ধারাবাহিক উপন্যাসঃ কাক-জ্যোৎস্নায়
কাক-ভোর (পর্ব-১৯)
শাশ্বত
স্বপন
আজকে
কালীর আগ্রহ অন্যরকম। প্রথমেই নারী সম্বন্ধীয় খবর খুঁজে খুঁজে পড়তে
লাগলো--যশোরে যৌতুকের দুই বলি--স্বামীকে আটকে রেখে স্ত্রী
ধর্ষণ--নারায়গঞ্জের গৃহবধূর আত্মহত্যা--কাজের বুয়াকে নিয়ে ব্যবসা--বিদেশে
নারী পাচার---মুনীরের ফাঁসী চলতি মাসে--বেগম খালেদা জিয়া বলেছেন, দেশের
অগ্রগতির জন্যে ধর্মঘট-হরতাল বন্ধ রাখতে হবে---রামগতিতে ধর্ষনের দায়ে
তিনজনের জরিমানা-- ধর্ষনের পর খুন হল গৃহবধূ রহিমা-- জমেলা হলো যৌতুকের
বলি--কাজের মেয়েকে পিটিয়ে হত্যা--বিমানবালা কর্তৃক কাজের মেয়ে খুন.. ।
এখন কালী সাবাতানি কিংবা স্টেফিগ্রাফ এর মত বিখ্যাত খেলোয়াড় হবার স্বপ্ন
দেখে না। গ্রাম অঞ্চলের মেয়ে সে। কে তাকে এতদূর যেতে সাহায্য করবে। একদিন
বাদলের সাথে জেলা পর্যায়ে খেলার শেষে বাড়ি ফিরছিল কালী। এই নিয়ে অনেক
কেলেংকারী হয়ে গেছে। মনে পড়ে, বাদল তাকে অবৈধ কাজে আহবান করেছিল। সে আহবান
ঘৃনার সাথে প্রত্যাখান করেছে। নারীর কলঙ্ক সামাজিক প্রভাবে আরো বৃহৎ আকৃতি
ধারন করে। সামাজিক কলঙ্ক সাবান দিয়ে দূর হয় না।
গত বছর থানা পর্যায়ে খেলা শেষে মোহনের সাথে ফসলের মাঠ দিয়ে আনন্দ উল্লাসে
সে বাড়ী ফিরছিল। দুইটা খেলায় প্রথম হবার কৃতিত্ব এবং অন্যটিতে তৃতীয় হবার
কারণ মোহনকে বোঝাচ্ছে। মোহন কালীর এমন সব গুনগান গাইছিল যা কালীর মোটেই
পছন্দ হচ্ছিল না। সে বুঝতে পারছে, এসব গুনগানের মূল্য হয়তো ক্ষেতের আড়ালেই
দিতে হবে। হলো তাই, ইচ্ছে করেই মোহন কালীকে ল্যাং মেরে ফেলে দিল মাটিতে।
কালী পড়তেই মোহন তার বুকের উপর পরে গেল। ও সরি, কথাটি বলেই মোহন তার মুখ আর
দু’হাত নারীত্বের প্রধান প্রধান অংশে চালাতে লাগলো। সেদিন কালী রাগে ক্ষোভে
এমন ঘুষি দিয়েছিল যে তাকে ২/৩ ঘন্টার মধ্যে বাড়ি ফিরতে হয়নি। কালী একাই বাড়ি
ফিরেছিল। মোহন এর পর থেকে কালীর শত্রু হল। বন্ধুরা মিলে কুৎসা রটাতে লাগলো।কাকে
কালী বিশ্বাস করবে । সব জায়গায় তার সতীত্বের ঝুকি।
তার মনে পরে, নবম শ্রেনীতে ওঠার পর সুবোধ নামে এক ছেলে তাকে ভালোবেসে ছিল।
সুবোধ ওদের এলাকার কলেজে ডিগ্রিতে পড়ে, হোস্টেলে থাকে। সে কালীকে খেলাধুলা
ছেড়ে দিতে বলেছিল। কালী তাই করেছিল। খেলাধুলা করলে বিভিন্ন জায়গায় যেতে হয়।
কে তার সংগে যাবে। যাকে সে সঙ্গে নেবে অথবা যার সাথে সে আসবে-যাবে সেই দাবী
করে বসে তার নরম দেহের স্বাদ। সে সুবোধের কথা মত আর কোন খেলায় অংশগ্রহণ
করেনি। কালী এখন দশম শ্রেণীর ছাত্রী। বয়স তার ১৬/১৭ । একদিন সুবোধ নাটকের
মহরায় কালীকে আসতে বলেছে। কালী জয়কে নিয়ে কলেজে যায়। বিকাল বেলা। অনেক ছেলে
কলেজের মাঠে ফুটবল খেলছে। জয় দিদির অনুমতি নিয়ে মাঠে চলে গেলো খেলা দেখতে।
সুবোধ কালীকে নিয়ে চলে যায় কোন এক কামরার কোনায়। তারপর কালীকে গালে চুম দেয়,
ঠোঁটেও দেয়। কালী মৃদু হাসে। তারপর অনেকক্ষণ প্রেমালাপ করে। সুবোধ
প্রসঙ্গক্রমে পকেটে রাখ নগ্ন নারীর ছবি কালীকে দেখায়। কালী দেখতে চাইছে না
তবুও সুবোধ জোর করে দেখাচ্ছে। সুবোধের সুপ্ত কামনা জাগছে। কালী ওর
আচার-আচরণে বুঝতে পারছে। সুবোধ কালীর বুকের স্তন্যে হাত রাখে। কালী হাত
দু’টি সরিয়ে দিয়ে বলে।
তুমি আমাকে বিয়ে কর। তারপর...
করব তো। আগে একটু ...
আই লাভ ইউ বাক্যটি উচ্চারণ করতে করতেই কালীর উরুতে হাত রাখে। বিদ্যুতে শক
খাওয়া অংগের মত কালী উরু সরিয়ে নেয়। রাগে ক্ষোভে কালীর চোখে জল এসে যায়।
সুবোধ ওর কান্না থামাতে গিয়ে জড়িয়ে ধরে। কালী নিম্নাঙ্গে সুবোধের বিষাক্ত
সাপের উষ্ণ চলাচল অনুভব করে। কালী সুবোধকে কিল-চড় দিয়ে জয়কে নিয়ে বাড়ী ফিরে
আসে। জয়ের সাথে হেসে হেসে গল্প করতে থাকে। তার কষ্ট জয়কে সে বুঝতে দেয় না।
কালী বেশ কিছু দিন ধরে স্কুলে যায় না। সুবোধ এর কাছ থেকে প্রচন্ড আঘাত
পেয়েছে সে। স্কুলে আপা, স্যার, ছাত্রীরা তাকে উপেক্ষা করে, চরিত্রহীন মনে
করে। পাশা দুপুরে ভাত খেতে এসে শুনল কালী স্কুলে যায় না। সে কালীকে বোঝাল
বিদ্যা কি জিনিস? জীবনের জন্য নয়, সময়ের প্রয়োজনেই নারীদের লেখাপড়া করতে
হবে। আরো অনেক তর্ক-বিতর্ক হল। কালী তর্ক-বিতর্কে পাশার কাছে হেরে গেল।
পরদিন থেকে নাসরিন, দীপার সাথে কালী স্কুলে যেতে শুরু করল। প্রচন্ড
হাসি-খুশী সে। মনে হয় সামান্য দুঃখও নেই তার। সে পাশাকে আবিষ্কার করেছে।
পাশা এত কাছে অথচ কালী এতদিন...।
এ যেন ‘দেখিতে গিয়াছি পর্বত মালা..একটি শিশির বিন্দু…। পাশা যেন তার জীবনে
শুভ কোন খবর বয়ে এনেছে। সে এতদিনে আবিষ্কার করল শুভর ব্যবহার, আচার-আচরণ,
কথাবার্তা যে কোন ছেলের থেকে পৃথক। শুভ কালীকে, অনিতাকে, জয়কে খুব আদর করে।
এর মাঝে কালীর হাসি নিয়ে ঘটে গেছে মন নেওয়া-দেওয়া। স্বল্পশিক্ষিত হলেও তার
প্রতিভা বিস্ময়কর। একদিন পাশা দোকান থেকে এসে ভাত খেতে বসেছে। কালী তরকারীর
বাটিতে বেশ পরিমান লবন মিশিয়ে পাশাকে দিয়েছে। পাশা ভাত আর তরকারী মিশিয়ে
যেই মুখে দিয়েছে তখনি কালী হেসে ফেলেছে। ক্ষুধার্ত জিহ্বা স্বাদ নিতেই
হতভম্ব। তারাতারী মুখের ভাত কাটাজমানো প্লেটে ফেলে দেয়। মুখ কুলকুচি করে।
বিড়ালটা ওর পাশেই ছিল কিন্তু খেতে সাহস পাচ্ছিল না। পাশা রাগ না করে কালীকে
বলল, সন্ধাতারা দারুন সুন্দর তোমার হাসিটা। এইনিয়ে পাশা কয়েকবার তার হাসির
প্রশংসা করেছে। সে হাসি থামিয়ে পাশার দিকে চেয়ে রইল। এক বিগত সন্ধায়
দোকানের ঠোংগা বানাতে বানাতে তারা প্রেমের হাজার গল্প নিয়ে আলাপ করছিল।
সেদিনই পাশা কালীর নাম রেখেছিল সন্ধাতারা।
তোমাকে আমি আর উষা বা কালী নামে ডাকবো না। ডাকবো সন্ধাতারা বলে। তবে কারও
সামনে না।
আমি তোমাকে পাশা ভাই বলে ডাকবো না। আড়ালে আড়ালে উল্কা বলে ডাকবো। তুমি আমার
সময়ের আকাশে উল্কা হয়ে ধরা দিয়েছো।
সন্ধাতারা , জন্মসূত্রে আমি যে মুসলমান, তুমি পারবে...।
আমি পারবো, পারতে আমাকে হবে। আমাদের পারতেই হবে। ব্যক্তি থেকেই শুরু হবে
সমষ্টিগতভাবে। এই বর্ণ-বৈষম্য আর ধর্ম-বৈষম্য কবে শেষ হবে বলতে পার উল্কা ?
কবে হবে জানি না। তবে নিশ্চই একদিন হবে। পাশা গান গাইতে শুরু করলো। তুমি
সুন্দরও যদি নাহি হও...।
পাশার ডাকে কালীর ঘোর কাটলো । পাশা আবার তরকারী চাইছে। কালী আবার তাকে
তরকারী দিল। খাওয়া শেষে এক গ্লাস দুধ দিল। কালী হঠাৎ কেমন যেন হয়ে গেল।
মাথা উচু করে রাখতে পাড়ছে না। শ্বাশত নারী , লজ্জা তাকে গ্রাস করছে। সে
পাশাকে হবু স্বামী ভাবছে। সে পাশার সামনে আর দাড়িয়ে থাকতে পাড়ছে না। খুশিতে
তার কাঁদতে ইচ্ছে করছে। কোন এক অজু হাতে সে কেটে পরতে চায়।
তুমি দুধ খাবে না।
আরো আছে, তুমি খাও।
বলেই কালী ছুটে পালাল। চোখে হাত দিয়ে দেখে অশ্রু। কিন্তু তার বুকেতো কোন
বেদনাই নেই। তার আজ মরে যেতে ইচ্ছে করছে। মানুষ যে অতি খুশীতে কাঁদে, কালী
আজ তা আবিষ্কার করল। এতদিন খেলায় জয়ী হয়েও অতি খুশী হয়েছে। কিন্তু অশ্রু তো
ঝরেনি। তবে কি ভালোবাসা পাওয়া মানুষের শ্রেষ্ঠ আনন্দ? কালীর তাই মনে হচ্ছে।
ARNING:
Any unauthorized use or reproduction of 'Community' content
is strictly prohibited and constitutes copyright infringement liable to
legal action.
[প্রথমপাতা] |