ধারাবাহিক উপন্যাসঃ কাক-জ্যোৎস্নায়
কাক-ভোর (পর্ব-১১)
শাশ্বত স্বপন
কোন একদিন কালী, মিলন ও
নাসরিনকে কাছিমের মাংস খাইয়েছিল। অবশ্য ওরাই ইচ্ছে করে খেতে চেয়েছে। খাওয়ার
পর মিলন, নাসরিন বমি করেনি। কিছু দিন পর কালীও গরুর মাংস খেয়েছে। এবার আগের
মত প্রতিক্রিয়া হয়নি। কোন কালে, কোন সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে কোন কারণে, কোন
যুক্তি দেখিয়ে কারা এসব খাওয়া নিষেধ করেছে--তা কি বর্তমানের এ যুগে
প্রবাহমান থাকবে? সমাজ পরিবর্তনশীল। একই ধর্মের লোকদের জন্য যে জিনিস হারাম
সেই একই জিনিস স্থান, কালভেদে অন্য কোথাও হালাল ভাবে চলে। যদি সেই
আদ্যিকালের নিয়ম মানতে হয় তবে সতীদাহ, চিরবিধবা, শিশুবিবাহ আবার শুরু হোক।
মুসলমান নারীদের ইংরেজী তথা পূঁথিগত শিক্ষা বন্ধ করে বোরখার আড়ালে চাপা
দেওয়া হোক। যারা ধর্মের এতসব গোঁড়ামী সৃষ্টি করেছিল, যারা ব্রাহ্মণ,
ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র এবং এই চার জাতের মধ্যে হাজার হাজার বর্ণ--বৈষম্য
সৃষ্টি করেছিল তারা স্বর্গের জানালা দিয়ে পৃথিবীতে উঁকি দিয়ে ফোঁকলা দাঁতে
হাসতে থাকবে। এদের আনন্দ দেখে ভগবান খুশী হবেন কিনা জানি না।
সারাদিন উপাস থেকে দেব-দেবীদের পূজা দেবার মত মনমানসিকতা অন্যান্য হিন্দু
মেয়েদের থাকলেও কালীর তা এক বিন্দুও নেই। আগে তা পূর্ণভাবেই ছিল। তার
চিন্তাশক্তি এখন অন্যরকম হয়ে গেছে। এখন সে খুবই কঠিন, খুবই নরম মনের মানবী।
এতটা দিন সে পূজা-পার্বণ করে যা পেয়েছে--তা মনে রাখতে চায় না। টানা-পোড়েন
সংসার তাদের। বিদ্যার দৌড় ঠাকুরঘর পর্যন্ত। কোনদিনই সে মেধাবিনী ছাত্রী ছিল
না। স্বরস্বতী মেধা, বিদ্যা দেননি বলেই দুই-এক বিষয়ে ফেল তার নিত্য ব্যাপার।
সব হিন্দু মেয়েরাই লক্ষ্মী পূজা করে লক্ষ্মী পাবার জন্য । কিন্তু শ্বশুর
বাড়ী গিয়ে কি রকম লক্ষ্মী কপালে জুটে তা কালী ভালভাবেই পর্যবেক্ষণ করেছে।
লক্ষ্মীপূজা করে কোন মেয়ে কি রকম ধনসম্পদের মালিক হয়--তা বরের যৌতুকের
দাবীর ফল ভোগ করলেই বুঝা যায়।
বেশ কয়েক মাস হল কালীপদ দোকানে একজন কর্মচারী রেখেছে। ছেলেটির নাম পাশা।
এতিম খানায় অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত কোনমতে লেখাপড়া করেছে। তারপর মানুষের বাড়ি
বাড়ি কাজ করে, কোথাও জায়গীয় হয়ে জীবন যাপন করেছে। ত্রিজগতে তার আপন কেউ নেই।
হরিপদের দোকানে আসার আগে বালিগাঁও বাজারে এক মুদির দোকানে কাজ করত। ছেলেটি
খুব ভাল। আচার-ব্যবহারও ভাল। খরিদ্দারকে সুন্দর কথায় বশ করতে পারে। কালীপদ
আশ্বাস দিয়েছে এই দিঘলী বাজারেই তাকে একটা দোকান করে দেবে। পাশার বয়স
চব্বিশ-পঁচিশ হবে। চেহেরাতে জ্ঞানী ভাব। সে মুসলমান কিন্তু নামায-রোজাতে
তার সামান্য লক্ষ্যও নেই। কালীর সাথে তার একটা ভাল মিল, দু’জনেই গল্প পড়ুয়া।
পাশা রাত-দিন দোকানে থাকে। কালীপদ বাড়ীতে ভাত খাইয়ে ওর জন্য খাবার নিয়ে যায়।
আবার কখনও পাশাও বাড়ীতে খেয়ে দোকানে কালীপদের জন্য ভাত নিয়ে যায়। কালীর সাথে
প্রথম দুই মাস মাস তেমন একটা কথা হয়নি। গল্পের বই চেয়ে নেবার সময় পাশা ওর
সাথে দু’একটা কথা বলেছে। তবে আস্তে আস্তে কথা বাড়তে থাকে।
কালী এখন আগের চেয়ে আরো বেশী সচেতন। সে স্বাধীনতা প্রিয় মানুষ। কুসংস্কার
আর যুক্তিহীন কর্মকান্ডে সে বিশ্বাসী নয়। বই, নিজের জ্ঞান আর পারিপার্শ্বিক
পরিস্থিতি হল তার অধ্যয়নের আধার। তবে সে যতই বোঝমান হচ্ছে, নিজের দৈহিক
ব্যাপারে সে ততই অবুঝ হয়ে পড়ছে। সে ভাবে, কেন এ পৃথিবীর সৃষ্টি হল--কেন এত
সুন্দর হল পৃথিবী--কেন মানুষ সৃষ্টি হল--মৃত্যু হলে মানুষ কোথায় যায়--তারপর
কি হয়? নারী, পুরুষ, হিজরা কেন হল? আর কি হতে পারত? কেন সে এত কুৎসিৎ হল?
যিনি সৃষ্টি করেছেন, তিনি তো সুন্দর করে বানাতে পারতেন? কেন এমন করলেন?
আমাদের নিয়ে কেন তিনি এত খেলছেন ? এসব নিয়ে ভাবতে ভাবতে পড়ার টেবিলে কালী
ঝিমিয়ে পড়ছিল। হঠাৎ মা এসে জানাল, আজ কল্যাণরা কোলকাতা চলে যাবে। শুনামাত্র
কালীর মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ল। এতদিন কল্যাণের মা সবিতা কোলকাতা পাড়ি দেবার
জন্য টাকা জমিয়েছে। কাউকে কিছু বলেনি। গোপনে গোপনে জগ, গ্লাস, পাটা-পোতা,
হারিকেন ইত্যাদি সব বিক্রি করে দিয়েছে। কালী কল্যাণকে অবশ্য জিজ্ঞাসা
করেছিল। কল্যাণ বলেছিল, ওরা গোপালগঞ্জ এক মামার বাড়ীতে চিরতরে চলে যাবে।
কিন্তু শেফালীর কাছে গতকাল সবিতা সত্য কথা বলেছে, কেঁদেছে দু’জনে। ওদের এসব
বিক্রির ব্যাপার নিয়ে অনেকেই অবশ্য সন্দেহ করেছিল।
ARNING:
Any unauthorized use or reproduction of 'Community' content
is strictly prohibited and constitutes copyright infringement liable to
legal action.
[প্রথমপাতা] |