|
(মতামতের জন্যে সম্পাদক দায়ী নয়।}
রাহমান মনি
জাপান প্রবাস জীবনে
আমার কৃষি কাজে সম্পৃক্ত হ’বার গল্প
বৃক্ষ রোপণ এবং সবুজের প্রতি ভালোলাগা,
ভালোবাসাটা শৈশব থেকেই। বলতে গেলে বলা যায় অনেকটা পৈতৃক সূত্রে পাওয়া।
পূর্ব পুরুষদের মধ্যে দাদা (মরহুম) আলী আহম্মদ হাওলাদার’র পর্যন্ত আয়ের
একমাত্র উৎস ছিল কৃষি জমি থেকে। তৎকালীন মুন্সিগঞ্জ মহকুমার টঙ্গিবাড়ী
থানার দিঘিরপাড় ইউনিয়নের সরিষাবন নামের এক বদ্ধগ্রাম আমার পৈতৃক নিবাস হলেও
লৌহজং এর সবুজ ছায়ান্যে ঘেরা পালের বাজার নামক গ্রামে আমার জন্ম ।
পিতা প্রাক্তন থানা কৃষি কর্মকর্তা মরহুম আলহাজ্ব মোঃ ফজলুর রহমান এর
কর্মক্ষেত্রের সুবাদে সেখানে আমার জন্ম হলেও শৈশব কাটে সরিষাবন গ্রামেই।
যদিও কৈশোর থেকেই পিতা কর্তৃক ক্রয়কৃত মুন্সিগঞ্জ সদরের মাঠপাড়াতেই বড় হয়েছি।
মনে পড়ে শিশুকালে পাকা আম খাওয়ার পর আটি খানি মাটির নিচে পুঁতে রাখতাম গাছ
হওয়ার আশায়। কোন কোন সময় চারা অঙ্কুরিত হতোও। এছাড়াও রমজান মাসে ইফতারির
জন্য ছোলা ভিজিয়ে রাখলে সেখান থেকে কয়েকটি ছোলা নিয়ে মাটিতে পুতে রাখতাম।
সেখানে কিছু চারা অঙ্কুরিত হলে কি যে ভাল লাগতো সে অনুভূতির কথা ভাষায়
প্রকাশ করার মতো নয়। অন্তর দিয়ে অনুভব করা যায় মাত্র। প্রয়োজনের অতিরিক্ত
পানি দেওয়া হ’ত যদি তাড়াতাড়ি বড় হয়ে ফলন দেয়, এই আশায়। যদিও সে চারা
কিছুদিন পর নিজ আয়ুষ্কাল আর ধরে রাখতে পারতো না। অনেকটা আমার বৃক্ষরোপণ
স্বপ্নের মতো।
একটু বড় হবার পর শুরু হ’লো বাগান করার শখ। মাঠপাড়ার মমতাজ কুটির ( বর্তমানে
উইলস লিটল ফ্লাওয়ার কিন্ডারগার্টেন ) এর সম্মুখ ভাগটাতে ছোট্ট বাগানের
সৌন্দর্য বৃদ্ধিতে চারা সংগ্রহে বিভিন্ন স্থানে হানা দিতে গিয়ে পাঁচমিশালি
অভিজ্ঞতা এবং হরেক রকমের ফুলের সমাহার, নিয়মিত ভাবে পানি দেওয়ার কথা
স্মৃতিতে আজও চির অম্লান।
মুন্সিগঞ্জ এর হরগঙ্গা সরকারী মহাবিদ্যালয়ে অধ্যায়নকালীন সময়ে বিভিন্ন ফুল
গাছের চারা সংগ্রহ অন্যতম একটি শখে পরিনত হয়। আর এই ব্যাপারে উৎসাহের সঙ্গী
ছিল বন্ধু ইকবাল হোসেন খান। আর অর্থের যোগানটা আসতো খন্ডকালীন শিক্ষকতা
করার আয় থেকে।
মনে পড়ে ফুলের চারা সংগ্রহ করার কাজে মাঝে মধ্যেই চলে যেতাম ঢাকার নীলক্ষেত
এবং নিউমার্কেট এলাকাগুলোতে। এছাড়াও মাঝে মধ্যে আশপাশের বাগান গুলোতে হাত
যে পড়তো না, তা কিন্তু নয়। এমন কি হাত পড়েছিল মুন্সিগঞ্জ জেলার এস,পি’র
বাসভবনের বাগানেও। লক্ষ্য একটাই ভাল ফুলের চারা সংগ্রহ এবং নিজ বাগানে তার
স্থান দেয়া।
হরগঙ্গা কলেজে পড়াকালীন বি,এন,সি,সি ( বাংলাদেশ ন্যাশনাল ক্যাডেট কোর )
করার সুবাদে প্রায়শই বৃক্ষরোপণ অভিযানে অংশ নিতে হতো । এছাড়াও নিজ উদ্যোগে
স্বতঃস্ফূর্ত বৃক্ষ রোপণের অংশ হিসেবে মাঠপাড়ার রাস্তার দু’পাশে কড়ই গাছের
চারা রোপণ করতাম পথিকের ছায়া পাওয়ার আশায়। যদিও চারাগুলো শৈশবেই ভোজনপ্রিয়
গরু ছাগলের খাদ্যে পরিণত হওয়ায় সেই আশাও নিরাশায় পরিণত হতে বেশীদিন অপেক্ষা
করতে হতো না।
স্নাতক সম্পন্ন করে আশির দশকের মধ্যভাগে ভাগ্যের অন্বেষণে চলে আসি জাপানে।
জাপানে আসার পর প্রথম প্রথম কেবলি অর্থ কামানোতেই মনোনিবেশ করাতে সবুজের
প্রতি ভালোবাসায় কিছুটা ভাটা পড়ে । অন্যভাবে বলা যায় ফুরসত না থাকায় এক
কথায় ভুলেই যাই।
১৯৯১ সালে বিয়ে করার পর কিভাবে যেন সবুজের প্রতি ভালোবাসার পুনঃযোগাযোগ
সংযোগ সম্ভব হয়। প্রথমেই কেবল ফুলগাছ দিয়ে ।
১৯৯২ সালে আমার প্রথম সন্তান ইফা’র জন্ম উপলক্ষ্যে ‘আসাগাও’নামের একটি ফুল
( সকালে প্রস্ফুটিত হয় বলে আসাগাও নামকরন করা হয় । যদিও একই গোত্রের দুপুরে
এবং বিকেলে প্রস্ফুটিত ফুলের অস্তিত্বও রয়েছে ) –এর গাছ দিয়ে।
টোকিওর সুগিনামি জেলার তাকাইদো নামক শহরে জাপানি স্ত্রী এবং সন্তান নিয়ে
বসবাস করি। জাপানের নিয়ম অনুযায়ী এজেন্ট এর মাধ্যমে বাড়ী ভাড়া নেয়ার কারনে
সাধারনত বাড়ীওয়ালার সাথে তেমন একটা সখ্যতা গড়ে উঠে না। পাশেই বাড়িওয়ালা
থাকেন। মাঝখানে অযত্নে পড়ে থাকা কিছুটা খালি জায়গা। রিটায়ার্ড করার পর
বয়স্ক ভদ্রলোক সস্ত্রীক বাড়ীতে বসবাস করেন। সন্তানরা নিজেদের মতো করে ভিন্ন
ভিন্ন স্থানে বসবাস করেন। মুন্সিগঞ্জ এর আঞ্চলিক রেওয়াজ অনুযায়ী বাড়ীওয়ালার
সাথে আলাপ চারিতায় ঘনিষ্ঠ একটা সম্পর্ক গড়ে উঠে। তাকে ওকা সান ( জাপানে
মা-কে ওকা সান বলা হয়ে থাকে ) সম্বোধন করি। এমন কি বাসায় ভালো কিছু রান্না
হলেই তাকে কিছুটা দিয়ে আসা হয়। বিনিময়ে তিনিও জাপানী ফল বা স্ন্যাক্সস
জাতীয় কিছু একটা দিয়ে যান। অনেকটা টেইক এন্ড রিটার্ন এর মতো।
কি যেন খেয়াল চাপলো হঠাৎ একদিন ওকা-সান কে বললাম তোমার এই জায়গাটা তো এমনিই
পড়ে আছে, আমাকে ব্যবহার করার অনুমতি দাও, আমি চাষাবাদ শুরু করি, তুমিও টাটকা
সবজী খেতে পারবে।
তিনি এককথায় রাজী হয়ে গেলেন এবং আমাকে অবাক করে দিয়ে পরেরদিন আগাছা গুলোর
অনেকটাই পরিষ্কার করে ফেললেন দুই জনে মিলে।পরের দিন আমিও তাদের সাথে যোগ
দিয়ে তিন জনে মিলে পরিশ্রম করে মোটামুটি একটা অবস্থানে নিতে সক্ষম হ’লাম।
যেখানে বীজবপন বা চারা রোপণ করা যায়।
প্রথমেই স্থানীয় একটি দোকান থেকে টমেটো, বেগুন, কাচা মরিচ, পিমান এর সাথে
কিছু ফুলের চারাও কিনে আল্লাহ্র উপর ভরসা করে শুরু করলাম।
এইভাবেই জাপানে আমার শখের চাষাবাদের শুরু।
প্রতিদিন নিয়ম করে পানি দেয়া এবং কাজে যাওয়ার আগে পরিচর্যা করা এক প্রকার
অভ্যাসে পরিণত হয়। পরিচর্যার নামে আসলে বাগান দেখা ই মূল উদ্দেশ্য। লোকে বলে
বাংলার মাটি নাকি উর্বর ভূমি। কিন্তু জাপানে প্রমাণ পেলাম উর্বর মাটি আসলে
কি। কোন প্রকার সার ছাড়াই এবং অযত্নে পড়ে থাকা ভূমিতে উদ্ভিদ এবং এর ফলন
দেখে আমি তো অভিভূত একই সাথে আল্লাহ্র প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই।
ডিসেম্বর, জানুয়ারি এবং ফেব্রুয়ারি এই তিন মাস বাদ দিয়ে বিভিন্ন সবজীর
চাষের সময় বাংলাদেশী সবজী গাছ লাগানোরও ইচ্ছা জাগে মনে। হাজার হউক বাঙালী
পোলা । মনে প্রাণে বাঙালী । এছাড়া পরিমানে খুব কম হলেও ওই সময় পুইশাক , করলা
পাওয়া যেতো। এই দুইটি সবজী আমার খুব ই প্রিয়। তাই এই দুইটি সবজী চাষ করার
খুব ইচ্ছা জাগে মনে।
পরিমানে কম হলেও যেহেতু পাওয়া যায় তার মানে এর বীজ অথবা চারা অবশ্যই পাওয়া
যাবে ক্ষীণ এক আশা ছিল মনে। কিন্তু কোথাও না পেয়ে অবশেষে বাজার থেকে কেনা
পুইশাকের কাণ্ডকে মাটিতে পুঁতে রাখি। এতে কাজও হয়। সেই সময় আজকের মতো
ইন্টারনেট সুবিধা ছিলনা। এখন তো অনলাইনে সব কিছুই পাওয়া যাচ্ছে মাত্র একটি
ক্লিক এর মাধ্যমে। যদিও ইতোমধ্যে জাপানে সব কিছুই সচরাচর হয়ে গেছে। এই জন্য
বাঙালীরা অনেকটাই ভুমিকা রাখেন।
বাংলাদেশ থেকে ডাটা, লালশাক, ঢেঁড়স, করলা, সিম, লাউ, ধনে, বরবটি বীজ আনানোর
ব্যবস্থা নিই এবং বপন করি। আশাপ্রদ ফলনও পাওয়া যায়।
সে আনন্দের কথা ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। আশ্চর্য হলেও সত্যি সুরেশ্বরী
ডাটা তিন মিটার পর্যন্ত লম্বা হয়। আমার বাড়ীওয়ালা মা কে বাঙালী স্টাইলে সব
কিছু রান্না এবং খাওয়া শিখাই। তিনি ও আমাকে বাংলাদেশী সবজীর জাপানি রান্না
শেখান। তার মধ্যে পুইশাক দিয়ে টেম্পুরা অন্যতম।
১৯৯৫ সালে আমার দ্বিতীয় সন্তান আশিক জন্ম নেয়ার সময় আব্বা এবং মা জাপান
আসেন।
অবসরপ্রাপ্ত কৃষি কর্মকর্তা আমার বাবা ফজলুর রহমানের হাতের ছোঁয়ায় সোনার
কাঠি রুপার কাঠির ছোঁয়ার মতো ছোট্ট পরিসরের আমার কৃষি প্রজেক্ট মাত্র একমাসে
অত্র এলাকায় আলোড়ন সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়। কারন, আয়তনে ছোট হলেও শহরের মাঝে
অচেনা সবজীর একটি বাগান যেখানে ডাটা বাঁশের মতো দাঁড়িয়ে , করলা এবং লাউ
মাচায় ঝুলছে, গাছে গাছে মরিচ ঝুলছে, উপরে পুঁইশাক নিচে ধনে পাতা দিয়ে সবুজে
শোভিত, তা দেখে পথিকেরা কিছুক্ষনের জন্য থমকে দাঁড়ায়। বিশেষ করে বাংলাদেশী
সবজীগুলি অচেনা হওয়ায় তা পরখ করে দেখেন। বয়স্কদের অনেকেই আবার ছবিও তুলে
নেন।
এইভাবেই চলে যাচ্ছিলো দিনগুলো।
১৯৯৮ সালে হঠাৎ করেই ব্যক্তি জীবন এবং সাংসারিক জীবনে এক কাল বৈশাখী এসে
ক্ষনিকের জন্য জীবনের স্বাভাবিক গতি থমকে দাঁড়ায়।
এক এবং চার বছরের দু’টি সন্তান নিয়ে একা পথ চলা শুরু হয়। বড় বাসা ছেড়ে দিতে
হয়। এক পর্যায়ে ওদের নিয়ে কয়েকমাসের জন্য বাংলাদেশে চলে যাই। আবার ফিরেও আসি।
আটমাস পর ফিরে এসে ছোট ভাই উজ্জ্বল (প্রয়াত) এর বাসায় কিছুদিন থাকার পর ২
রুমের একটি বাসা নিয়ে ১৯৯৯ সালে টোকিওর কিতা সিটিতে বসবাস শুরু করি। সবজী
চাষ করা তো দূরের কথা চিন্তাতেও আনা সম্ভব হয়নি বাস্তবতার কারনে।
অনেক চেষ্টা এবং আল্লাহ্র অশেষ রহমতে লটারির মাধ্যমে ২০০১ সালে একটি বড়
বাসা পাই একই শহরের কিরিগাওকা নামক স্থানে। যেখানে বর্তমানেও বসবাস করছি।
নতুন বাসার বারান্দাটি প্রত্যাশার চেয়েও বড়। ২১ মিটার লম্বা এবং ১.৮ মিটার
প্রশস্ত বারান্দাটি আমার সন্তানদের জন্য রীতিমতো ছোটোখাটো একটা খেলার মাঠ।
দক্ষিণ পশ্চিম কর্নার হওয়ায় আলো বাতাসের অবাধ চলাচল সব সময় স্থানটিকে
আলোকিত করে রাখে এবং বাগান করার করার জন্য উপযুক্ত পরিবেশ তাতে কোন সন্দেহ
নেই।
বাসায় উঠার পরের মাসেই ছেলের জন্মদিন হওয়ায় তার পছন্দের একটি ফুলের গাছ কিনে
বারান্দায় রেখে তাকে সারপ্রাইজ দেই। ফুল গাছটি একনাগাড়ে কয়েকমাস ফুল উপহার
দিয়ে বারান্দা আলোকিত করে স্বীয় আয়ুষ্কাল শেষ করে অবশেষে প্রাকৃতিকভাবে
বিদায় নেয়।
গাছটি ছাড়া বারান্দাটা খালি হয়ে যায় এবং অতীব প্রয়োজন ছাড়া বারান্দাতে
যাওয়ার উৎসাহ হারিয়ে ফেলি। আগে যেটা সকাল বিকাল দু’বেলা পানি দেওয়া ছাড়াও
ফুলের সৌন্দর্য উপভোগ করতে একাধিকবার বারান্দায় যেতাম।
এরপর ২০০২ সালের জুন মাসে নিকটস্ত অজি এলাকার একটি ফুলের দোকানে বাংলাদেশের
বোম্বাই মরিচ সদৃশ্য ৬টি মরিচ সহ একটি গাছ দেখতে পাই। মুল্য খুব রিজেনেবল
হওয়ায় সাতপাঁচ না ভেবেই কিনে নিয়ে এসে বারান্দায় তাকে স্থান দেই।
আমাদের তিন ভাইবোন ( ছেলে , মেয়ে এবং আমি )-এর সংসারে যত্ন আত্তিতে এবং
সুষম খাবার ( পানি ) পেয়ে গাছটি বেশ সতেজে বলীয়ান হয়ে ফুল ও ফল দেয়া শুরু
করে।
গ্রামের ছেলে হিসেবে বাংলাদেশের বোম্বাই মরিচ এবং এর গাছ ও ফলনের সাথে
পূর্ব থেকে পরিচিত থাকায় বর্তমান গাছটির ধরন এবং ফলন-এর দেখে পার্থক্য খুঁজে
পাই। তাই, আন্তর্জালের শরণাপন্ন হই একটু খোঁজ খবর নেয়ার জন্য।
আন্তর্জাল থেকে জানা যায়, মরিচটির নাম ‘হাবানেরো চিলি, বার্ড’স আই চিলি,
স্কচ বনেট পিপার’।
এই হাবানেরো চিলি খুব ঝাল হয়ে থাকে। এর ঝালের মাত্রা স্কোভাইল স্কেলে
১০০,০০০-৩৫০,০০০ ইউনিট পর্যন্ত হতে পারে। কাঁচাকালীন সময় এ মরিচের বর্ণ
সবুজ থাকে, কিন্তু পরিপক্ব হলে লাল হয়ে যায়। এ শস্যোর উৎপত্তি অ্যামাজনে।
এটি মেক্সিকোতে ছড়িয়ে পড়ে এবং খুব জনপ্রিয় হয়। । তথ্য সূত্র - https://risingbd.com/feature-news/243882।
কাঁচা মরিচ ছাড়া ঝাল তেমন একটা খেতে পারিনা । সন্তানরা তো আরও না। তাই ,
প্রবাসে পরিচিতজনদের মাঝে বিলিয়ে দেয়ার মধ্যেই আনন্দ খুঁজে পাই। এই মরিচ
পেয়ে প্রবাসীদের মাঝে আনন্দের আলোকছটা আমাকে দ্বিগুনভাবে উৎসাহিত করে এই
মরিচ চাষের ধারাবাহিকতায়।
জুন থেকে একটানা ডিসেম্বর পর্যন্ত তার ফলন পাওয়া যায়। মাঝখানে অতিরিক্ত
গরমের কারনে জুলাই আগস্ট মাসে কিছুটা কম হলেও সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বর
পর্যন্ত প্রচুর ফলন হয়।
এই কারনে পরের বছর আরও বেশী সংখ্যক চারা রোপণ করার প্রবণতা এমন পর্যায়ে
পৌঁছে যে সর্বোচ্চ ৩০ টি পর্যন্ত হাবানেরো মরিচের গাছ আমার বারান্দা বাগানে
শোভা পায়।
শুধুই কি হাবানেরো মরিচের গাছ লাগিয়ে কি আর তৃপ্তি পাওয়া যায় ? সাথে বেগুন
, টমেটো , করলা , লাউ , লাল শাক , ধনে পাতা , পুই শাক, দুন্দল , শসা’র সাথে
কাঁচা মরিচের গাছ তো রয়েছেই।
আর এদের যত্নে সকাল বিকাল প্রতিদিন ৬৪ লিটার পানি দেয়া সহ দেখভাল করা,
সপ্তাহন্তে ফলন সংগ্রহ এবং সবার মাঝে বিলিয়ে দেয়া, মাসে একবার সার দেয়া
আমার রুটিন দায়িত্বে পরিনত হয়। সকালবেলা মেয়ে এবং বিকেলে আমার পানি দেয়ার
পালা। কচি হাতে আমার মেয়ে ইফা খুব আনন্দের সাথেই পানি দেয় গাছগুলিতে। এর
মধ্যেই আনন্দ খুঁজে পাই। তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলি।
ছোট ছোট প্যাকেট করে ব্যাগ ভরে জাপান প্রবাসীদের কোন সামাজিক আয়োজনে অনেকের
মাঝে বণ্টন করার মধ্যে যে কি আনন্দ লুকায়িত তা লিখে বুঝানোর মতো নয়। সমাজের
সর্ব শ্রেনী থেকে দূতাবাস সংশ্লিষ্ট অনেকেই পূর্ব থেকে অনুরোধ করে রাখেন
যেনো ভুলে না যাই।
আজ 'সোনারং তরুছায়া' র পাঠকদের কাছে অবিশ্বাস্য একটি সত্য ঘটনা তুলে ধরতে
চাই। ঘটনাটি অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি।
২০১০ সালে অন্যান্য সবজী চাষ করার সময় একটি মরিচ গাছ যা স্থানীয় হোম
সেন্টার ‘ভিভা হোম’ থেকে কেনা হয় , নিয়মিত পানি দেয়ার সময় হঠাৎ করেই একটি
উদ্ভিদের অস্তিত্ব দেখতে পাই। অন্যান্য সময় এই জাতীয় উদ্ভিদের অস্তিত্ব চোখে
পড়লে আগাছা হিসেবে তার জীবন আর দীর্ঘায়িত হ’ত না। কিন্তু কেন জানি এই
গাছটির প্রতি সদয় হয়ে তাকে একটু সময় দেই এবং অপরিচিত হওয়ায় নজর দিয়ে যাই।
এক পর্যায়ে গাছটির তার স্বভাবসুলভ লতাপাতা ছড়াতে থাকে। স্নাতকে উদ্ভিদ
বিদ্যা একটি বিষয় থাকায় গাছটি আমার কাছে লতা জাতীয় উদ্ভিদ হিসেবে মনে হওয়ায়
তুলে ফেলতে আরও কিছুদিন অপেক্ষা করি, শেষটা দেখার জন্য। তখনো বুঝতে পারিনি
যে আমার জন্য বিস্ময় অপেক্ষা করছে। আমাদের মুন্সিগঞ্জের খুব পরিচিত , এমন
কি আমাদের বাসায় প্রতি বছরই এই সবজীটি লাগানো হতো। জাপানে ইতোমধ্যে ২৫ বছর
কেটে যাওয়ায় অনেকটাই অপরিচিত হয়ে যাই উদ্ভিদটির সাথে। যদিও সবজীটি আমার খুব
পছন্দের এবং পরিচিত।
কিছুদিন পর শুভ্র সাদা ফুল ফুটতে শুরু করলে গাছটির প্রতি মমতা এবং যত্ন আরো
বেড়ে যায়। অল্প কিছুদিনের মধ্যে তাতে ২টি সব্জীর অস্তিত্ব দেখতে পেয়ে আমার
চোখ তো চড়কগাছ ! সবজীটি আর কিছুই নয়, এ যে আমাদের মুন্সিগঞ্জের অতি পরিচিত
কহি বা কৈডা অনেকেই আবার চিচিঙ্গাও বলে থাকেন। ( চিচিঙ্গা বা কইডা বা কুুুশি
(ইংরেজি: Snake gourd) (বৈজ্ঞানিক নাম: Trichosanthes cucumerina) হচ্ছে
ঝিঙের মত কিন্তু আরো লম্বা বা কখনো সাপের মত পেঁচানো, অপেক্ষাকৃত নরম সবজি।
এটি ঝিঙে, লাউ, শশা, কুমড়ো ইত্যাদির মতই কিউকারবিটেসি পরিবারের সদস্য। –
ইন্টারনেট সূত্রে )
সবজীটি দেখে আমি যতোটা না আশ্চর্য হয়েছি, তার চেয়েও ঢের বেশী ভাবিত হয়েছি
এই চারার বীজটি আসলো কোথা থেকে ?
সে সময়ে জাপানে আমার ২৫ বছর অতিবাহিত হয়ে গেছে। এই ২৫ বছর আমি জাপান জীবনে
সবজীটি কোনদিনই পাইনি, খাইনি এমন কি দেখিওনি। তাহলে এই গাছটি আসলো কথা থেকে
? এ আমার কাছে বিলিয়ন বিলিয়ন প্রশ্ন। পাঠকদের কাছেও আমার একই প্রশ্ন ।
আমি এই কৃষিকে ‘বারান্দা কৃষি’ নাম দিয়েছি ।
প্রথম প্রথম শখ থেকে বারান্দা কৃষি শুরু করলেও এখন আমার বাগান কৃষি আমার
বাগানে উৎপন্ন সবজী আমার বাসার দৈনন্দিন দিবসে রান্নার কাজে প্রয়োজনীয়
সবজীর অনেকটাই যোগান দিয়ে থাকে। বন্ধু বান্ধবদেরও উপহার দিতে পারছি।
বাগানের প্রতিটি গাছই যেন আমার সন্তানতুল্য। একটি ফুল ফুটাকে আমার কাছে
সন্তানের মুখে হাসির মতোই অনুভূত হয়।
বর্তমানে আমার বাসায় সদস্য সংখ্যা একজন বেড়েছেন । বিবাহ সূত্রে ( এডভোকেট
হাসিনা বেগম রেখা ) বাংলাদেশ থেকে তার আগমন।
তিনিও বাগানের পরিচর্যাকারিণী হিসেবে নিজেকে অন্তর্ভুক্ত করে নিয়েছেন। আমার
অবর্তমানে তিনিও খাবার হিসেবে তাদের পানি বিলি করেন এবং বাগানটিকে যথেষ্ট
ভালোবাসেন ।
আমার অবর্তমানে বাসার সবাই গাছে পানি দেয়, একটু আধটু যত্ন আত্তিও করে,
তারপরও কেন জানি আমার কাছে মনে হয় ওদের সঠিক যত্ন হচ্ছেনা , পর্যাপ্ত পানি
পাচ্ছে না। আমি আবার তাদের পানি দিই এবং বারংবার ক্ষমা চেয়ে কথাও বলি।
বর্তমানে আমি নিজেকে কেবলি গাছ লাগানো , ফলন ফলানো এবং সবার মাঝে বিলি
করানোর মধ্যেই আর সীমাবদ্ধ রাখিনি।
অনেককেই চারাও বিতরণ করি এবং তার পরবর্তী খোঁজ খবরও নিতে চেষ্টা করি।
আবার অনেকেই তাদের করা বাগানের কথা শেয়ার করেন। সবজী গাছের বিভিন্ন সমস্যার
কথা জানান, সমাধান জানতে চান। যদিও আমি অভিজ্ঞ নই এবং এ বিষয়ে
প্রাতিষ্ঠানিক কোন শিক্ষাও নেই আমার, তারপরও নিজ অভিজ্ঞতা থেকে কিছু একটা
সমাধা দেয়ার চেষ্টা করি।
তবে , একটা বিষয় ভেবে খুবই ভালোলাগা কাজ করে মনে। উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা
আমার শ্রদ্ধেয় পিতা মরহুম আলহাজ্ব মোঃ ফজলুর রহমান বিভিন্ন সমস্যা সমাধানে
কৃষকদের উপদেশ দিতেন। আর তারই ছেলে এই রাহমান মনি জাপান প্রবাসেও তা ধরে
রেখে এর ধারাবাহিকতা বজায় রেখে চলেছে।
এই কথা বলার অপেক্ষা রাখেনা যে, শ্রদ্ধেয় শাইখ সিরাজ ভাইয়ের ছাদ কৃষিতে
উদ্বুদ্ধ হয়ে আমি বারান্দা কৃষিতে আগ্রহী হয়ে উঠি। এইজন্য আমি তাঁর কাছে
কৃতজ্ঞ এবং ঋণী।
rahmanmoni@gmail.com
ARNING:
Any unauthorized use or reproduction of 'Community' content
is strictly prohibited and constitutes copyright infringement liable to
legal action.
[প্রথমপাতা] |
|