|
(মতামত সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব)
রাহমান মনি
স্মৃতির মণিকোঠায়
সাংবাদিক সফিউদ্দিন আহমেদ ভাই

বয়সের ব্যবধানে তিনি আমার পিতার
সমতুল্য হলেও আমাদের সম্পর্কটা ভাই-ভাইয়ের মতো। তাঁকে সফি ভাই বলেই সম্বোধন
করতাম।
বলছিলাম ভাষা সৈনিক, ছাত্রনেতা, সংগঠক, বাংলাদেশ মফঃস্বল সাংবাদিকতার পথিকৃৎ
ও চারণ সাংবাদিক সফিউদ্দিন আহমেদ এর কথা।কিছু কিছু ব্যক্তি থাকেন তিন
পুরুষের ভাই হয়ে থাকেন। অর্থাৎ পরস্পরায় তিন পুরুষ তাঁকে ভাই বলে সম্বোধন
করে থাকেন। সফি ভাই তাঁদেরই একজন।
সফি ভাই মানেই, সুঠাম দেহের ভরাট কণ্ঠের একজন সাহসী যোদ্ধ্বা। যিনি ১৯৫২
সালের ভাষা আন্দোলনে তৎকালীন মুন্সিগঞ্জ মহকুমার নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। সে সময়
তিনি জগন্নাথ কলেজ ছাত্র সংসদের জিএস (সাধারন সম্পাদক) ছিলেন।
মুন্সিগঞ্জ জেলার লৌহজং উপজেলার হাড়িদিয়া গ্রামে ১৯২২ সালের ১ নভেম্বর জন্ম
নেয়া ক্ষণজন্মা অকুতোভয় জাতির এই বীর সন্তানের সাথে পরিচয় অনেকটা পারিবারিক
ভাবেই। আমার ফুফু, মুন্সিগঞ্জের এ,ভি,জে,এম সরকারী উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের
শিক্ষিকা ফিরোজা বেগম ( মুন্সিগঞ্জ জেলা সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট সভানেত্রী
খালেদা খানম এর মাতা ) এবং আমরা একই বাউনডারীতে ( মমতাজ কুটির , মাঠপাড়া )
বসবাস করা জনিত কারনবশত ১৯৭২ সাল থেকে সফি ভাই এর সাথে পরিচয়। সফি ভাই
ফিরোজা বেগম এর বাসায় যাতায়াত করতেন। তার ভরাট কণ্ঠের জন্য বাসায় প্রবেশ করা
মাত্রই জানা যেত যে , সফি ভাই এসেছেন। গেটের কাছ থেকেই তিনি কথা বলা শুরু
করে দিতেন
পরে খালেদা আপা এবং আমাদের একই বাউন্ডারী তে বসবাস ছিল। খালেদা আপার
বাসাতেও সফি ভাইয়ের যাতায়াত করতেন। তাই, আমাদের পরিবারের সাথেও সফি ভাইয়ের
একটা সম্পর্ক হয়ে যায়।
অগ্রজ মোঃ মোস্তাফিজুর রহমান মঞ্জু ( বর্তমানে আব্দুল মোনেম ইকোনমিক জোন এর
ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার )’র হাত ধরে ১৯৭৩ সালে মুন্সিগঞ্জ সৃজনী
কচিকাঁচার মেলায় আমার পদযাত্রা শুরু হয়। সফি ভাই ছিলেন এই মেলার অভিভাবকদের
অন্যতম একজন। বীর মুক্তিযোদ্ধ্বা সাংবাদিক ইকবাল ভাই, কাজল ভাই, গাজী আফজল
বুলা ভাই, নান্টু ভাই, গোলাম কাদের গোলাপ ভাই, জুলহাস ভাই, খালেদা আপা, গাজী
আসাদুজ্জামান (গাজী ভাই), চন্দন দা, মুকুল ভাই সহ বড় ভাইদের বিশেষ স্নেহ
পেতাম মঞ্জুর ছোট ভাই হিসেবে। তাঁরা সবাই কচিকাঁচার মেলার সাথে জড়িত ছিলেন।
সফি ভাই তাদেরও শ্রদ্ধ্বা ভাজন ছিলেন ।
১৯৭৭ সালে কচিকাঁচার মেলার দ্বিতীয় জাতীয় শিক্ষা শিবির-এ মুন্সিগঞ্জ থেকে
আমি, উজ্জ্বল, রুবী, নুরুল হক, মুকুল আপা, বিপা চৌধুরী এবং গাজী আসাদুজামান
(গাজী ভাই) প্রতিনিধিত্ব করি। ১০ নভেম্বর থেকে শুরু হওয়া ঢাকার গুলশান ২
নাম্বার পার্ক এ ২ সপ্তাহ ব্যাপী শিক্ষা শিবির এর সমাপনী আয়োজনের প্রধান
অতিথী ছিলেন বাংলাদেশের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ।
সবার আত্মীয় স্বজন, পরিচিতজনরা সবার সাথে দেখা করতে যেতেন। তাদের সবাই হাতে
করে কিছু না কিছু নিয়ে যেতেন। এর-ই মধ্যে আশরাফ আলম কাজল ভাই, বড়ভাই মঞ্জু
সহ অনেকেই আমাদের দেখে গেছেন।
আমাদের তাবু টা ছিল সবচেয়ে বড়। গুলশান ২নং পার্কের দক্ষিন পূর্ব কোণে এর
অবস্থান ছিল। ৪৫ জন মিলে সেই তাবুটিতে থাকতাম বলে নাম দিয়েছিলাম ৪৫ ভাইয়ের
তাবু। আমি, উজ্জ্বল, নুরুল হক এবং গাজী ভাই একই তাবুতে ছিলাম। দুপুরের
খাবার খেয়ে দেড় ঘন্টার বিশ্রাম পেতাম।
তাবুর ভিতর সময় কাটাচ্ছি এমন সময় ডাক পড়ল মুন্সিগঞ্জ সৃজনী কচিকাঁচার মেলা
থেকে আগত সবার। সবাইকে অভ্যর্থনা কেন্দ্রে যেতে হবে। অতিথিরা আসলে সেখানেই
সাক্ষাতের ব্যাবস্থা করা হতো। আমরা তখন বুঝে গিয়েছি যে, কেউ একজন এসেছেন
আমাদের খোঁজ খবর নেয়ার জন্য। যেহেতু সবার ডাক পড়েছে তাই ,মুন্সিগঞ্জ সৃজনী
কচিকাঁচার মেলা সংশ্লিষ্ট কেউ হবেন তা নিশ্চিত।
কিন্তু কে হবেন !
সেখানে যাওয়ার পর তো আমাদের সবার চোখ ছানাবড়া। সফি ভাই বসে আছেন সেখানে।
আমাদের দেখে যেমন তার চোখেমুখে হাসির ঝিলিক তেমনি আমাদেরও ।
চিরচেনা সফিভাই প্রথমেই জানতে চাইলেন, কিরে তোরা কেমন আছিস ? ওরা কোথায় ?
অর্থাৎ বিপা আপা , মুকুল আপা রুবিদের কথা জানতে চাইলেন। কিছুক্ষনের মধ্যে
তারাও এসে গেলেন। তাদের অবস্থাও আমাদের মতোই। অর্থাৎ সফি ভাইকে পেয়ে আমরা
খুশীতে আত্মহারা। সবাই একত্রিত হওয়ার পর সফি ভাই বললেন তোদের জন্য তো আমি
কিছু আনতে পারি নাইরে।
কিছু নিতে না পারাটা যেনো একটা অপরাধ। আর এ অপরাধ যেন তাঁকে কুঁড়ে কুঁড়ে
খাচ্ছে। তাই, তিনি ব্যাথিত। অথচ আমরা সফি ভাইকে পেয়ে যে আকাশের চাঁদ হাতে
পাওয়ার চেয়েও বেশী খুশী তা তাঁকে বুঝাই কিভাবে ! সফি ভাই এসেছেন এটাই তো
আমাদের কাছে অনেক কিছু। আমাদের অভিভাবক কে পেয়েছি। আর কি চাই !
এরপর ১৯৮১ সাল থেকে মুন্সিগঞ্জ সৃজনী কচিকাঁচার মেলার শিশুদের কুচকাওয়াজ ,
শরীর চর্চা করানোর দায়িত্ব পড়ে আমার উপর। নুরুল হক ভাই পড়াশুনা নিয়ে
ব্যাস্ত হয়ে যাওয়ায়, রোকেয়া আকতার রুবি এবং আমি মিলে শিশুকিশোরদের
কুচকাওয়াজ এবং শরীর চর্চা করানোর দায়িত্ব পালন করতে থাকি। রুবি মেয়ে মানুষ
মাঝেমধ্যে সময় দিতে পারেনা। আমি ছেলে মানুষ , আমার সে ঝামেলা নেই।
লিচুতলায় এস,ডি,ও ( সাবডিভিশন অফিসার বা প্রাক্তন মহকুমা কর্মকর্তা )’র
বাসভবনের পার্শ্বে ছোট্ট ময়দানটিতে আমরা জাতীয় দিবস গুলির বিশেষ করে ১৬ই
ডিসেম্বর এবং ২৬ মার্চ ( মাঝখানে কিছুদিন ৭ই নভেম্বর , জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি
দিবস ) এর পূর্বে প্রতিদিন কুচকাওয়াজ শিখানোর পাশাপাশি ব্রতচারী নৃত্য,
ডাম্বেল নৃত্যসহ আরো অনেক রকমের শারীরীক কসরত করাতে ব্যস্ত সময় কাটাতে হতো।
শিশু-কিশোরদের উৎসাহ দেওয়ার জন্য প্রতিদিন চকলেট বা কিছু একটা দেওয়া হতো।
আর এর যোগান আসতো বড় ভাইদের কাছ থাকে। বীর মুক্তিযোদ্ধা, সাংবাদিক ইকবাল
ভাই, কাজল ভাই, খালেদা আপা, মঞ্জু ভাই, গাজী ভাইদের কথা-ই মনে পড়ছে বেশ। মনে
পড়ছে ভক্তিময় ঘোষাল (চৈতন্য ) দা’র কথা। আমরা সবাই চৈতন্য দা কে লর্ড ভাই
বলেই ডাকতাম। শিশুকিশোরদের কাছে লর্ড ভাই খুবই জনপ্রিয় ছিলেন। তিনিও
মুন্সিগঞ্জ এর সব শিশুকিশোরদের খুব ভালোবাসতেন। তার পকেটে শিশুদের জন্য কিছু
না কিছু থাকতো। বিশেষ করে লজেন্স। আউয়াল ভাই ( প্রয়াত , জেলা আনসার
কর্মকর্তা ) আসতেন , আসতেন খালেদা আপা সহ আরো অনেক মুরব্বীগন ।
সফি ভাই মাঝে মধ্যে আসতেন। কি কি করা হচ্ছে, কে কেমন করছে খোঁজ নিতেন।
কিছুক্ষন থেকে যাওয়ার আগে বলতেন, আমি তো ওদের জন্য কিছুই আনতে পারি নাইরে,
নিজের কাছে খুব খারাপ লাগে। আমি বলতাম সফি ভাই, আপনি যে আসেন এতেই আমি ,
আমরা যারপরনাই খুশি। কিছু আনতে হবে না।
একজন সৎ মানুষ এর প্রতিচ্ছবি ছিলেন আমাদের সফি ভাই। তাই বাড়তি খরচটা তাঁর
জন্য কষ্টকর হয়ে যেত। আজ এতো বছর পর তা উপলব্দি করতে পেরে সফি ভাইয়ের প্রতি
শ্রদ্ধ্বায় মাথাবনত হয়।
এর মধ্যে সফিভাই মুন্সিগঞ্জ সৃজনী কচিকাঁচার মেলার সভাপতি নির্বাচিত হলেন।
আমি তখন দফতর সম্পাদক, পরে সাংগঠনিক সম্পাদকে উন্নীত। সভা আহবান করার পর
সবাইকে জানান দেয়া, তাদের দস্তখত সংগ্রহ করার কাজটি আমার উপর। তখন মোবাইল
ছিলনা। তাই, ইমেইল, শর্ট ম্যাসেজ বা যখন তখন ফোন করার কোন ব্যাবস্থা ও ছিল
না। এদিকে এব্যাপারে কোন বরাদ্দ ও ছিলনা যে, রিক্সায় চড়ে দস্তখত সংগ্রহ করবো।
আর নিজের পকেট থেকে খরচ করার মতো সঙ্গতি বা ইচ্ছা কোনটাই ছিলনা। তাই, পায়ে
হাটা –ই ছিল একমাত্র উপায়। লম্বা একটা খাতা নিয়ে সবার দস্তখত নেয়ার কাজটা
ছিল আমার কাছে আনন্দের। কোন কোন সময় একাধিকবার যেতে হতো বৈ কি !
সফি ভাই থাকতেন পিটি ( প্রাইমারী ট্রেইনিং ) স্কুল এর কাছে। আর আমার বাড়ী
ছিল মাঠপাড়ায়। প্রায় দেড় কিলোমিটার এর পথ। সফি ভাই সাংবাদিক মানুষ। সব সময়
বাসায় থাকেন না। কাজেই সফি ভাইয়ের দস্তখত আনতে হলে একমাত্র উপায় হিসেবে
সকাল বেলায় তার বাসায় হানা দেওয়া ছাড়া দ্বিতীয় কোন পথ খোলা ছিল না।
বাসায় গেলে অনেক সময় পাওয়া যেতো, আবার কোন কোন সময় পাওয়া যেত না। পাওয়া না
গেলেও ভাবীর সাথে দেখা হত কথা হতো, কথা বলতাম। আমি ছিলাম তার ছেলের বয়সী।
সফি ভাইয়ের বড় ছেলে মুক্তি ( বর্তমানে গনপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের
একজন যুগ্মসচিব হিসেবে অবসর প্রাপ্ত ) এবং তৃতীয় মেয়ে তৃপ্তি মুন্সিগঞ্জ
সৃজনী কচিকাঁচার মেলার সদস্য ছিল। সুপ্তি, সুক্তি ওরা তখন আরো ছোট ছিল। আর
শারমীন একেবারেই ছোট। সফি ভাইয়ের ৫ মেয়ে এবং ২ ছেলে ছিল।
বলতে দ্বিধা নেই, সফি ভাইয়ের বাসায় যাতায়াতের মাধ্যমে যে বিষয় গুলি চোখে
পড়েছে বা অভিজ্ঞতা অর্জন হয়েছে তা হচ্ছে একজন সৎ সাংবাদিক আর্থিক ভাবে
স্বচ্ছল হতে পারেন না। এটা থাকে তো ওটা থাকে না। অথচ সফিভাই যদি টাকা
কামানোর দিকে নজর দিতেন তাহলে অনেক কিছুই করতে এবং করাতে পারতেন। অবশ্য সফি
ভাই সেটা করলে আজ তাঁকে নিয়ে এই গর্বটা আর করার সুযোগ হতো না ।
১৯৮২ সালের নভেম্বর মাসের কোন সন্ধ্যায় মুন্সিগঞ্জ সৃজনী কচিকাঁচার মেলা
এবং ঘাস ফুল নদী সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী আয়োজিত এক ঈদ পুনর্মিলনী
অনুষ্ঠানের আয়োজনে প্রধান অতিথি হিসেবে মহকুমা প্রশাসক সহ অনেক গন্যমান্য
ব্যাক্তিদের উপস্থিতিতে আমারও উপস্থিতি ছিল সেখানে। তখন আমি মুন্সিগঞ্জ
হরগংগা সরকারী মহাবিদ্যালয়ের দ্বাদশ শ্রেনীর শিক্ষার্থী মাত্র।
বলা বাহুল্য সফি ভাই, খালেদা আপা, ইকবাল ভাই, চন্দন দা , ফেনু দা, নান্টু
ভাই, ডাঃ সমির দা, কাজল ভাই, আরশেদ উদ্দিন চৌধুরী, কানু ভাই, কামুজ্জামান
ভাই, কাম্রুল হাসান কাম্রুল ভাই ( প্রয়াত ) , কাজী ইমদাদুল হক, নাইমুল হক (
ও,সি মুন্সিগঞ্জ থানা ), শিপ্রা দাস, ডাঃ নিলুফার রুনু ( শিশু বিশেষজ্ঞ ) ,
শিরিন আপা , বেবী আপা , ডাঃ হারুন ভাই, মুকুল ভাই, গাজী ভাই, অগ্রজ মঞ্জু
ভাই এবং তার বন্ধু সাকী ভাই ------- সহ আরো অনেক অতিথিদের উপস্থিতিতে
সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান চলছে। আমার বন্ধু ইকবাল, নূরুল হক মিনু, সাহাবুদ্দিন,
উজ্জ্বল , মমতা দাস , বেবী, ছবি , পপি , ময়না , রুবি , মুকুল আপা সহ আমরা
তো ছিলাম-ই। ছোটদের মধ্যে কান্তা , টূটূ ( প্রয়াত ) , তৃষ্ণা , মুন্নী সাহা
( সাংবাদিক ) । আমি কনিষ্ঠদের একজন।
অনুষ্ঠানের শেষ পর্যায়ে শুরু হলো লটারীর মাধ্যমে যার হাতে যেটা ওঠে তাকে
সেটাই করতে হবে। ছোট বলে আমাকে বাদ দেয়া হয়নি। সব বড় ভাইদের উপস্থিতিতে
দুরু দুরু মন নিয়ে একটি কাগজ তুলে এদিক সেদিক তাকিয়ে “আমবাত রসবাত, গিঠায়
গিঠায় বাত, ওঠলে বসতে পারেনা, বসলে ওঠতে পারে না--------- --- বলে
নাতিদীর্ঘ এক ক্যানভাস” করে ফেললাম। অর্থাৎ আমার ভাগে পড়েছিল “ফুটপাতে ঔষধ
বিক্রী”।
কারোর ভাগে গান , কারোর বা নাচ। এইভাবে অভিনয় , আবৃতি --- আরো কতো কি !
এবার ফলাফল ঘোষণার পালা। সবাই অপেক্ষা করছেন ফলাফল শোনার জন্য। অপেক্ষা
করছি আমিও। বিচারকদের একজন সফি ভাই। খালেদা আপা , ইকবাল ভাই তো আছেন ই
বিচারক মন্ডলীতে। কেনো জানি, ইকবাল ভাইকে খুব ভয় পেতাম। এই ভয় শ্রদ্ধার ভয়।
আমি কেনো, আমাদের দু’চার ব্যাচ সিনিয়র এবং দু”চার ব্যাচ জুনিয়র সবাই ইকবাল
ভাইকে ভয় পেত এবং শ্রদ্ধ্বাও করতো।
সেই ফলাফল কিনা ইকবাল ভাইয়ের হাতে। যদিও পরে ঘোষণা করেছেন আশরাফ আলম কাজল
ভাই। প্রথম পুরস্কার হিসেবে যখন আমার নামটি ঘোষণা করা হলো, তখন শুধুই তালি
শোনার কথাই কেবল মনে আছে। সম্বিৎ ফিরে পাই একটু পর, যখন সফি ভাই বললেন,
ভালোই করেছিস। পড়াশুনা বাদ দিয়ে কি এগুলিই দেখা হয় ? এটা ছিল আমার প্রতি
তাঁর বিশেষ স্নেহ ভরা শাসন।
সংগঠন কর্তৃক আহবান করা সব সভাতেই যে সফি ভাই আসতে পারতেন এমনটি নয়।
সাংবাদিক মানুষ। ব্যস্ততার কারনেই অনেক সময় আসতে পারতেন না ইচ্ছা থাকা
সত্বেও। তবে মাঝে মাঝে আগে আগেই চলে আসতেন ।
যেহেতু আমি দফতর এর কাজ গুলি দেখতাম তাই সবার আগেই আমাকে যেতে হতো। আর
চাবিটিও থাকতো আমারই কাছে। আমাকে কাছে অনেক গল্প শোনাতেন সফি ভাই। ছাত্র
জীবনের বিভিন্ন সংগ্রাম এর কথা, হুলিয়া মাথায় নিয়ে পালিয়ে বেড়াবার কথা। জেল
জীবনের কথা। ভাষা আন্দোলন এর কথা। তার নিজের জীবনের প্রাপ্তি না প্রাপ্তির
কথা।
বলতেন, আজ আমরা যে ভাষায় কথা বলতেছি তা কিন্তু এমনি এমনিতেই পাওয়া যায়নি।
অনেক সংগ্রাম, ত্যাগ তিতিক্ষার মধ্য দিয়ে আদায় করতে হয়েছে।
আমি চারণ কবি দেখিনি, চারণ সাংবাদিক দেখেছি, কাছ থেকে দেখেছি। যিনি কিনা
কাধে একটি ব্যাগ ঝুলিয়ে মুন্সিগঞ্জ এর একপ্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে ঘুরে
ঘুরে সংবাদ সংগ্রহ করেছেন। সেই চারণ সাংবাদিক হচ্ছেন আমাদের প্রিয় সফি ভাই।
সফি ভাইদের সময়ের সাংবাদিকতা এতো সহজ ছিল না, ছিল না অর্থের ছড়াছড়ি। কিন্তু
ছিল পেশার প্রতি শ্রদ্ধ্বা, কর্তব্য প্রবনতা এবং ন্যায় নীতি। নীতির কাছে
সফি ভাই কোন আপোষ করেন নি।
সারাদিন খাটাখাটুনি করে সংবাদ সংগ্রহ করে সন্ধ্যার পর সামসু মিয়ার চায়ের
দোকানে বসতেন সফি ভাই। সাংবাদিক ইকবাল ভাই, সেলিম ভাই, সুনির্মল স্যার,
হারাধন গাংগুলী স্যার প্রমুখেরা সফি ভাই থেকে সংবাদ সংগ্রহ করে তা পরিবেশন
করতেন। সে সময় মুন্সিগঞ্জে কোন প্রেস ক্লাব ছিল না। সামসু মিয়ার চায়ের
দোকানকেই আমরা প্রেস ক্লাব বলতাম আড়ালে আবডালে।
সফি ভাই একজন দক্ষ সংগঠক ছিলেন। তিনি ছিলেন আজীবন পরিশ্রমী এক যোদ্ধ্বা
তিনি তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশনের অন্যতম
প্রতিষ্ঠাতাও। ১৯৬১ সালে তিনি এ সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন এবং
বাংলাদেশ সাংবাদিক সমিতির বহুবার সভাপতি হন।
নিজের জন্য কিছু না করলেও মফস্বল সাংবাদিকদের ন্যায্য বেতন ও মর্যাদা
প্রতিষ্ঠার জন্য নিরলসভাবে কাজ করে গেছেন তিনি। সরকার নির্ধারিত বেতন
(রোয়েদাদ) অর্থাৎ ওয়েজ বোর্ড বাস্তবায়নের লক্ষ্যে প্রেস কমিশন আর
কাউন্সিলের সদস্য হয়ে সংবাদকর্মীদের বেতন কঠামো গঠনে নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করে
গেছেন।
তার আজীবন স্বপ্ন ছিল বাংলাদেশের মফস্বল শহর গুলিতে একটা করে প্রেস ক্লাব
প্রতিষ্ঠা করা। তিনি তাতে অবদান রেখেছেন।
লড়াকু এই বীর সৈনিক ১৯৪৮ সালে মুন্সীগঞ্জ হরগঙ্গা কলেজ ছাত্র সংসদের সাধারণ
সম্পাদক থাকাবস্থায় বাংলা মাতৃভাষা জন্য রাজপথে আন্দোলনে অংশ নিয়ে কারাবরণ
করেছেন একাধিকবার। ১৯৫০ সালে রাজশাহীর খাপড়া ওয়ার্ডে বন্দী থাকাবস্থায় গুলি
বর্ষণ করা হলে বুদ্ধি বলে প্রাণে বেঁচে যান তিনি।
১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের সময় ঢাকার জগন্নাথ কলেজ ছাত্র সংসদের সাধারণ
সম্পাদক থাকা অবস্থায় সফিউদ্দিন আহমদ অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। ’৫২ এর
ভাষা আন্দোলনে অংশ নিয়েও তিনি কারাবরণ করেন। এর ফলে তিনি ভাষা সৈনিক হিসেবে
উপাধি পান।
চারণ সাংবাদিক সফি ভাই জাতীয় প্রেসক্লাবের সদস্য এবং মুন্সিগঞ্জ
প্রেসক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা ও বিক্রমপুর প্রেসক্লাবের প্রাক্তন সভাপতিসহ
বিভিন্ন সংগঠন সংস্থা এবং প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তাঁকে মফস্বল
সাংবাদিকতার পথিকৃৎ বলা হয়ে থাকে।
ইন্টারন্যাশনাল প্রেস ইনস্টিটিউট কর্তৃক আয়োজিত ২৬ জাতি দক্ষিণ-পূর্ব এশীয়
সাংবাদিকদের কনফারেন্সে তিনি বাংলদেশের প্রতিনিধিত্ব করেন। শ্রীলঙ্কায়
অনুষ্ঠিত কনফারেন্সের প্রতিযোগিতা অংশে, সিরিজ বক্তৃতায় বাংলাদেশের গ্রামীণ
সাংবাদিকতার ওপর বক্তব্য রেখে তিনি প্রথম হওয়ার গৌরব অর্জন করেন। ১৯৮৭ সালে
ভারতে অসম’র গোয়াহাটিতে অনুষ্ঠিত অসম জার্নালিস্ট কনফারেন্সে তাকে প্রধান
অতিথি করে, পরে অসম জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশনের সম্মাননা প্রদান করেন।
বাংলাদেশের বিখ্যাত চারণ সাংবাদিক এবং বিক্রমপুরের কৃতিসন্তান হিসেবে ২০০০
সালে ভারতের কলকাতায় বিক্রমপুর সম্মেলনের পক্ষ থেকে সংবর্ধনা প্রদান করেন।
বিদেশের মাটিতে সফি ভাই সন্মানিত হলেও নিজ মাতৃভূমিতে তিনি তার প্রাপ্ত
সন্মান টুকু পাননি। ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহন থাকা সত্যেও অকুতোভয় এই
সৈনিককে আমাদের রাষ্ট্র কোন সন্মাননা দেয়নি।
রাষ্ট্র তাঁকে মূল্যায়ন না করলেও চারণ সাংবাদিক হিসেবে তিনি জনগণের হৃদয়ে
স্থান করে নিয়েছেন।
সাংবাদিকতায় অবদান রাখার জন্য জনকণ্ঠ “প্রতিভা সন্মাননা ১৯৯৯” , “মাওলানা
মনিরুজ্জামান ( চট্টগ্রাম ) স্বর্ণপদক ২০০২”, “বাংলাদেশ সুফি পরিষদ পদক
২০০৬” মাওলানা ভাসানী স্বর্ণপদক , তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া পদক , অতীশ
দিপংকর পদক সহ আরও বহু গুণীজন সন্মাননায় ভূষিত হন চারণ এই সাংবাদিক।
দেশের এই সংগ্রামী কৃতি সন্তান ও মফস্বল সাংবাদিকতার পথিকৃৎ গ্রামীণ
সাংবাদিক ও ভাষা সৈনিক সফিউদ্দিন আহমদ ২০০৯ সালের ২২ অক্টোবর রাতে
মৃত্যুবরণ করেন। ঢাকার আজিমপুর কবরস্থানে তাকে সমাহিত করা হয়।
আজীবন সংগ্রামী, আপোষহীন ছাত্রনেতা, ভাষা সৈনিক ও চারণ সাংবাদিক সফিউদ্দিন
আহমদ তার ত্যাগ ও আদর্শের জন্য অমর হয়ে থাকবেন।
মোঃ মোখলেসুর রহমান ( অঞ্জু )
rahmanmoni@gmail.com
ARNING:
Any unauthorized use or reproduction of 'Community' content
is strictly prohibited and constitutes copyright infringement liable to
legal action.
[প্রথমপাতা] |

|