|
রাহমান মনি
জাপানে বৈশাখী মেলা,
আমাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য
সম্প্রতি টোকিওতে বিশতম বৈশাখী মেলা ও কারি
ফেস্টিভ্যাল ২০১৯ অনুষ্ঠিত হয়ে গেল। যা, টোকিও বৈশাখী মেলা নামে সমধিক
পরিচিত।
বৈশাখী মেলা জাপানের মাটিতে খোলা ময়দানে জাপানে বসবাসরত যে কোন দেশের
প্রবাসীদের দ্বারা সর্ব বৃহৎ আয়োজন একথা এখন আর শুধু দাবীই নয় ,
সর্বজনবিদিত সত্য।
বৈশাখী মেলাকে ঘিরে জাপান প্রবাসীদের মধ্যে বছরব্যাপী এক ভালো লাগা অনুভূতি
কাজ করতে থাকে। এমন লোক খুঁজে পাওয়া দুস্কর যিনি বৈশাখী মেলা বিরোধী। মেলা
কমিটি নিয়ে হয়তো অনেকেরই আপত্তি আছে কিন্তু, মেলার আয়োজন নিয়ে নয়। সকলেই
অধীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করতে থাকেন দিনটির জন্য।
বৈশাখী মেলাকে ঘিরে ডঃ শেখ আলীমুজ্জামান এর নেতৃত্বে প্রতিবছর একটি কমিটি
নিরলস কাজ করে থাকেন, যার ফলশ্রুতিতে সফলতার মুখ দেখে , আর আমরা সকলে মিলে
তা উপভোগে আনন্দ উল্লাসে মেতে উঠি।
কমিটি কমিটির মতো কাজ করে থাকে বলেই এমন বড় একটি আয়োজন সম্পন্ন হয়। নতুবা
হযবরল অবস্থা হয়ে যেতো।
কিন্তু , আমরা কি কখনো ভেবে দেখেছি এমন একটি আয়োজনের পেছনে কি শ্রমটাই না
দিতে হয় ! আসুন , আন্দাজ মতো একটা ধারনা নেয়া যাক ( সম্পূর্ণ অনুমান নির্ভর,
সত্য বলে মনে করার কোন কারন নেই ) কি কি কর্মযজ্ঞ পরিচালনা করতে হয় ।
প্রথমেই যা করতে হয় তা হলো একটি সম্ভাব্য তারিখ নির্ধারণ এবং মাঠ প্রাপ্তি
সাপেক্ষে পরবর্তীতে অর্থ যোগানের ব্যবস্থা সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাড়ায়।
এর উপর রয়েছে বিভিন্ন প্রশাসনিক সম্মতি আদায় ( অগ্নিনির্বাপক, স্বাস্থরক্ষা,
শব্দ দূষণ এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ) , বিভিন্ন সংস্থার সাথে যোগাযোগ ও
চুক্তিপত্র , সাংস্কৃতিক ( জাপান-বাংলা উভয় দেশের ) সংগঠন সমূহের সাথে
যোগাযোগ , অতিথিদের সম্মতি গ্রহন , বাংলাদেশ থেকে শিল্পী নির্বাচন ও লিয়াজো
রক্ষা করে চলা এবং ভিসার ব্যবস্থা করা , শিশুদের অভিভাবকদের সাথে যোগাযোগ ও
রিহার্সাল, স্টেজ পরিকল্পনা, আনুষঙ্গিক কেনাকাটা সহ হাজারো কর্ম পরিচালনা
করতে হয় কমিটিকে। রয়েছে স্টল মালিকদের সাথে যোগাযোগ করে তাদের সম্মতি আদায়
করা।
আর এই সব কর্ম সমাধা করতে হয় নির্দিষ্ট দিনটির পূর্বেই। মেলার পূর্ব রাতে
অনেকটা চাঁদ রাতের মতোই কাটে সংশ্লিষ্টদের। তারপর অনুষ্ঠিত হয় সেই
মাহেন্দ্র দিনটি অর্থাৎ 'বৈশাখী মেলা'।
মেলা কমিটির কর্ম পরিচালনায় তো মেলা অনুষ্ঠিত হয়। সে মেলায় আমরা অংশ নিয়ে
দিনভর আনন্দ উল্লাসে মেতে থাকি। জাপানে বাংলা সংস্কৃতিকে তুলে ধরার কাজে
আমরা যুক্ত হই। কিন্তু , এতে জাপানে কি বাংলাদেশকে কি আদৌ তুলে ধরা হয় ?
জাপানে আমরা পেরেছি কি বাংলাদেশকে তুলে ধরতে ? মেলা শেষে দেখা যায় পুরো মেলা
প্রাঙ্গনই যেনো এক ভাগাড়ে অর্থাৎ ময়লার স্তুপে পরিনত।
খাবারের উচ্ছিষ্ট , এলকোহল নিষিদ্ধ থাকা সত্বেও বিয়ারের খালি ক্যান ,
সিগারেট ফুঁকার পর অবশিষ্ট অংশটি থেকে শুরু করে কি নেই সেখানে ? এমন কি শিশু
সন্তানের ব্যবহৃত লেংটিটি পর্যন্ত যত্রতত্র ফেলে রাখা রীতিমতো আমাদের
অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। বাড়ী থেকে আনা খাদ্যসামগ্রী পর্যন্তও দেখা মিলে মেলা
শেষে আশেপাশে । এই গুলিই যেনো মেলায় দর্শনার্থী হিসেবে আমাদের দায়িত্ব পালন
!
শুধুই কি তাই ? মেলা আয়োজন স্থলের আশেপাশের অবস্থা , এমন কি পার্শ্ববর্তী
কম্বিনিয়েন্স'র টয়লেট গুলিতেও আমরা বৈশাখী মেলার স্বাক্ষর রেখে যাই। বিষয়টি
জাপানের মাটিতে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বলে কতোটা সহায়ক, না ভেবে আমরা
করে যাচ্ছি প্রতি বছর ।
ইকেবুকুরো নিশিগুচি পার্কটি আসন্ন ২০২০ গ্রীষ্মকালীন টোকিও অলিম্পিক ও
প্যারা অলিম্পিক কে ঘিরে সংস্কারাধীন থাকায় অনেক চড়াই উতরাই পেড়িয়ে অবশেষে
এবছর হিগাশি ইকেবুকুরো পার্ক-এ মেলা আয়োজনের অনুমতি মিলে। পার্কটি জাপানের
তৃতীয় সর্বোচ্চ উচু ইমারত ( এক সময়ের সর্বোচ্চ উচু ) খ্যাত "সান সাইন সিটি
" সংলগ্ন হওয়ায় আলাদা একটি পরিচিতি রয়েছে।
এবছর বৈশাখী মেলার প্রভাব পড়েছিল সুসজ্জিত সান সাইন সিটি ভবনেও। সংস্কৃতি
প্রিয় বাঙ্গালী জাতী এখানে উচ্ছিষ্ট গুলি রেখে গেছেন সযত্নে নিজেদের ঘরের
মতো ময়লা ফেলার স্থান মনে করে।
একই কারনে ইকেবুকুরো নিশিগুচি পার্কটি'র পার্শ্ববর্তী টোকিও নাট্যশালাটি
থেকেও প্রতিবছর বিভিন্ন অভিযোগ শুনতে হয়েছে আয়োজকদের
মেলার শোভা এবং প্রয়োজনীয় , স্টল সমূহ নির্দিষ্ট সময় অতিবাহিত হওয়া সত্বেও
বন্ধ না করা নিয়মিত একটি আচারে পরিনত হওয়ায় মেলা প্রাঙ্গন সময় মতো
পরিচ্ছন্ন করা সম্ভব হয়না । বিশেষ করে খাবারের স্টলগুলো । আবার কিছু কিছু
ক্ষেত্রে অবিক্রীত খাবার ফেলে যাওয়া ( নিষেধ থাকা সত্বেও ) আয়োজকদের বেশ
বিড়ম্বনায় ফেলে দেয়। প্রতিবছর একই ঘটনার পুনরাবৃতি ঘটেই চলেছে। স্টল
মালিকদের যেনো এই ব্যাপারে দায়িত্ব ও কর্তব্য বলতে কিছুই নেই !
আমাদের মনে রাখতে হবে যে মেলার মাঠে ফেলে যাওয়া আমাদের এই ময়লাগুলো
পরিস্কার করার পরই সংশ্লিষ্টদেরকে স্থান ত্যাগ করতে হয়। এতে করে তাদের উপর
বাড়তি চাপ পড়ে । আর এই কাজগুলি না করলে পরবর্তীতে মেলা আয়োজনের জন্য
কর্তৃপক্ষ আর কোন অনুমতি দিবে না। সাথে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নষ্টতো রয়েছেই
।
মেলা পরিচালনায় একাধিক উপস্থাপক থাকা সত্বেও বিষয় ভিত্তিক উপস্থাপনায় কয়েক
জনের উপস্থিতি পরিলক্ষিত হয়। তাদের উপস্থাপনায় মিশ্র ভাষার ব্যবহার
অনুষ্ঠানের অর্জনকে ম্লান করে দেয়। একই বাক্যে কথায় কথায় এনি ওয়ে , বাট
কিন্তু হোয়াট কি ধরনের হয়ে যায়। কাজ শেষ হলেও মঞ্চে সার্বক্ষণিক উপস্থিতি ও
দৃষ্টি কটু। তারচেয়েও বড় শ্রুতিকটু হলো উপস্থাপনায় ব্যক্তি সম্পর্ক টেনে এনে
সম্বোধন করা।
মনে রাখতে হবে জনসম্মুখে ব্যক্তি সম্পর্ক শোভা পায়না। মঞ্চে যাদের ডাকা হয়
নিঃসন্দেহে তাঁরা সন্মানিত ব্যক্তি। তাঁদের কে সন্মান দিয়েই সম্বোধন করা
বাঞ্ছনীয়। এখানে তুমি বা তুই সম্বোধন করা গর্হিত কাজ ।
এছাড়াও কোন ব্যাক্তিকে অতিরিক্ত বিশেষণে বিশেষিত করে বার বার পরিচয় করিয়ে
দেয়াটা কতোটুকু দায়িত্ব ও কর্তব্যের মধ্যে পড়ে তা ভেবে দেখা দরকার।
মেলার শোভা বর্ধনে এবং আকর্ষণীয় করার জন্য অর্থ ব্যয়ে বাংলাদেশ থেকে শিল্পী
আনা হয়। তারা এসে সংগীত পরিবেশন করে শ্রোতাদের মন জয় (?) করেন, আবার চলেও
যান।
আমন্ত্রিত শিল্পীদের জানা থাকে যে জাপানে বা প্রবাসে বাংলা সংস্কৃতি ও একই
সাথে বাংলাদেশকে তুলে ধরার জন্যই অর্থ খরচ করে তাদের আনা হয়ে থাকে। শুধু
মাত্র দর্শকদের মন জয় করাই তাদের একমাত্র দায়িত্ব ও কর্তব্য নয় , এর বাইরেও
নৈতিক দায়িত্ব এবং কর্তব্য বলতে একটা দায়বদ্ধতা থেকে যায়। তার উপর রয়েছে
দেশপ্রেম বলতে অলিখিত এক দায়িত্ববোধ।
প্রবাসে বাংলা সংস্কৃতিকে তুলে ধরার জন্য শুধুমাত্র বাংলা সংগীত-ই যথেষ্ট
নয়। একই সাথে পোশাক সংস্কৃতি এবং অন্যান্যও ওতপ্রোত ভাবে জড়িত। তাই ,
প্রবাসে স্টেজ প্রোগ্রামে পোষাক নির্বাচনে বাংলাদেশীয় ঐতিহ্যে পোষাক
নির্বাচন বাংলা সংস্কৃতিরই একটি অংশ। এ দায়িত্ববোধটুকু তাঁদেরও থাকা উচিত।
বিদেশের মাটি তাই , যা ইচ্ছে টাইপের পোষাক পরিধান বাংলাদেশের পোষাক
সংস্কৃতিকে তুলে ধরা হয়না । অথচ , বৈশাখী মেলার অন্যতম উদ্দেশ্যই হচ্ছে
প্রবাসে বাংলাদেশীয় সংস্কৃতিকে তুলে ধরা। আর এই জন্যই তাদের আমন্ত্রন জানিয়ে
আনা ।
এছাড়া এবছরও আমন্ত্রিত শিল্পীদের গানের মধ্যে গানের কথার চেয়ে তার নিজের
কথাই বেশি থাকায় কথার মাঝ থেকে গানের কথা খুঁজে নিতে হয়েছে। যেমনটি বর্তমানে
বিজ্ঞাপনের মাঝ থেকে নাটক খুঁজে নেওয়া হয়ে থাকে। এভাবে অতিরিক্ত কথা এবং
বার বার মাইক্রোফোন দর্শকদের মাঝে দিয়ে তাদের কাছ থেকে গান আদায় করতে হলে
দেশ থেকে শিল্পী আনার আদৌ কোন প্রয়োজন আছে কি ?
মেলা শেষ হ'বার পর সময় মতো মাঠ পরিস্কার/পরিচ্ছন্ন করতে না পারার পেছনে
মেলার কিছু কিছু কো- অর্ডিনেটর , মডারেটর , সদস্যরাও কম দায়ী নয় । কিছু কিছু
( সবাই নয় ) কো- অর্ডিনেটর , মডারেটর , সদস্য রয়েছেন যারা মেলা শেষ হওয়ার
পর তৃষ্ণা নিবারণে বসে পরেন ।
অথচ মেলা প্রাঙ্গনে মদপান সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ । নিয়মটি তাদের জানা এবং নিয়ম
নির্ধারণে তারা জড়িত । কিছু বললে মেলা শেষ হওয়ার কথা মনে করিয়ে দেন তারা।
অথচ এলকোহল পানরত অবস্থায় আড্ডায় মেতে উঠেন । তাদের কিছু বলাও যায়না । অনেকে
আবার কর্মী সভাটাও সেরে ফেলতে চান ।
অন্যরা যে , পরিশ্রম করে যাচ্ছেন মাঠের পরিচ্ছন্নতা ফিরিয়ে আনতে সেইদিকে
তাদের ভ্রূক্ষেপ নেই । এইবছর ব্যাপারটি খুবই দৃষ্টি কটু ছিল ।
অথচ এই ছোট ছোট দায়িত্ব ও কর্তব্য গুলি যদি আমরা স্ব স্ব অবস্থান থেকে
সঠিকভাবে পালন করে যাই, তাহলে অক্লান্ত পরিশ্রম করে যে উদ্দেশ্যকে সামনে
নিয়ে জাপানের মাটিতে বৈশাখী মেলার আয়োজন করা হয় তা স্বার্থক যে হবে তা
নিঃসন্দেহে বলা যায়।
জাপানে বাংলা সংস্কৃতি ও একই সাথে বাংলাদেশকে তুলে ধরা হবে ।
আমাদের সকলের শুভ বুদ্ধির উদয় হউক ।।
ছবি – সুখেন ব্রহ্ম
rahmanmoni@kym.biglobe.ne.jp
ARNING:
Any unauthorized use or reproduction of 'Community' content
is strictly prohibited and constitutes copyright infringement liable to
legal action.
[প্রথমপাতা] |
|