে আমার
বিশ্বাস। ফ্রেমটির স্থানে স্থানে জোড়াতালি দেখার পর যে কারোরই সে বিশ্বাস
জন্মাবে।
আমাদের পড়া ধরিয়ে দিয়ে স্যার নিজের বেত খানার যত্ন নিতেন, মানে ধরার স্থানটি
পুনঃ পুনঃ ঝালাই করে নিতেন।। কিংবা নিজ চশমার। আবার মাঝে মাঝে
শিক্ষার্থীদের বই খাতা ছিঁড়ে গেলে তা জোড়াতালির কাজটিও করে দিতেন।
স্যারের হাটার স্টাইলও ছিল একটু ব্যাতিক্রমধর্মী। যখন হাঁটতেন বেত খানা চলতো
স্যারের আগে। আর, তাতেই খবর হয়ে যেতো সব কয়টি শিক্ষার্থীর।
ধোপা স্যার একা-ই এবং একই সাথে ওয়ান, টু থ্রি --- সবগুলি ক্লাশ-ই নিতেন।
টেবিল চেয়ার না থাকায় সোনালী আঁশ খ্যাত পাটের তৈরি ছালার উপর বসে আমাদের
শিক্ষা নিতে হতো। ধোপা স্যার নিজেও ছালার উপর বসতেন।
ধোপা স্যারের একটি বিশেষত্ব ছিল শিক্ষার্থীরা যেদিন বেতন নিয়ে স্যারের হাতে
দিতেন , স্যার সেদিন তার হাতে দু’পয়সা ( তিন পাই , সে সময় এক পয়সাকে এক পাই
বলা হতো এবং ৩ পাইকে দু’পয়সা, ৬ পাই কে একআনা, ২৫ পাই কে এক সিকি এবং ৫০
পাইকে আধুলী বলে অভিহিত করা হতো ) করে দিতেন। আর এই দু’পয়সা দিয়ে তখন একটি
লজেন্স ,একটি আইসক্রিম কিংবা একটু খানি চালতার বা অন্য কোন আচার কিনতে পারা
যেতো।
এছাড়াও স্যার কর্তৃক নির্বাচিত একজন শিক্ষার্থী প্রতিদিন উচ্চস্বরে স্বরে অ
,স্বরে আ, হ্রস্ব ই, দীর্ঘ ঈ এভাবে ক , খ , গ ,ঘ , নামতা এবং ইংরেজী
বর্ণমালাগুলো সহ বিভিন্ন পড়া সবাইকে পড়াইলে আরো দু’পয়সা করে দিতেন। আর এই
বাছাইকৃত ছাত্রটি ছিলাম আমি। এছাড়াও ক্লাশ শেষে স্যারের সব কিছু গুছিয়ে দিলে
আরও দু’পয়সা করে পেতাম। স্যার আমাকে খুব ভালোবাসতেন। আর এই কারনে স্যার কে
দেখলে ভয় লাগতো না। তবে , শ্রদ্ধার কমতি ছিল না।
স্যার, আমাদের বাসায় দুপুরের খাবার খেয়েছেন বেশ খানিকটা সময়। বিনিময়ে বিকেলে
আমাদের পড়িয়েছেন। বিদ্যালয়ের পর্ব শেষ করে বাসায় আসতে আসতে দুপুর পেরিয়ে
প্রায়শই বিকেল হয়ে যেত । তাই দুপুরের খাবারটাও বিকেলে খেতে হতো।
আমার পড়াশুনা নিয়ে বেগ পেতে না হলেও ছোটভাই মামুনকে বাগে আনতে গলদঘর্ম করতে
হ’তো স্যার কে।
আমার মা কে তিনি ‘মা জননী’ বলে সম্বোধন করতেন। এমনভাবে সব শিক্ষার্থের মে-কেই
তিনি মা বলে সম্বোধন করতেন। এভাবে তিনি অনেক বাসাতেই আতিথেয়তা নিতেন
পাঠদানের বিনিময়ে। আর এভাবেই কেটে যেতো জীবন সায়াহ্নে একাকীত্ব স্যারের
জীবন।
১৯৭১ সালের মে মাসে ( যতটুকু মনে পড়ে ৯ ই মে ) পাকহানাদার বাহিনী
মুন্সিগঞ্জ মহকুমায় প্রবেশ করে । তারা যখন মার্চপাস্ট করে সারিবদ্ধভাবে
হরগঙ্গা কলেজের দিকে অগ্রসর হচ্ছিল তখন আমরা ধোপা স্যারের কাছ থেকে শিক্ষা
নিচ্ছিলাম।
অফিসার পর্যায়ের একজন সাথে ৪/৫ জন নিয়ে রাস্তা থেকে নিচে নেমে স্যারের সাথে
কি যেন কথাবার্তা বললেন , আবার চলেও গেলেন। এর পরপরই আসেন আব্দুল হাকিম
বিক্রম্পুরী সাহেব । তাদের মধ্যে কথাবার্তা হয় । তবে হিন্দু হলেও পাকবাহিনী
ধোপা স্যারের কোন ক্ষতি করেনি।
এর কিছুদিনের মধ্যে স্কুলটি বন্ধ হয়ে গিয়েছিল । বিজয়ের পর আবার যথারীতি খুলে
।
মুন্সিগঞ্জ শহরের অনেক গণ্যমান্য ব্যাক্তিবর্গের শিক্ষাজীবনের হাতেখড়ি
হয়েছে ধোপা স্যারের কাছ থেকে। তাঁদের অনেকেই সরকারের বেশ উচ্চ পর্যায়ে
কর্মরত থেকে আজ অবসরে। কেহবা প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী হয়ে সমাজে স্থান করে
নিয়েছেন। অথচ স্যারের খোঁজখবর কেউ নিয়েছেন বলে আমার জানা নেই।
ধোপা স্যারের মৃত্যুর সঠিক তথ্য কেহই দিতে পারেন নি। যা জানা গেছে তার
অনেকটাই ভাসা ভাসা। যতদূর জানা যায় স্যারের একমাত্র সন্তান যোগেশ চন্দ্র
দাস ভারতেই আস্তানা গেড়েছিলেন স্যারের জীবিতাবস্থায়। স্যারের মৃত্যুর খবর
তার কানে পৌঁছেছে কিনা জানা যায়নি। কারন, চিতায় মুখাগ্নি করার জন্য তাকে
পাওয়া যায়নি।
খোঁজ নিয়ে জানা যায় মুন্সিগঞ্জ শহর পুরাতন শ্মশানঘাঁটে স্যারকে দাহ করা হয়।
শুধুমাত্র ধর্মীয় আচার যা না করলেই না হয় শুধুমাত্র সেইটুকুই করেন পুরোহিত
এবং কালীবাড়ি সংশ্লিষ্টদের উপস্থিতিতে। অথচ ধোপা স্যারের হাতে শিক্ষাজীবন
শুরু করাদের মধ্যে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, প্রশাসনিক কর্মকর্তা বা
ব্যবসায়ীদের সংখ্যার কমতি ছিলনা মুন্সিগঞ্জ শহরে।
আজ প্রায় অর্ধশতক বছর পরও মনের স্মৃতি কোঠরে স্যারের স্থান চির অম্লান।
জাপান আসার পরও ধোপা স্যারের কথা একটিবারের জন্য ভুলে যাইনি। বিভিন্ন
কারনেই জাপানের অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্ঞ্যানীগুনী প্রফেসরদের সাথে
চলাফেরার সুযোগ ঘটেছে, অনেকের সাথে সম্পর্কও গড়ে উঠেছে।
কিন্তু , শিক্ষক মানেই আমার কাছে আমার প্রথম শিক্ষাগুরু ধোপা স্যারের
স্মৃতি । ভাঙ্গা ফ্রেমে পুরু কালো চশমা , হাতে মোটা বেত আজ অনেকের কাছে
ভীতির হলেও আমার কাছে অত্যন্ত সন্মান এবং একই সাথে শ্রদ্ধারও।
আজ এতোদিন পরও মনে হচ্ছে তাঁর বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করা ছাড়া স্যারকে
দেয়ার মতো আমাদের আর কিছুই করার নেই। আর দেয়ার যখন ছিল তখনই কিছুই যখন
দেইনি এখন আর সে চিন্তা করেও লাভ নেই।
তবে , স্যারের কাছ থেকে অর্থাৎ স্যারের আদর্শ থেকে নেয়ার অনেক কিছুই আছে ।
স্যারের দেয়া শিক্ষা থেকে দীক্ষা নেয়া। অর্থাৎ সততা এবং দেশপ্রেম থেকে
ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে তা ছড়িয়ে দেয়া। নিজের জীবনেও তা ব্রত করা।
স্যার পরপারে যেন আল্লাহ আপনাকে ভাল রাথেন ।।
১৩ আগস্ট ২০২০
টোকিও , জাপান
rahmanmoni@gmail.com
ARNING:
Any unauthorized use or reproduction of 'Community' content
is strictly prohibited and constitutes copyright infringement liable to
legal action.
[প্রথমপাতা] |
|