প্রথমপাতা  

সাম্প্রতিক সংবাদ 

 স্বদেশ

আন্তর্জাতিক

বাংলাদেশ কমিউনিটি

লাইফ স্টাইল

এক্সক্লুসিভ

বিনোদন

স্বাস্থ্য

বর্তমানের কথামালা

 শিল্প-সাহিত্য

 প্রবাসপঞ্জী 

আর্কাইভ

যোগাযোগ

 

 

 

(মতামত সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব)

 

 

রাহমান মনি                                          

 

 

গণপিটুনি অবিলম্বে বন্ধ করা উচিত

 

 

 

বাংলাদেশে এখন বহুল সংঘটিত এবং সবচেয়ে আতঙ্কের নাম হচ্ছে গণপিটুনি। অতি সম্প্রতি যা ব্যাপক আকার ধারন করেছে যাকে মহামারি বললেও ভুল হবে না।

এই গণপিটুনি থেকে বাঁচার জন্য আনস্মার্ট থাকা অবস্থায় স্মার্ট কার্ড হাতে নিয়ে ভিক্ষুকদের ভিক্ষা মাগতে দেখা গেছে। কতোটা আতংক বিরাজ করলে মানুষ এ পথ বেঁছে নিতে পারে তা সহজেই অনুমেয়।

মানুষ কেমন যেনো দিন দিন অমানুষ হয়ে যাচ্ছে। শিক্ষিত এবং যুব সমাজ এ জাতীয় ন্যাক্কার জনক কাজে জড়িত হচ্ছে বেশী। অনেকটা আদিম যুগে ফিরে গিয়ে আনন্দ উল্লাস করে প্রকাশ্যে মানুষ পিটিয়ে হত্যা করছে। মানুষ পিটিয়ে হত্যা করার মধ্যেও যেনো আনন্দ আছে , মানুষ হত্যা করে তৃপ্তির ঢেঁকুর তোলা যায়।

সম্প্রতি সিরিজ ধর্ষণ ও যৌন নিপীড়নের ঘটনায় গোটা দেশকে আক্রান্ত করা হয়েছে। তার মধ্যে আবার যোগ হয়েছে গণপিটুনি ।

গণপিটুনিতে মানুষ হত্যা দেখার প্রথম অভিজ্ঞতা হয়েছিল সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে, মহকুমা শহর মুন্সিগঞ্জ এর কাচারি ঘাটের পুরাতন পানির ট্যাঙ্ক এর নিচে।

সেদিন মুন্সিগঞ্জ শহরের এক কুখ্যাত রাজাকার কে ধরে এনে জুম্মা নামায শেষে সবাই মিলে প্রকাশ্যে আঁখ দিয়ে পিটিয়ে মেরে ফেলা হয় ( প্রাসঙ্গিক কারনে রাজাকার এবং জনতার নাম প্রকাশ করা হ'লো না )। ছোট ছিলাম বলে সবার সাথে আমি দর্শক হিসেবেই দেখেছি। প্রতিবাদ করার কথা কল্পনায়ও আনতে পারিনি।

এরপর অনেক গণপিটুনি দেখেছি । যার অনেক যৌক্তিক কারনও ছিল । তবে সেইসব গণপিটুনিতে এখনকার মতো এমন নিষ্ঠুরতা ছিল না, ছিলনা পৈচাশিকতা কিংবা কারন বিহীনতা। কারন বশত কিছু উত্তম মধ্যম দিয়ে গলায় জুতার মালা পড়িয়ে কিংবা মাথার চুল ন্যাড়া বা এলোমেলো কেটে ছেড়ে দেয়া হতো।

আর এখন কোন কারন ছাড়াই গণপিটুনিতে মারা হচ্ছে পৈচাশিকভাবে। যে বা যারা মারছে তারাও যেমন জানছেনা কি কারনে তাকে মারা হচ্ছে ? কেবলমাত্র হুযুগের বশবতী হয়ে মানুষ মারার আনন্দে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলছেন । তেমনি যাকে মারা হচ্ছে তিনিও জানতে পারেন না কেন তাকে মরতে হ'ল। শুধুমাত্র পাহাড়সম ঘৃণা নিয়ে তিনি ইহলোক ত্যাগ করেন।

শুধু মাত্র পত্রিকায় প্রকাশিত এবং আইন সালিশ কেন্দ্রের হিসাব অনুযায়ী গত ৮ বছরে ৮০০ জনকে গণপিটুনিতে মারা হয়েছে। এর বাইরের খবর আমাদের জানা নেই।

রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক আলী রীয়াজ এর তৃতীয় মতবাদ অনুযায়ী গণপিটুনির অন্যতম কারন হচ্ছে রাজনৈতিক। যখন আইন-আদালত, পুলিশ, সরকারের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের ওপরে মানুষের আর কোনও আস্থা থাকে না এবং তারা ধরে নেন যে, এই ব্যবস্থায় সুবিচার হবে না, ফলে তাকেই এই 'বিচার' করতে হবে। এবং দ্বিতীয়ত যখন রাষ্ট্র, সরকার ও প্রভাবশালীরা এই ধরনের ঘটনাকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে উসকে দেয়, এই ধরনের ঘটনার সঙ্গে যুক্তদের বিচার হয় না, উপরন্তু ক্ষমতাসীনদের আনুকূল্য পায়। সেটা অন্যদের 'মব'হয়ে উঠতে উৎসাহী করে।"

মূল কথা একটাই , এইসব ঘটনার সঙ্গে দায়ী ব্যক্তিদের কখনও শাস্তির আওতায় আনা হয় না বলে এরা বারবার এ জাতীয় ঘটনা ঘটাবার সুযোগ পায়। শুধু গণপিটুনি কেনো, ধর্ষণ, অপহরণ, যৌন হয়রানি, অন্যান্য হত্যাকাণ্ড, নিপীড়ন কোনোটারই ঠিকমত বিচার হয় না বলে অপরাধীরা বারবার এই অপরাধ করে।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে রীতিমত ফুলশয্যা সাজিয়ে ধর্ষণের সেঞ্চুরি করা মানিকদের বিচারের আওতায় না আনা শুধুমাত্র দলীয় আনুগত্যের কারন। রাষ্ট্রীয় আনুকূল্যে আজ সে প্রবাসী।

বিশ্বজিৎদের প্রকাশ্যে হত্যা করার পরও শুধুমাত্র রাজনৈতিক পরিচয়ের কারনে সঠিক বিচার না করা , নিরাপত্তা বাহিনীর পরিচয়ে অপহরণ নাটকের সুরাহা না করা, এর সব কিছুই হচ্ছে রাজনৈতিক প্রভাবের কারনে। একই কারনে লক্ষ্মীপুরের এক আইনজীবী কে হত্যা করে মৃতদেহ টুকরো টুকরো করে নদীতে ভাসিয়ে দেয়ার প্রমান থাকার পরও দয়ার সাগর আমাদের রাষ্ট্রপতির অনুগ্রহে ছাড়া পেয়ে যান শুধুমাত্র দলীয় বিবেচনায়।

অতি সম্প্রতি ঢাকার মধ্য বাড্ডায় ঘটে যাওয়া ঘটনায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নিন্দার ঝড় ওঠে। নাড়া দেয় বিবেক কে। মেয়ের জন্য বিদ্যালয়ে খোঁজ নিতে গিয়ে তিনি মানুষরূপী নরপশুদের হাতে শাহাদাত বরণ করেন তাসলিমা বেগম রেনু, বয়স আনুমানিক ৪০ বছর, তিনি মহাখালীর ৩৩/৩ জিপি জ ওয়ারলেস গেট থাকতেন। তার ১১ বছরের এক ছেলে ও চার বছর বয়সী এক মেয়ে রয়েছে।

মৃত্যুর আগে তিনি কেবল বলতে পেরেছিলেন ..."ভাইগো ও ভাই, আমি এখানে এসেছিলাম আমার বাচ্চাকে স্কুলে ভর্তি করাতে"। আমি ছেলেধরা না। আমার নাম তাসলিমা রেনু। দুটো বাচ্চা আছে আমার। আমাকে মেরে ফেলবেন না। বাচ্ছাগুলোকে এতিম বানাবেন না। আমি মরে গেলে ওদের যে কেউ থাকবে না। বাসায় বাচ্চাগুলো আমার জন্য অপেক্ষা করে আছে।" কিন্তু হায়েনা রা তার কথায় কান দেননি। মেতে উঠেন বর্বরতায়। এতিম হয় নিষ্পাপ দুইটি ফুটফুটে শিশু।

সব ঘটনাই ভুলে যাই কিংবা ভুলার আগেই আরেক নতুন ঘটনার জন্ম দেয়। কিন্তু ভুলতে পারে কি তাদের নিকটজনরা ? ভুলতে পারবে কি তুবা নামের নিষ্পাপ কন্যা শিশুটি যে তার মাকে হারিয়েছে বিনা কারনে নিষ্ঠুরতার শিকারে । এই শিশু যখন বুঝতে শিখবে যে তার মা কে গণপিটুনিতে জীবন দিতে হয়েছে শুধুমাত্র তার জন্য, তার শিক্ষা জীবন শুরু করার সঠিক স্থান বেঁছে নেয়ার খোঁজে যাওয়ার কারনে। তখন সে কি তার নিজেকেই ক্ষমা করতে পারবে ? পারবে কি মানুষরূপী হায়েনাদের ক্ষমা করতে ?

সামান্য কারনে আজ মানুষ একে অন্যকে গণপিটুনির শিকার করাচ্ছে। স্বার্থে সামান্য আঘাত লাগলেই ছেলেধরা বা অন্য কিছু উপাধী দিয়ে গণপিটুনির ক্ষেত্র প্রস্তুত করছে একে অপরের বিরুদ্ধে।

"বকেয়া ভাড়া নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে ছেলেধরা গুজব ছড়িয়ে রাজধানীর যাত্রাবাড়ীতে ভাড়াটিয়াকে গণপিটুনি দেওয়ানোর অভিযোগ উঠেছে এক বাড়িওয়ালার বিরুদ্ধে।"

"রাস্তায় স্বামী-স্ত্রীর ঝগড়া: একে অন্যকে 'ছেলেধরা' বলে গণধোলাই খেলেন উভয়েই!"

উপরের দুইটি ঘটনা বিশ্লেষণ করলেই বুঝা যায় অতি তুচ্ছ কারনে মানুষ কি না করতে পারে ?

এর সাথে যোগ হয়েছে গুজব । পদ্মা সেতুতে মানুষের মাথা লাগবে এমন গুজব ছড়িয়ে পরলে সারা দেশে অন্তত ৮ জনকে এর বলীর শিকার হতে হয়েছে। অথচ পুলিশ জানিয়েছে , বাংলাদেশে পদ্মা সেতুতে মাথা লাগবে - এমন গুজব ছড়িয়ে পড়ার পর ছেলেধরা সন্দেহে গণপিটুনিতে নিহতদের মধ্যে কেউ ছেলেধরা ছিল না।

রাজধানী ঢাকার পুলিশ হেডকোয়াটার্সে এক সংবাদ সম্মেলনে পুলিশের মহাপরিদর্শক মোহাম্মদ জাভেদ পাটোয়ারী বলেন, "দুঃখজনক হলেও সত্যি, গণপিটুনির প্রতিটি ঘটনা আমরা বিশ্লেষণ করেছি। গণপিটুনির শিকার হয়ে মৃত্যুবরণকারীদের কেউই অপহরণকারী ছিল না, কেউই ছেলেধরা ছিল না।" এই স্বীকারোক্তিতে কি নিরপরাধ প্রান গুলি কি ফিরে আসবে ?

নিরপরাধ মানুষ যখন গণপিটুনির শিকার হয়ে মারা যান তখন শুধুই যে সে মারা যান তা কিন্তু নয়। নিকটজন যাদের রেখে যান তাদের কে জীবন্ত লাশ হিসেবে রেখে যান। স্বাভাবিক জীবন যাপনে অভ্যস্ত হতে তাদের হিমশিম খেতে হয়। সমাজ তাদের তা করাতে বাধ্য করে।

যে যতো অপরাধ-ই করুক না কেন তার বিচার হতে হবে। তবে তা দেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী। হুজুগে বিচার করানে ওয়ালা কিংবা স্বার্থানেষী মহলের ইন্দনে নয়।

সন্দেহবশত কাউকে ছেলেধরা কিংবা মাথা কাঁটা (?) আখ্যা দিয়ে পিটিয়ে মারার আগে তার মুখ থেকে বিস্তারিত শুনা , খোঁজ খবর নেয়া, প্রয়োজনে আটকে রেখে পুলিশে খবর দেয়া ।

পিটিয়ে মেরে ফেললে সত্যিকারের তথ্য পাওয়া যায় না। তথ্য পাওয়া গেলেও প্রাণটি আর ফিরিয়ে আনার সুযোগ থাকেনা । যেমনটি ঘটেছে তাসলিমা বেগম রেনু'র বেলায়। আমরা সবাই হাহুতাশ করতে পারি , শোক প্রকাশ করতে পারি , আদালতে তাদের বিচারও হয়তোবা হবে , সাজাও পাবেন । কিন্তু , ১১ বছরের আল মাহি কিংবা ৪ বছরে তুবা'র মতো নিস্পাপ দু'টি শিশু কি তাদের স্নেহময়ী মা'কে ফেরত পাবে ?

প্রিন্সেস ডায়নার মৃত্যুর পর তার বড় ছেলে প্রিন্স উইলিয়াম মিডিয়াতে বলেছিলেন ,

'মায়ের মৃত্যুর যন্ত্রণা অন্য কারোর সঙ্গে তুলনা করা যায় না'। তুবা বা মাহির মনোভাব যে একই অবস্থা তা বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা না। কারন, শিশু তুবাও কিন্তু তার মায়ের কাছে এবং চোখে প্রিন্সেস ই ছিল বৈ কি !

কাজেই গণপিটুনির নামে কোন প্রিন্সেস বা রাজকন্যা কে তার রানীমার কাছ থেকে কেড়ে নেয়া কিংবা কোল খালি করার অধিকার আমাদের কারোর ই নেই । নারী-পুরুষ সবার ক্ষেত্রেই একই কথা প্রযোজ্য ।

যেহেতু গণপিটুনি দিয়ে অন্যের প্রান কেড়ে নেয়ার অধিকার আমাদের কারোর নেই, বাংলাদেশের সংবিধানেও নেই , তাই অনধিকার চর্চা থেকে বিরত থাকা আমাদের সকলের উচিত।

তাই, আসুন গণপিটুনির নামে বিনা বিচারে মানুষ হত্যার আদিম খেলায় মেতে না উঠে সভ্য সমাজে আমাদের দেশকে তুলে ধরি। বন্ধ করি গণপিটুনি নামের বর্বরতা ।

rahmanmoni@gmail.com 
 

 

 

 

ARNING: Any unauthorized use or reproduction of 'Community' content is strictly prohibited and constitutes copyright infringement liable to legal action. 

[প্রথমপাতা]